মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার অনন্যপ্রেমিক: মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
ড. নাসিমা আকতার
আধুনিক বাংলাসাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত একটি অবিস্মরণীয় নাম। অসামান্য মেধা ও প্রতিভার অধিকারি মাইকেল আধুনিক বাংলাসাহিত্যের অগ্রদূত ছিলেন। তিনি একাধারে বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃতি, জার্মান, হিব্রæ, গ্রিক, লাতিন, ফরাসি, ইতালি ইত্যাদি দেশের ভাষায় দক্ষতা অর্জন কিেছলেন।
ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর সাহিত্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। হিন্দু কলেজে ছাত্র থাকাকালীন সাহিত্য চর্চার মাধ্যম ছিল ইংরেজি ভাষা। পরবর্তীতে বিদেশি ভাষার মোহ ছেড়ে তিনি মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চা করে খ্যাতি লাভ করেন। বলা যায়
মাতৃভাষা বাংলায় রচিত অমর কাব্যের তিনিই ¯্রষ্টা। তাঁর রচনায় অপূর্ব মিলন ঘটেছে রোমান্টিক ও দ্রæপদী সাহিত্যের। দেশপ্রেম, মাতৃভাষা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ,মানবিকতা স্বাধীনতার চেতনা এবং নারী-জাগরণ ছিল তাঁর সাহিত্যের মূলসুর। পুরাতন প্রথা ভেঙে নতুন ছন্দ, নতুন বিষয় নিয়ে তিনি বাংলাসাহিত্যে হাজির হয়েছেন। তাঁর হাতে ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’, সনেট বা চতুর্দশ কবিতা, মহাকাব্য, শিল্পসফল আধূনিক বাংলা নাটকের সৃষ্টি।
এর চেয়ে বড় যেদিকটি তা হলো, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও বঙ্কিমচন্দ্র চন্দ্র বাংলাসাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, নতুন যুগকে জাতির জীবনে সত্য ও সার্থক করে তুলতে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের অন্তরযোগ ঘটানো এবং তাকে সার্থক করে তুলতে মাইকেলই প্রথম বাংলা সাহিত্যে সে যুগের চিন্তা-ভাবনায় নতুন প্রাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটা জীবনাবেগ সৃষ্টি করে ছিলেন। ইতমধ্যে রাজারাম মোহন, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের সমাজ সংস্কার , ধর্মসংস্কারের মধ্যে একটা নতুন চেতনার প্রকাশ লক্ষ্যনীয় তবে নবযুগের মন্ত্র, প্রাণের সাড়া সে মধুসূদনের কাব্যেই সমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছিল।
মধুসূদনই পেরে ছিলেন একটি জাতির গভীর চেতনাকে ধারণ করে মেধার সাথে প্রাণের যোগ ঘটাতে।
ঊনবিংশ শতাব্দি ধরে যে অব্যক্ত বেদনা জাতির মননে, চিত্তে নানামূখী সমস্যা ও সংশয় সৃষ্টি করেছিল, সেই চেতনাই মধুসূদন তাঁর কাব্যে ধারণ করলেন। বিপুল উৎসাহে প্রাচিন কাব্য ধারার, নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করলেন। কারণ বৃটিশদের কাছে ভারতমহাদেশের স্বাধীনতাসূর্য অস্তমিত হলে, বৃটিশরা তাদের নিজস্ব চিন্তা, কর্মকৌশল দ্বারা এদেশ পরিচালিত করতে শুরু করেন। এরফলে প্রাতিষ্ঠানিক ইংরেজি শিক্ষার প্রসার, নগরায়ন, বিজ্ঞান সভ্যতার বিস্তার, বর্হিবিশ্বের সাথে যোগাযোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতির ফলে নতুন-পুরাতন সস্কার, সংযোজনবিয়োজনে জাতীর মননে একটা সংকট তৈরি হয়েছিল। কেউ সহজে পুরাতনকে বর্জন করে নতুনকে মেনে নিতে পারছিল না। যারা নতুনকে গ্রহণ করলো তারা আবার অতিমাত্রায় নিজস্ব বাঙালির মৌলিকত্বকে আঘাত করলো, কেউবা সমন্বয় করার চেষ্টা করলো। যুগবিবর্তনের এমনি সংকট সময়ে খাঁটি হিন্দু বাঙালির ঘরে মধুসূধন জন্মগ্রহণ করেন। হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়ার পূর্বপর্যন্ত পল্লী প্রকৃতিতে সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে বেড়ে উঠা, পল্লী প্রকৃতির ধুলোমাটি, পাখির কলকাকলী, ছায়াঘেরা সবুজ খোলা প্রকৃতি, স্বচ্ছ- মিষ্টিজলের কপতাক্ষ নদীর সান্নিধ্য আর মায়ের অকৃত্রিম ¯েœহে, ব্রাহ্মণ পরিবারের কৃষ্টি কালচারে তার বেড়ে উঠা। তাই শ্রীমধুসূদন ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য আদর্শকে গ্রহণ করলেও, সে প্রভাবকে কাজে লাগিয়েছেন দেশীয় আদর্শের প্রতি অনুগত থেকে।
দেশপ্রেমের অনন্য প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়, ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ এ। বিশেষ করে এই কাব্যের ষষ্ঠ সর্গে মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসা যেমন ব্যক্ত হয়েছে, তেমনি জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতিত্ব ও জাতি সত্তার সংহতির প্রয়োজনীয়তাকে আন্তরিকভাবে তুলে ধরেছেন এবং বিশ্বাসঘাতকতা, দেশদ্রোহিতাকে নীচতা, বর্ববরতা বলে ঘৃণা জানিয়েছেন দৃঢ়চিত্তে।
বাঙালি ও বাঙালি জীবনের প্রতি মমত্ববোধ কাজ করেছে বলেই বাঙালি সংস্কারকে ত্যাগ করতে পারেননি। সীতা চরিত্র নির্মাণে হিন্দু সংস্কার জয়ী হয়েছে। বীরাঙ্গনা প্রমীলাও বাঙালি কুলবধূর ¯িœগ্ধরূপ তাকে উগ্র করে তোলেনি। পাশ্চাত্য মহাকাব্যের আদর্শ অনুযায়ী বীর চরিত্রগুলো দৃঢ়তা লাভ করেনি।
য়ুরোপীয় আদর্শ অর্থাৎ হোমার মিল্টন হতে গিয়ে মধুসুদন সে যুগের বাঙালিচিত্তের প্রতিচ্ছবিকেই প্রকাশ করেছেন। ‘মেঘনাদবদ’ মহাকাব্যের মত বাংলাসাহিত্যে চতুর্দশপদী কবিতা মধুসূদনের অনন্যকীর্তি। এর আঙ্গিক ইংরেজি সাহিত্য থেকে গ্রহণ করেছেন। এখানেও তিনি পের্ত্রাক বা মিল্টনের সনেট লেখার রীতিকে, এককভাবে গ্রহণ করেননি। দুজনের রীতিকে ভেঙে নতুন কাঠামো তৈরি করেছেন। সে কাঠামোর ভিতরের বিষয় ও ভাব চিরন্তন বাঙালির প্রকৃতি ও জীবনসংস্কৃতি। এভাবে তিনি পুরাতনের সাথে নতুনের, প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের সমন্বয় করে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করে অনন্য প্রতিভার সাক্ষর রেখেছিলেন।
বঙ্গ ভাষা
হে বঙ্গ, ভাÐারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে,(অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্র্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!
অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায় মন:,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্য বরি;Ñ
কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষী কয়ে দিলা পরে;-
“ওরে বাছা, মাতৃ-কোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারি-দশা তবে কেন তোর আজি ?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞাসুখে পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।
কপোতাক্ষ নদ
সতত,হে নদ, তুমি মনে পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত(যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্ত্রির ছলনে
বহু দেশে দেখিয়াছি বহ নদ দলে,
কিন্তু এ ¯েœহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ- ¯্রােতরূপী তুমি জন্মভ’মি-স্তনে!
আর কি হবে দেখা?Ñ যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপে কর তুমি; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ-জনের কানে, সখে, সথারীতি
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে।
বঙ্গভ’মির প্রতি
রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাধ
ঘটে যদি পরমাদ,Ñ
মধুহীন করো না গো তব মন:- কোকনদে।
আত্মবিলাপ
আশার ছলনে ভুলি
তাই ভাবি মনে ?
জীবন-প্রবাহ বহি কালসিন্ধুপানে ধায়,
ফিরাব কেমনে?
ভারত – ভূমি
কার শাপে তোর তরে, ওলো অভাগিনী,
চন্দন হইল বিষ; সুধা তিত অতি ?
এছাড়া কাশীরাম দাস, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, নদীতীরে প্রাচীন দ্বাদশ শিব-মন্দির, বিজয়ী দশমী, কবি, ব্রজ বৃত্তান্ত, শ্যামাপক্ষী, সাংকালের তারা, মিত্রাক্ষর, নূতন বৎসর, সৃষ্টিকর্তা, সাগরে তরী, সাংসারিকজ্ঞান ইত্যাদি কবিতায় একজন খাঁটি দেশপ্রেমিকের অভিব্যক্তি, চিন্তা চেতনার অনুরণন।
কবি ইংরেজি সাহিত্যে বড় সাহিত্যিক হতে চেয়েছিলেন এজন্য খ্রিস্টান নারীকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, তাঁর সে আশা পূর্ণ না হওয়ায়, বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। বিশেষ করে কাব্যের মধ্যে কবির যে প্রাণের পরিচয় ফুটে উঠেছে তাতে মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামেই বাঙালির হৃদয় জয় করেছিলেন। তাঁরপ্রতি বাঙালি সমাজের বিন্দু মাত্র শ্রদ্ধা বা ভালবাসার অভাব ছিল না। নির্দ্বিধায় বলা যায় তিনি বাঙালির সন্তান এবং মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার অনন্যপ্রেমিক ছিলেন।
তিনি ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য ফ্রান্সের গিয়েছিলেন। ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে থাকাকালিন অর্থাৎ বিদেশ-বিভ’ঁয়ে থেকে নিজ ভাষা ও স্বদেশের প্রতি বেশী আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন এবং এর মূল্য বুঝেছিলেন। দেশে থাকলে হয়তো সে বিরহ বেদনা এবং নিজ দেশ ও ভাষার প্রতি এতটা আকুলতা প্রকাশ পেত না। তিনি নিজদেশে ফিরতে এবং জন্মভূমিতে তাঁর সমাধি হবে একান্তভাবেই তা চেয়েছিলেন তাইতো তাঁর এপিটাপে লেখা কবিতায় তিনি নিজেকে শ্রীমধুসূদন বলেই পরিচয় দিয়েছিলেন। অকুণ্ঠচিত্তে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছিলেন-
দাঁড়াও পথিকবর জন্ম যদি তব বঙ্গেÑ
… … … … … … … …
মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন।
যশোরে সাগড়দাঁড়ী কপতক্ষ-তীরে
জন্মভ’মী, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।
কবির সমাধি ফলকে নিজের পরিচয় রখে যাওয়ার এই আকুতি ছিল, তাঁকে যেন সবাই বাঙালি বলেই জানে, তিনি এদেশের সন্তান, সে পরিচয় যেন হারিয়ে না যায়। কবির এই বাঙালিয়ানার নিগূঢ় প্রকাশ তাঁর সাহিত্যকর্মে উজ্জ্বল রূপে প্রতীয়মান। সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার যথার্থই বলেছেন যে, পাশ্চাত্য আদর্শ ও পাশ্চাত্য কাব্যকলার অনুকরণে তিনি যে নতুন বাংলাকাব্য সৃষ্টি করেছেন, পরবর্তী বাংলাকাব্যে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কলা-কৌশল ও কল্পনাগৌরব লক্ষ করা গেলেও খাঁটি বাঙালির কাব্য হিসেবে কেউ তাঁকে অতিক্রম করতে পারেনি।
মধুসূদন কত বড় দেশপ্রেমিক ছিলেন কতটা মাতৃভ’মি, মার্তভাষার প্রতি অনুগত ছিলেন। সেটি তাঁর কাব্য রচনার পরতে পরতে প্রকাশ পেয়েছে ।
বাংলার নবজাগরণের কবি বাঙালির জীবনে যে গতিপরিবর্তন ঘটালেন তা কেবল মধুসূদনের বিরল প্রতিভাগুণে সম্ভব হয়ে হয়েছিল।
উপমা এসেছে চিরায়ত বাংলার প্্রকৃতি, পুরান, ইতিহাস, ঐতিহ্য থেকে।
“করি ¯œান সিন্ধুনীরে রক্ষোদল এবে
ফিরিল লঙ্কার পানে, আর্দ্র অশ্রæনীরেÑ
বিসর্জ্জি প্রতিমা যেন দশমী-দিবসে!
সপ্তদিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।” (মেঘনাদবধ কাব্য, নবম সর্গ – প্রমিলার চিতারোহন)
প্রিয়জনকে হারাবার বেদনা, শূন্যতার অনুভ’তি পাঠক-মনে সঞ্চারিত করবার বা জাগিয়ে তুলবার যথার্থ উপমা কবি এখানে দিয়েছেন। বাঙালি মনের প্রাণের সুরকে তিনি আত্মস্ত করেছিলেন, বাঙালির মানস চেতনাকে নীরিক্ষণ করতে পেরেছেন বলেই তাঁর হাতে সেটি সার্থক হয়ে উঠেছে।
এই বাংলার কপতক্ষ তীরে, সাগরদাঁড়ী গ্রামে, পিতা রাজনারায়ন দত্ত, মা জাহ্নবী দেবীর সন্তান শ্রীমধূসুদন দত্ত। তিনি যে এই বাংলার সন্তান, তাই কবির মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা তাঁর সাহিত্যের আদর্শ, প্রেরণা । কবির বাল্যস্মৃতি রসঘণ বর্ণনায় তা উঠে এসেছে,
বাজিছে মন্দিরবৃন্দে প্রভাতীবাজনা
হায় রে, সুমনোহরÑবঙ্গগৃহে যথা
দেবদোলোৎসব-বাদ্য, দেবদল যবে
আবির্ভাবি ভবতলে পূজেন রমেশে!
কবি প্রভাতী বাজনার রূপমাধুরীকে উপলব্ধি করেছেন এই বাংলার প্রতিটি উপকরণ, অনুসঙ্গকে একান্তভাবে অধ্যয়ণ করেছেন বলেই তা এত জীবন্ত ও আবেগময় হয়েছে।
“নাচিছে কদম্বমূলে বাজায়ে মূরলী রে
রাধিকা রমণ,” (ব্রজঙ্গনা কাব্য, বংশী-ধ্বনি অংশ)
কদমতল, বাঁশী ইত্যাদি বাংলার একান্ত অনুসঙ্গ।
উনিশ শতকের শেষ এবং বিশশতকের প্রথম পর্যন্ত বাংলাসাহিত্যে বাঙালিত্বের প্রাণবন্ত প্রকাশ অর্থাৎ জাতির আশা, বিশ্বাস ও আকাক্সক্ষা জাতীয় চেতনায় বাংলাসাহিত্য বিশেষভাবে শক্তিলাভ করেছিল।
ভাষাপ্রীতি – মধুসূধন দেশি-বিদেশি নানাবিধ ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তথাপি বাংলাভাষার প্রতি ভালবাসা ছিল অতুলনীয়, বাংলা সাহিত্যে শ্বব্দ ব্যবহারের নানামাত্রিক নৈপুণ্যতায় সে প্রমান পাওয়া যায়। দেশীয় সাহিত্যসহ তিনি বিশ্বসাহিত্যের রস আস্বাদন করে বাংলাভায়ায়, নিজস্ব ঢঙে, বাংলাসাহিত্যকে নতুন রূপদিয়েছেন। এরফলে তিনি যুগের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। নতুন শব্দ সৃষ্টি করে, কাব্যের লালিত্য,সুষমা, মাধুর্যগুণ বাড়িয়েছিলেন। মহাকাব্যের চরিত্র অনুযায়ী বাংলায় তৈরি করলেন, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, পয়ারের রাজ্যে যা ছিল একেবারেই নতুন। তিনি শুধূ নতুন ছন্দই তৈরি করলেন না। শব্দের ধ্বনিসৌন্দর্য্য ব্যঞ্জনা বাড়াতে নতুন শব্দ ব্যবহারে পুরাতন ব্যকরণ ও অভিধানের নিয়মকেও ভাঙলেন। ছন্দ ও ভাবের সুর ঠিক রাখবার জন্য অতি পরিচিত ও অপরিচিত শব্দকে যুক্ত করেছেন এবং খাঁটি বাংলা শব্দের প্রচলিত অর্থকে বাদ দিয়ে সংস্কৃত অর্থে প্রয়োগ করেছেন। সামান্য একটু আকার, ইকার ইত্যাদি পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা শব্দের নতুন রূপ দান করেছেন। যেমন ‘হৈমবতী পুরী’ ‘অম্বিকার পীঠতলে শারদপার্ব্বণে’, ‘উচ্চ অবরোধে’ ‘কুসুম বিবৃত পথে’ ইত্যাদি। এভাবে ভাবের ওজস্বী অনুযায়ী শব্দ নির্বাচন করে ভাষার সূক্ষতর যাদু গুণ সৃষ্টি করেছেন। তা কেবল মধুসুদনের মত প্রতিভাধর কবির পক্ষেই সম্ভব ছিল। এরফলে বাংলাভাষার গৌরব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
Leave a Reply