রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ০৬:৫৯ পূর্বাহ্ন

পাকিস্তান ভ্রমণ:৪-মাহাতাব লিটন

পাকিস্তান ভ্রমণ:৪-মাহাতাব লিটন

পাকিস্তান ভ্রমণ-৪
মাহাতাব লিটন

৪.
সন্ধ্যা নামিয়া আসিল, ইসলামাবাদের বায়ুযান ধরিবার জন্য আবারও বোর্ডিং কার্ডের জন্য লাইনে দাঁড়ানো, অবশেষে নানা রকম নিয়ম মানিয়া জীবনের ২য় বার বায়ুযানে উঠিবার সৌভাগ্য অর্জন করিলাম।
যথারীতি প্রবেশমুখে সেবিকাদ্বয়ের
অভ্যর্থনায় বিমোহিত হইবার অবকাশ নাই কারণ ইহা যে তাহাদের কৃত্রিম ☺ বুঝিতে পারিলাম বৈকি। আর যাহা হউক তাহারা যে আমাদের স্বাধীনতা লাভে খুশী নহে ইহাতো পরিস্কার।
বায়ুযানে আসন গ্রহন করিবার পর বারংবার একজন বাংলাদেশী নারী যাত্রীর কথা মনে পড়িল। তিনি আমাদের সহযাত্রী ছিলেন, সমস্যা হইল করাচি ✈ বন্দরে নামিয়া তাহার আত্মীয় স্বজনকে খুঁজিতেছিলেন। ঘন্টা দুই পার হইলেও তাহাকে কেউ গ্রহন করিতে আসে নাই। জানিনা শেষমেশ সন্ধান মিলিল কিনা কেহ আসিল কিনা। পাশের যাত্রীর কাছে শুনিয়া ছিলাম স্বাধীনতার পর তাঁর বাবা মা আটকে পড়া পাকিস্তানি এবং তাঁহারা প্রয়াত হইয়াছেন অনেক আগেই, বহু কষ্টে তিনি করাচি ফিরিয়াছেন আত্মীয় স্বজনের টানে। আমার মনে হইবার কারণ টার্মিনালে তাহাকে কান্নারত অবস্থায় দেখিয়া ছিলাম।
কিন্তু এইদিকে আমার চক্ষু কপালে উঠিল বায়ুযানের সাজসজ্জা সুবিধাদি আধুনিক যন্ত্রপাতি। আভ্যন্তরীণ বায়ুযানের খাবার সরবরাহ এমন কি বিমান সেবিকা পর্যন্ত, প্রতিটি আসনের সম্মুখে মনিটর, হেডফোন সব কিছুই PIA এর আন্তর্জাতিক রুটের থাকিয়া শত শতগুণ ভালো।
পূর্বে আমার সীমাবদ্ধতা ছিল অভিজ্ঞতার কিন্তু দ্বিতীয় বায়ুযানে উঠিবার পর সংগত কারণে একটি বায়ুযানের সহিত অন্যটির তুলনা করিতে পারিলাম। কিন্তু এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি ইহার কারণ। মূলতঃ 🇧🇩 বাংলাদেশী শ্রমিকেরা PIA মাধ্যমে যাতায়াত করিয়া থাকে। নাকি স্বদেশী রিক্রুটিং এজেন্সীগুলি তাহাদের পাকি বায়ুযানে টিকেট কাটিতে উদ্বুদ্ধ করে। প্রশ্নটি মাথায় থাকিয়া গেল। বিশ্বাস করুন সেই রুগ্ন বায়ুযানের কথা আমার মনে থাকিবে যতদিন বাঁচিয়া থাকিব।
মিনিট ৫০ এর মধ্যেই আমরা ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে নামিলাম। “পূর্বে এটি ইসলামাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামে পরিচিত ছিলো, ২০০৮ সালের ২১ জুন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানী এই নাম পরিবর্তন করে প্রয়াত পাকিস্তানী নেত্রী বেনজির ভুট্টোর নামে নতুন নামকরণ করেন”
রাতের বন্দরে নামার পর সার্চ লাইটের আলোতে যাহা দেখিলাম তাহা হইল ডানে বামে শুধু যুদ্ধযানের সাজ সাজ রব। মনে পড়িল জেনারেল মোশাররফ তখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। ব্যারাক থাকিয়া আসিয়া যুদ্ধং যুদ্ধং ভাব লইয়া ক্ষমতায় টিকিয়া থাকা। কেহ কেহ জাতপাতের কেহ কেহ ধর্মের দোহাই দিয়া রক্ত প্লাবনে উল্লাসিত হয়।
কেহ কেহ দেশের ক্ষুধা নিবারনের চেষ্টা না করিয়া সমরাস্ত্র ক্রয় নতুবা নিউক্লিয়ার বোমা বানাইতে উন্মাদনায় মাতে রাস্ট্র।
দেখুন দেখি কোথা হইতে কোথা যাইতেছি আমি, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বায়ুযান থাকিয়া চার চক্রযানে করিয়া বর্হিগমন পথে নামাইয়া দিল অতঃপর লাগেজ লইযা বাহিরে অপেক্ষা করিতে থাকিলাম।
বাহিরে নানা মানুষের মধ্যে জনৈক ব্যক্তির হস্তে শোভিত উঁচু প্লাকার্ডে আমাদের দুইজনের নাম। ভিনদেশে নিজের নাম দেখিয়া অবাক হইলাম যেমন কিঞ্চিৎ পুলকিত হইলাম বটে। পরে বুঝিলাম তিনি অভ্যর্থনাকারী তারকা চিহ্নিত হোটেলের প্রতিনিধি।
সোডিয়ামের আলোয় সজ্জিত সড়ক ধরিয়া চারচক্র যানটি বেশ জোর গতিতে ছুটিতে লাগিল। হোটেলে পৌঁছাইতে মিনিট ত্রিশিকের যাত্রা ছিল। হোটেল পৌঁছানোর পর তাহারা ফলের রসপানের মাধ্যমে স্বাগত জানাইল। চেক ইন করিতে করিতে আশপাশের সাজসজ্জা দেখিয়া নিজেকে বেশ বেমানান মনে হইল, বলিয়া রাখা ভালো পাঁচ তারকা হোটেলে এই প্রথম আমার রাত্রিযাপন করিবার অভিজ্ঞতা হইবে।
সু সজ্জিত হোটেলে আমার জন্য বরাদ্দ কক্ষটি দেখিয়া ভাষা হারাইয়া ফেলিলাম। যাহা কিছু দেখিতেছি তাহা সব কিছুইতো আমার ঝুলিতে নতুন বলিয়া গন্য হইবে। কলাবিহীন নানা ফলের ঝুড়ি দিয়া কক্ষে বরণ। এতো বর বরনের মতো। ফলের ঝুড়িটি ছিল রঙিন কাগজে মোড়ানো। কক্ষে ঘুরিয়া- ফিরিয়া ও নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিলাম। হঠাৎ ডোর বেল বাজিয়া উঠিল। দরজা খুলিয়া দেখিলাম আপা বিলম্ব না করিয়া তাৎক্ষনিক তিনি বুঝাইয়া বলিলেন ” লিটন মনে রাখিবেন কক্ষের ভিতরে রাখা রেফ্রিজিটরে রক্ষতি চকলেট বা পানীয়জল যাহা কিছু আছে তাহা গ্রহন বা পান করিলে
ইহার মূল্য আপনাকেই পরিশোধ করিতে হইবে। অফিস হইতে প্রতিদিন হাত খরচ বাবদ ৫ ডলার বরাদ্দ। ঠান্ডা বাক্সের ভিতরে রক্ষিত কোনো কোনো পণ্যগুলির দাম আমার দৈিনক বরাদ্দের তিনগুণ চারগুণ পর্যন্ত মূল্য।
তবে হ্যাঁ ওযাশরুমে রক্ষিত প্রসাধনী সামগ্রী আপনি নিঃসংকোচে গ্রহন করিতে পারিবেন। যেমন ধরুন সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেষ্ট, ব্রাশ, ওয়ানটাইম রেজার, শেভিং ক্রিম ইত্যাদি ইত্যাদি তবে তোয়ালাখানি নহে ।” শুনিয়া লাম।
কিন্তু সেই যে শুরু করিয়া ছিলাম তাহা এখনও ননস্টপ চলিতেছে গুরু।

৫.
(ঢাকা টু ইসলামাবাদ ভায়া করাচি, দুইখানা যাত্রা ২৮০০ কিঃমিঃ অতিক্রম করিয়া হোটেলের নিজ কক্ষে প্রবেশমাত্র )
দ্রুত ফ্রেস হইয়া রাতের আহারে যোগ দেওয়ার তাড়া রহিয়াছে। কাল বিলম্ব না করিয়া ভোজনালয় গিয়া হাজির।
নানা পদের বাহারি খাবারের থরে থরে সাজানো কমপক্ষে শতাধিক হইবে। যাহা খাইবেন যতটুকু মন চাহিবে খাইতে পারিবেন অনেকটা ফেরিঘাটে পেটচুক্তির মত। ১৭ বছর আগে প্রতিবেলা খাবারের মূল্য নির্ধারিত ১০২০ রূপিয়া ভ্যাটওট্যাক্স সংযুক্ত।
বলিয়া রাখা ভালো আমাদের একই হোটেল আমাদের আরেকজন বোন ডাক্তার সেহলিনা আহমেদ তিনিও উঠিয়াছেন। উনি দুইদিন আগেই আসিয়াছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের একটা সভায়এ যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে। আজ সভা শেষ হইয়াছে আগামীকাল হইতে আমাদের সফরসঙ্গী হইবেন। দলে তিনজন হওযায় আমার সাহস বাড়িয়া গেল।
পছন্দমতো খাবার নিয়া এক টেবিলে তিনজন বসিলাম। অবাক হইলাম আমার প্লেটটি নানা পদের খাবারের ভিড়ে যখন দিশেহারা ঠিক উল্টোটা তাহাদের দুই প্লেটে দুইখানি শশা’র ফালি আর পাশে স্বচ্ছ পানির বোতল। আমার দুই সিনিয়র স্টাফের খাবারের থালাখানি যদি এই দশা হয় তবে পাঠক আমার বাকি দিনগুলোর কি হইবে তাহা অনুমানযোগ্য।
আমার মৌন্যতা দেখিয়া ডাক্তার সেহলিনা আপা কহিলেন “আপনি খান আপনারতো বয়স কম, আমরা আপনাকে সঙ্গ দিচ্ছি।” তাহাদের মতো এতো সিনিয়র স্টাফের এমন মনোভাব আমাকে ঋণী করিয়াছিল।
ধীরে ধীরে তাহাদের সহিত খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম।
রাত্রিতে স্ত্রী ও কন্যার কথা মনে পড়িল বারংবার কন্যার মুখটি ভাসিয়া উঠিল। নিদ্রা আসিল না মধ্য রাত্রি অবধি নিদ্রাহীন সময় কাটিল। রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রটিতে গুতাগুতি করিয়াও বাঙলা চ্যানেলের দেখা মিলল না এমন কি ইন্ডিয়ান চ্যানেল। ভুলিয়া গিয়াছিলাম ইহা পাকিস্তান।
ইসলামাবাদে আমার দ্বিতীয় দিন প্রাতরাশ সারিয়া চার চক্রযানে চড়িয়া
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল পাকিস্তানের কান্ট্রি অফিসে পৌঁছাইলাম। পরিচিত পর্ব শেষ করিয়া তাহাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত করিলেন। আমাদের ভ্রমণের লক্ষ্য হইল Early Children Development (ECD) এর কর্মসূচি সম্পর্কে তাহারা কি কি করিতেছে? কিভাবে করিতেছে ? আমার ব্যক্তিগত শিখনের বিষয় ছিল Child to Child (CTC) Health Programme. সভায় উপস্থিত দুই দেশের সহকর্মীদের মধ্যে সভ্যগনের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক মিথস্ক্রিয়া চলিল বিরতিযুক্ত জলযোগ হইল।
পুনরায় মিথস্ক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটিল। শেষ হইয়াও শেষ হইল না। চুড়ান্ত উপস্থাপনার বিষয় হইল নিরাপত্তা সংক্রান্ত। সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স ছাড়া হোটেল হইতে এককদম বাহিরে যাওয়া নিষেধ।
অদ্ভুত ব্যাপার আমি যে এতো বাচাল স্বভাবের মানুষ তাহার মুখে তালাবদ্ধ (দুটি কারণঃ
১. ইংরেজি কম বুঝতে পারা,
২. জ্ঞানগর্ভ আলোচনা)
দুই একটি বাক্য ব্যয় করিয়া বিপদ ডাকিয়া না আনাই শ্রেয়। মধ্যাহ্ন বিরতিতে হোটেলে ফিরিয়া আসিলাম। বাহারি আহার শেষ করিয়া খানিক সময় বিশ্রাম পাইলাম।
পাঞ্জাবে প্রদেশে জুন মাসের তাপমাত্রা ও আমাদের দেশের মতই গড় তাপমাত্রা কিন্তু স্বদেশে ঘাম নির্গত হয় আর এই ভিনদেশে শরীর দাহ হচ্ছে।
সেই যাই হউক বিশ্রাম শেষ করিয়া লবিতে আসিয়া বৈকালিক জলযোগে অংশ নিলাম। আগামীকাল নর্থওয়েস্ট ফেডারেল প্রভিন্সে যাত্রার বিষয়ক ছোট্ট আলোচনা হইল। জনৈক ভদ্রলোক কান্ট্রি অফিস হইতে আসিয়া ছিলেন। ক্ষমা করুন তাঁহার নাম ভুলিয়া গিয়াছি।
গোধূলিবেলা তিনজনে মিলিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে আমাদের হোটেলের পিছনের (পশ্চিমে) দিকটায় একটি মার্কেটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দুই বড় বোনের স্নেহময়তায় আমি আনন্দিত ও সৌভাগ্যবান। তাহাদের দুইজনের কাছেই পাকিস্তানটি বেশ পরিচিত একজনের পিতা করাচিতে বিমানবাহিনীতে ছিলেন অপরজনের পিতা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসলামাবাদে কর্মরত ছিলেন। যতদূর শুনিয়াছিলাম তাহাদের শৈশব ও কৈশোর কাটিয়াছে এইদেশে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম হইবার পূর্বেই। মার্কেটটি মাঝারি ধরনের দেখিয়া মনে হইল অতি সাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকিতে পারে।
সামান্য ঘুরিয়া ফিরিয়া আমরা একটি রেস্তোরাঁর বাগানের ছাতাঝুরির নিচে বসিলাম এবং ভগ্নিদ্বয়ের পছন্দের তালিকায় জলযোগে যুক্ত হইল মাংসের হাড়িভুনা সহিত গার্লিক নানরুটি। আশপাশের মানুষজনকেও দেখিলাম তাহারাও একই আহারে ব্যস্ত, সরল হিসাব হইল এই ধরনের খাবারের জন্যই রেস্তোরাঁটি প্রসিদ্ধ বৈকি। পুনরায় হাঁটিতে হাঁটিতে হোটেলে ফিরিলাম।
এখন পর্যন্ত যতটুকু দেখিলাম বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, ছকে বাঁধা অনেকটা দাবা খেলিবার সাদাকালো ঘরের মত।
বলিয়া রাখা ভালো নিরাপত্তা জনিত কারণে চারচক্র যান ব্যবহার না করিয়া ইতিউতি উঁকি মারা চেষ্টা করিয়াছি মাত্র।
বিশ্বাস করুন দুইদিনে পাকি খাবারের প্রতি অরুচি ধরিয়া গেইল সেই কারণে তিনজনার মধ্যে ডাল ভাত খাইবার চাহিদা জাগ্রত হইল। মার্জনা করিবেন রাত্রিতে হোটেলে আহার গ্রহন করিয়া ছিলাম কিনা তাহা মনে নাই। ইহা মনে আছে হোটেলের নিজস্ব রেস্তোরাঁয় সেদিন গজল শুনিয়া ছিলাম। জনৈক তরুণ শিল্পী গজল পরিবেশন করিতেছিলেন আর উপস্থিত শ্রোতাগণ আহার করিতেছিলেন। বুঝিলামা তাহারা ভালো শ্রোতা নহে। ইহা হোটেল ব্যবসায়ীর বাণিজ্যিক কৌশলমাত্র আহার করিলে বিনামূল্যে সংগীত শুনিতে পারিবেন। আসন গ্রহন না করিয়া একটি গজল শুনিয়া ☺ নিজ কক্ষে ফিরিলাম। ফিরিবার কালে শুনিলাম ডাক্তার আপা বাংলাদেশী ডাক্তারের খোঁজ করিতেছেন তিনি হলেন ডাক্তার মোঃ মাহাতাব নিবাস বাগেরহাট। তিনি পাকিস্তানে ইপিআই কার্যক্রম সম্প্রসারনে উপদেশক হিসেবে কর্মরত। উদ্দেশ্য তাঁহার গৃহে হানা দুটি ডাল ভাতের সন্ধানে এবং আহারে।
ইহাও জানিলাম আগামীকাল আমাদের সঙ্গে দুই জন উপদেশক সফরসঙ্গী হইবেন একজন চিকিৎসক অপরজন প্রকৌশলী।
যথারীতি নিদ্রায় যাওয়ার পূর্বে রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্রটি ডান হস্ত বাম হস্ত করিয়া বৃথা চেষ্টা পরিচিত চ্যানেলের সন্ধান। তবে নিদ্রার তাড়া ছিল ভোরবেলা উঠিতে হইবে।

৬.
তৃতীয় দিন প্রভাতে উঠিয়া ফরিদাবাদ যাইবার প্রস্ততি লইলাম। সামান্য প্রাতরাশ শরীরে শক্তি গ্রহন করিলাম। রাত্রিযাপন হইবে অ্যাবাটাবাদে।
কিন্তু যাত্রা আরম্ভ হইতে হইতে বেলা বেশটা গড়াইয়া পড়িল, অবশেষে আমাদের পাকিস্তানি সফরসঙ্গী দুই উপদেশক একটি কোস্টার লইয়া হোটেল সম্মুখে হাজির হইলেন। চিকিৎসক ইরফান তিনি স্বাস্থ্য উপদেশক এবং প্রকৌশলী ইমরান তিনি উপদেশক ওয়াশ কর্মসূচি। মজার বিষয় হইল আমাদের সহিত ক্ষুদে দুই সফরসঙ্গী যুক্ত হইল। তাহারা প্রকৌশলী ইমরানের ফুটফুটে দুই সন্তান। দুই ক্ষুদে সফরসঙ্গীদের পাইয়া ভালোই হইল। আমাদের চালক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষ।
এর আগে তিনি কাজাখস্তানসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে দীর্ঘদিন গাড়ি চালিয়েছেন। হাল্কা পাতলা গড়নের তামাটে শরীর। যানটির সম্মুখে বাম পাশের আসনটি আমার জন্য বরাদ্দ হইল। সাদা আলখেল্লা গায়ে চাপানো চালকটি আমার পানে তাকাইয়া মৃদু হাসি দিয়া কোমর বন্ধনী বাঁধিবার ইশারা দিলেন। সকলেই আসন গ্রহন করিবার পর চার চক্রযানটি চলিতে আরম্ভ করিল। দিনের আলোয় শহরটিকে দেখিবার চেষ্টা করিতে ছিলাম। সড়কের ডানদিকে রাষ্ট্রপতি ভবন, শুনিয়াছি রাষ্ট্রপ্রতি ভবনের সম্মুখ হইতে গাড়ির স্টিয়ারিং সোজা করিয়া ধরিয়া রাখিলে সরাসরি লাহোর পৌঁছানো যাইবে। পিছনের যাত্রীদের কথোপকথনে ইহাই বুঝিলাম যে জেনারেল মোশাররফ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইবার পর যোগাযোগ ব্যবস্থার অসামান্য উন্নতি করিয়াছেন। তাহার কিছু নিদর্শন পাইলাম যাত্রা কালে সড়কগুলি ছিল মসৃণ ও পরিচ্ছন্ন। মহাসড়কের পাশে পেট্রোলপাম্প গুলির সহিত ফার্স্টফুডের দোকান খদ্দরে জমজমাট ছিল। ধীরে ধীরে শহর উপশহর ছাড়িয়া পাহড়ি পথের দেখা মিলিল। আফগান সীমান্তবর্তী এলাকায় যাইব বলিয়া সন্ধ্যার আগেই পৌঁছানো তাড়া রহিয়াছে। কিছুদূর যাইবার পর মহাসড়কে একস্থানে যাত্রা বিরতি এবং জলযোগ হইল। ইহার পর পুনরায় চলিতে আরম্ভ করিলাম। যাইবার কালে খেয়াল করিলাম পাহাড়ি সড়কের আশে পাশে লোকালয় খুউব একটা দেখিলাম না। মাঝে মাঝে দুই চারটি দোকান খোলা দেখিলাম। খাড়া পাহাড়ের ডানদিকের গা ঘেঁসিয়া চলিতে লাগিলাম। বাম পার্শ্বের পাহাড়ি খাদ দেখিয়া শিউরে উঠি।
আমাদের ভ্রমণকালীন এই প্রদেশটির নাম ছিল উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। গুগলে জানিলাম “১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রদেশের উত্তর সীমান্ত পাঁচটি দেশীয় রাজ্য, উত্তরপূর্বে ক্ষুদ্র রাজ্য গিলগিত এজেন্সি, পূর্বে পশ্চিম পাঞ্জাব এবং দক্ষিণে বালুচিস্তান প্রদেশ দ্বারা বেষ্টিত ছিল। উত্তর পশ্চিমে ছিল আফগানিস্তান।প্রদেশের অধিকাংশ অঞ্চল ১৮শ শ্তাব্দী থেকে ১৮২০ এর দশক পর্যন্ত মূলত দুররানি সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। মহারাজা রণজিৎ সিং আফগানদের অন্তর্দ্বন্দ্ব্বের সুযোগে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং এই অঞ্চলকে তার সাম্রাজ্যের সাথে একীভূত করে নেন। দ্বিতীয় ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের সময় পাঞ্জাব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে আসে।সীমান্তের উপজাতীয় এলাকাসহ এই অঞ্চল আফগানিস্তানের সাথে বাফার অঞ্চল হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। ১৯০১ সালে প্রদেশ গঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রদেশ পাকিস্তানের অংশ হয়। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত প্রদেশটি টিকে ছিল। এরপর এক ইউনিট নীতির মাধ্যমে চারটি প্রদেশ একীভূত করে নতুন পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ গঠিত হয়। এক ইউনিট নীতি বাতিলের পর পুরনো নামে প্রদেশ পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এই নাম বহাল ছিল। এরপর প্রদেশের নাম বদলে খাইবার পাখতুনখোয়া রাখা হয়”
এই খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের ১৪টি জেলার মধ্যে একটি জিলার নাম হইল “অ্যাবাটাবাদ” পৃথিবীর অনেকেই অ্যাবাটাবাদ নামটি শুনিয়াছেন ওসামা বিন লাদেনের বদৌলতে। অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বাদ দিয়া সম্মুখে যাইবার নিমিত্তে মনোনিবেশ করিলাম। তবে ইতিহাস হইতে জানিলাম “ব্রিটিশ শাসন আমলে অ্যাব্‌টাবাদ শহরটি ব্রিটিশ ভারতের হাজারা জেলার সদর দপ্তর ছিলো পাঞ্জাব অঞ্চল দখলের পর মেজর জেমস অ্যাবট ১৮৫৩ সালের জানুয়ারিতে অ্যাব্‌টাবাদ জেলা এবং শহর প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার নামেই শহরটির নামকরণ করা হয়। ইহা ১৮৬৩ সনে স্থাপিত। শহরটি অ্যাব্‌টাবাদ সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে উচ্চতা প্রায় ১,২৬০ মিটার (৪,১৩৪ ফু)। পাকিস্তান জুড়ে শহরটি তার মনোরম আবহাওয়া, উচ্চমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সামরিক স্থাপনার জন্য পরিচিত। এখানকার জনপ্রিয় হিল স্টেশন প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক আকর্ষণ করে।”
ওরে মা বলিয়া ডাকিয়া উঠিলাম কারণ হঠাৎ করিয়া ৯০° চারচক্র যানটি বাঁক ঘুরিল ঠিক ঐ মুহূর্তে অপরদিক হইতে আসা একটি মালবাহী লড়িও ৯০° তাহার বাঁক ঘুরিল। চালক মহাশয় যে সুদক্ষ তাহা প্রমানের অপেক্ষা রাখিল না। মজার বিষয় হইল লড়ি বা পরিবহন যাহাই চোখে পড়িল সবই নানা রঙের নকশায় সজ্জিত। সাজ সজ্জায় বাহিরের অংশ কোথাও ফাঁকা দেখিলাম না গরু ছাগলের গলায় বাঁধা ঘন্টা সাদৃশ্য অসংখ্য ছোট বড় ঘন্টা পরিবহন গুলির সম্মুখে ও পশ্চাতে বাঁধা ঘন্টাগুলি ঝুলিতেছে আর টু টাং বাজিতেছে। স্বদেশী গরু গাড়ির চলিতেছে ইহা যে কেহই মনে মনে ভাবিতে পারেন বৈকি। নতুবা ঢাকার ত্রিচক্র যান প্যাডেল মারা রিক্সার কথা ভাবিতে পারেন।
ভীত হইয়া পথ চলিতে চলিতে বৈকালে অ্যাবাটাবাদে পৌঁছাইলাম। শহরটি যে বৃটিশরা তৈরি করিয়াছেন ইহার নিদর্শন ধীরে ধীরে বুঝিতে পারিলাম।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge