মঙ্গলবার, ০৬ Jun ২০২৩, ০৩:০৩ পূর্বাহ্ন

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১৩ মো. শওকত আলী

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১৩ মো. শওকত আলী

দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১৩
মো. শওকত আলী

একসময় গ্রাম্য যাত্রায় ‘ঈসা খাঁ–মান সিংহ যুদ্ধ ‘ পালা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। সে সুবাদে ছোটবেলাতেই মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত ঈসা খাঁ’র বীরত্বগাঁথার সাথে আমার পরিচয়। শৌর্য-বীর্যে তেজোদ্দীপ্ত এক নাম হচ্ছে ঈসা খাঁ। তিনি ছিলেন বারো ভুঁইয়াদের নেতা। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে দু’শত বছরের স্বাধীন সালতানাথ পতনের পরে বারো ভুঁইয়াগণ বাংলার ভাটি অঞ্চলের কতৃর্ত্ব গ্রহণ করেন। তবে তারা কোন রাজপরিবারের বংশধর ছিলেন না। তারা ছিলেন মূলতঃ জমিদার। অসীম সাহসিকতা আর বীরত্বের সঙ্গে প্রায় তিনযুগ বাংলায় মুগল আক্রমণ ঠেকিয়ে রেখেছিলেন তারা। আর এক সময় বারো ভুঁইয়াদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ঈসা খাঁ। তিনি সম্ভবত১৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অবাঙালি। তার পিতা সোলায়মান খাঁন ছিলেন আফগানিস্তানের সোলায়মান পার্বত্য অন্চলের এক দলপতির বংশধর। ঈসা খাঁর জীবদ্দশায় মুগল সম্রাট আকবর ভাটি অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্টা করতে পারেননি।
বারো ভুঁইয়াদের সম্পর্কে এক সময়ে আমার যেরকম ভ্রান্ত ধারণা ছিল কারো কারো সেরকম ভ্রান্ত ধারণা থাকতে পারে। এরা সকলে একই ছিলেন না। যেমন ধরুন, ঈসা খাঁ আকবরের রাজত্বকালে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে করে সেসময়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার পুত্র মুসা খাঁ তার স্থলাভিষিক্ত হন।সেটি ছিল জাহাঙ্গীরের শাসনামল। আবার বারোজনই যে ছিল এটিও কিন্তু ঠিক নয়। সকলে আবার মুসলমান ছিলেন সেটিও ঠিক নয়। ভুইঁয়া শব্দের অর্থ ভূ-স্বামী। মুগল ইতিহাস বর্ণনার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বাহারিস্তান-ই-গায়েবীতে বারো ভুঁইয়াদের সম্পর্কে বলা হয়েছে মুসা খাঁ ও তার বারোজন মিত্র জমিদার ছিলেন । এদের মধ্যে মাধব রায় এবং বিনোদ রায় দুজন হিন্দু জমিদার ছিলেন।
ঈসা খাঁকে ‘মহাবীর’, ‘মসনদ-ই-আলা’ বলা হতো। তাকে ‘মহাবীর’ বলা হতো কারন তিনি বর্তমান কিশোরগন্জ জেলার এগারসিন্দু নামক স্হানে মুগল সেনাপতি মানসিংহকে রুখে দিয়েছিলেন।১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এগারসিন্দুর দুর্গদ্বারে ঈসা খাঁ এর সংগে যুদ্ধে মুগল সেনাপতি মানসিংহ এর পুত্র দুর্জনসিংহ নিহত হন। এবং মানসিংহ নিজেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে ঈসা খাঁ তার তলোয়ার ভেংগে ফেলেন। পরে অবশ্য উভয়পক্ষ সন্ধি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
কারো কারো মতে, ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ঈসা খাঁ সোনারগাঁও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মুগল নৌবহরকে বিতাড়িত করতে দাউদ খানকে সাহায্য করেছিলেন। দাউদ খান তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ‘মসনদ-ই- আলা’ খেতাবে ভূষিত করেন। আবার অনেকের মতে, ঈসা খাঁ ১৫৮১-৮২ খ্রিষ্টাব্দে নিজেকে ভাটি অঞ্চলের অধিপতি হিসেবে ঘোষনা দেন এবং নিজেই ‘মসনদ-ই-আলা’ উপাধি গ্রহণ করেন। যা’হোক এটি ইতিহাসের পাঠ।

