রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ০৫:০৯ পূর্বাহ্ন

নয়নস্যার-মাসুদ বশীর

নয়নস্যার-মাসুদ বশীর

নয়নস্যার
মাসুদ বশীর

“ঐ যে রে, দ্যাখ্ দ্যাখ্ একচৌখা স্যার এদিকেই আসছেন বোধহয়”- শোভন, তার সাথে থাকা সহপাঠী সকল বন্ধুদের হাত ইশারায় বললো, আর তৎক্ষনাৎ তারা সকলেই সেদিকে একনজর তাকিয়ে তাদের নিজেদের চোখগুলোকে বিশ্রীরকম উল্টিয়ে হো.. হো… করে হেসে উঠলো। তাদের মধ্য থেকে একজন মৃদুস্বরে বলে উঠলো- “এই তোরা এখন একটু চুপ্ কর্ তো, স্যার এদিকেই আসছেন, দেখে ফেলবে, বুঝে ফেলবে, চুপ্ কর্ প্লিজ”।
যথারীতি তাদের নয়নস্যার তাঁর ক্লাস শেষ করে তাদের কাছ অব্দি হাঁটতে-হাঁটতে চলে এলেন এবং সকলকে সহজাত হাসিমিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলেন- “এই তোমরা সবাই ভালো আছো তো রে, সবার পড়ালেখা ঠিকঠাকভাবে চলছে তো?”
ছাত্ররা সকলেই তাদের চোখগুলোকে কিছুটা স্যারের মতো করে উল্টিয়ে মৃদু হেসে-হেসে সমস্বরে বলে উঠলো- “জ্বি স্যার, ভালো আছি স্যার, চলছে স্যার”।
স্যার বললেন- “গুড, ভেরী গুড, শুনে বেশ খুশি হলাম”।
নয়নস্যার, সবসময়ই তিনি কথা বলার সময় ক্যানো য্যানো তাঁর চোখ দু’টো দু’দিকে কি রকম একটা বিশ্রীরকম উল্টে যায়! এরকমটি করা বোধহয় ওনার অভ্যেস। কিন্তু তা দেখতে একদম অন্যরকম অদ্ভুত লাগে, একদম না হেসে থাকা যায়না।
হঠাৎ করে কেউ একজন তাঁকে দেখলে, তাঁর সাথে কথা বললে, সে মানুষেরও নিশ্চয়ই একটু হাসিই পেয়ে বসবে। তাইতো স্কুলের শিক্ষক-ছাত্র থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই তাঁকে দেখলে অবচেতনে হটাৎ-ই একটুখানি হেসেই ফ্যালে। এ বিষয়টা যে তিনি জানেন না তা কিন্তু নয়, তিনি তা খুব ভালো করেই জানেন, কিন্তু কখনোই কিছু বলেন না, মনেও করেন না। তাঁর ডানচোখটাও আবার পাথরের। ওই পাথরে চোখকে তিনি যত্নভরে হৃদয়ে নিয়েই য্যানো বুকের ভেতরে একটা ভারী আনন্দের স্মৃতি নীরবে বয়ে-বয়ে বেড়ান সারাক্ষণ এবং কাউকেই কিছু না বলে, বুঝতে না দিয়ে, সততার সাথে মন দিয়ে নিজের কাজটাই শুধু তিনি নিষ্ঠার সাথে ঠিকঠাক মতো করে যাওয়ার চেষ্টা করেন সবসময়।
এ স্কুলে তিনি জয়েন করেছেন তা-ও তো প্রায় ছ’মাসের মতোই হলো। কিন্তু কেউই এখনো তাকে য্যানো ঠিক স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছে না। বড়োই কষ্ট! এ য্যানো বড়োই কষ্ট তাঁর…!
উপস্থিত সকল ছাত্রদের তিনি হাসিমুখে শুভকামনাসহ বিদায় জানিয়ে টিচার্স রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন…
টিচার্স রুমে ঢুকতেই সেখানে উপস্থিত তাঁর সহকর্মীদের একজন তাঁর দিকে মৃদু হেসে বললেন- “কি খবর স্যার, ক্লাস নেয়া শেষ হলো, তা কেমন লাগছে আপনার এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান?”
প্রতি উত্তরে তিনি বলেন-“এখানকার বাচ্চারা, আপনারা, অনেক অনেক ভালো। আমি তো খুব আনন্দই পাচ্ছি এখানে শিক্ষকতা করে।”
ওখানে উপস্থিত তাঁর আর একজন কলিগ চট্ করে বলে ওঠেন- “আশ্চর্য! এসব আপনি কি বলছেন স্যার, এতোকিছুর পরেও আপনি…!”
তিনি বলেন- “কই আমি তো তেমন কিছু বুঝিনা, সবাই তো অনেক ভালো, তাছাড়া তেমন কিছু তো হয়নি, কেউই তো তেমন কিছু করছে না আমার সাথে। আর যা ভাবছেন, তা তো কোন বিষয়ই নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সময়ে একদিন সবাই সব জানবে, বুঝবে।”
একজন পাশ থেকে বলেন-“সব জানবে, বুঝবে! মানে, কি স্যার? কি জানবে, কি বুঝবে, স্যার?”
তিনি কথা ঘুরিয়ে নিয়ে বলেন- ” বাদ দ্যান তো ওসব কথা, আসেন লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে সকলে মিলে একসাথে লাঞ্চ করি”।
বছর পাঁচেক আগের কথা, নয়নের এক খুব ক্লোজ এবং ভালোবন্ধু সাদমান (মানে সেরকমই তাঁর ক্লোজ বন্ধুু, একদম আত্মার আত্মীয় বন্ধু, যাকে বলা যায় একদম মানিকজোড়, তারা দু’জনে যেন একে অপরের জন্য প্রাণটা দিতেও প্রস্তুত) রোড এক্সিডেন্টে ভীষণরকম ইনজুরড হয়। সেই বন্ধুর দুচোখ, মুখসহ শরীরের বেশিরভাগ অংশ এক্সিডেন্টে মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এর মধ্যে দুচোখের অবস্থা আরও বেশি ভয়াবহ, তখন একদম তার সংকটাপন্ন যায়যায় অবস্থা! নয়ন খবর পেয়েই তৎক্ষনাৎ ছুটে গেলো মেডিক্যালে বন্ধুর কাছে। ওখানে গিয়ে দ্যাখে ততোক্ষণে সাদমানকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে, তার অপারেশন চলছে। নয়ন তার বন্ধুকে নিয়ে ভীষণ টেনশনে এদিকওদিক পায়চারি করতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদ অপারেশন থিয়েটার থেকে সার্জারী ডাক্তার সাহেব বেড়িয়ে এসে বললেন- “রোগীর একদম ক্লোজ কেউ আছেন এখানে, একটু আমার সাথে ভেতরে আসুন জরুরী কথা আছে”। নয়ন ডাক্তারের কথায় ডাক্তারের সাথ সাথ ভেতরে প্রবেশ করলো। কিছুক্ষণ পর সে বিষন্ন মুখে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে এলো। তার চোখেমুখ যেন তখন ঘণকালো বিষাদময় মেঘের অন্ধকার ছায়ায় ছেয়ে গেছে। বাইরে অপেক্ষমান সবাই তাকে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে নয়ন? কেমন আছে সাদমান? নয়ন পরিষ্কার করে কোন উত্তর না দিয়ে শুধু বললো- “সাদমান সুস্থ আছে, ভালো আছে, ওর ইনজুরিটা একটু মারাত্মক। তবে, ভয়ের কিছু নেই সাদমানের জন্য আমার একটা কিছু অবশ্যই করতে হবে”- একথা বলেই সে সেখানে উপস্থিত এক সহকারি ডাক্তারকে সাথে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেনো চলে গেলো। অতঃপর পনেরো দিন অতিবাহিত হয়ে গেলো কিন্তু নয়নের আর কোন খোঁজই নেই। ওদিকে তার বাড়ির লোকজনও তার খোঁজ না পেয়ে তারা নয়নকে নিয়ে ভীষণ একটা টেনশনের মধ্যে পরে গেল, সবাই টেনশন করছে আর ভাবছে ছেলেটা আসলে গেলো কোথায়?
এদিকে সাদমান প্রায় সুস্থ হয়ে উঠছে কিন্তু তখনো তার চোখেমুখে লাগানো ব্যান্ডেজ রয়েই গেছে। নয়নকে নিয়ে সকলের টেনশনের কথা শুনতে পেরে অপারেশন থিয়েটার থেকে আবারও একজন ডাক্তার বেড়িয়ে এসে বললেন- “নয়ন সাহেব আমাদের কাছেই আছেন। আমরাই ওনাকে সাদমান সাহেবের জন্য আমাদের কাছে রেখেছি। আপনারা অহেতুক টেনশন করবেন না। উনি ওনার বন্ধুর জন্যই একটা জরুরী কাজে এখানে ব্যস্ত আছেন এবং সাদমান সাহেব এখন নয়ন সাহেবের জন্যই অনেক অনেক ভালো আছেন এবং সুস্থ আছেন। আমরা ওনাকে এবং নয়ন সাহেবকে এখন আমাদের এখানে জরুরি পর্যবেক্ষণে রেখেছি”।
একদিন নয়নস্যারের স্কুলের এক স্টুডেন্ট তার নিজস্ব ফেসবুক একাউন্টের ওয়ালে একটা লেখা পোস্ট করে। সেই লেখা পড়ে স্কুলের সকল স্টুডেন্ট ও টিচারগণের সকলের চোখ অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে যায়! স্কুলের সবাই উক্ত পোস্টটি পড়ে/পোস্টে লেখা বিষয়টি জানতে পেরে তারা সকলেই তখন নিজেদেরকে ভীষণরকম অপরাধী ভাবতে লাগলো এবং কাঁদতে শুরু করলো….
পোস্টটি ছিলো এমনঃ
একজন আদর্শবান ভালো মানুষের প্রতিচ্ছবি ছিলেন আমাদের বিদায়ী নয়নস্যার….
আজ আমি অতীব কষ্টের সাথে একটি বিষয় আমাদের স্কুলের সকলের সাথে শেয়ার করছি। এই পোস্টটি যখন লিখছি তখন পোস্টের সকল শব্দগুলো যেন চোখের জলে ধুয়ে যাচ্ছে।

বেশ কিছুদিন হলো আমাদের নয়নস্যার বাধ্য হয়ে আমাদের ছেড়ে অন্যত্র পোস্টিং নিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু আমরা কেউই সঠিক অনুভব করলাম না তাঁকে নিয়ে, জানলাম না, ঠিকভাবে জানতেও চাইলাম না তাঁর চোখ সংক্রান্ত জটিলতার কথা। শুধু হাসিঠাট্টাতে বিরক্ত করেই শেষ পর্যন্ত তাঁকে বিদায় দিলাম।
স্যারের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক প্রথম প্রথম সেরকম ভালো না থাকলেও একদিন আমার পড়া সংক্রান্ত একটা জটিল বিষয় নিয়ে আমি তাঁর শরণাপন্ন হলে, তিনি আমাকে সে বিষয়টিকে অতীব যত্নের সাথে সুন্দর সাবলীলভাবে বুঝিয়ে দেন এবং সেদিন তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেক অনেক বেড়ে যায়। প্রসঙ্গক্রমে ওইদিন আমি তাঁকে তাঁর চোখ সংক্রান্ত সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করি কিন্তু তিনি প্রথমে কিছুতেই বলতে রাজি হননা। পরবর্তীতে আমার অনেক অনেক রিকুয়েষ্টে তিনি বলেন- “আমি তোমাকে বলবো কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে বিষয়টি আমি এই স্কুলে থাকা অবস্থায় কারো সাথেই শেয়ার করবে না তাহলে আমার নিখাঁদ বন্ধুত্বকে হেয় করা হবে, যা আমি করতে পারবো না কিছুতেই”।
আমি বললাম- “নিখাঁদ বন্ধুত্ব বিষয়টা ঠিক বুঝলাম না স্যার?”
তিনি বললেন বলছি- “সাদমান নামের আমার একজন খুবই প্রিয় বন্ধু আছে। সে একদা রোড এক্সিডেন্টে ভীষণভাবে ইনজুরড হয় এবং তার দুটো চোখ-ই ওই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সে অন্ধ হয়ে যায়। তখন তাকে এই অন্ধত্ব থেকে বাঁচাতে একমাত্র উপায় ছিলো যদি কেউ তাকে চোখ দান করেন। আমি বিষয়টি ডাক্তারের কাছে জানতে পারি এবং ভাবি আমি দেখবো আর আমি থাকতে আমার বন্ধু একদম অন্ধ হয়ে যাবে তা কি করে হয়? তৎক্ষনাৎ আমি আমার একটি চোখ সাদমানকে দান করতে একদম হৃদয় থেকে ইচ্ছে প্রকাশ করি। পরবর্তীতে ওখানকার ডাক্তার আমাকে নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখেন এবং আমি নিশ্চিন্তে চোখ দিতে পারবো কোনই সমস্যা নেই, হবেনা, এ বিষয়ে তারা একটা পজেটিভ রিপোর্ট দেয়। আমি যে আমার চোখ দান করছি বন্ধুর জন্য এ কথা আমি আমার পরিবারের লোকজনসহ কাউকেই জানাই নি। কারণ, ভেবেছি জানাজানি হলে বন্ধুর জন্য আমার চোখ দানে পরিবার থেকে বাঁধা আসতে পারে। তাই সবার অজান্তেই আমি আমার প্রিয়বন্ধুকে আমার ডানচোখটি দান করি। কিন্তু অপারেশনকালীন কিছু জটিলতার কারণে পরবর্তীতে আমার ‘সাইট ডিজঅর্ডার’ হয়ে যায়, যার কারণে, কথা বলার সময় আমার চোখগুলো অমন এলোমেলো হয়ে ওঠে। এটাই আমার চোখ সংক্রান্ত সমস্যা। কিন্তু কাউকে কিছু এ বিষয়ে আমি কখনোই বলিনা, ভাবি যদি তারা আমার বন্ধুকে নিয়ে একটা বিরূপ কোন মন্তব্য করে বসে এজন্য। আমি আমার বন্ধুত্বকে, আমার বন্ধুকে কোনমতেই ছোট করতে পারবো না, কখনোই না, একদমই না…”

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge