খুমের রাজ্যে একদিন
মুহিউদ্দীন আল মামুন
ডিজিটাল যুগে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়, কথাটি এখনো ৯৯% সত্য। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কিছু কিছু জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক এখনো পৌছেনি। এক অর্থে সেটা কিন্তু খারাপ নয় । বলছিলাম বাংলাদেশের বান্দরবন জেলার থানচি উপজেলার খুমের রাজ্যের এক খুম- নাফাখুমের কথা। এখানে কোন কোমপানির মোবাইল নেটওয়ার্কই কাজ করেনা। এক প্রকার দূর্গম পাহাড়ী এলাকা।
সকলের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ২/৪ দিন একা একা থাকতে চাইলে আর পাহাড়ের সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে চাইলে চলুন যাই- থানচি উপজেলার রেমাক্রী । একই সাথে দুটো ফলস দেখা হবে। রেমাক্রী ফলস আর নাফাখুম ফলস । সময় বেশি নিয়ে গেলে, অমিয়খুম, সাত ভাই খুম, দেবতা খুম, আলি কদম – সব দর্শনীয় জায়গা গুলোয় ঢু মারতে পারেন।
যা হোক, অনেক চড়াই-উৎরাই শেষে ৩ দিনের ছুটি সামনে রেখে আমরা ৮ জন ঢাকা থেকে রওনা হলাম একটা গাইডকে সাথে নিয়ে। সকাল ৬ টার মধ্যে বান্দরবন শহরে পৌছে হোটেলে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিলাম। তারপর চাঁন্দের গাড়ীতে সোজা থানচির উদ্দেশ্যে রওনা। পথে ২ জায়গায় নাম রেজিস্ট্রি করার বিধানটি সকল পর্যটকের জন্য আইন শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অবশ্য পালনীয় বিধান। আমরা দুপুর ১.৩০ টা নাগাদ থানচি বাজারে পৌঁছলাম । এখানেও আবার পুলিশ এবং বিজিবির খাতায় নাম লেখালাম, গ্রুপ ফটো তুলে রাখলো পুলিশ ভাইয়েরা। দুপুরে খেলাম বাজারের একটি হোটেলে। দারুন খাবার এবং পরিবেশটা পরিচ্ছন্ন।
খাওয়া শেষে ২ দিনের প্রোয়জনীয় বাজার করে লোকাল গাইড সাথে নিয়ে বিকাল ৪ টা নাগাদ নৌকায় ৩ ঘন্টার যাত্রা শুরু করলাম রেমাক্রীর উদ্দেশ্যে । বেশ শীত শীত লাগছে সাংগু নদীর উপরের বাতাস । দুই পাশে কখনো কখনো ৫০/৬০ ফুট উঁচু উঁচু পাহাড় আবার কিছুটা সমতল । মাঝে মাঝে লোকালয় চোখে পড়লো। থানচি বাজারে থাকতেই পরিবারের সবার সাথে ২ দিনের জন্য কথা বলে নিলাম। কারণ কিছুক্ষন পর আমরা অন্য জগতে চলে যাব, যেখানে ফোনে কোন রিংটোন বাজবেনা। যতদিন থাকি ঠিক ততদিন। অবশ্য রেমাক্রী বাজারের সাথে বিজিবির ফাড়ী, ওটা একটা আশার জায়গা । আমার চাচা তখন বিজিবিতে চাকরি করতেন এবং এক সময়ে ওনার এই এলাকায় পোস্টিং ছিলো। সেই সুবাদে অনেক কারবারি এবং গাইড চাচাকে চিনতো। চাচার পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথে আমাদের লোকাল গাইড চিনেছে এবং চাচা ফোনে ওঁকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিলেন।
আমাদের পাহাড়ী লম্বা নৌকা সাংগু নদীর বুকের উপর দিয়ে চলছে স্বগৌরবে, গন্তব্য আমাদের অচেনা রেমাক্রী। পথে পথে নদীর মাঝে বেশ বড় বড় পাথর দেখলাম। এক জায়গায় পাথরের সাথে আলাপ না করে আপনি যেতেই পারবেন না। নাম তার “রাজা” পাথর এবং “রাণী” পাথর। দেখলাম ওখানে ভক্তগণ পূজো করে। পাথরের মধ্য দিয়ে সরু পথে নৌকা যেতে হয়। শীতের সময় মাঝে মাঝে আপনাকে নৌকা থেকে নেমে হাটতে হবে, নইলে নৌকা চালানো বেশ কষ্টসাধ্য । পথে তিন্দুতে নৌকা থামিয়ে একটু চা-পানি খেয়ে নিলাম। দুই পাশে উঁচু পাহাড় থাকার কারনে মনে হচ্ছে দিনের আলো তারাতারিই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অচেনা পথে সময় আর শেষ হচ্ছেনা । সাথে থাকা মোবাইল অনেক আগেই কেবল টর্চ লাইট আর ঘড়ি হয়ে গেছে । সময় দেখছি আর অন্ধকার উপভোগ করছি।
হঠাৎ দূর রং বে রংয়ের লাইট দেখছি আসমানে । গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম ওটা কি ? ওটাই রেমাক্রী । আমাদের গন্তব্য । আদিবাসীরা নদীর পারে তাদের ঘর গুলোতে আলোকসজ্জা করেছে, যাতে করে দূর থেকে চোখে পরে। আমি কিছুক্ষনের জন্য প্রায় বোবা হয়ে গেলাম । অসাধারণ পরিবেশ, পাশেই রেমাক্রী ফলস। এতদিন কেন এখানে আসিনি ? এই প্রশ্ন নিজেকে আপনি করতেই পারেন ।
নদীর দুই পারে পর্যটকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা । আমরা নৌকা থেকে নেমে প্রায় ৪০-৫০ ফুট উপরের দিকে হেঁটে আমাদের থাকার জায়গায় রেমাক্রী বাজারে গেলাম।
আর কিছুক্ষণ পর চাঁদ উঠবে, আজ পূর্নিমা রাত । আমরা রাতে আদিবাসীদের বাড়ীতে খেয়ে নদীর তীরে চলে এলাম রাত ১১ টার দিকে। খাবারটা খেয়ে মনেই হয়নি যে বাসার বাইরে কোথাও খেলাম। আজ রাতভর চলবে বারবিকিউ আর সকলের বেসুরো গলায় গান । জীবনে এমন পরিবেশ সব সময় আসেনা !!! আমাদের আঁশে পাশে আরো কয়েকটি গ্রুপকেও দেখলাম আনন্দ উদযাপন করতে । রাত প্রায় ৩ টা নাগাদ বারবিকিউ চললো আর গান-চিল্লা পাল্লা তো চললোই। সকালে নাস্তা করে হেটে রওনা হলাম “নাফাখুম” এর উদ্দেশ্যে। শুকনো সাংগুর উপর দিয়ে কখনো শুকনো পথে আবার কখনো পানির মধ্য দিয়ে প্রায় আড়াই ঘন্টা হেটে চলছি।পথে কখনো হাটু পানি, কখনো উঁচু পথ, সে এক দারুন অভিজ্ঞতা। চলতে চলতে দূরে ঝর্ণার গান শুনতে পেলাম । “নাফাখুম” ফলস যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো !!! আমরা সে গান উপভোগ করলাম।
আমরা প্রায় ২ ঘন্টা ওখানে থাকলাম, ছবি তুললাম, গোসল করলাম, ভেজা কাপর চোপর শুকিয়ে আবার রেমাক্রীর উদ্দেশ্যে ফেরার পথ ধরলাম। বলে রাখি, ঢাকা থেকে নেওয়া আমাদের গাইডটা ছিলো বাটপার, তাই রেমাক্রী ফিরে দুপুরের খাবার খেয়েই ১ দিনের ট্যুর কমিয়ে বান্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । যেন রাতের গাড়ীতে ঢাকা ফিরতে পারি। অবশ্য বাটপার গাইডটাকে রেমাক্রী রেখেই আমরা আলাদা হয়ে চলে এসেছি। আসার সময় প্রশান্ত মন আর সৌন্দর্যের মুগ্ধতা নিয়ে এসেছি। অমন পূর্ণিমা রাতে সাংগুর তীরে বারবিকিউ, আড্ডা আর নাফাখুমের সৌন্দর্য একজনমে আপনি ভুলতে পারবেন না, গ্যারান্টি ।
আপনাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি, নেট থেকে থেকে গাইড/ ট্যুর কোম্পানি সিলেক্ট করার সময় অবশ্যই যাচাই বাছাই করে রেটিং বা রিভিউ খেয়াল করে নিবেন। অনেক নাম সর্বস্ব ছেলেরাও আজ এই ব্যবসার সাথে জরিত। দেখে শুনে গাইড নিলে আর প্রতারনায় পরবেন না। রেমাক্রীর খাবারের এবং থাকার ব্যবস্থা করবে লোকাল গাইড। আগে থেকেই গাইড এবং থাকার বন্দোবস্তো করে তারপর ট্যুরে যাবেন । অবশ্য লোকাল গাইড গুলো বেশ ভালো, মাঝে মাঝে বাটপারি করে ঢাকার কিছু সংখ্যক ছিঁচকে গাইডরা।
ঢাকা থেকে যাওয়া-আসার জন্য একজনের খরচ পরবে ৪৫০০/- থেকে ৬৫০০/- টাকা পর্যন্ত। বান্দরবন থেকে থানচির রিজার্ভ চাঁন্দের গাড়ী ভাড়া ৬০০০/- ৭০০০/- টাকা এক পথ। আর লোকাল গাইড দুই দিনের জন্য ১৫০০/- থেকে ২০০০/-। ৪/৫ জনের জন্য নৌকা ভাড়া ৩০০০/- থেকে ৪০০০/- টাকা। যাওয়ার সময় অবশ্যই প্রয়োজনীয় ঔষধ, পাওয়ার ব্যাংক, মোবাইল চার্জার।
Leave a Reply