দেওপলি
দিব্যেন্দু নাথ
এক.
অবশেষে নিজের দ্বিগুণ বয়েসের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হল বদাচগীর। তার দোষ, দুর্বৃত্তরা তাকে অপহরণ করে রেখেছিল প্রায় বছরখানেক। কুকি দুর্বৃত্তরা রাণী কালিন্দীর রাজ্য সহ গোটা আসাম প্রদেশে চরে বেড়াত। সংগঠিত করত তাদের সৃষ্টিছাড়া অসংখ্য কাজ। লুট, মার, খুন-খারাবি, সুন্দরী নারী অপহরণে যেন তাদের আনন্দ। আসামের চা বাগানের মালিক ইংরেজ লেউনি সাহেবের কন্যা মেরী উইনস্টার অপহরণ হতেই টনক নড়ে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির। এর আগেও উত্তর পুর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন রাজ্য থেকে কত সুন্দরী মেয়ে অপহরণ হয়ে গেছে এবং পুরুষ অপহরণ করে তারা হত্যা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। দেশী মেয়েদের অপহরণে, ইংরেজ সরকারের কি যায় আসে! চা বাগানে যে দিন তারা লুট খুন অপহরণ চালাল, সেই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। শুরু হল দৌড়ঝাঁপ। সেদিন তারা গুলি করে মাটিতে ফেলে দেয় লেউনি সাহেবকে। তার রক্তাক্ত দেহ, বাঁচার শেষ অবলম্বনে ছটফট করতে লাগল সাদা বেডশীট লাল করে। তার চোখে চশমা খুলে নিয়ে দুর্বৃত্তরা লাথি মেরে ফেলে দেয় মাটিতে কারপেটের উপর। ততক্ষণে হয়তো তিনি নিথর হয়ে গেছেন। শুরু করে লুট। আধুনিক সমাজের নিত্যনৈমিত্তিক জিনিসগুলি প্রথম দেখে কৌতুকপ্রদ নেশায় মত্ত হয়ে উঠে তারা। সাহেবের পাওয়ারফুল চশমা খুলে নিজেদের চোখে লাগিয়ে ঝাপসা দেখে। রান্না ঘর থেকে চিনির কৌঠো এনে মুখে দিয়ে মিষ্টি স্বাদ পায়। শেষে এই চশমাকে ঘোড়ার চোখ আর চিনিকে মিষ্টি লবণ বলে আখ্যায়িত করে বর্বর কুকি দুর্বৃত্তরা। স্কুল সেরে তার মেয়ে উইনস্টার বাড়ি ফিরছিল চাকরের সাথে। তাকেও পার পেতে দেয়নি দুর্বৃত্তরা। বন্দি করে, চাকরকে বন্দুকের নলের মুখে তুলে গুলি করবে বলে। হাত তুলে সমর্পণর ভঙ্গিতে জানায় সে ভাগলপুরের প্রসিদ্ধ কর্মকার। এতল্লাটে পেটের দায় এসেছি। সুন্দরী সাহেব তনয়া ও চাকরকে নিয়ে তারা মিজোরামে গা ঢাকা দেয়।
সাধারণত পুরুষদের অপহরণ করে বলি দেয় তারা। যশের জন্য মুণ্ডু ছেদ করে খুলি সাজিয়ে রাখে ঘরে। ভিন্ জাতির সুন্দরী নারীদের সর্দার বিবাহ করে, মন ভরে গেলে সাঙ্গপাঙ্গদের নিকট ছেড়ে দেওয়া হয় ফুর্তির জন্য। একাধিক পুরুষ কর্তৃক ধর্ষণের পর সেই নারীর জীবন হয়ে উঠে আরও মর্মান্তিক। বন্দি থেকে দাসীর জীবন, বা ধারালো অস্ত্রের নির্মম আঘাতে জীবনাবসান।
চাকরকে কর্মকার জেনে বাঁচিয়ে রাখল। তাদের নৃশংস হত্যা, লুট, অপহরণের কাজে প্রয়োজনীয় অস্ত্রের জোগান এবং ভোঁতা হয়ে যাওয়া অস্ত্রে শান দেওয়ার কাজে নিয়োজিত করল তাকে।
সাহেব কন্যার জন্য শাসক ইংরেজদের ঘুম হারাম করে তুলল বৃটেন। বারবার আসতে লাগল গভর্নরের তার। ছোট-বড় সব সাহেব পাগল হয়ে উঠলেন। তলব পড়ল রাণী কালিন্দীর। তাঁর হজাক সৈন্য আছে। তাদের যুদ্ধ কৌশল ছাড়া শুধুমাত্র আধুনিক অস্ত্র দিয়ে জংলী কুকিদের বশে আনা যাবে না। কারণ, যান্ত্রিক সহায়তায় আধুনিক অস্ত্রের সম্ভার নিয়ে, পাহাড়ের চড়াই-উত্তারইয়ে যুদ্ধ করা রীতিমত অসম্ভব। কিন্তু, রাণী কেন তাদেরকে সাহায্য করবেন?
খবর নিয়ে জানা যায়; চাকমা রাজ্য কুকিদের অত্যাচারে বহুদিনের জর্জরিত। সুযোগ পেলেই তারা লুট, ধর্ষণ সংঘটিত করে। এখনও অপহৃত কত নারী তাদের কাছে বন্দি। লালসা মিটে গেলেও তাদেরকে আটকে রাখে অর্ধাহারে অনাহারে। ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ পালিয়ে আসে, এমন সংখ্যা নেহাতই কম! অধিকাংশই বন্দি দশায় মারা যায়। এখনও কালাবি, দেওয়ান ভগ্নি বদাচগীর মতো কত জন বন্দি, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। আদৌও তারা বেঁচে আছে কিনা! নিশ্চিত কোনও খরব নেই। প্রজা হিতৈষী রাণী মুক্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন,
-আমি সর্ব শক্তি দিয়ে সাহায্য করব ইংরেজ সরকারকে। রাণীর আশ্বাস পেয়ে ইংরেজরা ঝাপিয়ে পড়ে কুকি সাম্ব্রাজ্যের উপর। হজাক সৈন্যের প্রথম দিনের তুমুল আক্রমণে কুকিরা পিছ পা হল।
হাত পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার হল কয়েকটি চাকমা দুহিতা। অন্যদিকে ইংরেজ ও চাকমা রাণীর হজাক সৈন্যর সাড়াঁশি অভিযানে উইনস্টারকে ফিরিয়ে দিয়েও প্রাণ বাঁচানো দায় হল কুকিদের। দিশেহারা হয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে প্রাণে বাঁচলো। কিন্তু হজাক সেনাপতি নিশ্চিত হতে পারলেন না। উদ্ধার করা মহিলাদের মধ্যে বদাচগী আছে কিনা?
চলবে…
Leave a Reply