শুক্রবার, ০৯ Jun ২০২৩, ০৫:২২ অপরাহ্ন

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১৫ মো. শওকত আলী

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১৫ মো. শওকত আলী

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১৫
মো. শওকত আলী

নীলফামারী জেলাশহরটি আমার নিজ জেলাশহর থেকে পশ্চিমে মাত্র ৭০ কি.মি দূরে। কিন্তু এ শহরটিতে আমার গমণ অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে। সেটিও ‘নীলসাগর’ দীঘির বিষয়ে একটি দাপ্তরিক কাজ শেষে বিকেলের ফিরতি ফ্লাইটে ঢাকা ফেরার পথে। সেটি ২০১৯ এর আগষ্ট মাসের প্রথমদিককার কথা।
বাংলাদেশের যে কোনো জায়গার নামকরণের একটা পটভূমি বা তাৎপর্য থাকে। তাই নীলফামারী নামটা শুনলেই মনের মাঝে উঁকিঝুঁকি মারতো এ জেলার নামকরণের সংগে নীলচাষের কোন সম্পর্ক আছে কিনা? নীলফামারী গিয়ে সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে যা জানলাম তা’তে এ নামকরণের পিছনে দু’ধরনের ধারণা প্রচলিত আছে। প্রচলিত এক ধরনের ধারণায় নীলচাষ হতেই নীলফামারী নামের উৎপত্তি। বৃটিশ আমলে নীলফামারী মৌজায় (নটখানা) নীলচাষের একটি বৃহৎ ফার্ম ছিল।নীল ফার্মিং বা নীল ফার্ম থেকে নীলফামারী নামের উৎপত্তি। নীলফামারী নাম নিয়ে আর একটি ধারণা প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন যে এক সময় এ অন্চলকে ‘ন্যালপামারী’ বলা হতো। ‘ন্যালপা’ একটি আন্চলিক শব্দ যার অর্থ পিচ্ছিল। নীলফামারী অন্চলের জলাশয়গুলিতে প্রচুর পরিমাণে এক প্রকার পিচ্ছিল জলজ উদ্ভিদ জন্মাতে দেখা যায় যেগুলো স্হানীয় লোকজনের কাছে ন্যালপা নামে পরিচিত। সেখান থেকে ‘ন্যালপামারী’ এবং পরবর্তীতে নীলফামারী হয়েছে।
নীলফামারী নামকরণ যেভাবেই হোক না কেন নীলফামারীতে যে একসময় নীলচাষের আধিক্য ছিল তার সাক্ষ্য এখনও শহর ও শহরতলিতে রয়েছে।

অবিভক্ত বাংলায় নীলচাষের ইতিহাস অতি প্রাচীন। ভেষজ উপাদান হিসেবে নীলের ব্যবহার সম্পর্কে ভেষজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। প্রাচীন আমলের পট এবং চিত্রেও নীলের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় ১৭৭৭ সালে বাংলায় আধুনিক পদ্ধতিতে নীলচাষ করা হয়। বাংলায় লুইস বোনার্ড নামক একজন ফরাসী ব্যবসায়ীকে নীলকর হিসেবে কাজ করতে দেখা গিয়েছিলো।বৃটিশ শাসনামলে সারা বংগে শুধুমাত্র বিদেশি যার মধ্যে অধিকাংশই ইংরেজ নীলকর ছিলেন তাদের মোট নীলকুঠি ছিল ৭৪৫২টি। পূর্ববাংলার যশোহর, খুলনা, বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা,ফরিদপুর ময়মনসিংহ, বরিশাল, নীলফামারী প্রভৃতি জেলায় নীলচাষ করা হতো। ঐসময় অবিভক্ত বাংলার নীলের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।
কোম্পানি শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এককভাবে নীলচাষ করলেও পরবর্তীতে ১৮৩৩ সালে আইন পাসের মাধ্যমে তাদের একচেটিয়া অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়। তখন ইংল্যান্ড থেকে প্রচুর ইংরেজ নীলকর এসে বাংলায় নীলচাষ শুরু করে।কারণ শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে তখন বস্ত্রশিল্পের রমরমা ব্যবসা। নীলের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ইংরেজ নীলকররা কৃষকদের উর্বর জমিতে নীলচাষে বাধ্য করতে শুরু করে। শুধু তাই নয় তারা রীতিমত কৃষকদের উপর জোর জুলুম আর অত্যাচার শুরু করে দেয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে যখন অত্যাচারের মাত্রা সীমাহীন পর্যায়ে যায় তখন কৃষকরাও প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ আরম্ভ করে। প্রথম দিকে অহিংস আন্দোলন হলেও পরবর্তীতে কৃষকদের বিদ্রোহ সশস্ত্র রুপ নেয়। নদীয়ার বিশ্বনাথ সর্দারকে নীল বিদ্রোহের প্রথম শহীদ বলা হয়। বৃটিশ সরকার তাকে ফাঁসি দিয়ে তার শবদেহ লোহার খাঁচায় পুরে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল। তারা চেয়েছিল বিদ্রোহীর এই বীভৎস পরিণতি দেখে কৃষকরা শংকিত হোক। কিন্তু তা’ হয়নি। নীলচাষ করে কপর্দকহীন হয়ে পড়া কৃষকদের বিদ্রোহ আরও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ রকম পরিস্থিতিতে বৃটিশ পার্লামেন্ট বিদ্রোহ আর অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করে এবং কমিটির সুপারিশে নীল গাছের দাম বাড়িয়ে দিলে লাভের অংক কমতে থাকায় নীলকররা নীল উৎপাদন বন্ধ করে দিতে থাকে। এভাবেই এদেশে ক্রমান্বয়ে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়।

১৮০১ সালে বর্তমান নীলফামারী জেলায় তৎকালীন কাজিরহাট পরগনা বা দারোয়ানী, বারোনী এবং ডিমলায় ব্রিটিশ বেনিয়ারা নীলচাষ শুরু করে। তারপর থেকেই সেখানকার কৃষকদের জীবনে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে। বাংলার অনান্য অন্চলের মতো নীলফামারীতেও বৃটিশ নীলকরদের অত্যচার, নির্যাতনের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। অবিভক্ত বাংলায় যখন নীল বিদ্রোহ শুরু হয় তখন নীলফামারীতেও এ বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৫০ সালে থেকে নীলকরদের সংগে এ অন্চলের কৃষকদের সংঘর্ষ শুরু হলেও বিদ্রোহ চূড়ান্ত রুপ নেয় ১৮৫৯ সালে এবং ১৮৬০ সালে পরিসমাপ্তি ঘটে।
নীলকরদের মোকাবিলা করার জন্য কাজিরহাট পরগনা বা দারোয়ানী, বারোনী এবং ডিমলাতে কৃষকরা স্হানীয়ভাবে একটি বাহিনী গড়ে তুলে। সে বাহিনীতে বল্লমধারী, লাঠিয়াল, সাধারণ কৃষক, জেলে এমনকি নারীরাও অংশগ্রহণ করে প্রতিপক্ষ নীলকরদের সৈন্য, লাঠিয়াল বাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য। এভাবেই জীবন বাজি রেখে তারা নীলকরদের প্রতিহত করে এবং অবশেষে নীলকররা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
নীলফামারীর বর্তমান জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের পার্শ্বে যে টিনসেড ভবনটি রয়েছে, যেটি একসময় মহকুমা অফিস ছিল সেটি আদিতে মূলতঃ ইংরেজ সাহেবদের বসবাস এবং নীলচাষ ব্যবসা পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হতো। নীলকরদের কথামতো উর্বর জমিতে নীলচাষ না করলে অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা ছিল সে সময়। নীলফামারীর অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটরা তখন ঐ ভবনে বসবাস করতো। বর্তমানে ঐ ভবনটি জেলার অফিসার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখানে কিছু সংস্কার কাজ সম্পন্ন করে ভবনটির ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে একটি ফলক লাগানো হয়েছে। ফলকটিতে ভবনের নির্মাণ কাঠামো, ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে মন্তব্য করা হয়েছে ‘কালের সাক্ষী এ ভবন নীলফামারীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহনকারী। এ পুরাকীর্তি ভবনের কোনরকম পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ছাড়া সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।’ এ নৈতিক দায়িত্ব যথাযথভাবে মেনে চলা হচ্ছে কীনা যারা ভবনটি প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে। ফলকপ্রস্তরে উৎকীর্ণ আছে ‘এ এলাকার উর্বরভূমি নীলচাষের অনুকূল হওয়ায় দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় নীলফামারীতেই বেশিসংখ্যক নীলকুঠি ও নীল খামার গড়ে উঠে।’ এ দাবীর সত্যতা ইতিহাসবিদগণ যাচাই করতে পারেন।তবে নীলফামারী শহরের একপ্রান্তে এখনও কালের স্বাক্ষী হয়ে নীলকুঠি, নীলকুঠির সম্মুখে বিস্তীর্ণ ভূমি (হয়তো নীলগাছ চাষ করা হতো),মাঠের একপ্রান্তে নীলগাছ থেকে নীল প্রস্ততকরনের কাজে ব্যবহৃত একটু কূপের অংশবিশেষ রয়েছে।

পাঠকদের জানার জন্য সেই অফিসার্স ক্লাবে উৎকীর্ণ শিলালিপিতে বিধৃত বর্ণনা হুবহু তুলে ধরলামঃ
নীলফামারী নীলকুঠি তথা নীলফামারী অফিসার্স ক্লাবের ইতিহাস
ইংরেজ নীলকরেরা দুই শতাধিক বছর পূর্বে নীলফামারীতে নীল চাষের খামার স্হাপন করেন। এ এলাকার উর্বর ভূমি নীল চাষের অনুকূল হওয়ায় দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় নীলফামারীতেই বেশি সংখ্যক নীলকুঠি ও নীল খামার গড়ে উঠে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই নীলফামারীর নটখানা, দুরাকুটি, ডিমলা, কিশোরগন্জ, টেঙরামারী প্রভৃতি স্হানে নীলকুঠি স্হাপিত হয়। ইংরেজ সাহেবদের বসবাস ও নীলচাষ ব্যবসা পরিচালনার জন্য এই টিনসেড ভবনটি ব্যবহৃত হতো। এই ভবনের মধ্যে শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ২টি Fire place, ২টি বাথরুম, ২টি শয়নকক্ষ, একটি ড্রইং রুম ও ১টি বারান্দা রয়েছে। তৎকালীন সময়ে এটি এলাকার সুরম্য অট্টালিকা ও দৃষ্টিনন্দন ভবন হিসেবে খ্যাত ছিল। মূল ভবনের দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট এবং প্রস্থ ৫১ ফুট। এতে বৃটিশ আমলের স্হাপত্য শৈলী পরিলক্ষিত হয়।
১৮৭৫ সালের ১৮ মে খ্রি: তারিখে রংপুর জেলা হতে বিভক্ত হয়ে ডোমার উপজেলার বাগডোগরা এলাকায় নীলফামারী মহকুমা কার্যালয় স্হাপিত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিকুলতার জন্য ১৮৮২ সালের ১৯ মে খ্রি: তারিখে বাগডোগরা হতে বর্তমান নীলফামারী জেলা সদরে মহকুমা কার্যালয় স্হানান্তরিত হয়। তখন হতে এটা মহকুমা প্রশাসকের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। গত ৩০. ০১.১৯৮৪ খ্রি: তারিখে নীলফামারী মহকুমা জেলায় উন্নীত হলে ১৯৮৮ খ্রি:সাল পর্যন্ত এটি জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

গত ১২.১০.১৯৯৯ খ্রি. তারিখ হতে এটা নীলফামারী অফিসার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কালের স্বাক্ষী এ ভবন নীলফামারীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষর বহনকারী এ পুরাকীর্তি ভবনের কোনরকম পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ছাড়া সংরক্ষণ করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
সংকলনে:
জনাব এস, এম, মাহফুজুল হক
জেলা প্রশাসক,নীলফামারী ও
সভাপতি নীলফামারী অফিসার্স ক্লাব
নির্দেশনায়:
জনাব আসাদুজ্জামান নূর
মাননীয় সংসদ সদস্য
নীলফামারী -২
তারিখ : ১৭ নভেম্বর ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ রোজ রবিবার
সৌজন্যে : নীলফামারী অফিসার্স ক্লাব, নীলফামারী।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge