কানাডার টরন্টো থেকে
বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক জসিম মল্লিক এর কলাম পরিযায়ী
করোনা দিনের ডাইরি : পর্ব-৭
যোদ্ধারা এভাবেই জয়ী হন
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতটা পুরোপুরি সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী। প্রবল পরাক্রমশালী মাফিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেখানে স্বল্প খরচে চিকিৎসা কিংবা অল্প দামের ওষুধ দিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বা ডাক্তার জাফরুলাহর মতো মানুষের টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু তিনি টিকে আছেন। কারন তিনি যোদ্ধা। দেশপ্রেমিক। লুটেরা নন। বাংলাদেশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কোনো চিকিৎসা হয় না। ওগুলো করা হয়েছে মানুষের পকেট কাটার জন্য। মানব সেবার কোনো আদর্শ নিয়ে নয়। আমি একবার স্কয়ার হাসপাতালে গিয়েছিলাম আমার গলা ব্যথা নিয়ে। সেখানকার সবকিছুই সুন্দর, ছিমছাম পরিপাটি, যেনো পাঁচ তারকা হোটেল। বসার জায়গা, ওষুধের ফার্মেসি, টাকা পয়সার ক্যাশ কাউন্টার সবই আমার পছন্দ হয়েছে। শুধু চিকিৎসা পছন্দ হয় নাই। অনেক ভোগান্তি আর টাকা পয়সা খৱচ করার পর কানাডায় এসে আমার গলা ব্যথা ভাল হয়েছিল। ডাক্তার ধরতেই পারেনি কেনো গলা ব্যথা হয়েছিল।
যে দেশে মৃত মানুষকে লাইফ সাপোর্টের নামে আটকে রেখে বিল আদায় করা হয় সে দেশের মানুষের মানবতা কোন পর্যায়ের বলার অপেক্ষা রাখে না। এই করোনা কালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুরো কঙ্কাল বের হয়ে পড়েছে। মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছেনা। রাস্তায় রাস্তায় মারা যাচ্ছে। ডাক্তাররা পর্যন্ত মারা যাচ্ছে। নকল মাস্ক, নকল পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে। কি ভয়াবহ! কি মর্মান্তিক! সিন্ডিকেটের কারণে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিটের এখনও অনুমোদন দেয়া হয়নি। এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে! ডা. জাফরুলাহ একজন সত্যিকার যোদ্ধা। তিনি মানুষের দোয়ায় তাৱ হাসপাতাল থেকেই করোনা মুক্ত হয়েছেন। ৭৯ বছর বয়সের মানুষটার উদ্যম দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে।
দেশে সৎ লোকের কোনো জায়গা নাই। সৎ মানুষকে সবাই বোকা ভাবে। সংসারে তার কোনো দাম নাই। সন্তান, স্ত্রী, আত্মীয়রা তারে গোনায় ধরে না। তার সাথে কেউ বন্ধুত্ব করে না, দাওয়াত দেয় না, কোথাও আমন্ত্রিত হয় না। আবার বেশি সত্যবাদীর গন্তব্য হচ্ছে জেলখানা। চুরি চামারিতে দেশটা ছেয়ে গেছে। নকল আর ভেজাল সবকিছুতে। নৈতিকতা শ‚ন্যের কোঠায়। সর্বত্র্য দ‚র্নীতি আর দ‚র্নীতি। এমপি বিদেশে গিয়ে আটক হয়। ব্যাংক লুটপাট আর টাকা পাচার করে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে মিথ্যার বেসাতি, দালালি, চাটুকারিতা। যারা এসবে পারদর্শী তারাই সব হাসিল করে নেয়। তারাই সুখে শান্তিতে আছে, সুখের জীবন। নৈতিকতা আর সততার দিন শেষ!
টরন্টো ১৪ জুন ২০২০
ভালবাসার শহরে
বাংলাদেশ এবং কানাডা নামক দুটো মহান দেশের নাগরিক বলে এই দেশ দুটি আমার ভালবাসার তালিকার শীর্ষে থাকবে সবসময়। এর পরের দেশ দুটি হচ্ছে ভারত এবং আমেরিকা। কারন বলছি। আমি বরিশালে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি। আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে বরিশালে। সর্বোপরি বরিশালে আছে আমার মা-বাবা, আমার ভাই-বোন, আমার আত্মীয়-পরিজন আর বন্ধুরা। তাই বরিশাল আমার সব সময়ের জন্য প্রিয় শহর। আবেগের শহর। আমি যদি কখনও আবার ফিরি তাহলে বরিশালেই ফিরব।
বরিশাল ছেড়ে একদিন আমি ঢাকা আসলাম। আমার লেখাপড়া, জীবন সংগ্রাম, চাকরি, সংসার সবই ঢাকায়। তাই ঢাকা সবসময় আমার স্মৃতির শহর হয়ে থাকবে। ঢাকা আমাকে অনেক দিয়েছে। তারপর একদিন আমি কানাডায় পাড়ি জমাই। এক বছর অটোয়া কাটিয়ে আমি টরন্টোতে স্থায়ী হই। দীর্ঘদিন এই শহরে থেকে শহরের গলিপথ, আনাচ কানাচ সব আমার অতি পরিচিত হয়ে উঠেছে। ভালবাসার শহর টরন্টো। এই শহরের পথে নামলেই মনে হয় এটা আমার নিজের শহর। মোলায়েম, নিরাপদ, উষ্ণ আর সহজ একটি শহর।
ভারত আমার প্রিয় দেশ নানা কারণে। আর কোলকাতা শহর হচ্ছে আমার একটি আবেগের নাম। আমি প্রথম ইমিগ্রেশন পার হয়ে যে শহরে গিয়েছি সেটা ভারতের কোলকাতা। জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমন। তাই ভারত আমার ভালবাসার দেশ হিসাবেই থাকবে। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের এক কোটি মানুষকে নয় মাস আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয় বেড়ানো, কেনাকাটা, চিকিৎসা,পড়াশুনা বা ব্যবসার কাজে আমরা বেশি যাই ভারত।
ঐতিহাসিকভাবেই দুই বন্ধু দেশ। দুই পাড়েই রয়েছে আত্মীয়তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ভারতের গান শুনে, সিনেমা দেখে আর বই পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। আমার ছেলে হায়দারাবাদের মেয়ে বিয়ে করেছে। ভারতে আমার অনেক বন্ধু আছে। কানাডায় আমার অনেক সহকর্মী ভারতীয়, আমার প্রতিবেশি ভারতীয়। মনে আছে আমার বস অনেক বছর আগে একবার বলেছিল জসিম, যদি কখনো বিদেশে যাও তাহলে চেষ্টা করবা ভারতীয়দের প্রতিবেশি হতে..।
আমার অপর ভালবাসার দেশ হচ্ছে আমেরিকা। এর কারণ হচ্ছে কোলকাতার পরই আমার দ্বিতীয় বিদেশ ভ্রমণ ছিল আমেরিকা। একলাফে আটলান্টিক পারি দেওয়া যাকে বলে। আমেরিকার যে শহরটিতে প্রথম পা রেখেছিলাম সেটি হচ্ছে বিশ্বের রাজধানী হিসাবে খ্যাত নিউইয়র্ক। তাই নিউইয়র্ক সবসময় আমার প্রিয় জায়গা। নিউইয়র্কে আমার অনেক বন্ধু আর আত্মীয় আছে। নিউইয়র্কের মাটিতে যখনই পা রাখি মনে হয় এটা আমার নিজের শহর। এই শহরের মানুষ আমাকে অনেক ভালবাসা, প্রশ্রয় আর সম্মান দিয়েছে। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।
এরপর তো অনেক দেশেই গিয়েছি, অনেক শহর ঘুরেছি।আমেরিকারই বিশ পঁচিশটা স্টেটে গিয়েছি কিন্তু নিউইয়র্কের কোনো তুলনা নাই। গত বিশ বাইশ বছরে কমপক্ষে পঞ্চাশবার নিউইয়র্কে যাওয়া হয়েছে আমার। আমেরিকা এই পৃথিবীর মানুষকে অনেক দিয়েছে। পৃথিবীর মানুষের আমেরিকার কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আমেরিকার পর আমি ভারতকেই সুপার পাওয়ার হিসাবে দেখতে পছন্দ করব। তাতে বাংলাদেশও লাভবান হবে বলে আমি মনে করি।
টরন্টো ১৯ জুন ২০২০
অভিমানই বাবাদের অস্তিত্ব
বাবাদের নিয়ে তেমন কথা হয় না। একসময় বাবারা খুউব একা হয়ে যায়। একা হতে হতে একদিন শ‚ন্যে মিলায়। সন্তানক্ষুধা বাবাদের যে কত তীব্র এই কথাটা কেউই প্রায় বোঝে না। মায়ের কাছে সন্তানেরা যতটা স্বচ্ছন্দ, অকপট বাবাদের কাছে ততটা না। আমার সন্তানেরা তার মায়ের সাথে প্রতিদিন কথা বলে, মায়েরা অনেক কিছু খুঁটিয়ে জানতে চায়। কিন্তু বাবারা তেমন না। আমার বাবা মারা গেছেন আমার দু’ বছর বয়সে। মানুষ নাকি ইচ্ছে করলে তার জন্মমুহ‚র্তও মনে করতে পারে। আমি ন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি , নাকের জ্বলে, চোখের জ্বলে পড়ে আছি মাটিতে, মা ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, সাজু কখনো আমাকে একটু কোলে নিয়ে পাড়ায় ঘুরতে বের হয়, মা অনেকক্ষন পর এসে একটু আঁচলে নাক মুখ মুছে দেয়। মাকে বাবা বলছেন, দেখেছো তোমার ছেলেটা কেমন জিদ্দী আর অভিমানী! তারপর বাবা আমার হাতে লজেন্স গুজে দেন। এই পর্যন্ত অস্পস্ট চোখে ভাসে। হয়ত এটা একটা কল্পনা।
আমি নিজেও এখন বাবা। সন্তানের জন্য বাবাদের মমতা আর লড়াইটা থাকে নিভৃতে। আমি অনেক বাবা দেখেছি যারা মায়ের ভ‚মিকাও পালন করে। তবে সন্তানদের বেড়ে ওঠা, তাদের মানুষ করার ব্যাপারে মায়েদের কৃতিত্ব বেশি। মায়েরা সন্তানকে নয় মাস গর্ভে ধারণ করে এবং সন্তান প্রসবের যন্ত্রণা ভোগ করে। মৃত্যু যন্ত্রণার পরই এই যন্ত্রণা। কিন্তু মায়েরা এই কষ্টটা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে মুহ‚র্তে ভুলে যায়। তারপর বড় হয়ে সন্তান একসময় দ‚রে চলে যায়। সন্তান মানে সমতান। এদের মধ্য দিয়েই বাবারা বেঁচে থাকে। সন্তানের জন্য বাবাদের বুকের গভীরে চৈত্রের কুয়োর তলানি জলের মতো কিছু ভালবাসা সবসময় পড়ে থাকে। ওই দুস্তর পথ পার হয়ে সেইটুকু স্পর্শ করবে কে? অভিমানই বাবাদের অস্তিত্ব। তার সঙ্গে চলে অপেক্ষা অপেক্ষা। তার পাশে কেউ আসুক, সবাই আসুক..।
টরন্টো ২১ জুন ২০২০
ফিরে দেখা একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০
মহাদুর্যোগ চলছে পৃথিবীতে। প্রকাশনা শিল্প সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। বেকার হয়ে পড়েছে এই শিল্পের সাথে সংশিষ্ট মানুষেরা। প্রকাশনা ও বিপনন হুমকির মুখে। এই পরিস্থিতিতে আগামী একুশে গ্রন্থমেলা ২০২১ অনুষ্ঠিত হতে পারবে কিনা তা অনিশ্চিত। লেখক ও প্রকাশকের প্রস্তুতির এই সময়টা অনিশ্চিয়তার কালোমেঘ ছেয়ে আছে। তবুও আশাবাদী বইমেলা হবে। অচিরেই দেশে যাওয়ার জন্য ট্রাভেল এজেন্সিকে ফোন করব, লেখালেখি, প্রুফ দেখা চলবে। বিদেশে থাকি বটে কিন্তু মন পড়ে থাকে দেশে।
আমার লেখালেখির পুরোটাই বইমেলা কেন্দ্রিক। কোনো বই মেলা মিস করিন। টরন্টো, নিউইয়র্ক,কোলকাতা সব বইমেলায় উপস্থিত থাকতে চেষ্টা করি, কখনো আয়োজকদের একজন হই। বই প্রকাশিত হবে, পাঠক ও লেখকের সম্মিলন ঘটবে, অটোগ্রাফ দেয়া চলবে, এটাইতো জীবন। পাঠকই শেষ কথা। পাঠক যখন বই কিনবে সেটাই হবে লেখকের সার্থকতা, আনন্দ। বড় লেখক কিন্তু পাঠক বই কিনল না এমন প্রচারনা আমি চাই না। বিদেশে এসে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে।
টরন্টো ২৩ জুন ২০২০
Leave a Reply