জীবন যেভাবে যায়
নূরুন্নাহার বেগম
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জুলেখার ৷ হাত পা কাঁপছে রীতিমত ৷ কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা ৷ বৃষ্টিও যেন পেয়ে বসেছে ৷ যতক্ষন বৃষ্টি চলবে বিছানাপত্র গুটিয়ে বসে থাকতে হয় ওদের ৷ জুলেখার স্বামী জগদুল থেকেও নেই ৷ কত আর কষ্ট করবে ! বিয়ের পর ক ‘বছর সাধ আহ্লাদে কেটেছে ৷ এ ক ‘দিনের টানা বৃষ্টিতে উঁচু নীচু জমি সব পানিতে সয়লাব ৷ নদীর পানিও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে ৷ এরকম দিনে জগদুলকে বাড়িতে পায় কার সাধ্যি ! ও ঠিক সময়মত টর্চ সাথে মুট জালটা নিয়ে ঠিকঠাক বেড়িয়ে গেছে ৷ সাথে বিড়ির মোথাটা কোমরে গুঁজে নিতে ভুল হয়না জগদুলের ৷ হাজার বারণ করলেও শোনে না ৷ বললে ওর মুখ দিয়ে যখন তখন যা— তা বের করতে কোনো কসুর করে না সে ৷ জুলেখা শুনতে শুনতে বলে “আচ্ছা কুলসুমের বাপ , তোমরা কি খাসলত আজো ছাড়বার পারলেন না, মানুষ কেমন খালি মুখ দিয়া খারাপ কতা নাড়ে, ভালো কতা জানেন না ৷ তোমরা মরলে তোমার সাথে কতগুলা মাইনসের মরণ হইবে, জানেন সেটা ৷ ” জগদুল কান হেলে জালটা নিয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বেড়িয়ে যায়৷
জগদুলের মাথায় এরপর কি বুদ্ধি এলো ও এলাকার কামাই রোজগার ছেড়ে চলে গেল কক্সবাজার ৷ জুলেখা মানুষের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে স্বামীর এক চিলতে জমির উপর আশায় ঘর বাঁধে ৷ মেয়ের সন্তান নাতি আজগরকে নিয়ে যা পায় রাঁধে ৷ দুু ‘জনে চেটেপুটে খেয়েদেয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ৷ জুলেখা বেশ নামাজী ৷ নামাজের সূরা কালাম শুনে শুনে ঢের মুখস্ত করেছে ৷ তাসবিহ তাহলিল ভালোই হেফজ করেছে ৷ মাঝেমধ্যে এবাড়ি ওবাড়ির মা— বোনদের উদ্দেশ্যে বয়ান দেয় ৷ ওদের নামাজে মনোযোগি হতে বলে ৷ বেনামাজীর শাস্তি কি হয় তাও ভাঁজে ভাঁজে বলে জুলেখা ৷ বুবুরা খুসিমনে পানসুপারি খাওয়ায় ৷ ” বলে, হামার বেটাছাওয়াটাক একনা বুঝান তো বুবু ৷ ওমরা মসজিদ মুখে হবারে চায় না ৷ ছইলেরা তো বাপের কাছ থাকিয়ায় শেখে ৷ নাকি বুবু ? ” জুলেখা অনেক সময় ঝোপ বুঝেই কোপ মারে ৷ আশপাশের পুরুষদেরকে নামাজের কথা বলে ৷ জুলেখা বুঝিয়ে, গুছিয়ে বলতে পারে ৷ শুধু পারে না স্বামী জগদুলকে বোঝাতে ৷ পুরুষরা জুলেখার কথা ধৈর্য ধরে শোনে ৷ বিরক্ত হয় না৷
অনেকটা স্বস্তি এখন জুলেখার মনে ৷ জগদুল থাকতে হাতে টাকাপয়সা মোটেও রাখতে পারত না ৷ জুলেখা একটা পালিত ছাগল বিক্রয় করে ৷ এমনিতেই জুলেখা কোনো টাকা জমাতে পারে না ৷ ছাগল বিক্রির কয়েকটা টাকাই জুলেখার সম্বল৷ আপদে বিপদে কাজে লাগাবে ৷ জগদুল জানতে পেরে আর যায় কোথায় ৷ ঐ টাকা না হলে যেন কোনো ঠেকাই সামলাতে পারেনা সে ৷ মুখ খারাপ, অকথ্য গালিগালাজ কাঁহাতক জুলেখার সহ্য হয় ৷ সময়ে একবার ভাবে জগদুল দূরে আছে ওর খচখচানি থেকে বেঁচে গেছে ৷ তারপরেও বিয়ের স্বামী বলে কথা ৷ একমাত্র মেয়ে কুলসুম ঢাকায় ৷ গার্মেন্টস— এ ৷ চাকুরী অনেকদিন হওয়ায় অভিজ্ঞতা বেড়েছে ৷ মাইনে বেড়েছে ৷ কথাবার্তায় ঠাঁটও বেড়েছে ৷ রাত হলে ফোন, ছুটির দিনে কথা বার্তা চলতেই থাকে ৷
“হ্যাঁ মা বলো ৷ তোমরা ভালো আছ তো ? বাবুটা ভালো আছে? বাবুকে একটু দাওতো কথা বলি ৷ ফোন নিয়ে কত বায়না ছেলেটার ৷ আম্মু ঈদে জিনসের প্যান্ট নেব ৷ রোজার ঈদে করোনা করে করে নানী আমাকে শুধু শার্ট কিনে দিয়েছে ৷ এবার কিন্তু শার্ট প্যান্ট কোনোটাই ছাড়ব না ৷ তুমি কবে আসবে আম্মু? জুলেখা চেঁচিয়ে উঠে, ক্যান মুই কি তোর যত্ন কম করম , তাতো তুই আম্মু আম্মু করিস ৷ যাহ কাইল থাকি আর মুই কিচ্ছু করবার নম ৷” কিছু করবে না জুলেখা ৷ জুলেখার কথায় নাতিটা ভয় পেয়ে গেল ৷ করোনার ভয়ে স্কুলে শিক্ষকের নির্দেশমত কাপড়চোপর পরিষ্কার করা, কিছুক্ষন পর পর ডেটল সাবান দ্বারা হাত পরিষ্কার, বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা সহ যত রকমের নির্দেশনা সব ঠিকঠাক মত পালন করে ছেলেটা ৷
দূর্ভোগ বেড়েছে ঘনঘন বৃষ্টিতে ৷ ফোনটা হাতে নিয়ে গরগর করে কথাগুলো বলে ফেলে জুলেখা ৷ মা সাজি কিছু টাকা পাঠিয়ে দে মা ৷ চাটাই আর পলিথিন দিয়ে ছাউনীটা দেই ৷ এর ওর কাছে কয়েকটা বাঁশ চেয়ে পেয়েছি ৷ লাগাতার বৃষ্টিতে ভেজা চুলায় কি করে রান্না করি বল ৷ একটু দেড়ি হলে খাওয়ার জন্য তোর ছেলে মাতম শুরু করে ৷ কানার পা ঐ গর্তেই পড়ে ৷ রান্না ঘরটায় আগুন লাগিয়ে কে যে পুড়িয়ে দিলে তার কস্মিন কালেও ভালো হবে না ৷ আমার ছাতা নেই, মাথা নেই আমার উপরই যত্ত জুলুম ৷
জুলেখা ছাতা বলতে এখন অব্দি স্বামী জগদুলকেই ভাবে ৷ জগদুল বিয়ের কিছুদিন পরে এলাকা ছেড়ে কাজের খোঁজে কক্সবাজার যায় ৷ যাবার পর কয়েকবার জুলেখার কাছে আসা যাওয়া করলেও ২০ বছর হলো আর অাসে না ৷ ওখানেই জুলেখার বিনা অনুমোতিতে আবার বিয়ে করে সে ৷ জুলেখা আইন আদালত করেনি ৷ সে ঘরে সন্তান আছে জগদুলের ৷ সে বউ আয়েশা ঢাউস দেহে মাথার ‘পর ২০ টাকার মাল এ বাড়ি ও বাড়ি বিক্রি করে সংসার চালায় ৷
জুলেখার মনেও স্বামী সোহাগ পেতে ইচ্ছে করে ৷ হাজার হলেও বিয়ের স্বামী ৷ ওর শ্যামলা চিকন গড়ন দেহটাতে তো সেই আগুন ধরিয়েছিল ৷ নিজে খেয়ে না খেয়ে স্বামীকে খাইয়েছে ৷ জমির আইলে গরম ভাত বেঁধে নিয়ে বসে থেকেছে ৷ কোনোদিন কড়ই গাছের নীচে ছেঁড়াখোঁড়া ছায়ায় দম নিয়ে আবার হেঁটেছে জুলেখা ৷ কষিয়ে মজিয়ে রান্নায় জগদুল তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে জুলেখা তাই করেছে ৷ সূর্যটা মাথার ওপর এসে চোখ রাঙালেও জুলেখার ঘাম ঝরেনি ৷ হাতপাখাটাও সাথে নিয়েছে ৷ পাখায় হাত দুলিয়ে নিজেও বাতাস খায়, জগদুলকেও আরাম দেয় ৷ জগদুল খায়, জুলেখা ভাবে একটিবারের জন্য কুলসুমের বাপটা বললো না জুলেখা তুই কি খেয়েছিস ? অথচ জগদুলের মুখের প্রতিটা গ্রাস জুলেখার মুখস্ত ৷ রুটি খেতে মন না চাইলে তেল দিয়ে পরোটা সাথে একটা ডিম ভাজি করে খাইয়েছে জগদুলকে ৷ যত্ন— আত্নির কোনো ত্রুটি করেনি জুলেখা ৷
এই গরমে জুলেখার ঘোমটা ঢাকা মাথাটা থেকে কপাল আর মুখ বেয়ে ঘাম ঝরে ছোট ছোট লম্বা দাগের মত ৷ সেই দাগে জুলেখার ব্লাউজ ঘেমে ঘেমে উঠছে ৷ পরনের কাপরটাতে কালিঝুলির দাগ ৷ গত কয়েকবছর যাবৎ একটা নতুন কাপড় কিনে দিতে পারেনি জগদুল ৷ গ্রামের অপেক্ষাকৃত ধনীরা ফেৎরা হিসাবে কাপড় দেয় সেগুলোই গুনে গুনে বেশ কয়েকটা জমে ৷ সারা বছর ফিরে ফিরে ওগুলোই পড়ে জুলেখা ৷
ভাবতে ভাবতেই বত্রিশ পাঁজর ভেদ করে চাপা দীর্ষশ্বাস বের হয়ে আসে জুলেখার ৷ কয়েকবার ফোন করলে একবার হয়তো ধরে জগদুল ৷ জগদুল একসময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে ৷ আসতে চায় জুলেখার কাছে ৷ জুলেখা অনেক শক্ত হয়ে যায় তখন ৷ প্রতি উত্তরে অনেক কড়া ভাষায় জানিয়ে দেয় জুলেখা, “জোয়ান বয়সের কামাই আয়েশারে খাওয়াইলা ৷ সেই দেখবে তোমাকে ৷”
মনে মনে ভাবে এখন তো জগদুলের শরীরের অর্দ্ধাংশ অবশ ৷ এখন এলে মেয়ের কামাই জগদুলকেই বসে বসে খাওয়াতে হবে ৷ এমনই ভাগ্য জুলেখার মেয়েটাকে বিয়ে দিল ৷ জামাইটা এমনই হলো সে প্রচন্ড অলস ৷ সেই বরঞ্চ শাশুড়ির উপর নির্ভর করে চলতে চায় ৷ হাতের উপর দিয়ে মেয়ে জামাইকে পোষার মত ক্ষমতা জুলেখার নাই ৷ এর মধ্যে জুলেখার মেয়ের কোল জুড়ে ছেলে সন্তান এলো ৷ খরচও বেড়ে গেল৷ কিন্তু জামাইয়ের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই ৷ মেয়ে জামাইকে রোজগার করতে বললে এক দুই কথায় কুলসুমের উপর শারিরীক অত্যাচার শুরু করে দেয় ৷ ভাত দেয়ার ভাতার নয, কিলানোর গোসাই৷ সহ্য করতে না পেরে পরে মেয়ে তার জামাইকে তালাক দিয়ে কিছুদিন মায়ের সাথে থেকে ঢাকা চলে যায়৷
ফোনে মায়ের সব কথা শুনে কুলসুম বললো, মা তোমাকে একটা সুখবর দেয়া হয়নি মা ৷ আমার একটা প্রমোশন হয়েছে মা ৷ বেতনও বাড়বে ৷ চিন্তা করিও না তোমাকে আরো বেশি পরিমানে টাকা পাঠাতে পারব মা ৷ তুমি শুধু আমার ছেলেটার দিকে দেখিও ৷ওর যত্ন নিও ৷ আর তুমি সুস্থ থেক ৷ জুলেখা ভাবে মেয়েকেও তো তার সুখবর দেয়া হয়নি ৷ ঘর পুড়ে গেল সরকারের তরফ থেকে একবান টিন আর তিন হাজার টাকা পেল ৷ সরকারের নতুন আর একটি কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে নিজ ভিটায় দুঃস্থ নারীদের দুই রুমের পাকা বাড়ি করে দেবে সরকার ৷ জুলেখার নাম তার মধ্যে আছে ৷ বলতে বলতে জুলেখার কন্ঠ আড়ষ্ঠ হয়ে আসছিল আনন্দে ৷ বলছিল মা, ” আর হামারঘরক বৃষ্টি পানি খাওয়া নাগবার নয় ৷ হামার আল্লাহ দিলে পাকা ঘর হইবে মা ৷ হামরা পাকা ঘরত শুতি থাকম মা ৷ তুই যেটা বেশি করি টাকা পাঠালু হয়৷ তাক তুই জমে যাইস ৷ বেটা উপর ক্লাসে উঠলে মেলা মেলা টেকা নাগবে ৷সেলা খরচ করবার পাবু মা৷”
ফোনে নেটওয়ার্ক মাঝে মধ্যেই থাকে না ৷ শেষ কয়েকটা কথা জুলেখা বললো ঠিকই পরে বুঝতে পারল মেয়ে পর্যন্ত কথাগুলো পৌঁছায় নাই ৷ পরে যখন আবার কথা হবে শেষ কথাগুলো ঠিক ঝালাই করবে জুলেখা ৷ কিছুক্ষন পর জুলেখার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ৷ অনেক কষ্টের পর পান চিবোনা দাঁতের হাসিতে তখন প্রশান্তির স্বস্তি৷
Leave a Reply