বিশ্বসাহিত্যে মড়ক-মহামারী উপাখ্যান
আনওয়ারুল ইসলাম রাজু
মড়ক-মহামারী মানব সভ্যতার সমান বয়সী। কালে কালে দেশে দেশে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। যা অগণিত মানুষের প্রাণসংহার করেছে, বিপন্ন করে তুলেছে মানব সভ্যতাকে, স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে। কিন্তু কোন কিছুতেই হার মানেনি মানুষ। সকল প্রতিকুলতা ও বৈপরিত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। ফিনিক্স পাখির মত আপনার অস্থি-মজ্জার ভষ্মস্তুপ থেকে আবারও আপন অস্তিত্ব নিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠে জীবনের জয়গান করেছে মানুষ। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াইয়ের (স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স) ইতিকথা ইতিহাসের পাতায় ধারণ করে রাখার পাশাপাশি এ নিয়ে রচিত হয়েছে সাহিত্য। সাহিত্য তো সমাজ ও জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। তাই কালে কালে দেশে দেশে মহামারীর তাণ্ডবে মানব-সমাজ ও সভ্যতায় যে বিপরযয়ের সৃস্টি করেছে তা কবি-সাহিত্যকদেরকেও আলোড়িত করেছে দারুণভাবে। ফলে সাহিত্যেও মহামারীর প্রতিফলন ঘটেছে অনিবারযভাবে।
মড়ক-মহামারী নিয়ে বিশ্বসাহিত্য আসলে অনেক বেশি সমৃদ্ধ বলা যায়। বিশ্বসাহিত্যে মারী-মড়কের আখ্যান বর্ণিত হতে দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব নবম/অষ্টম শতাব্দীতে মহাকবি হোমার রচিত গ্রিক মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ ও খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিক নাট্যকার সোফোক্লেস রচিত “অয়দিপাস রেক্স’(রাজা ইডিপাস) নাটক থেকে শুরু করে সমকাল অবধি বিশ্ব সাহিত্যের বিপুল সম্ভারের ধারাক্রমে।
গ্রীক পুরাণে প্যান্ডোরার কথা বর্ণিত আছে। এক অসামান্য সুন্দরী ও সরলা নারী প্যান্ডোরাকে দেবতারা পৃথিবীতেপাঠালেন হাতে একটা মুখবাঁধা জার দিয়ে। এই জারকেই বলা হয় প্যান্ডেরার বাক্স, যা খুললেই বিপদ। প্রমিথিউস এর ভাই এপিমিথিউসকে নিষেধজ্ঞা সত্বেও প্যান্ডোরার বাক্স খোলার পরে বেরিয়ে এলো মহামারী। এভাবেই পৃথিবীতে মহামারীর শুরু। ট্রয়ের যুদ্ধে সূর্যদেবতা অ্যাপোলো ট্রোজানদের জন্যে প্রথমেই পাঠিয়েছিলেন মহামারীকে।
হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াডে মহামারীর কথা রয়েছে। মহাকবি হোমার তাঁর ইলিয়াড-এর মধ্যেই বলেছেন, স্রষ্টা কোনো বিষয়ে মানুষ ও পৃথিবীর ওপর রুষ্ট হলে পাঠিয়ে দেন মহামারী। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তৌরাতেও মহামারীর কথা আছে।
মহামারী হিসেবে ‘প্লেগ’ পশ্চিমা বিশ্বসহ গোটা দুনিয়কে তছনছ করে দিয়েছিল এক সময়। প্লেগ মধ্যযুগে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক মানুষকে হত্যা করেছিল। চৌদ্দ শতকে প্লেগের আক্রমণে দুনিয়ায় যে পরিমাণ মানুষ মারা গিয়েছিল, সেই মৃত জনসংখ্যা নতুন মানুষ দিয়ে পূরণ হতে সময় লেগেছিল দু-দুটো শতক। মানব ইতিহাসে প্লেগের প্রভাব বুঝতে এ পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত মাঝে মধ্যেই প্লেগের মহামারী ইউরোপকে বিধ্বস্ত করেছে।
স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপে প্লেগের সেই মহামারীর বিনাশী ভূমিকা ইউরোপীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি, জীবনদর্শন এমনকি ধর্মশাস্ত্রকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। সে সময় এবং পরবর্তীকালে ইউরোপীয় শিল্প, সাহিত্যে অহরহ চিত্রিত হয়েছে প্লেগজনিত দুর্দশা, ব্যঙ্গ এমনকি আশাও। সবকিছুর মূলে ছিল মৃত্যু—ঘুরেফিরে নানা চেহারায় এসেছে মৃত্যুর চেহারা। তাই স্বভাবই বিশ্বসাহিত্যে এর প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ্যণীয়।
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে সম্ভবত গ্রিক নাট্যকার সফোক্লেস প্লেগকে প্রথমবারের মতো নাটকে উপজীব্য ব্যবহার করেছিলেন। তার কালজয়ী ট্র্যাজেডি “অয়দিপাস রেক্স’(রাজা ইডিপাস) এর কাহিনীতে ব্যবহার করেছেন প্লেগের অভিশাপ। সফোক্লিসের আগে গ্রিক মহাকাব্য ইলিয়াডে মহামারীর কথা রয়েছে। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তৌরাতেও মহামারীর কথা আছে।
চৌদ্দ শতকের ইতালিয়ান লেখক জিওভানি্ন বোকাচ্চোর গল্পসঙ্কলন ‘ডেকামেরন’ গ্রন্থে ইতালিয়ান শহর ফ্লোরেন্সে দ্য ব্ল্যাক প্লেগ নামক মহামারীর উল্লেখ করা হয়। বোক্কাচ্চিও তার বিখ্যাত ডেকামেরনে প্লেগের বর্ণনা দিয়েছেন দারুণ মুনশিয়ানায়। ১৩৪৮ সালে প্লেগ আঘাত হেনেছিল ইতালির ফ্লোরেন্সে। লাখখানেক ফ্লোরেন্সবাসীর জীবন গিয়েছিল সেবার। তবে প্রমাণ আছে যে ১৩৪৮ সালে বোক্কাচ্চিও ফ্লোরেন্সে ছিলেন না, বরং সে বছর তিনি ছিলেন নেপলসে। তিনি অন্যদের মুখে শুনে সেই বর্ণনা অনুসারে তার বিবরণী লিখেছিলেন। এও সত্য যে বোক্কাচ্চিও প্লেগের আক্রমণ সম্পর্কে ভালোভাবেই জানতেন। কারণ কথিত আছে যে তার বাবা প্লেগেই মারা গিয়েছিলেন।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যখনই ইউরোপে মারি বা মড়কের বিস্তার ঘটেছে, কোয়ারেন্টিনে বন্দী মানুষেরা হাতের কাছে বই পেলে নিজেদের সৌভাগ্যবান ভেবেছে। বই পড়ে সময় কাটিয়েছে। যখন হাতের কাছে বই পাওয়া যায়নি, তখন তারা গল্প বলেছে। জিওভান্নি বোকাচ্চিওর ‘ডেকামেরন’ সেই চৌদ্দ শতকে ‘কালো মৃত্যু’ বা মড়ক থেকে পালিয়ে থাকা সাতজন নারী ও তিনজন পুরুষের দশ দিন ধরে বলতে থাকা গল্পের কথকতা।
মধ্যযুগে ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি জিওফ্রে চসার তার বিখ্যাত ক্যান্টারবারি টেলসেও প্লেগের প্রসঙ্গ এনেছেন। ক্যান্টারবারি টেলসের পারডোনার’স টেলে পাওয়া যায় প্লেগের বিবরণ। সেখানে যে মহামারীর বর্ণনা চসার দিয়েছেন, সেটা সংঘটিত হয়েছিল ১৩৪৮ সালে তৃতীয় এডওয়ার্ডের আমলে।
১৫৯২ সালে রচিত ইংরেজ স্যাটায়ারিস্ট টমাস নাশে (১৫৬৭-১৬০১) তার নাটক ‘সামারস লাস্ট উইল অ্যান্ড টেস্টামেন্টে’ যুক্ত করেছেন প্লেগ মহামারী।
১৬১০ সাল ছিল প্লেগের আক্রমণে ইউরোপের জন্য বিভীষিকাময় একটি বছর। বেন জনসন এবছরই প্লেগকে নিয়ে রচনা করেন তার বিখ্যাত নাটক ‘দি আলকেমিস্টে’।
১৬৬৫-৬৬ সালে লন্ডনে প্লেগের যে আক্রমণ দেখা দিয়েছিল, তা গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন নামে খ্যাত। মাত্র ১৮ মাসে এক লাখ লন্ডনবাসী প্রাণ হারিয়েছিল, যা ছিল সে সময়ের লন্ডনের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। লন্ডনে সে প্লেগের অভিশাপ কেমন ছিল, তার সেরা চিত্রায়ণটি করে গেছেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ড্যানিয়েল ডিফো ‘আ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’ উপন্যাসে। ড্যানিয়েল ডিফোর এ উপন্যাসটিকে প্লেগ নিয়ে বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে গন্য করা হয়।
১৯১২ সালে জ্যাক লন্ডন [১৮৭৬-১৯১৬] রচনা করেন ‘দ্য স্কার্লেট প্লেগ’ উপন্যাস। এটি মূলত আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসে পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপটিক উপন্যাসের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে। উপন্যাসটি রচিত হয়েছিল আমেরিকায় রেড ডেথ মহামারীতে একটি জনপদ উজাড় হওয়ার পরে বেঁচে যাওয়া মানুষের জীবন-আখ্যান নিয়ে। এটি মূলত আমেরিকার সান-ফ্রান্সিসকো এলাকায় ঘটে যাওয়া মহামারীর প্রায় ষাট বছর পরে টিকে যাওয়া মানুষের গল্প।দ্য স্কার্লেট প্লেগ। মুষ্টিমেয় যে ক’জন বেঁচে ছিলেন তাদের মধ্যে জেমস হাওয়ার্ড স্মিত ওরফে গ্রানসার অন্যতম। উপন্যাসে তিনি তার বন্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা নাতির কাছে সেই পরিস্থিতির বর্ণনা করেন—কিভাবে মহামারীতে লোকজন মারা গিয়েছিল। মৃত্যুর প্রতি তখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল। যদিও উপন্যাসটি একশ বছরের বেশি সময় আগে প্রকাশিত হয়েছে; তবু মানবসমাজে বারংবার হানা দেয়া এই অদৃশ্য মহামারী ছড়িয়ে পড়লে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং হতাশার রূপ কেমন হতে পারে তারই অক্ষয় চিত্রায়ণ আছে এতে।
অবশ্য জ্যাক লন্ডনের এই উপন্যাস রচনার প্রায় সত্তর বছর আগে ১৮৪২ সালে অ্যাডগার অ্যালান পো [১৮০৯-১৮৪৯] আমেরিকার রেড ডেথ নিয়ে একটি গল্প লেখেন—যার নাম ‘দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ’।
ইহুদিদের আদি পুস্তক এবং নিউ টেস্টামেন্টে উল্লেখ আছে, বনি ইসরাইলিদের প্রভু কিভাবে শাস্তি দিয়েছিলেন তাদের পাপের ফলে। আর টেস্টামেন্টের দাবি অনুসারে ঈশ্বর অবাধ্যতার জন্য মাঝে মাঝে মানুষকে এ ধরনের শাস্তি দিয়ে থাকেন। ঈশ্বরের আরো অনুগত হওয়া ছাড়া যে শাস্তি থেকে মানুষের রেহাই নেই।
জ্যাক লন্ডনের ‘দ্য স্কার্লেট প্লেগ ’ উপন্যাসেই যে প্রথম এ ধরনের পাপের কথা উল্লেখ আছে তা নয়। প্রাচীনকালের প্রায় সব সাহিত্যেই মহামারীকে মনে করা হতো দৈবনিয়ন্ত্রিত পাপের শাস্তি। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগে গ্রিক সাহিত্যে সফোক্লিস রচিত বিখ্যাত নাটক অয়দিপাস রেক্সে-ও সেই পাপের উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি। রাজার পাপের ফলে একদা সমৃদ্ধশালী থেবেস রাজ্যে নেমে আসে মহাদুর্যোগ। কিন্তু এতে রাজার কোনো হাত ছিল না। গ্রিসের মানুষজন মনে করত, মানুষের ভাগ্যের উপরে তার কোনো হাত নেই; অদৃষ্টে যা লেখা আছে তা হবেই; আর মানুষ অজান্তেই সেই পাপের পথে পা বাড়াবে। তবে তৎকালীন গ্রিসে এমনকি সফোক্লিসের আগেও অনেক লেখক মহামারীকে দৈবের অভিশাপ হিসাবে মেনে নিতেন না।
জ্যাক লন্ডনই প্রথম সাহিত্যে মহামারীর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজেছেন। এমন দুর্যোগকালে সমাজ রাজনীতি অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি তিনি বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া ততদিনে বিজ্ঞানের উন্নতি, পুঁজির বিকাশ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জীব-রাজনৈতিক বিষয়াদি তার পুস্তকে ধরা পড়েছে। জ্যাক লন্ডনের উপন্যাস রচনার দীর্ঘকাল পরেও এখনো এ ধরনের দুর্যোগ একটা প্রতীকী রূপ নিয়ে হাজির থাকে। মহামারীকালে মানুষের অসহায়তা, বিপর্যস্ততা, হতাশা, ভেঙে-পড়ার করুণ পরিণতি আর একই সঙ্গে মানুষের লোভ ও বৈশ্যবৃত্তিরও ঘৃণ্য-প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। একটি লোকালয়ে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার কালে পুরনো ওষুধ কাজ করতে চায় না। মহামারী তার নতুন রূপ নিয়ে হাজির হয়। ভাইরাসগুলো তার চরিত্র পরিবর্তন করে। তখন এর একমাত্র প্রতিকার এই রোগের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, বিচ্ছিন্ন থাকা বা অন্তরীণ থাকা। কিন্তু এর মধ্যেও চলতে থাকে ক্ষমতাকে প্রশ্নাতীত করার জন্য নানারকম অযৌক্তিক অবৈজ্ঞানিক বিষয়াদি, এবং ধর্মের দ্বারাও তা সমর্থিত করার চেষ্টা করা হয়। যেমন রেড ডেথের সময় শাসককুলের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাইবেলে প্রভু বলেছেন, এটি মানুষের পাপের শাস্তি। আর ঈশ্বর যখন শাস্তি দেন তখন কেউ রক্ষা করতে পারে না। ঈশ্বর মানুষকে রোগ দ্বারা ক্ষুধা ও বিপদ দ্বারা পরীক্ষা করে থাকেন। কারণ ঈশ্বর সর্বাবস্থায় মানুষের কাছে আনুগত্য প্রত্যাশা করেন। মানুষ সীমা লঙ্ঘন করলে তিনি কুপিত হন। তবে খ্রিস্টপূর্বকালে ল্যাটিন কবি লুক্রেটিয়াস [খ্রি.পূ ৯৯-৫৫] তার লেখায় উল্লেখ করেছেন প্লেগ ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে টানাপড়েনের ফল নয়; বরং মানুষ যখন সামজিক দায়বদ্ধতা হারিয়ে ফেলে এবং স্বার্থপরতা বৃদ্ধি পায় তখনই এ ধরনের আঘাত নেমে আসে।
প্লেগের মতো মহামারীর উদ্ভব, ভয়াবহতা ও নিরসনের সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক সংকট উত্তরণে জ্যাক লন্ডনের ‘দ্য স্কার্লেট প্লেগ ’সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রচনা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। কারণ তিনি বিশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত এ সংক্রান্ত বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আবিষ্কারগুলোও তার রচনায় ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।
১৯৩০ সালের দিকে মিলান শহরে যে ব্যাপকভাবে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে; ইতালীয় ঔপনাসিক আলেসান্দ্র মানজানি-র [১৭৮৫-১৮৭৫] বইতে তার ভয়াবহ বর্ণনা রয়েছে।
‘দ্য প্লেগ’ মহামারীতে আক্রান্ত একটি শহরে অবরুদ্ধ মানুষের দুঃসহ সময়কে উপজীব্য করে লেখা আলবেয়ার কামুর একটি বিখ্যাত উপন্যাস। ১৯৪৫ সালে ফরাসি দার্শনিক, লেখক ও সাংবাদিক সাহিত্যে দ্বিতীয় কনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী আলবেয়ার ক্যামু [১৯১৩-১৯৬০] রচিত কালজয়ী ধ্রুপদী এ উপন্যাসে করোনাকালের মতো প্লেগ মহামারী কবলিত ‘ওরাও’ নামক এক শহরের গল্প বলা হয়েছে। ফ্রান্সের তৎকালীন উপনিবেশ আলজেরিয়ার এক আধুনিক শহর ওরাও।
এই শহরে ইঁদুরের উপদ্রব হতে জন্ম নেয় প্লেগ মহামারী। শহরে হঠাৎ একদিন দেখা গেল ইঁদুরের মড়ক লেগেছে। হাজার হাজার ইঁদুর শহরের ড্রেন, নালা, গলিঘুপচি থেকে মরার জন্য বেরিয়ে আসতে থাকে। ফিনকি দিয়ে রক্ত তুলে মৃত ইঁদুরগুলো ভরিয়ে তুলে শহরের রাস্তাঘাট, হোটেল, অ্যাপার্টমেন্টসহ সব জায়গা। একসময় ইঁদুরের মৃত্যু থেমে যেতে থাকে আর মৃত্যু শুরু হয় মানুষের। প্রচন্ড জ্বর, শরীরে ছোপছোপ কালো দাগ নিয়ে একে একে মরতে থাকে মানুষ। একের পর এক সংক্রমিত হয়ে মানুষ আক্রান্ত হতে থাকে হাজারে হাজারে। ওরাও–এর সর্বত্র বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে থাকে মৃত্যুসংবাদ। শহরের ডাক্তার বার্নার্ড রিউ কর্র্তৃপক্ষকে তাগাদা দেন জরুরি পদক্ষেপ নিতে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগা শহর কর্তৃপক্ষ একটা পর্যায়ে বাধ্য হয়, পরিস্থিতিকে প্লেগ হিসেবে ঘোষণা দিতে। লকডাউন হয়ে পড়ে পুরো শহর।
উপন্যাস মূলত শুরু হয় এই অংশ থেকেই। একটা লকডাউন শহরে মানুষগুলোর জীবনাচার কীভাবে বদলে যায় তা কামু নির্জীব কণ্ঠে বয়ান করে যান। অনেকটা একঘেয়ে সুরেই কামু লিখে যান নিদারুণ একঘেয়ে জেলখানার মতো পরিস্থিতি, যে পরিস্থিতিতে অন্য শহরের সাংবাদিকর্ যাবেঁ আটকা পড়ে যায় ওরানে, প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদের বেদনা মানুষকে ভোগায়, এমন এক সময়ে যখন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ থাকে না। নতুন পরিস্থিতি নতুন শব্দ তৈরি করে, পত্রপত্রিকা দুষতে থাকে কর্তৃপক্ষকে।
ওরাও শহরের মানুষ স্বপ্ন দেখে, ভাবে কিছুদিন পর হয়তো এই দুঃখ-দুর্দশার দিন ফুরিয়ে যাবে, লকডাউন শিথিল হবে, আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু ডাক্তার রিউ ভাবেন, এই পরিস্থিতিই হয়তো নতুন ধরনের স্বাভাবিকতা। তিনি বরং মেনে নেন, এই নতুন স্বাভাবিকতাকে এবং আগের মতোই চালিয়ে যেতে থাকেন তার ডাক্তারি সেবা। গাড়ি চালিয়ে শহরের অন্য প্রান্তে আইসোলেশনে থাকা রোগী দেখতে যান। তিনি জানেন, এই অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবিলা করা তার পক্ষে কেন কারও পক্ষেই সম্ভব না। যা করা যায়, তা হলো নিজের মতো করে কাজ করে যাওয়া। ডাক্তার রিউয়ের কাছে এইটাই লড়াই। প্লেগ কখন নিজেই নিজেকে গুটিয়ে নেবে সেই আশা করা ছাড়া, এখানে জয়ের কোনো আশা থাকেনা। এই পেসিমিজম অটুট রেখেই উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে।
কাম্যু ‘দ্য প্লেগ’-এ লকডাউনে অবরুদ্ধ ওরাও শহরের চার দেয়ালের ভেতর ঘটা আখ্যান শোনান। এ উপন্যাসে মহামারী উঠে এসেছে মহাকাব্যিকভাবে। মৃত্যুর মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়ে সূচিত ‘দ্য প্লেগ’ আজও সাহিত্যে কিংবদন্তী হয়ে আছে।বিশেষ করে পৃথিবীতে যখন মহামারী নেমে আসে, তখন এই বিপর্যয়ের সামাজিক দার্শনিক ও রাজনৈতিক চরিত্র নিরূপণে এই বইটির প্রাসঙ্গিকতা পাঠককে মুগ্ধ করে থাকে। ক্যামুর উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য কেবল জীবন ও জীবিত মানুষের সমাজ কাঠামোর সংঘাত নয়। তার উপন্যাসে অস্তিত্ববাদী দর্শনের আলোকে মৃত্যু জীবনবোধের নতুন মাত্রা তৈরি করে। লা পেস্ত বা দ্য প্লেগ উপন্যাসেও এই মহামারীর কেবল মৃত্যুর প্রতিনিধিত্ব করে নি; বরং প্লেগকে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করেছেন। এজন্য, কামুর ‘দ্য প্লেগ’কে রূপক উপন্যাস হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। প্লেগ মহামারীর রূপকে রচিত এই উপন্যাসে ফ্যাসিবাদের ভয়াল বিস্তারের কথা বলতে চেয়েছেন বলে অনেকেই মনে করেন। স্মর্তব্য, এই উপন্যাস লেখার সময়ে, সদ্য পার করে আসা ফ্যাসিজমের রক্তাক্ত পরিণতি কামুর স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। তাই এই প্লেগনামী অদৃশ্য শত্রু, আরেক অর্থে ফ্যাসিজমের মেটাফর।
আলবেয়ার ক্যামুর দ্য প্লেগের সঙ্গে বর্তমান সময়ে চলমান বৈশ্বিক মহামারী করোনা পরিস্থিতির এক আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে। এ কারণে এই করোনাকালে ঘরবন্দি মানুষ আবার সেই উপন্যাস পড়তে শুরু করেছে। কামুর উপন্যাস দ্য প্লেগ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপর। ৭৩ বছর পর নতুন করে পাঠ করা হচ্ছে দ্য প্লেগ; ঘরবন্দি মানুষ তোড়জোড় করে কিনতে শুরু করেছে বইটি। করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে কয়েক হাজার কপি করে বিক্রি হচ্ছে বইটি। ফলে এর প্রকাশনা সংস্থা ‘ পেঙ্গুইন ক্লাসিকস’কে বইটি কয়েক দফা পুনর্মুদ্রণ করতে হয়েছে।
১৯৬১ সালে ‘দ্য সেভেন প্লেগ ’ নামে জেমস রলিন্স এর একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। যার মূল প্রতিপাদ্য ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত মোসেজের টেনথ কামানডমেন্টে সেই প্লেগ কি সত্যিই ঘটেছিল। নানা ঐতিহাসিক তথ্যকে আশ্রয় করে ৫৪ কল্পনার ডানা বিস্তার করেছেন লেখক।
১৯৬৭ সালে নোবেলজয়ী স্পানিশ সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ রচিত ‘লাভ ইন দ্য টাইম অভ কলেরা’ উপন্যাসে কলেরা মহামারীর চিত্র তুলে ধরেন।
১৯৯৮ সালে নোবলজয়ী পর্তুগিজ সাহিত্যিক হোসে সারামাগো (১৯২২-২০১০) রচিত ‘ব্লাইন্ডনেস ’ উপন্যাসটি মহামারী কালের চরিত্র বোঝার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে লেখক উপন্যাসের কাহিনি ও আঙ্গিকে কিছুটা ভিন্নতা এনেছেন। নাম উল্লেখ করা হয় নি এমন এক শহরে এক অজ্ঞাত কারণে লোকজনের মধ্যে দ্রুত অন্ধত্বের মতো রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লেখক এটাকে শ্বেত-অন্ধত্ব বলে অভিহিত করেছেন। এই উপন্যাসটি মূলত সেই দুর্ভাগাদের কাহিনি নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, যারা এই মহামারীর শুরুতেই আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে আছেন একজন ডাক্তার—যিনি নিজেও অন্ধত্বে আক্রান্ত হয়েছেন।
মহামারী নিয়ে বিশ্বসাহিত্যে সাড়া জাগানো ও ব্যাপক কৌতূহল উদ্দীপক ভবিষ্যকল্পবৈজ্ঞানিক উপন্যাস মেরি শেলি রচিত ‘দ্য লাস্টম্যান”। এর লেখিকা মেরি শেলি মহামারীর বিভিষিকা ভবিষ্যৎ মানবসভ্যতাকে কিরূপ বিপর্যয়ের অতল গহ্বরে ঠেলে দিতে পারে তারই ভবিষ্যকল্পরূপ তুলে ধরে ১৮২৬ সালে দ্য লাস্ট ম্যান' (‘অন্তিম মানব)’- উপন্যাস রচনা করেন। উপন্যাসটি একুশ শতকের প্রেক্ষাপটে লেখা মহাধ্বংসেও বেঁচে যাওয়া একদল ছিন্নবস্ত্র মানুষের মাঝে গড়ে ওঠা গল্প, কিন্তু বহুধা বিচিত্র। মানব ইতিহাসে এটিই প্রথম উপন্যাস, যেখানে গোটা বিশ্বজুড়ে একটি মড়কের প্রেক্ষিতে মানব প্রজাতির ধ্বংসের কথা কল্পনা করা হয়েছে। মেরি শেলি এই উপন্যাসটি লিখেছেন উনত্রিশ বছর বয়সে, যখন তাঁর প্রায় প্রত্যেক প্রিয়জনের মৃত্যু হয়েছে আর তিনি সেই ব্যক্তিগত ক্ষতিকেই এভাবে সাজাচ্ছেন, ‘এক প্রিয় জাতির শেষ ধ্বংসাবশেষ, আমার সঙ্গীরা, আমার আগেই সবাই বিলুপ্ত হলো।’ এই বইয়ের কথক একজন দরিদ্র ও অশিক্ষিত ইংরেজ মেষপালক: আদিম মানব, সহিংস ও আইনকানুনহীন, এমনকি বলতে গেলে দানবীয় প্রকৃতির। এক ধনী বিদ্বজনের হাতে মানুষ হয় এবং কিছুটা লেখাপড়াও শেখে— ‘জ্ঞানের জন্য এক আন্তরিক ভালবাসা...আমাকে এই দিন ও রাতগুলো পড়ালেখায় কাটাতে সাহার্য করছে।’ ধীরে ধীরে প্রজ্ঞার পথে তার উত্তরণ ঘটে এবং সে হয়ে ওঠে এক পণ্ডিত, স্বাধীনতার এক রক্ষক, একজন রিপাবলিকান ও মহাবিশ্বের নাগরিক। এরপর, ২০৯২ সালে, মড়ক আসে। প্রথমে ধ্বংস করে কনস্টান্টিনোপল। বছরের পর বছর ধরে প্রতি শীতে মড়ক কেটে যায় (শীতই যেন ‘এক যোদ্ধা ও অপরাজেয় ডাক্তার’) এবং প্রতি বসন্তে সে আবার দেখা দেয়, আরও তীব্র ও সর্বব্যাপ্ত চেহারায়। এই মড়ক অতিক্রম করে পাহাড়, পরিব্যাপ্ত হয় মহাসাগর পেরিয়ে। সূর্য ওঠে, কালো সেই সূর্য: এক অমঙ্গল চিহ্ন। ‘এশিয়া জুড়ে, নীল নদ থেকে কাস্পিয়ান সাগরের তীর হয়ে, হেল্লেসপন্ট থেকে এমনকি ওমান সাগর হয়ে, এক সহসা আতঙ্ক যেন সবাইকে তাড়িয়ে বেড়ায়,’ মেরি শেলি লিখেছেন। ‘পুরুষেরা মসজিদে ভিড় করে; নারীরা, বোরখাবৃতা, সমাধিসৌধে ছোটে এবং মৃতদের জন্য নৈবেদ্য দেয়, যেন এভাবেই তারা যা কিছু আজও জীবন্ত, সেসব বাঁচাবে।’ এই মড়কের প্রকৃতি কিন্তু থাকে খুবই রহস্যজনক। ‘একে সবাই মহামারি বলছিল। তবে বড় প্রশ্নটি হলো, কেউই নিশ্চিত ছিল না যে কীভাবে এই মারির বীজাণু ছড়াল এবং ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল।’ শুরুতে এই মড়ক কতটা ভয়ানক হবে, সেটা বুঝতে না পেরে এবং ভুল আত্মবিশ্বাসে, আইনপ্রণেতারা কাজ শুরু করতেই অনেক দেরি করে ফেলেন বা দ্বিধাগ্রস্থ থাকেন। ‘ইংল্যান্ড তখনো নিরাপদ ছিল। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও স্পেন তত দিনে সংক্রমিত হয়ে পড়ছে, আমাদের ও মড়কের ভেতর তখনই কোনো লঙ্ঘন ছাড়াই দেয়াল তোলা হয়েছিল।’ এরপর আসে পৃথিবীর নানা জাতির প্রতিবেদন, যারা মড়কে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও জনশূন্য হয়ে পড়ছে। ‘আমেরিকার বিশাল নগরীগুলো, ভারতবর্ষের উর্বরা সমতলভূমি, চীনের ঘনবসতিপূর্ণ যত বাসস্থান, সবই ধ্বংসের পথে চালিত।’ ‘দ্য লাস্ট ম্যান’-এ সভ্যতার বিপন্নতার কথা কল্পনা করা হয়েছে। মৃত্যুর পর মৃত্যু, দেশের পর দেশ ধরে মানব প্রজাতি মইয়ের একটি একটি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেছে আর তারপর আবার উঠেছে। শেলীর এই উপন্যাসের বয়ানকারী এক মেষপালক, মানবসভ্যতার যাবতীয় ‘অলঙ্করণ’, যা কিনা মানবতাকে আবরণে-আভরণে সুসজ্জিত করে, তার নিজের নগ্ন সত্তাকেই আবৃত করে—সেই যাবতীয় অলংকারের ধ্বংস ও বিসর্জনের সাক্ষী হয়ে উঠেছেন। এই অলংকারগুলো হলো আইন, ধর্ম, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, উদারনৈতিক সরকার, স্বাধীনতা, বাণিজ্য, সাহিত্য, সংগীত, নাটক, শিল্প, পরিবহন ব্যবস্থা, যোগাযোগ, কৃষি। ধীরে ধীরে এই ভয়ানক মহামারি যখন সবকিছুই নষ্ট করে দিল, তখন হাতে গোনা যে অল্প কিছু মানুষ বেঁচে গেল, তারাও যেন নিজেদের ভেতর যুদ্ধমান কয়েকটি গোষ্ঠীতে পরিণত হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন মাত্র মানুষ বা আমাদের কথক তথা সেই মেষপালক টিকে রইল। রোমের নানা ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এই মেষপালক এক লেখকের ঘরে ঢোকে এবং সেই লেখকের টেবিলে দেখতে পায় একটি পাণ্ডুলিপি: ‘এটি ইতালীয় ভাষার ওপর একটি বিদগ্ধ অভিসন্দর্ভ।’ এভাবেই পৃথিবীর টিকে যাওয়া শেষ বইটি হচ্ছে ভাষার অধ্যয়নবিষয়ক, মানবতার প্রথম অলংকরণ। আর আমাদের এই কাহিনির কথক শেষ মুহূর্তে পৃথিবীর একাকী মাত্র মানব হিসেবে কী করেন? ‘আমিও একটি বই লিখব, আমি কেঁদে উঠে বললাম, কার পড়ার জন্য বই লিখব?’ এটাকে কথক বলছে ‘শেষ মানবের ইতিহাস,’ এবং বইটি উদ্দেশ করছে সব মৃত মানুষকে। এই বইয়ের কোনো পাঠক থাকবে না। অবশ্যই মেরি শেলির পাঠকেরা তো পড়বেনই। ইতিহাসের ভয়ানক বাঁক মেরির উপন্যাসের পাতায় স্থান পায়, যেমন পায় ডেকামেরনেও, ‘আমরা ১৩৪৮ সালে মড়কের কথা মাথায় রাখতে বলেছিলাম, যখন গণনা করা হয়েছিল যে গোটা মানব প্রজাতির এক-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়েছিল। যেহেতু তখনো পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ সংক্রমিত হয়নি, তবে এমনটা কি আজীবন থাকবে?’ না, এমনটা তো সব সময় রইবে না। অনিবার্যভাবেই শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডেও মড়ক আসে। তবে ততক্ষণে স্বাস্থ্যবানদের আর কোথাও পালানোর জায়গা নেই। কারণ, মহামারির শেষ বিভীষিকার দিনগুলোতে ‘পৃথিবীর কোথাও আর কোনো আশ্রয় নেই।’ গোটা পৃথিবীরই যে নিদারুণ মারি হয়েছে! মড়কের সাহিত্য সব সময়ই কষ্টকর। মহামারি যেন মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের মতো দুরূহ কোনো বিষয়। মানুষকে তার উচ্চতর ভাবপৃথিবী ও মানবতার উত্তুঙ্গ সব শিখরাদেশ থেকে নামিয়ে এনে তার ভেতরের পাশববৃত্তিকেই যেন প্রকটিত করে দেখায় মড়কের সময়। মেরি শেলি যেমন ১৮২৬ সালে তাঁর
দ্য লাস্ট ম্যান’ (‘অন্তিম মানব)’-এ লিখেছেন, ‘মানুষের দানবীয় সব ক্ষমতাকে বিদায়,’ মড়কে বিধ্বস্ত এক সময়ের পর তিনি লেখেন, ‘শিল্পকে বিদায়, বিদায় বাগ্মিতাকেও।’ মারি বা মড়কের প্রতিটি গল্পই নিরক্ষরতার গল্প। ভাষা যখন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, মানুষ হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর। তবে তারপরও বইয়ের অস্তিত্ব নিজেই যেন মানবতার সহনক্ষমতার এক চিহ্ন, যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন এক আখ্যানপর্ব, পাঠের সংক্রমণই আমাদের টিকিয়ে রাখে। পাঠই হতে পারে এক সংক্রমণ, লেখকের মনন যেন চুঁইয়ে পড়া ধারার মত পাঠকের হৃদয় ভিজিয়ে দেয়। মড়কের সময় পাঠই প্রমাণিত হতে পারে এক শক্তিশালী ও প্রমাণিত প্রতিষেধক হিসেবে, যা অপরাজেয় ও সূক্ষ্ম।
১৯৮১ সালে DEAN R KOONTZ ‘দি আ্ইজ অব ডার্কনেস’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য এই যে, ৪০ বছর আগে লেখা এ উপন্যাসে করোনা ভাইরাসের মতই ‘ইউহান-৪০০’ নামে এক ভাইরাসের কথা উল্রেখ করা হয়েছে। উপন্যাসে বর্ণিত ভাইরাস জৈব অস্ত্র হিসেবে গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছিল। লে চেন নামে একজন বিজ্ঞানী চীন থেকে পালিয়ে আমেরিকায় যান। তিনি সঙ্গে নিয়ে যান একটি ডিস্ক, যাতে রয়েছে চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বিপজ্জনক নতুন জৈব অস্ত্র‘ইউহান-৪০০”।
উপন্যাসে আরও বলা হয়, ঐ ভাইরাস তারা অস্ত্র হিসেবে গবেষনাগারে তৈরি করেছিল। কিন্তু কোনওভাবে তা ‘লিক’ হয়েই মহাবিপত্তি সৃষ্টি হয়েছিল। ডারেন্থমাউথ নামে একজন টুইটার ব্যবহারকারী তার এক টুইটবার্তায় এই উপন্যাসটির কথা এবং এর প্রচ্ছদ ও সংশ্রিট পৃষ্টার ছবি প্রকাশ করলে বিশ্বব্যাপি সমারোচনার ঝড় ওঠে। এই উপন্যাসটির রেফারেন্স টেনে চলমান করোনা ‘ভাইরাস’ সঙ্কট চীনেরই কারসাজি বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
যাহোক, মহামারী নিয়ে বিশ্বসাহিত্য সম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছেন আরও অনেক লেখক। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রন্থ ও লেখকের নাম হচ্ছে- চেরি : নিকো ওয়াকার, পেইন কিলার : মেরি মেয়েবার, সুপারবাগস : ম্যাট ম্যাকক্যাথি, দ্য লাস্ট ওয়ান : এমিলি মেন্ট জন মেন্ডেল, দ্য এয়ার অব দ্য বুক: মার্গারেট এটউড, জোন ওয়ান : কোলোসন উইথহেড, দ্য স্ট্যান্ড : স্টেফেন কিং, র্যাবিড : বিল ওয়াসিক অ্যান্ড মনিকা মারফি, দ্য গ্রেট ইনফ্লুয়েঞ্জা : জন এম ব্যারি, দ্য ঘোস্ট ম্যাপ : স্টেফেন জনসন, ভাইরাস হান্টার : সি জেপিটার্স মার্ক ওলসাকার, ক্ল্যার্ক হোল: চার্লেস বার্ন, পক্স : মিকায়েল উইলবিচ, দ্য আমেরিকান প্লেগ : মলি কাল্ডওয়েল ক্রসবি, দ্য কামিং প্লেগ : লুরিয়ে গ্যারেট, দ্য রেমেডি : থমাস গোয়েটজ, দ্য ডেমন ইন দ্য ফ্রিজার ইমার্জি এপিডেমিক : মেডিলিন ডেক্সলার, দ্য স্টেইন ভলিউম : ডেভিড লাকাম, নেমেসিস : ফিলিপ রথ, ওয়াল্ড ওয়ার জেড : মাক্স ব্রুকস, ইয়ার অব ওয়ান্ডার্স : জেরান্ডিন ব্রুকস, দ্য হট জোন : রিচার্ড পেইসইন, সেভারেনস : লিং মা, দ্য ড্রিমারস : ক্যারেন থমাস, দ্য ক্যাম লাইক সোয়ালোস : উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েল, দ্য ইয়ার অব দ্য ফ্লাড : মার্গরেট এডউড, পেলে হর্স পেলে রাইডার : ক্যাথেরিন এনিপটার, দ্য ডগ স্টার : পিটার হলার, ওয়াইন্ডার গার্লস : ররি পাউয়ার, দ্য লাস্ট টাউন অব দ্য আর্থ : থমাস মুলার।
চলমান করোনা মহামারী কালে বিশ্বজুড়ে মহামারী নিয়ে রচিত উপন্যাসগুলো আবার নতুন করে পঠিত ও আলোচিত হচ্ছে।
Leave a Reply