বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ১০:২০ অপরাহ্ন

ভাববার বিষয়-পর্ব-৯ চরিত্রকথা অভীককুমার দে

ভাববার বিষয়-পর্ব-৯ চরিত্রকথা অভীককুমার দে

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাহিত্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ কবি ও সমালোচক অভীককুমার দে’র ধারাবাহিক
ভাববার বিষয়-পর্ব-৯
চরিত্রকথা

১.
হারায় কই! হারায় না তো! চরিত্র কখনওই মন থেকে স্থানান্তরিত হয় না, বরং মনে থেকেই রূপান্তরিত হয় এবং নিজগুণে বাসা বাঁধতে পারে। অন্যরা সেই রূপান্তরিত চরিত্রে প্রভাবিত হয় বা হতে পারে, এমনকি রোগগ্রস্তও হতে পারে। কেননা, শরীরের ভেতর চরিত্রের আলাদা কোনও আকৃতি বা অবয়ব থাকে না। মনের মতই অদৃশ্য।
চরিত্র মনের নির্দেশ মত শারীরিক ও মানসিক আচরণ পরিচালনা করে। সময়, প্রয়োজনিয়তা, পরিবেশ এসবের প্রভাবে মানুষের ভেতর চরিত্র ওঠানামা করে, কখনও উন্নত চরিত্র থেকে ভ্রষ্ট চরিত্রের দিকে, কখনও ভ্রষ্ট চরিত্র থেকে উন্নত চরিত্রের দিকে, কখনও দুয়ের মধ্যিখানে টাল সামলানো অবস্থান নিয়ে পড়ে থাকে ব্যক্তি। এতে ব্যক্তির নিজস্ব অবস্থান থেকে শুরু করে সামাজিক অবস্থানেরও অদলবদল হতে পারে বা হয়। তবে হলফ করে বলতে পারি, কোনও ব্যক্তিই চরিত্রহারা হয় না।
প্রসঙ্গত, সংসার একটি সমুদ্র। একেকটি সমাজ জাহাজ। প্রতিটি জাহাজের প্রতিটি লোক গন্তব্যের দিকে। সময় ও পরিবেশের কারণে ঝড় ওঠে সমুদ্রে। টালমাটাল জাহাজগুলো টিকে থাকতে চেষ্টা করে। জাহাজের ভেতর অস্থিরতা বাড়ে। ডুবে যাবার আশঙ্কা এলেই লাইফবোট খুলে যায়। স্থির চরিত্র স্থানচ্যুত হয়। বেঁচে থাকা, বাঁচিয়ে রাখা আর বেঁচে যাওয়ার পর কিছু অসহায় মৃত্যু ও কিছু মানুষের বরণীয় মৃত্যুই বেঁচে থাকে। সময় গড়িয়ে যায় জলের মতো। মাটি চেনায় চরিত্র গবেষক।

২.
আমরা যতই বলি, আমরা নিজেকে ভাঙতে থাকি, বুঝতে পারি, বিশ্লেষণ করতে পারি, এইসবই অনুমানসমৃদ্ধ। আমরা মৃত্যু পর্যন্ত নিজেকেই বুঝতে পারি না। অন্যের চরিত্র উপলব্ধি বা বর্ণনা, তা আকাশ থেকে তারা পেড়ে আনার মতো। একজীবনে ব্যক্তি মানুষ নিজেকে জানতে চিনতে পারবেন হয়তো (যেমনটা মুনিঋষিরা দাবি করেন), আমি আপনি বা এই জাতীয় মানুষ পারে না কারণ, আমরা অন্যকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে ভুলে যাই। এভাবেই সারাজীবন। পৃথিবীতে এমন কোনও মানুষ নেই যে নিজের কাছে সঠিক নয়। প্রতিটি মানুষ যদি নিজের জানালা খুলে রোদ ঢুকতে দিত, তাহলে ভেতরের ময়লা দেখলে নিজেই আতকে উঠতো।
বিস্তর গবেষণাকারী হয়ে মানুষ হয়তো মনোবিজ্ঞানের চৌকিদার হতে পারে, নিজের চিতাভস্মের মালিক হতে পারে না। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মানুষ সব ভালোমন্দ বোঝে, শুধু আচরণের পরিবর্তন করতে পারে না। যেমন, যিনি অন্যের ঘরের বেড়া ফাঁক করে দেখেন বা দেয়ালে কান পেতে থেকে অভ্যস্ত, তিনি কি ভালোমন্দ বোঝেন না ? তবুও করেন। যিনি নিজের জীবনে বহু অপরাধ করেছেন, আরো আরো অপরাধের পথে হেঁটে যান আর ঠিক তখন কেউ ইচ্ছে করলেও সঠিক পথ দেখাতে পারেন না, বরং এমন ১৯ কালে মদ্যক্রেতার মতো লাফঝাঁপ দেবে।
তবে একথা ঠিক, ঝড়ের পর অসম্ভব চুপ রহস্য থাকে। সব মাংসাশীও আবার হামলে পড়ে না। সময় ঠিক বুঝিয়ে দেয় প্রতিটি মানুষকে। একটি অপ্রকাশিত উপন্যাস বুকে নিয়ে মৃত্যুর দিকেই তো হেঁটে যায় মানুষ।

৩.
চরিত্র একটি রহস্যময় অনুভব। যিনি চরিত্রের ভালো খারাপ ফল ঘোষণা দেবার জন্য সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে দাঁত দেখিয়ে হাসেন, তাকেই প্রথমত সংযমী হতে হয় নেশামুক্ত ডাক্তারের মতো।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বা দৃষ্টিনন্দন অবয়বের উপর চরিত্র গঠন বা লালিত হয় না। অভ্যন্তরীণ জিহ্বার স্বাদ কোডের উপর তৈরি হয় মানসিক জগৎ। প্রতিটি মানুষের মানসিক জগৎ আলাদা। সবার ভেতর পরিবেশ সমান নয়। সবার সামাজিক অবস্থান একরকম হয় না বলে, ভেতর পরিবেশের সবুজায়ন সমান হয় না। প্রতিটি মানুষ অন্যকে নিজের পরিবেশের কাঠগড়ায় রেখে ব্যাখা ও পরিবেশন করে। এমন চারিত্রিক বিশ্লেষণের কোনো অনুশাসন নেই বলে সব মানুষ কিছু না কিছু মানসিক প্রতিবন্ধী। এমন প্রতিবন্ধকতা থেকে অবসাদের পরিবেশ রচিত হয়। কাল্পনিক ডানায় ভেসে যতসব আজগুবি চরিত্র সৃষ্টি করে পরিবেশক হয়ে ওঠেন একজন গল্পকার। একটু বেশি উন্মাদ হলে উপন্যাসিক হয়ে ওঠেন চরিত্রের।
যুদ্ধের তেপান্তর থেকে রূপকথা বেরিয়ে আসে না। জীবনের শেষ পরিণতি কেবল হারিয়ে যাওয়া। চরিত্র অঙ্কন তেমন কোনো শিল্প নয়। অঙ্কিত চরিত্রের ভেতর সত্য ও শিক্ষনীয় রসদের সম্ভার সৃষ্টি করাই শিল্প। শিল্প আর শিল্পের ভেতর মানুষ নিজের মতো অনুঘটক হতে পারে।

৪.
চরিত্র বায়বীয় হলে মানুষের নিজস্ব পারিবারিক ভূগোল হতো না। অবস্থানের মান নির্ণয়ও না। ছোট বড় ভেদ বিচার থাকতো না। আলখাল্লার মতো প্রত্যেক ব্যক্তির আলাদা আলাদা আলোচনা বা গবেষণা থাকতো না।
আমরা নিজেদের চারিত্রিক বিবেচনায় নির্ণিত হতে পেরেছি বলে নিজের ও অন্যান্য প্রাণীর নামকরণ করে আলাদা বিশ্লেষণের ছক আঁকতে পেরেছি। সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছি। সম্পর্কের কোমল অনুভবে পাশবিকতাকে আলাদা করতে পারি। মাকে মা, বাবাকে বাবা, ভাইকে ভাই, বোনকে বোন, বন্ধুকে বন্ধু’র মতো পৃথক করে অনুভব করতে পারি। এমন হাজার সম্পর্কের ভেতর মানুষকে তার আলাদা চরিত্রে বসিয়ে মর্যাদা দিতে পারা যায় বলেই এখনো মানুষ পশু হয়ে যায়নি। কারোর কিছু পৃথক উদাহরণ চোখে পড়লে মানুষ তার যে বর্ণনাত্মক পরিচিত উপস্থাপন করে, তা অবাক করে সমাজের অন্যান্য মানুষদের। এই মানের ভেতর লুকিয়ে থাকে মর্যাদাবোধ।
আপনার কথা অনুযায়ী, চরিত্র বায়বীয় হলেও অনুভব ও প্রয়োজনীয়তার বাইরে নয়। যে যার অবস্থান থেকে চরিত্রকে যেভাবেই বিশ্লেষণ করুক না কেন, মানসিক ও সামাজিক গন্ডি অতিক্রম করার সুযোগ নেই। আর বদলে যাওয়া তেমন কোনও অবাক হবার বিষয় নয়। সবকিছুই বদলায়। প্রতিদিন বদলায়। প্রতি মুহূর্তে বদলায়। সৃষ্টির যা কিছু, বদলে যাওয়াই স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। রূপ গুণ ভালো মন্দ ইচ্ছা অনিচ্ছা সব বদলায়। মন বদলায়, শরীর বদলায়, স্বভাব বদলায়, এমনকি চরিত্রও। যে শিশুটি প্রতিদিন নিজের ভেতর বিকশিত হয় কিংবা যে মানুষের প্রতিদিন নৈতিক অবক্ষয় ঘটে, তা অত্যন্ত সূক্ষ্ম অনুভবের বিষয়। আমরা বলতেই পারি না, কখন কিভাবে শিশুটি আর শিশু থাকে না। বুঝতে পারি না, বৈশিষ্ট্য সব বদলে গিয়ে খারাপ লোকটি কখন ভালো মানুষ হয়ে যায়, আবার ভালো মানুষটিও তদ্রূপ।
মানুষ তার চেতনার ঘরে যেমন যোগী হতে পারে, তেমনি পশুও লালন করতে পারে। ভাবনার আদলে নিজেকে ভাসিয়ে দিলে একক ব্যক্তির মানসিক সুখ প্রাপ্ত হলেও, ভিন্ন মানুষের অশান্তির কারণও হতে পারে। ফলত, আত্মীয়তায় ফাটল সৃষ্টি হয়। সামাজিক অবক্ষয়ের সম্ভাবনাও থাকে। সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা হারানোর আশঙ্কা বেড়ে যায়। মাকে মা, বাবাকে বাবা মনে না হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। এমতাবস্থায়, ব্যক্তি অথবা সমাজ অশ্লীলতায় ভরে যাবে বলেই এক অঘোষিত চুক্তিতে আবদ্ধ করি নিজেদের। আমরাই মান নির্ণয় করি। আমরাই মানুষকে মানুষের কাছে টেনে আনি। আমরাই ঠেলে দিই দূরে।
যাওয়া আসার ভেতর এক নীরব তরঙ্গ থাকে। নিঃশব্দ সুর আছে। এখানেও একটি অদৃশ্য জগৎ, বাতাসের মতো, অসংখ্য উপাদান থাকে। কেউ দেখে না, কেবল অনুভব করে। অক্সিজেনের জন্য নাক উঁচিয়ে থাকে। বাইরে ভেতরে চতুর বায়বীয় আস্ফালন।

৫.
এই পৃথিবীতে কাছের মানুষের অভাব নেই। কাছের মানুষ মানে, কেবল প্রিয় মানুষটি নয়। এমনকি, চেনা হতে হবে, তেমনও কোনো কথা নেই। চেনা অচেনা অনেক জন একে অন্যের প্রিয় হতে পারে যেমন, তেমনি অপ্রিয়ও। উভয় প্রজাতির মানুষকেই কাছে থাকতে হয় অনুভূতির প্রতিফলনের জন্য।
মানুষ মানুষকে বোঝার জন্য একটি সেতুবন্ধনের প্রয়োজন হয়। হৃদয় থেকে হৃদয়ের পথে পা বাড়াতে হয়। হৃদয়ের পথ সব থেকে জটিল পথ। অদৃশ্য রাস্তা ধরে অনুমানে ফেলতে হয় পা। ধরা যাক, দুটি হৃদয় দুটি পাহাড়। মাঝে অন্তহীন গিরিখাত। নিচে গলিত লাভাস্রোত নদীর মত। একপাশের পাহাড় চূড়া থেকে অন্য চূড়ায় যেতে হবে হৃদয় ছোঁবার জন্য। পথিক জানে, একটি অদৃশ্য পথ আছে, অনুভবের।
হৃদয়ারোহীর আরোহণ সৎ অসৎ দুরকমই হতে পারে। সৎ হলে হৃদয় থেকে হৃদনগর অনেক দূর। অনেক বেশি কষ্টের হয় পথচলা। অদৃশ্য পথ আরো অদৃশ্য হতে থাকে। তবে, একবার পৌঁছে গেছে রবীন্দ্রকানন। যে ফুল আপনার জন্য নয়, সে ফুলের ঘ্রাণ হলেও বাতাসে ভেসে ছুঁতে চায় পদচিহ্ন। অসৎ লোকটিও হৃদয়ের পথেই হাঁটে। হৃদয়ের ঘরে পৌঁছে যাবার অসংখ্য পথ খোলা থাকে তার। হৃদয়ের ভেতর হানা দেবার জন্য স্বর্ণমৃগ অথবা মারিচ হতে সময় লাগে না। রম্ভা, উর্বশী, মেনকা অথবা নটরাজ না হয়েও, ছলনার কপাট খুলে উলঙ্গ নাচতে পারে এমন মানুষ। এমন অসৎ লোকেরা হৃদয়ের অতলে বিষ ঢেলে ক্ষুধার্ত মাছটি ধরতে চায়। ধরতে পারলেই গিলে খায় না। বড়শির আধার বানায়। সমুদ্রে ফেলে। বড় মাছ ধরে নিজের জন্য। অতপর পরিযায়ী শ্রমিকদের মতই লকডাউনের নিঃসঙ্গ রাস্তায় পায়ের ক্ষতছাপ রেখে যায় মৃত্যুর আগে।
সময়ের হাত ধরে যে উড়ো চিঠি প্রজন্মের পর প্রজন্মের হাতে ঘোরে, আমি তাকে ভোমরাঘুড়ি বলি। বুকের হাড়ভাঙা ফ্রেমে যে ক্যানভাস তৈরি হয়, তাতে নিজের ছবিটি অবিকল এঁকে যাওয়াই শিল্প। শিল্পী যিনি, নকল হতে সাবধান।

৬.
একটি মানুষ প্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে অনেক কারণ থাকে। অনুভূতির জানালায় উঁকি দিলে যে রোদ আসে, যে বাতাস মুখমণ্ডলে আদর দিয়ে যায়, যে সবুজ চোখের ক্যানভাসে ছবি আঁকে, তা সব প্রেম বয়ে আনে না। ভিন্ন ভাবনাকেও জাগিয়ে তোলে। সৃষ্টির, স্রষ্টার, রচনার, গানের, রঙের কিংবা সুখদুঃখেরও। অচেনা মানুষ চেনা হয়। প্রিয় হয়ে উঠলে তার ভেতর ঘরে অতিথিও হয়। তারপর পরিচয়ের সূত্র ধরে দুদন্ড সুখানুভূতি বা সুখানপুকুরের ইতি বৃত্তান্ত জানতে ইচ্ছে করে। এই জানার ভেতর আরও অনেক অজানা কিছু থেকে যায় ঠিক, তবুও এক ঘাসফড়িং উড়তে দেখে ভালোই লাগে।
প্রতিটি মানুষের মনের উঠোনে গোলাপ কিংবা রজনীগন্ধা ফোটে না। একলা একা মানুষের উঠোনেও তেমন ফুল ফোটে। এমনও হতে পারে, হয়তো কোনো দামি ফুল নয়, হতে পারে ঘাসফুল, তবুও চারপাশ জড়িয়ে সেই ছোটো ফুলগুলো, মৃদু রঙ ছড়ায়। সেই মৃদু রঙ কোনো একা মানুষের জীবনমুখী সুর খুঁজে দিতে পারে।
প্রতিটি মানুষের মন নিজের মতই রাজা। নিজের রাজ্যে অন্যের বিচরণ সহ্য করলেও শাসনের অধিকার দেয় না। খুব বেশি বোঝাপড়া হয়ে গেলে খানিকটা বিশ্রাম নিতে পারে কেউ। তবে, ফাঁড়ি গেঁড়ে বসার এবং স্বত্তাধিকারী হবার কোন সূত্র কখনও আবিষ্কার হয়নি পৃথিবীতে। কেননা, মনের প্রহরী প্রতি মুহূর্তের খবর রাখে। কে আসছে, কে যাচ্ছে, কে উঁকি দিচ্ছে অথবা কে হানা দিচ্ছে, তারজন্য অনুভূতি জাল বিছিয়ে রাখে সীমান্তরক্ষীর মত। চিরসজাগ প্রহরী। তিনি মনের প্রধান উপদেষ্টাও। মনের ভেতর যদি কোনো বিষয়ে অন্তর্কোন্দল সৃষ্টি হয়, প্রহরী নিজেই ভালোমন্দ বিচার করেন এবং মন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
প্রতিটি মানুষের মনের সব সিদ্ধান্তই যে সঠিক হবে, তেমন কোনো কথা নেই। ব্যক্তির পরিবেশ পরিস্থিতি ও সময় কখনো কখনো মনকে বিচলিত করে। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে ভুলও হয়ে যায়। তখন সিদ্ধান্তের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষের চোখে প্রিয় মানুষটির অন্য এক চরিত্র ফুটে ওঠে। প্রিয় মানুষটি বিচক্ষণ হলেও চোখের সামনে অন্য এক মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হতে সময় লাগে না।

৭.
‘খোঁজ’ এমন একটি শব্দ যা চাহিদার মুখটিকে রসালো করে তোলে। শরীর কিংবা মনের তৃপ্তির জন্য প্রতিনিয়তই খোঁজ জারি থাকে ব্যক্তি মানুষের। এক চাহিদা পূরণ হলে অসংখ্য চাহিদার দরজা খুলে যায়। বাড়তে থাকে স্নায়বিক চাপ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, চাহিদার পেছনে ছুটে আর খুঁজে খুঁজেই ব্যক্তি মানুষ তার মানুষটিকে ভুলে যায়। অপরিচিত এক লোক বহন করে চাহিদার ভেতর হারিয়ে ফেলে পথ। এমন আবহে মনুষ্যত্বের আকাল তেমন অবাক করা বিষয় নয়। অবাক হবার বিষয় নয়– এই পৃথিবী একদিন খুব সুন্দর ছিল, এখন নেই। এখানে অদ্ভুত সব প্রাণীরা বসবাস করতো, এখন হারিয়ে গেছে অথবা হারিয়ে যাচ্ছে।
শূন্য মাঠের উর্বর জমি পৃথিবী। সবুজের বীজ বপন থেকেই গাছ হয়। স্থির দাঁড়িয়ে নিজস্ব সীমানায় ছায়া দেয়। প্রাণের রসদ বিলি করে। মানুষ গাছের মত স্থির হতে পারে না।গতি নিয়ে খেলতে খেলতে আজকাল অসম্ভব গতিশীল হয়ে পড়েছে মানুষ। নিয়ন্ত্রণ না হলে দুর্ঘটনা এক স্বাভাবিকতা। চাহিদার পিছে ছুটতে ছুটতে গন্তব্য থেকে ছিটকে যাচ্ছে মানুষ। লকলকে জিহ্বা থেকে অসন্তোষের লালা নদীটি যত বেশি খরস্রোতা হচ্ছে, ততই ধ্বংসের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠছে।
যে মানুষ, শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করে, প্রকৃতির দেশে রাজা হতে গিয়ে স্বঘোষিত মানুষ, মুখ লুকিয়ে নিচ্ছে দিনের পর দিন। চতুর্দিক ঘিরে আতঙ্ক। প্রতিযোগিতার বাজারে সফলতা খুঁজে খুঁজে যখন অসহিষ্ণু মানুষ, মুখ দেখাতে পারে না নিজের। অসংখ্য অন্যায় আর অতি মাত্রায় অপরাধের পর আরো খোঁজ বাকি থাকে। অন্য কেউ, অন্যভাবে খোঁজে। এভাবে একদিন একটি পথ মানুষের অজান্তেই নিয়ে যাবে গন্তব্যের দিকে। সেদিকে আগুন, শুধুই আগুন, পাশে নদী বয়ে যায়।
মানুষ নামের প্রাণী পৃথিবীকে ধ্বংস ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। লুটপাটের সামগ্রী দিয়ে নিজের চাহিদা পূরণের সরঞ্জাম বানালেই সৃষ্টি নয়। আবিষ্কৃত উপাদানের আঁচল ধরে কী এমন আবিষ্কার করতে পারে মানুষ ! যে ছোট্ট নদীটি বুকের ভেতর, যেখানে খুব সামান্যই ঢেউ, তবুও আঘাত সহ্য হয় না যার, তার সমুদ্রগর্জন শোভা পায় না। মানুষ নামক প্রাণী নীল রঙের শেয়াল, ভন্ড রাজা। বহু সময় পর, বৃষ্টি এলো বলে, শরীর গুছিয়ে খোলসের মানুষ। এই মানুষগুলো নিজেই জানে, ওদের ভেতর মানুষ নেই। ওরা আসলে শোষক ছাড়া কিছুই নয়। প্রকৃতির প্রকৃত শ্রমিক গাছ। প্রকৃতির দেশে সঠিক নির্বাচন হলে, গাছেরাই রাজা। তখন, গাছ নিজেই অন্য প্রাণীদের বিভিন্ন নামে ডাকতো। গাছেরা মানুষকে মানুষ ডাকলেও, মানুষ শব্দটি নিকৃষ্ট অর্থেই বিবেচিত হত। প্রতিটি গাছ জানে, মানুষ নামক প্রাণীরা আর যা কিছুই হোক, তবে গাছ হতে পারে না। কেননা, গাছ শ্রমিক, প্রকৃত শ্রমিক এবং উদ্ভিদ।

৮.
পৃথিবীতে এমনও অসংখ্য মানুষ দেখা গেছে, যারা বস্তুজগতের উপর রাজত্ব স্থাপনের লক্ষ্যেই ভিন্ন মানুষ। অন্যের চিন্তা চেতনায় তালা ঝুলিয়ে রাখতে চেয়েছে। এই প্রজাতির মানুষ মনে করে, বস্তুজগতের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারলেই মনোজগতের ঈশ্বর হওয়া সম্ভব। জীবন সে কথা বলে না। যাপনের রসদ সঞ্চয় করতে করতে এক বাউল জীবন। শরীরটাই অপরিচিত হয়ে যায়। শূন্যের পর একটি একলা শরীর, অজান্তেই বদলে যায়। অতঃপর শূন্য পথেই পুনরায় হাঁটতে থাকে।
শূন্য থেকে শূন্যে অতিক্রমের জন্য পথপ্রদর্শন করে মন। মন বলে কথা। যাকে দেখি না, অথচ যার সাথে প্রতিমুহূর্তে আলাপচারিতায় সিদ্ধান্তের পথ খুলে যায়, সে অদৃশ্য হলেও অস্তিত্বহীন নয়। চলার পথে ইন্দ্রিয়গুলো যা কিছু সংগ্রহ করে, সবকিছুই মনের যাঁতাকলে ডালজাতীয়। পিষে পিষে পদার্থের অভ্যন্তরীণ আচরণ প্রকাশ করে। জীবনের রসদ হয়ে বেঁচে থাকার যাবতীয় সুখ রচনা করে। মন যদি অস্থির হয়ে যায়, বহনকারী মানুষটি তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলত, মানসিক অবসাদের কালো ছায়া, ঢেকে ফেলে মনের আকাশ। ধ্যানবিন্দু ঝাপসা হয়। নিজস্ব মাটি হতাশায় চুপ হয়ে যায়। তখন চিন্তা ও চেতনার মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। এই দুয়ের ফাঁকা স্থানে উষ্ণ বাতাস বৃষ্টির আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে ইতি-উতি ছুটতে থাকে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মত। এক বিধ্বংসী ঘুর্ণিঝড়ের মতই অদ্ভুত ! মাটি ভিজে গেলে যদি আকাশের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, তাহলে সবকিছুই আবার স্বাভাবিক হয় অথবা স্বাভাবিক হবার আশা সঞ্চার হয়। নাহলে এক নিদারুণ বর্ষা। জলঘরে ডুবতে যায় মাটি।
প্রতিটি মানুষ তার ভেতর জগতের সিদ্ধান্তকেই মান্যতা দেয় মুলত। একনায়কতান্ত্রিক এই জগৎ ভিন্ন জগতের উপর প্রভাব বিস্তার করতে প্রতিনিয়তই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। নিজস্ব অনুশাসনে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে সময়। মনে করে, তার চিন্তা ও নিয়মনীতি অনুসারে পরিচালিত হলে ভিন্ন ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ জগতেও একই ফসল উৎপাদন সম্ভব। সর্বত্র একইরকম মনোচর্চায় বহিঃ জগতের কল্যাণ বা ক্ষতি হবে ইচ্ছানুযায়ী। অথচ মানুষ বুঝতে পারে না, এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই পারস্পরিক সম্পর্কগুলো ধীরে ধীরে বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে। বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে মানুষে মানুষে। উপর উপর পলির মত কোমল আস্তরণ দেখা যায় শুধু। গুছিয়ে রাখে নিজস্ব জগৎ এবং স্তরে স্তরে ঢেকে রাখে ভেতর বাড়ি। কঠিন থেকে কঠিনতম উপাদান জড়ো করে একেকটি প্রাচীর, সঞ্চয়ে রেখেছে লাভাস্রোত।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge