রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ০৬:১৯ পূর্বাহ্ন

দেওপলি-দিব্যেন্দু নাথ

দেওপলি-দিব্যেন্দু নাথ

দেওপলি
দিব্যেন্দু নাথ

(দুই)
পরাজিত কুকি সর্দার তিন মিজো রাণী ও এক চাকমা দুহিতাকে নিয়ে কোনওক্রমে গা ঢাকা দিল শাখান আর জম্পুই উপত্যকার দক্ষিণে। এখানেই দেওপানির উৎস। যুগের প্রয়োজনে হয়তো তার জন্ম। সেটা রূপবতী জম্পুই গরভে আর সটান শাখানটানের ঔরসে! এই নিরিবিলি স্থানে কুকিরাজ দুর্বল হয়ে দিন গুনে। শক্তি সঞ্চয়ে সে একদিন চলে গেল মুংতা পাহাড়ে। এই সুযোগে তিন মিজো রাণী মিলে স্বামীর একটি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে বসল। আসা থেকেই এই ফুলেল লাব্যণ্যময় চাকমা দুহিতা কেঁদে কেঁদে কাটাচ্ছে। দুশ্চিন্তায় নিজের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে দুই গুণ। বারবার কত কাকুতি করেছে, তবুও নিস্তার পায়নি, হিংস্র কুকি সর্দারের থাবা থেকে। দিনকে দিন ধর্ষিতা হয়েছে। উপায় না পেয়ে জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছে, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে। অর্ধাহারে দিন কাটিয়ে এখন পুরোদমে খাবার ছেড়ে দিয়েছে। দিনর পর দিন মেয়েটার শরীরের অবনতি দেখে তিন রাণী শংকিত। – সে বাঁচাতে হলে, এখান থেকে পালাতে হবে। নাহলে মেয়েটা মানসিক চাপে মরে-ই যাবে নিশ্চিত। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তিন রাণী মিলে, এক গভীর রাতে বাঁশের চালা করে ভাসিয়ে দিল দেওপানির জলে। সঙ্গে দিল পুটলি বেঁধে কিছু শুকনো খাবার।
এক বিকেলে চালা এসে লাগল দেওমনুর সঙ্গমে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেই অভিশপ্ত শিমুল গাছ। যেন কুকিদের সেই পটিয়ান পূজার নরবলির সাক্ষী হয়ে আছে সে। তার শাখাপ্রশাখা আবার আগুন রঙা ফুলে ভর্তি হয়ে উঠেছে। ভনভন সুরে ভ্রমর আসছে যাচ্ছে। মৌমাছিরা গুনগুনিয়ে অবাধ বিচরণ করছে ফুলে ফুলে। নীড়ে ফেরা পাখিদের কালতানে ভরা ডাল। আড়ালে কোথাও এক কোকিল ডাকছে কাতরে। কে জানে! সে ও কী – এই নির্মমতার সাক্ষী! চালার মেয়েটাকে জাগানোর চেষ্টা করছে। নাকি কাতরে ডেকে ডেকে সবাইকে বলছে, একমাত্র সাক্ষী মেয়েটা ঘুমের নাটক করে চলে যাচ্ছে বাঁশের ভেরুয়ায়।
নদী একটু তাড়াহুড়ো করেই ভাসিয়ে নিয়ে গেল চালা। সে জেগে গেলে, অবশ্য বুঝে যেত, এখানেই তার সাথীদের বলি দেওয়া হয়ে ছিল। বিলাপ করতে করতে তার জরাজীর্ণ শরীর এখানেই নিস্তেজ হয়ে যেত। আর বাড়ি ফেরা হতো না তার। বুড়ি মা বেচে আছে কিনা! বোনপ্রিয় ভাইয়ের বা কী অবস্থা। তা ও তো জানে না। সেই গাছতলায় আজ আর শোনিত স্রোত নেই। নদীর জলের মতো সব বদলে দিয়েছে সময়। নদী তো বহমান! নিরবধি বয়ে যেতে হয় তাকে, সব কথা বুকে চেপে। যতই অত্যাচার হোক, নিন্দা করুক, তার থামলে চলবে না! সব ব্যথা গোপন রেখে, সকল বিপত্তি উপেক্ষা করে তাকে চলতেই হবে সভ্যতা বাঁচাতে। তার কত গুরুদায়িত্ব, যুগের ইতিহাস বইতে হয়। অথচ থাকতে হয় নীরব। এজন্যই তো তার জন্ম। অচৈতন্য মেয়েটাকে বাড়ি পৌঁছানো তার কর্তব্য। নাহলে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না।
এবার মনুও দেওকে সাহায্য করছে চালা ঠেলতে। পুরো রাতের ক্লান্তিতে চালা এসে পৌঁছাল মৌলবী বাজার। ভোরের পাখি আর অপেক্ষমাণ ভ্রমররা পাপড়ি খোলা ফুলে গুঞ্জন তুলেছে। জনপদের নরনারী ধীরে ধীরে নদী বুকে ধাবিত হচ্ছে জীবনের তাগিদে। সবাই কি জেগে গেছে? মেয়েটাও?- না।
সে যদি এখন না জাগে! নদী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হবে। তাকে আসল ঠিকানায় পৌঁছানো যাবে না। নদীর এই অসহায় অবস্থা দেখে চিন্তিত প্রকৃতি।
গাছের পাতায় পাতায় সকালের মৃদুমন্দ বাতাস। ফুলগুলি আমোদিত। গন্ধে বিভোর চারপাশ। ঢেউয়ের পর ঢেউ উঠে নদীর জলে। সবাইকে হাতছানি দেয়। কেউ সাড়া দেয় না। আরো উতলা হয়ে উঠে, চালা সমশেরনগর ছেড়ে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে কিছু একটা করতেই হবে। চট্টগ্রামগামী ট্রেন ধরতে হলে, সমসেরনগর নামতে হবে মেয়েটাকে। ঢেউ তোড়ে চালা সজোরে ধাক্কা খেল নদী খাতে আটকে থাকা একটি গাছের মুড়ায়। অমনি কয়েক ঝাপটা নদীর তাজি জল এসে পড়ল মেয়েটির নাকেমুখে।
চোখ খুলতে বড় কষ্ট তার। অন্ধকারে ছোট হয়ে যাওয়া দুটি রন্ধ্র সহসা মুখরিত আলো নিতে পারছে না। রগড়ে রগড়ে তাকায়। উদ্ভাসিত আলোর কুসুমে, পূর্ণ চৈতন্য ফিরে আসে। শোনা যায়, কল্লোলিত নদীস্রোত আর মানুষের হৈ হৈ।
কেউ চাষের কাজে ব্যস্ত, কেউ বোঝা মাথায় নদী পার হচ্ছে, হাটে মুখে । কত নৌকায় তিল,কার্পাস, লাউ, কুমড়া বোঝাই হয়ে আসছে সকালের হাট ধরতে। আড়তে বিক্রি করে তেল, চিটা, লবন নিয়ে ফিরবে আলয়ে। কেউবা, কুনো জাল তুলে ধীর পায়ে অভীষ্ট মাছের ঝাঁক খুঁজছে। কেউ ইতিমধ্যে জাল ফেলে দিয়েছে জলে। কাঁচি টানছে মাছের আশায়। তখনই স্রোতের টানে ভেসে আসা মালবোঝাই একটা নৌকা ভীড়ল চালার কাছে।
-এই মেয়ে কোথা থেকে আসছো?
-বলতে পারবো না কোথা থেকে।
-মানে? চোখমুখে বিতৃষ্ণা চেপে রায়বাবু বললেন। তিনি ফটিকরায়ের নামকরা ব্যবসায়ী। কেউ চোখ রেখে কথা বলতে সাহস পায় না। – আর এইটুকু মেয়ে কি না….। মনে মনে রেগে আছেন। তবুও স্বভাব সুলভ গাম্ভীর্য রেখে আবার বললেন,
-এখানে এলে কীভাবে?
-আমি এক হতভাগি। ছেঙি ছিল আমার বাড়ি। নাম বদাচগী। কুকিরা আমায় তুলে নিয়ে গেছিল। তিন কুকি রাণীর কৃপায় সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছি।
-তো এখন যাবে কোথায়?
-জানি না। ছেঙি কোথায় আছে। পাশ কাটিয়ে রায়বাবু বললেন,
-ছেঙি, ছেঙি….। বলে রায়বাবু মাথাটা এদিকে ওদিক নাড়াচ্ছেন। অমনি বদাচগী বলল – রাঙ্গামাটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম।
-ও হো। সেখানে তো সাজেক.. ছেঙি … কর্ণফুলি…. নদী।
-হে দাদা।
কুকিদের এমন নির্মম অত্যাচারে কথা কমবেশি সবার-ই জানা। তবুও আশ্চর্য হলেন শুনে, এইটুকু মেয়ে কি না পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে! হতবাক চিত্তে রায়বাবু বললেন,
-ভাগ্যের জোরে বেঁচে এসেছ তুমি। তাদের হাতে অপহৃত হলে, সাধারণত কেউ ফিরে আসে না। এবার যেন বদাচগী ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। প্রবোধবাক্যে আবার বললেন তিনি,
-কান্না থামাও তুমি। নিশ্চিতরূপে বাড়ি পৌঁছতে পারবে এখন। আধঘন্টার মধ্যে সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী ট্রেন আসছে। যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি আমি।
কথায়, প্রশান্তিময় নিশ্বাস পেল বদাচগী। সে ভুলেই গেছে, কবে এমন বুকভরা বাতাস টেনেছিল। এই দম বন্ধকরা দিনগুলিতে তো শুধু ফুসফুস উঠানামা করে শরীর বাঁচিয়ে রেখেছে। এমন দিন আবার তার জীবনে আসবে, এ আশা ছেড়েই দিয়েছিল। সময় সবকিছু করতে পারে।
নৌকায় আনা মালের লেনদেন করে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে রায়বাবুর। সন্ধ্যে হলে পথে ডাকাতের দৌরাত্ম্য। আজ ছেলেও আছে নৌকায়। যেদিন মালের ফর্দ লম্বা, সে আসে। বাবাকে বেচাকেনা করতে সাহায্য করে। রায়বাবু কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন,
-তুই যা। ওকে খাইয়ে দাইয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আয়। আমাকে পাবি মোনাব্বরের আড়তে।
বদাচগী, রায়বাবুকে কী যেন বলতে চাইল ,পারল না। হাত দিয়ে মুখ চেপে রওনা হল সিক্ত নয়নে পারের দিকে।
ট্রেনের পাদানিতে পা রাখতেই জোরে জোরে ফুৎ ফুৎ করে বাষ্প ইঞ্জিন চলতে শুরু করল। স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা রায়বাবুর ছেলে ভ্রমর, বয়সের অনেক কম হলেও হাত জোড় করে প্রণাম জানালো জল ভরা চোখে বদাচগী।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge