বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ০৯:২১ অপরাহ্ন

জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা:বুলবুল ভাই আমাদের মাঝে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন-রানা মাসুদ

জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা:বুলবুল ভাই আমাদের মাঝে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন-রানা মাসুদ

জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা

বুলবুল ভাই আমাদের মাঝে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন

রানা মাসুদ

আজ একজন গুণীজনের জন্মদিন। রংপুরের গৌরব আমাদের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় রকিবুল হাসান বুলবুল ১৯৫৫ সালের ২৫ জুলাই রোববার সকাল আটটায় রংপুর শহরের নিউ সেন পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে শারীরিক ভাবে নেই কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন তাঁর কর্ম ও স্বকীয়তার গুণে; তিনি বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে আমাদের মানস মন্দিরে। আজ তাঁর জন্মদিন। এ দিনে তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁকে দেখে আসছিলাম। আমাদের বাড়ি ও তাঁদের বাড়ি ছিল এপাশ-ওপাশ। ছোটবেলায় তাঁর আদর-স্নেহ পেয়েছিলাম। মাঝখানে সঙ্গত কারণে অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। আবার তিনি রংপুর ফিরে এসেছিলেন। মানুষ তাঁকে পেয়ে আপ্লুত হয়েছিল। তিনি তাঁর প্রিয় রংপুর ফিরে এসে আবার সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং সাংগঠনিক সবকিছুর সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আমরা কাছে পেয়েছিলাম একজন আন্তরিক অবিভাবককে। কিন্তু সে স্নেহ ভালোবাসা আমাদের বেশিদিন জুটল না ।২০১৮ সালের ১৬ মার্চ তিনি আমাদের সকলকে ছেড়ে, সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে যান। আমি তখন স্বপরিবারে ছিলাম পবিত্র ওমরাহ করতে মক্কায়। ওখানেই এই খবর পেয়ে শোকাভিভূত হই।
আজ তুলে ধরার চেষ্টা করছি এই আলোকিত প্রয়াত গুণীজনে কথা।
প্রকৃত একজন সৎ, নির্লোভ, সাদা মনের স্নেহশীল মানুষ ছিলেন তাঁর পিতা মরহুম এ,কে,এম অকিল আহমেদ। তাঁর বিশাল চৌহর্দির বাড়ির মতোই ছিল বিশাল মনটা। জন্মদাতা মা মরহুমা রাহেলা আফরোজ বেগম। কিন্তু তাঁদের আর এক মা মরহুমা মাসতুবা আহমেদ ছিলেন তাঁদের সকলের অন্যতম শ্রদ্ধা, ভালোবাসার মানুষ। ছিলেন ছায়াবৃক্ষ। তাঁদের পুরো পরিবার ছিল শিক্ষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। বাবা- মায়ের অনুপ্রেরণা তাঁদের শিক্ষায় আলোকিত করে তোলে। ছোট তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ভাই আশরাফুল আলম সম্প্রতি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। পরের ভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো.লুৎফুল হাসান এবং একদম ছোট ভাই চাকরিজীবী মেহেদী আলম রাসেল। তিন বোনের মধ্যে নাসরিন আফরোজ বিউটি, শিরীন আফরোজ সম্ভ্রান্ত পরিবারের গৃহিনী এবং ছোট বোন আমাদের আরেক প্রিয় মুখ শিক্ষাবিদ, কারমাইকেল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড.আকলিমা আরা বেগম তুর্কী। ছোট বোন জামাই কবি ও প্রভাষক ড.সুলতান তালুকদার। সহধর্মিণী কবি ও সংগঠক আমাদের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন তাসমীন আফরোজ নিশি। জনাব বুলবুল রেখে গেছেন দুই ছেলে। রিয়াসাত হাসান জ্যোতি এবং তানজিম হাসান দীপ্ত।
বহুগুণের অধিকারী আমাদের পথ নির্দেশক রকিবুল হাসান বুলবুল ছিলেন এসএসসির ১৯৭০-এর ব্যাচ। এইচএসসি সম্পন্ন করেন ১৯৭২ সালে। এরপর প্রিয় কারমাইকেল কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স পড়ার পাশাপাশি যুক্ত হয়ে পড়েন সাহিত্য, সাংস্কৃতি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে। আসলে তিনি এ অঙ্গনে পদচারণা করেন না বরং তাঁর পদচারণায় আলোকিত হয়ে উঠতো এ অঙ্গন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় তিনি তাঁর অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেন। আবৃত্তি, বিতর্ক, কবিতা ঔ ছড়া রচনা, নাটকে অভিনয়, বিতর্ক এবং পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনায় তাঁর মেধা ও দক্ষতার বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকে। কারমাইকেল কলেজ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ১৯৭৬ সালে রানার আপ, ১৯৭৭-৭৮ সালে পরপর দুই বার চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৭৭ সালে কারমাইকেল কলেজ বার্ষিক নাট্য প্রতিযোগিতায় তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়ে তাঁর প্রতিভার আরেক ঝলক দেখান।এরপর পরপর দুই বার কারমাইকেল কলেজ বিতর্ক দলের নেতৃত্ব দিয়ে বিটিভির জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেন এবং তাঁর দল দু’বারই বিজয়ী হয়। জনাব বুলবুল তাঁর লক্ষ্যণীয় পারফরমেন্সের কারণে দু’বারই শ্রেষ্ঠ বক্তার পুরস্কার লাভ করেন। তিনি কারমাইকেল কলেজ বার্ষিকী সম্পাদনা করেন ১৯৭৮ সালে। এছাড়া তাঁর সম্পাদনায় ‘উচ্চারণ’ নামে একটি পত্রিকা বাংলা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হতো। ছিলেন ‘জলতরঙ্গ ‘ নামের একটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। তিনি ১৯৮১ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। কারমাইকেল কলেজে পড়ার সময় সরকার বিরোধী তীর্যক লেখার জন্য শাসকদের রোষানলে পড়েন।
তিনি বেশ কিছুদিন সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং এ অঙ্গনেও তাঁর মেধার সাক্ষর রেখেছেন। শিখা সংসদের ছিলেন একজন অন্যতম সদস্য ও অভিনয় শিল্পী। প্রায় ৩৭ টি নাটকে অভিনয় করে কাঁপিয়েছেন মঞ্চ। উদীচীর সাথেও যুক্ত ছিলেন এবং জেলা উদীচীর পক্ষ থেকে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট এবং মহিলা সমিতি মঞ্চে নাট্যাভিনয় করেন।
বেতার ও রকিবুল হাসান বুলবুল ছিল যেন অঙ্গাঙ্গী। সেই ১৯৭৪ সালে যুক্ত হয়েছিলেন; করে গেছেন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, গ্রন্থনা,পরিচালনা বিপুল জনপ্রিয়তার সাথে। ছিলেন একজন জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক। বিটিভির সংবাদ অনুবাদও ছিলেন তিনি। চাঁদের হাটসহ অনেকগুলো সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি।
পেশাগত জীবনে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হন। ১৯৮১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করেন। পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে উপাধ্যক্ষ পদে থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ক্যাডেট কলেজ পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মর্যাদা পেয়েছিলেন। তিনি শিক্ষক জীবনেও ক্যাডেট কলেজে বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন।
অবসর গ্রহণের পর অনেক সুযোগ সুবিধা পাওয়া স্বত্বেও তিনি অন্য কোথাও না গিয়ে ফিরে আসেন প্রিয় রংপুরে। আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠেন সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে। তিনি বাংলাদেশ দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির রংপুর বিভাগীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। ছিলেন আরো বিভিন্ন সংগঠনের সাথে উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন সন্মানিত পদে। অসম্ভব রকম আন্তরিক ব্যবহারে তিনি খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। অত্যন্ত সৎ,নিষ্ঠাবান ,নীতিবান এবং প্রজ্ঞাবান এই গুণীজনকে হারিয়ে আমরা এক অমূল্য সম্পদ হারিয়েছি।
তিনি একজন বলিষ্ঠ কবি ও ছড়াকার ছিলেন। তাঁর ছড়াগ্রন্থ ‘ কানা বগির ছা’ ২০১৮-তে রংপুরের আইডিয়া প্রকাশন থেকে এবং এর আগে ‘ এক আঁজলা জল হলে চলে যায় দিন’ শীর্ষক একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। যা পাঠক ও সুধী মহলে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এছাড়া শিক্ষা সহায়ক একাধিক গ্রন্থেরও জনক তিনি। তিনি অনেকগুলো পুরস্কার ও সন্মাননা লাভ করেছিলেন।
এই শ্রদ্ধেয় গুণীজন সম্পর্কে এখানে অতি সংক্ষেপে কিছু লিখলাম। তাঁর সম্পর্কে লিখতে গেলে আরো অনেক কিছু বলা ও লেখা যায়। কিন্তু সীমিত পরিসরে যা সম্ভব নয়।
তাঁর জন্মদিনে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা। আল্লাহ্পাক যেন তাঁকে জান্নাতের সবচেয়ে সুন্দর স্থানটা দান করেন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিয়োগব্যথা সহ্য করে সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী জীবন যাপন করতে পারেন এই দোয়া করি।
(তথ্যসূত্রঃ রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদ থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ‘রঙ্গপুরের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ‘ গ্রন্থে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক মো.মোজাম্মেল হক স্যারের নিবন্ধ, জনাব রকিবুল হাসান বুলবুল- এর পুত্র রিয়াসাত হাসান জ্যোতির একটি ফেসবুক পোস্ট এবং আমার স্মৃতি থেকে)

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge