জাতীয় শোক দিবস: বাঙালির কান্না চিরদিনের
প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ আলম
‘…কাঁদো, বাঙালি, কাঁদো।
এসেছে কান্নার দিন মুজিববিহীন এই স্বাধীন বাংলায় ।
..আগস্ট শোকের মাস, পাপমগ্ন, নির্মম-নিষ্ঠুর,
তাকে পাপ থেকে মুক্ত করো কান্নায় ,কান্নায়। ’
বেদনার প্রবল স্রোত আর যন্ত্রণার কাতরতা নিয়ে আরার এলো শোকাবহ মাস আগস্ট। বাঙালির অতলান্ত কষ্ট ও দীর্ঘশ্বাসে ভারী বাংলার আকাশ-বাতাস। শোকের ঝোড়ো হাওয়া বইছে হৃদয়ে হৃদয়ে। এ শোক বাংলা নামক দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, আমাদের স্বাধীনতার সাহসী অগ্রসৈনিক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে চিরতরে হারানোর শোক।
০ আগস্ট এলেই শোকের সাগর উথলে ওঠে, দিকে দিকে উচ্চারিত হয় বাঙলার দুখী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহামানের বিপুল ভালোবাসার কথা।
০ বিসুভিয়াসের অগ্নি লাভার মতো প্র্জ্জ্বলিত বঙ্গবন্ধু। জসীম উদদীনের কবিতায় উচ্চারণ-
‘মুজিবর রহমান
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি উগারী বান।’
পাকিস্তানী বেঈমান পতাকা ছিঁড়ে পড়েছে তাঁরই আঙুলের ইশারায়। তিনিই সাতই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বজ্রকণ্ঠে বলেছেনÑ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতর সংগ্রাম।’ ১৯৭৫এর পনের আগস্টের সূর্যোদয় দেখা হয়নি বঙ্গবন্ধু পরিবারের। রক্তলোলুপ ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে হিংস্র, লোভী ঘাতকরা সপরিবারে হত্যা করেছে বাঙালির গর্বের ধন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুর সাথে জীবন দীপ নিভে গিয়েছে প্রিয়তমা পত্নি ফজিলাতুননেছা মুজিবের, মায়ায় জড়ানো সন্তান, পুত্রবধুদের, এমনকি শিশু রাসেলের বুকেও গুলি চালাতে হাত কাঁপেনি ঘাতকদের। বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিঃশেষ করে বিশ্বসঘাতকরা উদ্যত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নাম বাঙালির ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে। কিন্তু না, তারা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি এ দেশের মানুষের কাছে অমলিন, দীপ্ত-আলোকশিখা, বিপদমুক্তির অনিবার্য প্রেরণা। বঙ্গবন্ধু ভাস্বর বাঙালির অন্তরে, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, দেশের উন্নয়নে, মানবিক কল্যাণ চেতনায়। ‘মুজিব বাইয়া যাও রে/ নির্যাতিত দেশের মাঝে / জনগণের নাও’; ‘সাতকোটি মানুষের আর একটি নাম / মুজিবুর মুজিবুর/ মুজিবুর’-এমন অসংখ্য গান,কবিতায় বঙ্গবন্ধু বীভাময়।
আগস্ট এলেই বঙ্গবন্ধুর জীবনের ও কর্মের প্রসারিত দিক আলেচিত হয়, বিশ্ববাসীও অপার আগ্রহে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের কথা, বিশ্ববরেণ্য নেতার সংগ্রামী কর্মধারার কথা। ছোটবেলা থেকেই মানব কল্যাণে স্বদেশী আন্দোলনে। নিজের ত্যাগর মন্ত্রে শিশুদের উজ্জীবিত করে ,নীতি নিষ্ঠ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপক্ষে ব্রতী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর ভাষ্য- ‘আমিও লেখা পড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম’। জরাজীর্ণ স্কুল ভবনের জন্য স্কুল পরিদর্শনে আসা মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে সাহায্য আদায় করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মচারীদের ন্যায্য দাবী আদায়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়েন তিনি। ছোট বেলাতেই জড়িয়ে পড়েন মানব কল্যাণী কর্মে। নিরলস কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধু।
পাকিস্তানী শাসকরা বাংলা ভাষাকে কেড়ে নিতে ষড়যন্ত্রজাল বিছালে তা ছিঁড়তে জেলে থেকেও প্রেরণা দেন বঙ্গবন্ধু। আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলার আসমী করলেও কর্তব্যের পথ ত্যাগ করেননি তিন। পাকিস্তানী দন্ডে ১৪ বছর কারাগারে থেক্ওে বাংলার স্বাধীনতার দাবী থেকে সরে আসেন নি সামান্যতম। ছয়দফা দাবীর মাধ্যমে পূর্ববাংলার মানুষকে মুক্তির তীর্থে পৌছে দিতে লড়াই করেছেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালিদের সংগঠিত করে তাদের মধ্যে স্বাধীকারের বীজমন্ত্র দিয়ে উজ্জীবিত করেছেন, তুলেছেন জয়বাংলা ধ্বনি। সত্তরের নির্বাচনে তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের অর্জন একক সংখ্যাগড়িষ্ঠতা। একাত্তরে পাকিস্তানী ঘাতকদের হাতে বন্দী হয়ে পাকিস্তান কারাগারে ফঁসির জন্য অপেক্ষা করেছেন, কিন্তু মাথা নত করেন নি অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা, মাথানত করে চলে গেছে পাকিস্তানী ঘাতকরা। এদশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সবুজ-শ্যামলে, ফুলে ফসলে সাজাতে কাজ করেছেন আন্তরিক। শিক্ষা,স্বাস্থ্য, শিল্প-কারখানা, কৃষি সবস্তরেই সাফল্যের ফুল ফোটাতে পরিশ্রম করেছেন হাসিমুখে। অসাম্প্রদায়িক দেশ হবে বাংলাদেশ এমন প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাÑ ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিতে হবে না।’ সোনার বাংলার বিপুল স্বপ্নে যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে গড়ার প্রত্যয়ে অগ্রযাত্রী বঙ্গবন্ধুকে বাঁচতে দেয়নি বিশ্বাসঘাতকরা।
নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধে জারি করেছিল ইনডেমিনিটি নামে কুখ্যাত আইন। জাতির জনকের যোগ্য কন্যা প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক উদ্যোগে কিছু খুনীর বিচার ও ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, কলঙ্ক মুক্তি ঘটেছে জাতির। অন্যান্য খুনীদের বিদেশ থেকে এনে বিচার ত্বরান্বিত করার প্রয়াস অব্যাহত আছে।
আগস্টে পিতা,মাতা, ভাই, স্বজন হারানোর অসীম বেদনা বুকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা জাতির পিতার আদর্শ প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। পনেরই আগস্ট যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে। বঙ্গবন্ধু স্মরিত হচ্ছেন শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়। আলোচনা, সেমিনার, কবিতা,গান, স্মরণসভায় শপথ বাণী উচ্চারিত – বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সোনার বাংলা গড়বার। আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশকে জঙ্গীমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, মাদকমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ার প্রতিজ্ঞা বিস্তৃত করতে হবে আমাদের। দেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ, উন্নয়নশীল দেশ, অচিরেই পরিণত হবে মধ্যম আয়ের দেশে, তারপর উন্নত দেশের মর্যাদায় বাঁচবে বাংলাদেশের মানুষ। শুধু আগস্টে নয় বঙ্গবন্ধুর বিপুল কর্মের জয়গাথা উচ্চারিত হবে প্রতিদিন, বছরের পর বছর। সত্য হলো বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোকে বাঙালির কান্না চিরদিনের, চিরকালের। কবির বেদনার্ত উচ্চারণ-
‘আজ পনেরো আগস্ট, আজ বাঙালির শোক।
অনার্য পতাকা হয়ে বাংলার আকাশটাও আজ নত হোক।
আজ খাঁ-খাঁ, আজ ধু-ধু, আজ ছিন্নভিন্ন মানুষ আসুক
রাঢ়ে বঙ্গে হরিকেলে সমতটে
বাঙালিদের বজ্রবুকে আজ ঘোর বারিপাত হোক’-।
যুগÑযুগান্ত ধরে বঙ্গবন্ধু জাগ্রত থাকবেন স্বধীনতা ও মানবিক ভালোবাসার প্রতীক হয়ে – এ বিশ্বাসে জাতীয় শোক দিবসে জাতির পিতার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
[লেখক: বিশিষ্টসাহিত্যিক, ভূতপূর্ব অধ্যাপক বাংলা, কারমাইকেল কলেজ,রংপুর]
Leave a Reply