করোনা দিনের ডাইরি
জসিম মল্লিক
স্মৃতিতে অনিন্দ্য সুন্দর স্টীমার জার্নি
তখন রকেট স্টীমার সার্ভিস ছিল দিনে। আমরা জাহাজ বা রকেটও বলি। কেনো তা জানি না। সকাল এগারোটায় বাদামতলী ঘাট থেকে ছাড়ত সন্ধ্যা ছটায় বরিশাল পৌঁছে যেতো। বরিশাল এক ঘন্টা স্টপ ওভার করে চলে যেতো খুলনা। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন প্রায়ই স্টীমারে বরিশাল যেতাম। দিনে দিনে পৌঁছে যাওয়া যায়। রাতে ঘুমানোর ঝামেলা নাই। টিকিট কাটতাম তৃতীয় শ্রেনীর কিন্তু স্টীমারের দোতলায় প্রথম শ্রেনীর সামনেই যে বিশাল ডেক আছে সেখানে চলে যেতাম। সুন্দর বসার ব্যবস্থা সেখানে। স্টীমারটা সদৱ ঘাট টাচ কৱে বুড়িগঙ্গাৱ বুক চিৱে কেমন ভোঁ দিয়ে ছেড়ে যায়। দুই পারের দৃশ্যাবলী দেখতাম আমি। ছোট ছোট নৌকা কোথা থেকে কোথায় চলে যায়! চাঁদপুরের মোহনায় এলে বিশাল মেঘনা নদীর ঢেউয়ে স্টীমারটা দুলত। মাঝিরা নদীতে জাল ফেলত। রুপালী ইলিশ ঝক ঝক করে উঠত স‚র্যের আলোতে। মাঝিরা ভয় পেতো না। ফার্ষ্ট ক্লাসের রুপসী নারীদের চুল উড়ত বাতাসে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। স্টীমার জার্নি নিয়ে আমার একটি প্রেমের গল্প আছে, নাম জীবন বারে বারে আসে। গল্পটি বিচিত্রার কোনো এক ঈদ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। মাঝে মাঝে আমরা তরুনরা দলে ভারি হয়ে কাঠের ফ্লোরে বসে কোরাস গাইতাম। একবার মলি নামের একটি রুপসী মেয়ের সাথে প্রায় প্রেম হয়ে যেতে নিয়েছিল জার্নিতে..।
দুপুরে দুই টাকা দিয়ে গরুর মাংস আর ডাল দিয়ে ভাত খেতাম। পঞ্চাশ পয়সায় ঘন দুধের চা পাওয়া যেতো। কলা, বিস্কিট, বনরুটি পাওয়া যেতো। আনলিমিটেড ভাত এবং ডাল দিত খাবারের সাথে। ওরকম স্বাদের গরুর মাংস আর কোনোদিন খাইনি। পুরো স্টীমার মাংসের ঘ্রানে ’ম ’ম করত। জীবনে অনেক জার্নি করেছি, পেনের বিজনেস ক্লাস থেকে শুরু করে বুলেট ট্রেনে চড়েছি, ইউরো স্টারে চড়ে ইংলিশ চ্যানেল পারি দিয়ে লন্ডন-প্যারিস গিয়েছি কিন্তু ঢাকা বরিশাল স্টীমার জার্নি পৃথিবীর সেরা।
বিয়ের পরও ফ্যামিলী নিয়ে স্টীমারে যেতাম। আমার বাচ্চারা এবং জেসমিন খুব এনজয় করত। তারপর একদিন হঠাৎ করে স্টীমার সার্ভিস দিনের পরিবর্তে রাতে শিফট হলো। কেনো তা জানিনা। ব্রিটিশ আমল থেকে ঐতিহ্যবাহী দিনের সার্ভিস বদলে রাতে হওয়ায় স্টীমার তার বৈচিত্র্য হারালো। বাষ্পচালিত ইঞ্জিন বদলে হয়ে গেলো ডিজেল চালিত। তারপর একদিন সবচেয়ে বিলাসবহুল গাজী স্টীমার রহস্যজনকভাবে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেলো। শোনা যায় বিআইডবিউটিসি এবং প্রাইভেট লঞ্চ কোম্পানীর লোকজন এর সাথে জড়িত ছিল। এছাড়াও অস্ট্রীচ এবং পিএস মাসুদ সহ কয়েকটি জাহাজ চলে এখনও। আজও স্টীমারে বরিশাল গেলে পুরনো সেই স্মৃতি মনে পড়লে মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে।
টরন্টো ২৬ জুন ২০২০
বুক ভিলা এবং নিমাইর মেমসাহেব
আমার বই পড়ার নেশার পিছনে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরির যেমন অবদান আছে তেমনি বরিশালের বুক ভিলারও অবদান অনেক। বুকভিলা বরিশালের সবচেয়ে বনেদি বইয়ের দোকান। আগেও বুকভিলার কথা লিখেছি। সদর রোড আর বিবির পুকুরের ইন্টারসেকশনেই বুকভিলা অবিস্থিত। যে কেউ একনামে চেনে। যে কেউ চোখ বন্ধ করে যেতে পারে। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক এবং সাহিত্যপ্রেমী সবার গন্তব্য বুক ভিলা। বরিশালের মানুষ প্রচন্ড সাহিত্যপ্রেমী। এই জেলায় অনেক কালজয়ী লেখকের জন্ম হয়েছে। বরিশাল ধান, নদী, খাল বিধৌত এক সৌন্দর্য্যের লীলাভ‚মি। যারাই একবার বরিশাল এসেছেন তারাই বরিশালের প্রেমে পড়েছেন। ব্রিটিশ আমল থেকেই বরিশালে সরকারি লোকজন বদলি হয়ে এলে আর যেতে চাইতেন না। এর সৌন্দর্য্যে আর আতিথেয়তায় বিমোহিত হতেন, আপুত হতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা অন্যান্য জেলার মানুষ যেমন ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, নলচিঠি, ভান্ডারিয়া এমনকি পটুয়াখালির লোকজনও নিজেদের বরিশালের বলে পরিচয় দেন। বিদেশে এসে বরিশাল নামে সংগঠন খোলেন। একসময় এইসব জেলা গ্রেটার বরিশালের অর্ন্তভুক্ত ছিল বলেই এমনটা ঘটছে।
বুকভিলা তিন জেনারেশন ধরে সমানভাবে জনপ্রিয়। বর্তমানে এর তত্বাবধান করেন আমার ছোটবেলার বন্ধু রুপক। পাকিস্তান আমল থেকে রুপকের বাবা তারপর বড় ভাই বুকভিলার দ্বায়িত্ব নেন। শহরের সাহিত্য সংস্কৃতির একটা মিলনকেন্দ্র হচ্ছে বুকভিলা। এখনও আমি বরিশাল গেলে কিছু সময় বুক ভিলায় কাটাই। এটা নিয়মের মধ্যে পড়ে। এই মার্চেও গিয়েছি। বইপত্র দেখি। নতুন মাসুদ রানা নিয়ে আসি। রুপক আর আমি একসাথে ক্লাস টু থেকে পড়েছি। তারপর একই সাথে মাষ্টার্স শেষ করি। বিয়েও করেছি কাছাকাছি সময়। কলেজে উঠে আমি আর রুপক সাহিত্য পাঠ এবং বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব করেছি। এখনও রুপক আমার মেন্টর। যে কোনো দরকারে রুপকের পরামর্শ নেই আমি। আমার চেয়ে রুপকের মাথা পরিষ্কার। আমার চেয়ে বৈষয়িক। বরিশালের মানুষের হৃদয় সমুদ্রের মতো বিশাল। যাকে ভালবাসে তার জন্য সবটুকু করতে পারে। আমাদের বন্ধুত্ব পঞ্চাশ বছরের ও বেশি সময়ের। আমরা সবসময় পরষ্পরের পাশে থেকেছি।
আমার লেখালেখির পিছনে পরোক্ষভাবে বুক ভিলার অবদান রয়েছে। বইয়ের জগতের মধ্যে অন্য এক পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছিলাম আমি। বিকেল হলেই সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম বুক ভিলায়। আড্ডা দিতাম সদর রোডে আর লেখালেখি নিয়ে কথা বলতাম বন্ধুরা। লেখকরা নতুন কে কি লিখেছে সেসব নিয়ে আলোচনা হতো। যখন যে বই পড়তে মন চাইতো বুকভিলা বা লাইব্রেরী থেকে নিয়ে আসতাম। বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করতাম। এখন বুক ভিলায় আমার লেখা বই পাওয়া যায়। ভাবতেও অবাক লাগে! আমার সাহিত্য পাঠ শুরু হয়েছিল নীহাররঞ্জন গুপ্ত, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর, বিমল মিত্র, প্রফুল রায়, শরৎ চন্দ্র আর নিমাই ভট্টাচায্র্ পড়ে। তখন থেকেই আমি গ্রোগ্রাসে বই পড়ি। মফস্বলের শান্ত স্নিগ্ধ জীবনে এইসব লেখকের বই এক স্বপ্নের জগতে নিয়ে যেতো আমাকে। বই পড়ে আমার মনোজগত বদলে গিয়েছিল।
নিমাইর প্রবল জনপ্রিয় উপন্যাস মেমসাহেব ছাড়াও এডিসি, রাজধানী এক্সপ্রেস, গোধ‚লিয়া, ম্যাডাম, ইমন কল্যান, আকাশ ভরা স‚র্যতারা ,শেষ পরানির কড়ি, ম্যারেজ রেজিষ্টার, প্রেয়সী এই সব বই পড়েছি। বাংলাদশের লেখকদের মধ্যে তখন মাত্র আলাউদ্দিন আল আজাদ, আকবর হোসেন, মাহমুদুল হক, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউলাহ, মীর মোশারফ হোসেন, সৈয়দ মুজতবা আলী, আল মাহমুদ প্রমুখের লেখা পড়তে শুরু করেছি। উপন্যাসের প্রতি আমার ঝোঁক বেশি। যাইহোক নিমাইর মতো একজন জনপ্রিয় লেখক হারালো বাংলা সাহিত্য। ফুটপাথ থেকে সহজ ম‚ল্যে কিনে পড়া যেতো অনেক বই..।
টরন্টো ২৭ জুন ২০২০
Leave a Reply