দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-১১
মো. শওকত আলী
পুঠিয়া রাজবাড়ি ঢাকা থেকে ১৭৫ কি.মি. এবং রাজশাহী শহর থেকে পূর্বদিকে ৩০ কি.মি. দূরে অবস্হিত। গত শতকের নব্বই দশকের প্রথমদিকে পুঠিয়া রাজবাড়ি দর্শনের প্রথম সুযোগ মেলে আমার। তারপর বেশ ক’বার গিয়েছি।
পুঠিয়া রাজবাড়ি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। বহুমাত্রিক নান্দনিক স্হাপনাই শুধু নয় এর রয়েছে প্রাচীন একটি দীর্ঘ ইতিহাস। সূচনা থেকে বিলুপ্তি পর্যন্ত প্রায় ৩৯৪ বছরের এধরনের ধারাবাহিক জমিদারি পরিচালনা বাঙালার ইতিহাসে নেই বললেই চলে।
মুঘল সম্রাট আকবরের সময় বঙদেশ ১৮ জন সুবেদার দ্বারা শাসিত ছিল। ঐ সুবেদারগণ মুঘল সম্রাট কতৃর্ক নিয়োজিত ছিলেন। তারা তাদের সুবা( একজন সুবেদারের কর্তৃত্বাধীন অঞ্চল) বা পরগণায় রাজস্ব আদায় করে একটা নির্দিষ্ট অংক মুঘল সম্রাটের রাজকোষে জমা করতেন। ১৫৭৬ সালে বাঙলার সুবেদারগণ মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। ঐ সময়ে লস্করপুর পরগণার সুবেদার লস্কর খাঁ ঐ বিদ্রোহে শামিল হন। তার বিদ্রোহ দমনে মুঘল সম্রাট আকবর মানসিংহকে দায়িত্ব দেন। লস্কর খাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করে বিদ্রোহ দমন করেন মানসিংহ। এক আশ্রমের সেবায়েত জনৈক বৎসাচর্য মানসিংহকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে ঐ যুদ্ধে সহায়তা করেন। যুদ্ধে জয়লাভের পর মানসিংহ খুশি হয়ে মুঘল সম্রাটের পক্ষে বৎসাচর্যকে উপঢৌকন হিসেবে ঐ পরগণার বন্দোবস্ত প্রদান করেন। কিন্তু সেবায়ত বৎসাচর্য তার নিজ নামে ঐ জমিদারি গ্রহণ না করে পুত্র পীতাম্বর এর নামে বন্দোবস্ত নেন। বয়স নাকি আশ্রম পরিচালনা করে জমিদারি বন্দোবস্ত নেয়া দৃশ্যমান শোভন কর্ম নাও হতে পারে এরুপ বিবেচনায় নাকি অন্য বিশেষ কোন কারনে তিনি জমিদারি তার পুত্রের নামে বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন ইতিহাসের গবেষকগণ তা খোঁজ করতে পারেন।
পীতাম্বর জমিদারি বন্দোবস্ত নিয়ে তার পৈত্রিক বাসস্হান চন্দ্রাকলা (বর্তমান নাটোর জেলার অন্তর্ভুক্ত এলাকা) থেকে লস্করপুর পরগণার রাজধানী বর্তমান পুঠিয়ায় স্হাপন করেন। এভাবেই পুঠিয়া জমিদার বংশের সূচনা হয় বর্তমান স্হানে।
বাংলার জমিদারের মধ্যে কেউ কেউ রাজা, রানী, এমনকি মহারাজ, মহারানী হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। মূলতঃ শাসককূল প্রদত্ত খেতাব ছিল ঐগুলি। কখনও ঐসব খেতাব পেত সরাসরি মুঘল সম্রাট এর নিকট থেকে, কখনও বা তার প্রতিনিধিদের কাছ থেকে। বৃটিশ আমলে বৃটিশরাও দিতো এধরনের খেতাব। জমিদাররা কখনও দক্ষিণা দিয়ে শাসকদের সন্তুষ্টি অর্জন করতো, কখনও বা তাদের কাজ- কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে খেতাব দিয়ে শাসকরা তাদের নেকদৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ করতো।
শাসককূলের সন্তষ্টি অর্জন করতে পারলে উপঢৌকন যে কত বড় হতে পারে তার বড় উদাহরণ হচ্ছে পুঠিয়ার রাজবংশ–প্রথম পুরুষে জমিদারি প্রাপ্তি, দ্বিতীয় পুরুষে রাজা খেতাব প্রাপ্তি। শাসকদের মান্যতা ছিল এ জমিদার বংশের একটা ধারাবাহিক ঐতিহ্য । তাদের বিভিন্ন পুরুষে তারা রাজা,মহারাজা, রানী, মহারানী খেতাব অর্জন করেছিলেন শাসককূলের কাছ থেকে। যেমন, নিঃসন্তান পীতাম্বরের দেহত্যাগের পর তার অনুজ নীলাম্বর জমিদারি প্রাপ্ত হন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাকে রাজা খেতাব দিয়েছিলেন। বোধকরি, তখন থেকেই হয়তো বা পুঠিয়া জমিদার বংশ রাজবংশ হিসেবে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে আবার ভুনেন্দ্রনাথ নারায়ণ ১৮০৯ সালে রাজা বাহাদুর উপাধি লাভ করেছিলেন।
এ জমিদারির লতিকাও ছিল ব্যতিক্রম আর বৈচিত্র্যময়। এখানে ভ্রাতা,পুত্র, দত্তক পুত্র, জমিদারের স্ত্রী অনেকেই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। একসময় ষোলআনা জমিদারি ভাগ হয় পাঁচ আনি, চার আনি, তিন আনি এভাবে। পুঠিয়া রাজবাড়ি কমপ্লেক্সে বিভিন্ন জমিদারের স্হাপনা থাকলেও মূল কাঠামো পাঁচ আনি জমিদারদের।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হাত ঘুরে এ জমিদারি আসে যোগেন্দ্র নারায়ণের হাতে। তিনি অন্তিম সময়ে সকল সম্পত্তি স্ত্রী শরৎসুন্দরীর নামে দিয়ে যান। জনদরদী শরৎসুন্দরী শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে প্রচুর দান করেছিলেন। তার পরার্থপরতায় মুগ্ধ হয়ে বৃটিশ সরকার তাকে ১৮৭৪ সালে ‘রানী’ এবং ১৮৭৭ সালে ‘মহারানী’ খেতাবে ভূষিত করেন।
এ জমিদার বংশের শেষ জমিদার ছিলেন কুমার যতীন্দ্র নারায়ণের বিধবা স্ত্রী হেমন্ত কুমারী দেবী। তিনিও তার শাশুড়ী শরৎসুন্দরীর মত নানা জনহিতকর কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। একটা দীর্ঘ সময় তিনি তার জমিদারি পরিচালনা করেন। তার বহুবিধ জনহিতকর কাজের জন্য বৃটিশ সরকারের মূখ্য কর্তাব্যক্তি লর্ড কার্জন তাকেও ১৯০১ সালে ‘রানী’এবং ১৯২০ সালে আরউইন ‘মহারানী’ খেতাবে ভূষিত করেন।
হেমন্ত কুমারীর জমিদারি আমলে জমিদারের খাজাঞ্চি থেকে মাসিক মাসোহারা পেতো অনেক শিক্ষার্থী,বিধবা আর অনাথ। তিনি রাজশাহী শহরের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্টান আর সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। জমিদারের চিরচেনা চরিত্রের বিপরীতে এ দুই ‘রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।’
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশে তাবত জমিদারদের রেখে যাওয়া স্মৃতি স্মারকগুলোর মধ্যে পুঠিয়া রাজবাড়ি অন্যতম। কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মনোমুগ্ধকর এসব স্হাপনা দেখে যেমন বুঝা যায় তাদের সৌখিনতা আর আভিজাত্য ভাব তেমনি ধর্মীয় চর্চায়েও যে এ জমিদার বংশের কেউ কেউ বেশ অন্তপ্রাণ ছিলেন তা’ বলার অপেক্ষা রাখে না।
দীর্ঘ ৩৯৪ বছর টিকে থাকা পুঠিয়া রাজবংশের সেসময়ের অত্যন্ত জৌলুসপূর্ণ অট্টালিকা, মন্দির, হাওয়াখানা, স্নানঘাট যা দেখেছি সে অভিজ্ঞতা কিছুটা ভাগ করে নিবো এখানে।
মহারানী হেমন্ত কুমারী দেবী ১৮৯৫ সালে তার বসবাসের জন্য ইন্দো -ইউরোপীয় স্হাপত্যরীতিতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাসাদটি তার শাশুড়ী মহারানী শরৎসুন্দরী দেবীর সম্মানে তিনি নির্মাণ করেন। চার একরের বেশি জমির উপর প্রতিষ্টিত দোতলা এ ভবনের সম্মুখভাগে বিরাট একটা খোলা মাঠ আছে। প্রাসাদের নিচতলায় স্হাপিত শিলালিপিতে উৎকীর্ণ রয়েছে-
THE PALACE CONSTRUCTED IN 1895 AD BY RANI HEMANTA KUMARI DEVI IN HONOUR OF HER ILLUSTRIOUS MOTHER IN LAW LATE MAHARANI SUNDURI DEVI.
এ ভবনে সব মিলিয়ে ২৬টি কক্ষ রয়েছে। নিচতলায় ছিল মহাফেজখানা, খাজাঞ্চিখানা আর গভীর ক’টি কুয়াসহ একটি কক্ষ। দ্বিতীয় তলা দরবার হল, জমিদারির দাপ্তরিক কাজ ও বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হতো। গূর্ব ও পশ্চিমে আরও ব্লক রয়েছে যেগুলিতে সেরেস্তাদার, নায়েবসহ অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের জমিদারি সংক্রান্ত কাজ করতেন।
ভবনের সামনের দিকে স্তম্ভ, অলংকরন, কাঠের কাজ, কক্ষের দেয়াল ও দরজার উপরে ফুল ও লতাপাতার চিত্রকর্ম চমৎকার নির্মাণশৈলীর পরিচয় বহন করে।
জমিদার বাড়ির অংগনে রয়েছে গোবিন্দ মন্দির।মন্দিরটিতে প্রাত্যহিক পুজা-অর্চনা এখনও করা হয়। একটি উচুঁ বেদির উপর মাঝখানে একটি কক্ষ আর চারদিকে চারটি ছোট বর্গাকৃতির কক্ষ রয়েছে। মন্দিরের পিলার ও দেয়াল পোড়ামাটির ফলক দ্বারা সজ্জিত। যেগুলিতে আবার দেব-দেবী,যুদ্ধের সাজ-সজ্জা, এরকম নানা বিষয়ভিত্তিক চিত্রসহ মুঘল আক্রমণ ও বিজয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ সমস্ত ফলকের মাধ্যমে মূলতঃ মুঘল সাম্রাজ্য ও সম্রাটের প্রতি জমিদারের আনুগত্য আর স্ত্ততি প্রকাশ করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ জমিদার বংশের জমিদার প্রেম নারায়ণ রায় অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে এ মন্দিরটি নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। মন্দিরটির প্রাংগন এখন গোবিন্দবাড়ি নামেও পরিচিত।
পাঁচআনি জমিদার বাড়ি থেকে সামনের দিকে তাকালে খোলা মাঠ পেরিয়ে দু’টি সুন্দর ভবনের শীর্ষদেশ দেখা যায়। যেগুলি এখন পুঠিয়া বাজারের ভিতরে পড়ে গেছে। এগুলোর একটি হচ্ছে দোল মন্দির অপরটি হচ্ছে বড় শিবমন্দির। ছোট শিবমন্দিরও রয়েছে একটি, যেটি এখন পুঠিয়া -আড়ানী সড়কের পাশে পড়েছে। মূল রাজবাড়ি হতে প্রায় ১০০মিটার দূরে এটির অবস্থান।
দোল মন্দিরটি অনেকটা বর্গাকৃতির চারতলা বিশিষ্ট ভবন। শীর্ষতলায় গম্বুজ আকৃতির ছাঁদ রয়েছে। পাঁচআনি জমিদার ভুবেন্দ্র নারায়ণ রায় ১৭৭৮ সালে এ মন্দিরটি নির্মাণ করেন।
দোল মন্দিরের কাছাকাছি রয়েছে বড় শিবমন্দির। এর উত্তর পার্শ্বে রয়েছে একটি বড় দীঘি। যেটির নাম আবার শিবসাগর। মন্দির থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে এ দীঘিতে। শিবমন্দিরটি বেশ উঁচু মঞ্চের উপর নির্মিত। মন্দিরটির চারকোণে চারটি এবং কেন্দ্রস্হলে ১টি চূড়া রয়েছে। এটিকে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শিবমন্দির হিসেবে বিবেচনা করা হয়।রানী ভূবনময়ী দেবী ১৮২৩ সালে এ মন্দিরটি নির্মাণ করেন।
রাজবাড়ি প্রাংগনে আরও রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বড় আহ্নিক মন্দির, ছোট আহ্নিক মন্দির, ছোট শিবমন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির, গোপাল মন্দির ইত্যাদি। বিভিন্ন সময়ে এ জমিদার বংশের চারআনি, পাঁচআনি বিভিন্ন জমিদারগণ মন্দিরগুলো তৈরি করেন। ধর্মীয়চর্চা, প্রজা কল্যাণের কাজগুলোতে পুঠিয়া রাজবংশের একটা নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল।
আরও দুটো জিনিস বেশ আকর্ষণ করেছিলো আমাকে। তার মধ্যে একটি হলো রানীর স্নান ঘাট। মহারানী হেমন্ত কুমারীর বাসভবনের প্রায় সংলগ্ন গোপাল সাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে চারদিক থেকে ঘেরা ইট বাঁধানো বড় একটি পুরানো ঘাট এখনও দেখা যায়। রানীরা তাদের স্নান কাজে এ ঘাটটি ব্যবহার করতেন। দীর্ঘদিনের অযত্ন অবহেলায় এর সৌন্দর্যের অনেকখানি হানি ঘটলেও এখনও বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়।
পুঠিয়া রাজবাড়ি থেকে প্রায় ৩ কি.মি. দূরে তারাপুর নামক গ্রামে একটি বিশাল আকার পুকুরের মধ্যবর্তী স্থানে পুঠিয়া রাজবংশের একটি হাওয়াখানা এখনও বিদ্যমান। বিশেষজ্ঞদের অনেকে যদিও এর নির্মাণ বৈশিষ্ট্য দেখে একে হাওয়াখানার পরিবর্তে মন্দির বলেই মনে করেন। তবে এর অবস্থান এবং স্হানীয় লোকজনের বংশপরম্পার শ্রুতি হিসেবে আমার কাছেও এটিকে হাওয়াখানা হিসেবে মনে হয়েছে। আমি চীনের বেজিং শহরের Forbidden City থেকে কিছুটা দূরে Summer Palaceও কৃত্রিম লেকের ধারে একটা স্হাপনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। গাইড আমাদের জানিয়েছিল গরমকালে ঠান্ডা হাওয়া পাবার জন্য এ ব্যবস্হা করা হয়েছিল।
পুঠিয়া রাজবাড়ি এবং মন্দিরসহ অন্যান্য স্হাপনা বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেছে।
Leave a Reply