কিশোরগন্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজংগল ইউনিয়নে প্রায় পাঁচশত বছরের পুরানো জংগলবাড়ী দুর্গ দেখতে গিয়েছিলাম ২০১৫ সালে। কিশোরগন্জ শহর থেকে মাত্র আট কি. মি দূরে করিমগঞ্জ উপজেলার নরসুন্দা নদীর তীরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে দুর্গটির অবস্হান। জংগলবাড়ী দুর্গের সংগে ঈসা খাঁ’র নাম ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী সামন্তরাজা লক্ষণ সিং হাজরার নিকট থেকে ঈসা খাঁ দুর্গটি দখল করে নিয়েছিলেন ১৫৮৬ সালে। তবে ধারনা করা হয় যে লক্ষণ সিং হাজরা বা ঈসা খাঁ কেউই দুর্গটির মূল নির্মাতা ছিলেন না। প্রাক- মুসলিম আমলে কোন এক শাসক এ দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। ঈসা খাঁর আমলে দুর্গের অভ্যন্তরে বেশ কিছু স্হাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল। ঈসা খাঁ এটিকে তার দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করতেন বলে প্রচলিত শ্রুতি রয়েছে।
জংগলবাড়ী দুর্গটির চারদিকে গভীর পরিখা খনন করে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছিল। স্হানীয় ভাষায় পরিখাকে আঁড়া বলা হয়। এ গভীর পরিখা দ্বারা দুর্গটি সংযুক্ত ছিল নরসুন্দা নদীর সংগে। তখন নরসুন্দা নদী দিয়ে এগারসিন্দু হয়ে রাজধানী সোনারগাঁওয়ে যাতায়াত করা হতো। চারদিকে পানিবেষ্টিত দূুর্গটির অবস্থান ছিল দ্বীপের মতো। প্রায় ৪০০ একর জমির উপর দুর্গটি অবস্হিত।
এখন অবশ্য চিত্র ভিন্ন। সারাবছর গভীর জলরাশির আঁধার পরীখাগুলোতে বাঁধ দিয়ে মাছচাষ করা হয়। নদীর সংগে পরিখার যুক্ততা বুঝতে বেশ কষ্ট হয় এখন।

দুর্গটির বর্তমান অবস্থা প্রায় শোচনীয় পর্যায়ে। ছাদবিহীন ঈসা খাঁর দরবার কক্ষটির অবস্থান কোনরকম টিকে আছে। দূর্গের পিছনদিকে প্রাচীর দ্বারা পৃথক ছিল অন্দরমহল। তবে একটি তোরণ ছিল সেখানে। সেটিরও ভগ্নদশা। অন্দরমহলের একাংশ কোনরকম সংস্কার করে ঈসা খাঁর বংশধররা বসবাস করে। ঈসা খাঁর মৃত্যু হয় সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে ১৫৯৯সালে। তার মৃত্যুর পরে তার উত্তরাধিকার হন তার পুত্র মুসা খাঁ। ধারনা করা হয় ঈসা খাঁর পুত্র মুসা খাঁর সময়ে তিনি মুগল সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করে রাজধানী সোনারগাঁও থেকে তার পরিবারের একাংশকে জংগলবাড়ী দুর্গস্হলে স্থানান্তর করেন।
দুর্গ এলাকায় মুগল স্হাপত্যরীতিতে নির্মিত তিনগম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে। যেটি এখনও অনেকটা অক্ষত অবস্থায় রয়েছে এবং স্হানীয় মুসল্লীরা সেখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন।
জংগলবাড়ী দুর্গটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর কতৃর্ক সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত স্হাপনা।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge