শুক্রবার, ০৯ Jun ২০২৩, ০৪:২১ অপরাহ্ন

পাকিস্তান ভ্রমণ-৫ মাহাতাব লিটন

পাকিস্তান ভ্রমণ-৫ মাহাতাব লিটন

পাকিস্তান ভ্রমণ-৫
মাহাতাব লিটন

৭.
অ্যাবাটাবাদকে ভ্যালি সিটি বলিলে মানানসই হইবে। বৈকাল হোটেলে পৌঁছাইলাম আগে হইতে ইহার কক্ষের বরাদ্দের ব্যবস্থা ছিল। না চেক ইন করিবার সময় তাহারা আমাদের সবুজ পাসপোর্ট চাহিল না। মূল সড়কের সাথে সাধারণ একটি হোটেল। দ্বিতীয় তলায় আমার কক্ষটি জুন মাসের তাপদাহটি বায়ুযানের শীতল হাওয়ায় উপেক্ষিত ছিল। কিন্তু যখনই গাড়ি হইতে নামিয়া হোটেলে প্রবেশ করিলাম তাপদাহ স্পর্শ করিল। পরক্ষণেই হোটেলের কক্ষে ঢুকিয়া প্রাণ জুরাইল। পূর্বে বলিয়া ছিলাম এই দেশে সমুদ্র পৃষ্ট হইতে অনেক বেশি উচ্চতার জন্য শরীর হইতে নোনাজল নির্গমন হয়না। তবে ৩০/৩২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় গাত্রদাহ হয়।
এইস্থানে আসিয়া রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রটি নিয়া দেশেকে খুঁজি যদি কোনো সন্ধান মিলে, বৃথা চেষ্টা মাত্র। খানিকবাদে মধ্যাহ্নের খাবারের ডাক পড়িল। নিচে গিয়া আহার গ্রহন করিলাম কিন্তু জিহবায় কোনো স্বাদ খুঁজিয়া পাইলাম না। নিজ গৃহের অনুপস্থিতি টের পাইতে লাগিলাম। তারকা সম্পন্ন হোটেল না হইলেও হোস্টগণ আন্তরিকতার ঘাটতি রাখিলেন না। নানা পদের খাবারের সমারোহ রহিয়াছে। হোটেলের পাশদিয়া চওড়া সড়কে যানবাহন চলিতেছে। বেশকিছু ফার্স্ট ফুডের দোকানও রহিয়াছে।
স্থানীয় বাজারে ইচ্ছা পোষণ করিলেন সকলে। কথামতো গোধূলিবেলায় ভগ্নিদ্বয়ের সহিত বড়সড় কাপড়ের বাজারে গিয়া কাপড়ের দোকানগুলি ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিতে লাগিলাম। আমাকে দেখিয়া অনেক বিক্রেতা জিজ্ঞাসা করিলেন কোথা হইতে আসিয়াছি? অনেকেই ভাবিলেন শ্রীলংকা অনেকই ভাবিলেন মালদ্বীপ অতঃপর কারণ বুঝিতে পারিলাম আমার শরীরের রঙ ইহার কারণ। তাহাদের শরীরের রঙ দুধে আলতা। গড়পড়তা উচ্চতাও সাড়ে পাঁচের উপর হইবে নিশ্চিত।
আমাদের দেখিয়া বিক্রেতাগণ ডাকিতে লাগিলেন। আফগান সীমান্ত প্রদেশ বলিয়া তাহাদের মাঝে অনেক উপজাতি ভাষাভাষী মানুষ রহিয়াছে।
একজন বিক্রেতা যখন শুনিল আমি বাংলাদেশ থাকিয়া আসিয়াছি তিনি অতিরিক্ত খাতির ও সম্মান দেখাইলেন ইহার পিছনে বড় কারণ ছিল বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতামায় অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু অবাক হইলাম বিক্রেতাগণ যখন ডাহা মিথ্যা বলিতেছেন ইন্ডিয়ান শাড়ি কাপড়গুলিকে তাহারা মেইড ইন চায়না বলিতেছেন। বুঝিলাম চায়না বলিয়া সরকারের চোখ ফাঁকি দিতে চাহিতেছেন। নাহ্ আমি কিছু ক্রয় করিলাম না। শুধু মানুষগুলিকে ভালো করিয়া দেখিতেছিলাম তাহাদের পোশাক পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ। ভগ্নিদ্বয়ের ক্রয় শেষে ফিরিয়া আসিলাম একটি কাবাব রেস্তোরাঁয়। মহসড়কের ধারে বেশ কিছু কাবাব ঘর রহিয়াছে। শহরের তরুণরা জাপানি হোন্ডা দ্বি-চক্র যান লইয়া আড্ডা মারিতেছে। মনে হইতেছিল পাকিস্তানি রূপিয়া সহজলভ্য তাহাদের কাছে (সাধারণত সীমান্তবর্তী শহরের তরুণরা ধনী হইয়া থাকে কারণ চোরাচালান), আহার ও তাহাদের কথোপকথনে খোশমেজাজ প্রতিফলিত হইতেছিল।
আমরাতো বহিরাগত ছিলাম, দ্রুত সান্ধ্যকালীন আহার নান রুটি তাহার সহিত শিক কাবাব দিয়া পাকস্থলীর সেবা পরিপূর্ণ করিলাম (সম্ভবত ভেড়ার কাবাব ছিল) তবে মন্দ লাগিল না। দ্রুত স্থান ত্যাগ করিলাম।
পাকিস্তানিরা আহার রসিকও বটে, শুনিয়াছিলাম তাহারা যদি ১০০ রূপি আয় করিলে ১২০ রূপি খাবারে ব্যয় করিয়া থাকে। রেস্তোরাঁ গুলিতে তাহাদের সরব উপস্থিতি আর টেবিলে বাহারি খাবারের ছড়াছড়ি তাহাই প্রমান করিল তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না।
আসিবার পথে দেখিয়াছিলাম কৃষকেরা অতিকষ্টে পাহাড়ের বুকে চাষাবাদ করিতেছিল। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে শুধু পাথর আর পাথর।
মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু হার অনেক বেশি ছিল। তখনও তাহাদের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সম্প্রসারিত টিকা প্রদান কর্মসূচিও বাঁধাগ্রস্থ মৌলবাদিদের কারণে। স্বাস্থ্য কর্মীদেরও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হইয়া প্রাণ হারাইয়াছে। কেহ কেহ চিরকাল মতো পঙ্গু হইয়া জীবনপাত করিতেছেন।
২০১৪ সনে শ্রী লংকায় গিয়া সরকার বাহাদুরের কাছে জানিয়া ছিলাম মৌলবাদি বুদ্ধিষ্ট নেতাদের বাঁধার মুখে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী পদ্ধতিকে আজ অবধি বাস্তবায়ন হয় নাই। যেই দেশে শতভাগ শিক্ষিত সেই দেশে TFR 2.7% (Total Fertility Rates) হাল দেখিয়া চক্ষু কপালে উঠিয়া ছিল। শ্রীলংকার হইতে আমদের বিশাল ঘনবসতি জনসংখ্যার দেশে TFR তাহাদের হইতে অনেক ভালো। এই হইল বড় সমস্যা আমার যাইতে ছিলাম ফরিদাবাদ চলিয়া গেলাম লংকা। অনিচ্ছা ভ্রমণের জন্য দুঃখিত আবার অ্যাবাটাবাদ ফিরিয়া আসিলাম। পাঠক, আগামীকালের গন্তব্য ফরিদাবাদ, মাঠ পরিদর্শনের পরিকল্পনা রহিয়াছে।

৮.
সুপ্রভাত অ্যাবাটাবাদ। রবির নরম আলোতেই নিদ্রার সমাপ্তি ঘটিল। শহরের পূ্র্ব দিকটায় উঁচু উঁচু অলস পাহাড়ের সারি তাহারা বেশ আয়েস করিয়া আমাদিগকে পর্যবেক্ষণ করিয়া থাকেন দিবানিশি।
কখনো তাহা রবির সহিত কখনো বা তাহা শশীর সহিত মিতালী করিয়া চলিতেছে সৃষ্টির শুরু হইতে। অথচ অতি আধুনিকতার সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্তির লক্ষ্যে জলে স্থলে আকাশে অথবা সমরাস্ত্র শক্তি প্রদর্শনের নামে প্রতিক্ষণে নিসর্গ প্রকৃতির গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলিতেছি ইহা যেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার সমান।
প্রাতরাশ শেষে আমাদের দলটি ফরিদাবাদের পাহাড়ি এলাকার উদ্দেশ্যে রওনা হইল।
আমাদের দলে আরও দুইজন যুক্ত হইলেন একজন নারী একজন পুরুষ সাথে নিশান মার্কা একটি ফোর হুইলার। তাহারা দুই জনেই প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ফরিদাবাদের কর্মরত।
আমাদের দেশে এনজিও পুরুষ কর্মীরা যত সহজেই নারীদের ক্ষমতায়নের লাগিয়া সভ্যদের সহিত হরহামেশা সভা করিয়া থাকে ইহা এই পাকিগ্রহে সম্ভব নহে। কৌশল হিসেবে নারীদের লইয়া নারী এনজিওকর্মীরা এবং পুরুষদের সহিত পুরুষকর্মীরা।
সমুদ্র হইতে প্রায় সাড়ে চারহাজার ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের ঢালে মসৃণ সড়ক খাইবার গিরিপথ ধরিয়া চলিবার অভিজ্ঞতা ইহাই প্রথমছিল। সড়কের বাম দিকে তাকাইলে মাথা ঘুরাইয়া যাইতেছিল অপরদিকে পাহাড়ের বুকে সবুজের প্রাণ সারি সারি পাইনগুলি দেখিয়া চক্ষু জুরাইয়া যাইতে ছিল। কিছুদূর যাইবার পর দেখিলাম আফগান শরণার্থীদের শিবির। মনের ইচ্ছা মনেই থাকিল কারণ শরণার্থী শিবিরে যাইবার অনুমতি নাই। শুনিয়াছি প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল পাকিস্তান শরণার্থীদের সহিত নিবিড়ভাবে কাজ করিতেছে। কিছুদূর যাইবার পর চালক যানটিকে বিশ্রাম দিলেন নাকি আমাদের বিশ্রাম দিলেন মনে হইল উভয়কেই।
পাহাড়ি ঝর্ণার যে পথ দিয়া প্রবাহিত হইয়াছে তাহার পাশেই আমাদের যাত্রা বিরতি হইল। ফল, বিস্কুট ও কফি পানের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। একটি গাছের নিচে পাহাড়ের বুকে ছায়াযুক্ত স্থানে রঙিন চাদর বিছানো রহিয়াছে সেইখানে আমরা সবাই বসিয়া গেলাম। শুরুতেই হলুদ রঙের পাকা টসটসে আমের দিকে আমার দৃষ্টি পড়িল। অবাক হইলাম যে
আম কি করিয়া খাইতে হইবে তাহা আমাদিগকে শিখাইতে লাগিলেন। মহাবিপদে পড়িলাম আম ছিলিব নতুবা কাটিব খাইব ইহাতে শিখিবার কি আছে? খানিক বাদে দেখিলাম আমগুলির পেট বরাবর চক্রকারে কাটা হইল এরপর বিচিটা ফেলিয়া দেয়া হইল। এরপর আমাদের একটি করিয়া চামুচ ধরাইয়া দিলেন বলিলেন এইবার আম খাও। জীবনে শুনিনি চামুচ দিয়া আম খায় আজি প্রথম দেখিলাম। মনে হইবে কাপ আইসক্রিম খাইতেছি। আঁশবিহীন আম ভারি সুস্বাদু আম ছিল।
আমার ভগ্নিদ্বয়ের অনুরোধে উটের পাশে দাঁড়াইয়া ছবি তুলিলাম।
তাহারা বলিলেন ছবি তুলুন দেশে ফিরিয়া কন্যাকে দেখািবেন সে ভীষণ খুশী হইবে।
পাঠক,শুধু আপনাকেই চুপিচুপি বলিতেছি ইহার আগে কিন্তু আমি স্বচক্ষে কখনো উট দেখি নাই। বাহ্ উটগুলি বসিয়া বসিয়া জাবর কাটিতেছে। আমরা যে তাঁর আশেপাশে অবস্থান করিতেছি তাহার দিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ করিল না। উটের ব্যক্তিত্ব দেখিয়া ভালোই লাগিল।
আমরা হেলথ ব্রেক শেষ করিয়া পুনরায় আসন স্ব স্ব গ্রহন করিলাম। চালক আমাদের সাথে নিয়া আবারও যাত্রা আরম্ভ করিলেন। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমারা একটি পাহাড়ের গায়ে আসিয়া দাঁড়াইলাম উপরে তাকাইয়া দেখিলাম বেশ কিছু বাড়িঘর রহিয়াছে। সফরসঙ্গীদের অনুসরণ করিয়া পাহাড়ি পথ দিয়া আমরা উপরে উঠিতে লাগিলাম। আঁকাবাঁকা
যেই পথে উঠিতেছিলাম সেই পথ দিয়া পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা করা হইয়াছে, নোংরা ব্যবহৃত পানি নিচের দিকে নামিয়া আসিতেছে। শুনিয়াছিলাম তাহাদের খাবারের পানি আনিতে প্রতিদিন ৪/৫ ঘন্টা সময় ব্যয় হয়। পানির উৎস হইল কোনো পাহাড়ি ঝিল নতুবা ঝর্ণা। গৃহস্থালি পানি নদী হইতে সংগ্রহ করিয়া থাকে। গ্রীষ্মকালে ভীষণ বেগ পাইতে হয়।
আমাদের প্রথমেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণী কক্ষে নিয়ে যাওয়া হইল। শিক্ষিকা শিশু বিকাশে কি কি পদক্ষেপ গ্রহন করিয়াছেন। তাহা জানাইলেন। সত্যি সত্যি শ্রেণী কক্ষটি সাজ সজ্জায় শিশুদের আনন্দদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হইয়াছে। নানা রকম শিশু উপযোগী খেলার মধ্য দিয়া যাহাতে তাহাদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশ ঘটিতে পারে তাহার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হইয়াছে বিদ্যালয়ের ভিতরে ও বাহিরে, প্রচলিত মতবিশ্বাসের বাইরে থাকিয়া বিজ্ঞান সম্মত ভাবে বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হইয়াছে। তাহারা কিভাবে এই সকল কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করিতেছেন, কি ধরণের বাঁধার সম্মুখীন হইতেছেন তাহাই জানিবার তাগিদে হাজার মাইল পারি দিয়া আফগান ও চীনা সীমান্তের সন্নিকটে আসিয়াছি। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকদের সহিত মিথস্ক্রিয়া শেষে অন্য একটি গোষ্ঠীর সহিত ভাব বিনিময় করিলাম। শুনিলাম তাহারা সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে কি কৌশলে কাজ করিতেছে তাহারা কি কি বাঁধার মোকাবিলা করিতেছেন। আজিকের বাড়তি পাওনা ছিল শিশুদের অভিনীত সচেতনতা মূলক “নাটিকা”। শিশুরা লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা বিষয়ে নাটক করিয়া পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আলো দেখাইতেছে ও নাটিকার মাধ্যমে সম্প্রসারিত টিকা দান, ম্যালেরিয়া, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানি পান ও শিশু বিকাশ সংক্রান্ত বার্তা পৌঁছাতেইছে। শিশু হইতে শিশু উন্নয়ন বার্তা ছড়াইয়া পড়িতেছে দূর্গম পাহাড় থেকে পাহাড়ে।
এই পাহাড়ি জনবসতির বাড়িগুলির একটি বৈশিষ্ট্য একজনে বাড়ির ছাদ অপরজনের বাড়ির উঠোন এইভাবে একের পর এক বাড়ি নির্মান হইয়াছে।
সমতল ভূমিতো সোনার হরিণ।
কর্মব্যস্ত দিনকাটাইয়া পড়ন্তবেলায় ফরিদাবাদের প্ল্যানের কার্যালয়ে ফিরিলাম। পরিচিত পর্ব শেষ করিয়া তাহাদের নিজেদের চলমান কর্মকান্ডের বিস্তারিত উপস্থাপন করিলেন। মাঠ পরিদর্শন শেষে আমাদের মতামতও ব্যক্ত করিলাম। সেই সাথে আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা বলিতে কালক্ষেপণ করিলাম না।
অ্যাবাটাবাদ ফিরিবার পূর্বে আমাদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হইল অনেকটা বার-বি-কিউ এর মতো। কার্যালয়ের ভিতরে নিচতলায় প্রবেশমুখে শিক কাবাব তৈরী হইতেছে পাশে গরম গরম পরোটা ভাজা হইতেছে। কাবাব ও তেলে ভাজা গরম পরোটা খাইতে বেশ লাগিতেছিল। যাহারা রন্ধনকারীরা ছিলেন পুরোদস্তুর শিল্পী। আহারের পর দ্রুতই অ্যাবাটাবাদ ফিরিয়া আসিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি দ্রুত বিছানায় যাইতে মন চাহিল না তা আর হইল না সারাদিনে কি কি শিখিলাম বা লার্নিং গুলি কি কি ছিল তাহা তিনজনে অংশগ্রহনমূলক অালোচনা করিয়া লিপিবদ্ধ করিতে হইবে। শেষমেশ দলবদ্ধ কাজ সম্পন্ন করিয়া নিদ্রায় গেলাম। কাল প্রভাতে পাঞ্জাবে ফিরিব মানে ইসলামাবাদ পাকিস্তানের রাজধানীতে। যাহ্ মজার একটি বলিতে বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছি, আমার দুইজন সিনিয়র স্টাফ তাহারা দুই জনেই যে চমৎকার উর্দু বলিতে পারেন তাহা পাকিস্তানি উপদেশকবৃন্দ জানিতেন না। মূলতঃ রাজধানী হইতে তাহারা আসিয়াছিলেন আমাদিগকে গাইড করিবেন এবং দোভাষীর কাজ করিবেন। কিন্তু ঘটনা ঘটিল উল্টো আমার ভগ্নিদ্বয় দুইজনা মিলিয়া পুরো সফরটা জমাইয়া রাখিলেন তাহারা শুরু করিতেন ” আপলোক ইজাজত দিজিয়ে” অনুমতি লইয়া পুরো সময়টা দোভাষী ছাড়াই শেষ করিতেন। বেচারি দুই জন উপদেশক একসময় বলিয়া ফেলিলেন শুধু শুধু আমাদিগকে আসিতে হইল আমাদের সকল কাজ তোমরাই করিতেছ। লিখিতে লিখিতে অনেক হইল এইবার ক্ষান্ত দিলাম।

৯.
গতকালের ফরিদাবাদ মাঠ পরিদর্শন শেষ করিয়া এক রাত্রি অ্যাবাটাবাদ হোটেলে থাকিয়া আজি ইসলামাবাদ ফিরিতিছি, পিছনে রাখিয়া আসিলাম পাহাড়ি জনপদ, আফগান শরণার্থী শিবির। নিসর্গ পাহাড় সবুজে ছেয়ে থাকা সারি সারি পাইন বাতাসে দুলিয়া দুলিয়া যেন আমাদিগকে বিদায় জানাইতেছিল।
চার চক্রযানের চালক অতি সর্তকতার সহিত তাঁর দায়িত্ব পালন করিতে ছিলেন। দূর্গম পাহাড়ি পথে একটুখানি ভুল হইলে কয়েক সহস্র ফুট গভীর খাদে পড়িয়া পটল তুলিতে হইবে। যথারীতি সম্মুখের আসনে বসিয়া রাজ্যের ভয় আসিয়া কাঁধে চাপিল। শীততাপ নিয়ন্ত্রক যানে বসিয়াও মাঝে মাঝে ঘাম ঝরিতেছিল। কাঁচের জানালা দিয়া দেখিতেছিলাম বড় বড় লরীতে করিয়া নতুন নতুন চারচক্র যানের চালান যাইতেছিল। শুনিয়াছি টয়োটা ব্রান্ডের জাপানি গাড়িগুলি পাকিস্তানে অ্যাসেম্বল হইয়া থাকে ইহাও শুনিয়া ছিলাম জেনারেল মোশাররফ জলপাই রঙের পোশাক ছাড়িয়া তারপর পাক রাষ্ট্রেরপতি হইয়া তাহাদের অর্থ্যাৎ জাতির উন্নয়নে নিরলস ভাবে কাজ করিতেছেন। যদিও বা পাহাড়ের মানুষগুলিকে দেখিয়া মনে হইল তাহারা দারিদ্র্য সীমার অনেক নিচে জীবনযাপন করিয়া থাকে।
পাঠক, মার্জনা করিবেন আপনারা যদি কোনো প্রশ্ন করিবার ইচ্ছা পোষণ করেন তাহা হইলে ইহা স্ব স্ব মনের ভিতরেই রাখুন কারণ ইহার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমান দিতে পারিব না কোনো প্রশ্নের উত্তর আমার স্থুল মস্তিষ্কে বোমা ফাটাইলেও বাহির হইবে না। বরং আপনাদের ক্যালোরী নষ্ট হইবে।
মধ্যাহ্নের পূর্বেই উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ হইতে রাজধানীতে ফিরিলাম। সরাসরি সেই হোটেলে সেই একই কক্ষে আবারও চেক ইন। পথে আসিবার কালে কিছু জলযোগ হইয়াছে কিন্তু তাহা মনে করা বা বলিবার মতো নহে। তাঁর মানে হইল আমার পাকস্থলীর ভিতেরর কোষকিটেরা মিছিল করিতেছিল
অন্ন চাই অন্ন চাই বলিয়া চিৎকার করিতেছিল। বাহির হইতে বেশ শুনিতে পারিলাম গুরুম গুরুম শব্দ মনে হইল দুই একটি বোমা ফুটিলো।
খানিকবাদে ভগ্নিদ্বয়ের ডাক পড়িল মধ্যাহ্নের আহার, শুনিয়া গদগদ হইলাম, লবিতে নামিয়া গাড়িতে উঠিলাম এরপর বুঝিলাম সন্ধান মিলিয়াছে ডাক্তার মাহতাব সাহেবের এবং মধ্যাহ্নের আহার হইবে তাহার গৃহে। ডাক্তার আপা শর্ত জুড়িয়া দিয়াছেন ডাল ভাত ছাড়া অন্য কিছু নহে। কুটনৈতিক পাড়ায় তিনি থাকেন। শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করিয়াছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কোনো রকম আততায়ীর হামলা অথবা দূর্ঘটনা ঘটিলে সংবাদ পাইবার মাত্রই পাঁচ মিনিটের মধ্যে কমান্ডো বাহিনী রেসকিউ করিবে।
ইসলামবাদের অভিজাত এরাকায় বাঙ্গালির অস্থায়ী আবাসিকে প্রবেশ করিলাম। এই প্রথমবার গৃহকর্তা ডাক্তার ভাইয়ের সহিত পরিচয় হইল। দেখিয়া বুঝিলাম টুপি পাঞ্জাবি পায়জামা পরিহত মানুষটির পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করিয়া থাকেন। সাচ্চা মুসলমান হওয়াতে পর্দার সহিত আহার পরিবেশন করা হইল। কথা ছিল ডাল ভাত খাইবো গত চারদিন ধরিয়া বাঙালী খাদ্য বাঙ্গালীর পেটের ভিতর প্রবেশ করে নাই কিন্তু খাবারের টেবিলে উন্নত খাবারের ভিড়ে সাধারণ ডাল ভাত অদৃশ্য প্রায়। দুরন্ত খাবারের ঘ্রাণে আমাদিগকে চম্বুকের মত আকর্ষণ করিল খাবারের গ্রহনের লাগি। অদ্ভুত বিষয় হইল চিকেন মাটনে অরুচি ধরিয়া গিয়াছিল যতটুকু আহার গোগ্রাসে গিলিলাম।তাহা ডাল শাক ভাজি আর সাদা ভাত। অতিথি কক্ষটি ছিমছাম ইরানীদের মত করিয়া সাজানো বিশাল ইরানী কার্পেট বিছানো, বড় বড় সাইজের কুশন বালিশ কাঠের আসবাবপত্র নাই বলিলে চলে। আহারের পর নানা কথোপকথন চলিল। ফিরিবার তাড়া আছে বৈকালে রাওয়ালপিন্ডিতে চিকিৎসক ইরফানের গৃহে নিমন্ত্রণ রহিয়াছে। হোটেল হইতে তিনি আমাদিগকে লইয়া যাইবেন। স্বদেশী চিকিৎসক ভ্রাতাকে রাখিয়া হোটেলে ফিরিয়া আসিলাম।
খানিকক্ষণ পরে আবারও যাত্রা এইবার রাওয়ালপিন্ডি। পিন্ডির নাম বহুত শুনিয়াছি কিন্তু স্বচক্ষে দেখা হয় নাই। যাইবার কালে দূর হইতে ফয়সাল মসজিদের সুউচ্চ মিনার দেখিলাম। দেখিলাম জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি- পাকিস্তানের কার্যালয়টি দেখিতে অনেকটা আগারগাঁও আইডিবি ভবনের সাদৃশ্য জাতিসংঘ বাংলাদেশ কার্যালয়টিও ঐ ভবনে অবস্থিত। দশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে মিনিট বিশেক লাগিল। চক্ষু কপালে উঠিল যখন ট্রাফিক জ্যামে পড়িলাম বুঝিলাম না ইহা পুরান ঢাকা না পিন্ডি। দেখিলাম গিজগিজ করছে মানুষ আর গাড়ি। আমাদের গাড়ির জানালায় একটি ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়া ২৫/২৬ বয়সী নারী সাহায্যের জন্য হাত বাড়াইল বারবার সাহায্য চাইল এ যেন ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম। অবশেষে জ্যাম ঠেলিয়া ডাক্তার ইরফানের গৃহে উপস্থিত হইলাম। সুন্দর পরিপাটি গৃহসজ্জা।
পাঠান পরিবারটি আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখিলেন না। চিকিৎসক ইরফানের স্ত্রীর আমাকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন – আরে তোমার নাম শুনিয়া ভাবিয়া ছিলাম “মেহতাব” সেতো নারী কিন্ত এখন দেখিতেছি তুমিতো পুরোটাই একজন পুরুষ। এই কথা শুনিয়া আমরা সব্বাই হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলাম। অাপ্যায়ন শেষে আমাদের হোটেলে ফিরিবার তাড়া কারণ আমাদের উপর সান্ধ্য আইন জারী ইহা নিরাপত্তার অজুহাতে। চিকিৎসক ইরফানের পরামর্শে ইসলামাবাদে ফিরিবার কালে চালকের সহয়তায় আইয়ূব খান ন্যাশনাল পার্কটি ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিলাম। রাত্রি বলিয়া কাল বিলম্ব না করিয়া আমাদের চিকিৎসক আপার কল্যণে এইবার মারগিল পাহাড়ের উদ্দেশ্যে চলিলাম ইহা রাজধানী ইসলামাবাদ যাইবার পথে পড়িবে । রাত্রিরবেলা গাড়িটি ঘুরিয়া ফিরিয়া মারগিলে দর্শনাথীদের স্থানে গিয়া আমরা নামিলাম। কারগিলকে মারগিলের পাহাড়ের শাখা বলিলে কি খুউব একটা ভুল হইবে? যাই হউক মারগিলে বসিয়া পুরো ইসলামাবাদ শহরটি দেখা যাইতেছে হাতের ডান দিকে ফয়সাল মসজিদের আলোক সজ্জা হাতের বাম দিকে রাষ্ট্রপতি ভবনের আলোকসজ্জা। দাবার ছকের মতো খোপ খোপ করে সাজানো রাজধানীটি ইসলামাবাদ। রাওয়ালপিন্ডিতে হইতে ইহার পার্থক্য হইল পিন্ডিতে ঘনবসতি, মানুষের ভীড়ে চলাচল দুঃসাধ্য। ইসলামাবাদে দেখিলাম উল্টো চিত্র হয়তোবা আমরা যেই দিকটায় থাকিলাম বা চলাচল করিলাম সেইখানটি ছিল সুনসান নীরবতা। খানিকক্ষণ বাদে আমরা হোটেলে ফিরিয়া আসিলাম।
কিন্তু মাহমুদার আপার আগ্রহে রাত্রির নয় ঘটিকার দিকে কুটনৈতিকদের আবাসিক এলাকার দিকে রওনা হইলাম। আপাকে নস্টালজিয়ায় পাইয়া বসিয়াছে। শৈশবের অনেকটা সময় তাহার কাটিয়াছে, হোটেল হইতে মিনিট দশেকর মধ্যে পৌঁছানোর পর হইতে তিনি ফেলা আসা স্মৃতিগুলি খুঁজছিলেন। তিনি বলেছিলেন-লিটন দেখেন আমরা এই রাস্তায় স্কেটিং করতাম, ঐ যে দেখছেন সিমেন্টের সিটবেঞ্চ আমরা টেবিল টেনিস খেলতাম একজন চাইনিজ আংকেলের কাছে থেকে। ঐযে দেখছেন বিল্ডিংটা ওইখানে আমরা থাকতাম। চলেন বাসাটা দেখে আসি, রাত্রির বেলা দ্বিধা দ্বন্দ্ব ফেলিয়া দিয়া দুই জনে সেই গৃহে গিয়া উঁকি দিলাম। একজন বেরিয়ে আসতেই তাহার সাথে কথা বলিয়া পুনরায় ফিরিয়া আসিলাম। পথে ফিরিতে আপার কাছ হইতে নানা গল্পের কথা শুনিলাম। কাল সকালেই বায়ুযান ধরিয়া করাচির ধরিব। পাঠক, বুঝিতে পারিতেছেন লম্বাপাঠ মানে কত ধকল গিয়াছে।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge