সমীকরণ
সায়ন্তী সামুই
অন্বেষা আজ সকাল থেকেই ব্যস্ত,তার সাথে চিন্তাগ্ৰস্ত মনটাও বেশ ভারাক্রান্ত। কলেজ শেষ করে চাকরির খোঁজ, নিজের দায়িত্ব, বেকারত্বের যন্ত্রণা, সব মিলিয়ে প্রায় ক্লান্ত দীর্ঘ ৪ বছর ধরে একাকী মনটা জীবনের সমীকরণের হিসাব মেলাতে অবসাদগ্ৰস্ত প্রায়।
আজকের ‘ইন্টারভিউ’ হয়তো ঠিক করবে জীবনের গতিপথ।জীবনের জটিল সমীকরণ না মিললে; হয় বাড়ির লোকের কথায় বিয়ে, আর নয় জীবনের সমীকরণের উত্তর না মেলাতে পারা মন নিয়ে অবসাদগ্ৰস্ত দীর্ঘ প্রতিক্ষিত স্বপ্নের অন্বেষণের সমাপ্তি ঘটবে। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক মন নিয়ে কখন বাস থেকে নেমে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে খেয়াল নেই।
অকস্মাৎ একটা শব্দ, বাস্তবে ফিরতেই দেখল-
সে রাস্তার মাঝে আর পিছন থেকে দুটো গাড়ির ‘হর্ণ’ দিচ্ছে। তারপর অফিসে পৌঁছে ‘রিসেপশন’ গিয়ে জানতে পারল―’ইন্টারভিউ’-টা হচ্ছেনা, মেইল করা হয়েছে। মেলটা দেখবে বলে মোবাইলটা খুলতেই অবাক। বাড়ি থেকে ফোন। মা -এর 10 টা ‘মিসডকল’। ঘুরে ফোন করতেই মা বলল ― ” আজকেই বাড়ি ফেরো, পারলে এখনি। বাবার শরীর ভালো নেই।”
অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো। হাত-মুখ ধুয়ে বাবার ঘরে যেতেই বাবা বিছানা থেকে উঠে বসে বলল ― “শোনো, আমার শরীর তেমন ভালো না, আমি তোমার বিয়ে তাড়াতাড়ি দিতে চাই। অনেক তো হলো চাকরির চেষ্টা। কাল পাত্রপক্ষ আসছে, তৈরি থেকো।”
অন্বেষা কিছু বলতে যাবে তাকে বাধা দিয়ে মা বলল―”বাবার শরীর খারাপ, ডাক্তার বলেছেন ওনাকে মানসিক চাপ না দিতে। তাই বাবা যা বলছেন তাই শোনো।”
সেদিন রাতটা ঘরের জানালা জানে কি হয়েছিল, অনেকবার সিলংফ্যানে ফাঁস লাগাতেও চেয়েছিল পারেনি অন্বেষা। কেঁদেছিল, কেউ শোনেনি তার কান্না। তারপর সেই কান্না বন্ধ ঘরে চাবি দিয়ে সব মেনে নেওয়া মনটাতে আজ কষ্ট ছাড়া কিছু নেই। সব আশা পরিত্যাগ করে পরিবারের কথা ভেবে নতুন জীবন বেছে নিতেই হলো।
ভাবতে ভাবতে আনমনা অন্বেষা খেয়াল করেনি কিছু, হঠাৎ দরজা বন্ধের আওয়াজ। তাকিয়ে দেখল বাবার পছন্দ করা সেই মানুষটি। অন্বেষার পাশে বসে হাতটা অন্বেষার হাতে রাখতেই অন্বেষা হাতটাকে সরিয়ে বলল―” ‘সরি’, কিছু মনে করবেন না,আমি―” পাশের মানুষটি অন্বেষাকে থামিয়ে বলে উঠল ― ” ‘নো প্রবলম’, আসলে ভুলটা আমারই অচেনা কারো অনুমতি ছাড়া তার গায়ে হাত দেওয়া উচিত হয়নি।” পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে অন্বেষার হাতে দিয়ে বলল ―” আজকের দিনে আপনাকে উপহার দেওয়া নিয়ম, তাই এটা দিলাম, আর একটা উপহার আছে, দাঁড়ান।” এই বলে একটা বড়ো আর ভারী বক্স হাতে দিলেন। অন্বেষা অবাক হয়ে ভাবল, পাগল নাকি, কিসব করছে কে জানে, ভাবতে ভাবতে কাগজ খুলে দেখল, একটা চাকরির পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য একটা কোচিং -এর ফর্ম তার সাথে চাকরির পরীক্ষায় আবেদন করার ফর্ম। তারপর বক্সটা তাড়াহুড়ো করে খুলে দেখে অবাক। এযে তার প্রিয় কিছু গল্পের বই আর সাথে চাকরির পরীক্ষায় প্রস্তুতির জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় বই। হঠাৎ ভদ্রলোকটি বলে উঠল- ” উপহার পছন্দ হয়েছে? অন্বেষা কাঁদতে কাঁদতে বলল―” আপনি, ভদ্রলোক অর্থাৎ পরিমল বলল―” বিয়ে ঠিক হবার পর আপনি তো কথা বললেন না, আপনার বিয়েতে উপস্থিত আপনার এক বান্ধবীর কাছে কথায় কথায় আপনার এই ইচ্ছা জানতে পারি। তারপর আপনার জন্য এইরকম উপহার। আপনি চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ান, আমি পাশে থাকব কথা দিলাম। অন্বেষার কাছে এ যেন অকল্পনীয় চিত্র। যেই বিয়ে থেকে পালিয়ে যেতে এত কিছু, সে বিয়ের কারনে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো হবে। আজকের রাত অন্বেষার জীবনের কাছে স্মরণীয়। জীবনের সমীকরণটা হঠাৎ বদলে গেলে একটা দমকা হাওয়ায়। এ যেন এক নতুন সমীকরণের সূচনা।
Leave a Reply