বাংলা সাহিত্যে মড়ক-মহামারী উপাখ্যান
আনওয়ারুল ইসলাম রাজু
“ আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে ॥
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে ॥
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ–
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে ॥”
(কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারী, প্রাকৃতিক দূর্যোগ-দূর্বিপাক মানুষের নিত্যসহচর।কখনও কখনও এসবের ব্যাপক বিস্তৃতি অগণিত মানুষের প্রাণসংহার ও সম্পদহানির কারণ হয়ে উঠেছে, বিপন্ন করে তুলেছে মানব সভ্যতাকে, স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে। কিন্তু কোন কিছুতেই হার মানেনি মানুষ। সকল বৈপরিত্যের সাথে লড়াই করে মানুষ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। ফিনিক্স পাখির মত আপনার অস্থি-মজ্জার ভষ্মস্তুপ থেকে আবারও আপন অস্তিত্ব নিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠে জীবনের জয়গান করেছে মানুষ। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াইয়ের (স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স) ইতিকথা ইতিহাসের পাতায় যেমন লেখা রয়েছে, তেমনি এ নিয়ে সাহিত্যও রচিত হয়েছে।আসলে সাহিত্য তো সমাজ ও জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আর বিশ্বের সকল দেশে মড়ক-মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে সেই সমাজ ও সভ্যতার উষালগ্ন থেকে। ফলে সকল দেশের সাহিত্যে আদি কাল থেকেই মড়ক- মহামারীর প্রভাব ও প্রতিফলন ঘটেছে অনিবারয ভাবে।
আমাদের দেশের ইতিহাসেও মহামারী নতুন কিছু নয়। তবে অতীতে তার পরিচয় ছিল ‘মড়ক’ হিসেবে। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকও বাঙালির নিত্য সহচর। আর এগুলোর অনিবার্য সঙ্গী হয়ে এসেছে দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর, মড়ক-মহামারী।বাংলাদেশসহ এই উপমাহাদেশের মানুষ আবহমান কাল ধরে এইসব মড়ক-মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর ইত্যাদির সাথে লড়াই-সংগ্রাম করে টিকে আছে। তাই স্বভাবতই বাংলা সাহিত্যেও এসবের প্রভাব ও প্রতিফলন ঘটেছে সেই আদিকাল থেকে।
প্রচলিত মৌখিক সাহিত্য তথা লোকসাহিত্যের বিভিন্ন শাখার পাশাপাশি লিখিত সাহিত্যের সকল শাখায় নানা প্রসঙ্গে-অনুষঙ্গে বর্ণিত হয়েছে মড়ক-মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির কথা। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা বাংলা সাহিত্যে ‘মড়ক-মহামারীর’ প্রসঙ্গ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরার প্রয়াসী হবো।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি ও প্রতিষেধক আবিস্কারের আগে এবং আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতার কারণে অতীতে ম্যলেরিয়া, কলেরা, বসন্ত, প্লেগের মত রোগ প্রায়শঃই মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় করে দিয়েছে। এমন উজার গ্রামকে নিয়ে অনেক অতিলৌকিক বা ভৌতিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে লোক মুখেমুখে।
প্রচলিত এমন একটি গল্প : ‘বহু দিন পরে জামাই ভিনগ্রামে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছেছে অনেক রাতে। শুনশান গ্রামে নিশুতি রাতে শ্বশুরবাড়িতে জামাইকে খেতে দিয়েছেন শ্বাশুড়ি। জামাই একটু লেবু চাইতে শ্বাশুড়ি ঠাকরুন ঘর থেকেই হাত বাড়িয়ে দূরের বাগানের লেবুগাছ থেকে লেবু পেড়ে আনলেন। তা দেখে জামাই ভয়ে অজ্ঞান। পর দিন জ্ঞান ফিরতে দেখতে পেল এক জঙ্গলের মধ্যে সে পড়ে রয়েছে। কোনও রকমে পালিয়ে এক জনপদে পৌঁছে সে জানতে পারল, তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামটি কলেরা বা ম্যালেরিয়ায় উজাড় হয়ে গিয়েছে। তাই সেখানে এখন ‘তেনাদের’ রাজত্ব।’ প্রচলিত এই গল্পে এককালে এদেশে মহামারীর ভয়াবহতা কিরূপ ছিল তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে সরাসরি মড়ক-মহামারীর কথা উল্রেখ নেই। তবে বৌদ্ধ ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সাধন সঙ্গীত হিসেবে রচিত চর্যাপদে রূপকের আশ্রয়ে সমকালীন দরিদ্র বাঙালির নিত্যদিনের অভাব, ক্ষুধা, দুঃখ-দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি-বেদনা-পীড়িত জীবনের করুণ চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে।
অতীতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপরযয়, দুরযোগ-দুর্বিপাক, -রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারীর নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীকে কল্পনা করা হতো এবং এসব থেকে বাঁচার জন্য পূজা-অর্চনাসহ নানাভাবে তাদের পরিতুষ্টিবিধানের চেষ্টা করতো অজ্ঞ-অসহায় সাধারণ মানুষ।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের আগে এই সব লৌকিক দেব-দেবীর কাল্টের উদ্ভবের সুবাদে তৈরি হয় দেবদেবী মহিমা-কীর্তনকারী কাহিনিকাব্য, পাঁচালি, ব্রতোপাখ্যান। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগের লোকজ বাংলা কাব্যে বিকাশ লাভ করে মঙ্গলকাব্য নামে একটি বিশিষ্ট সাহিত্য ধারা। মঙ্গলকাব্যে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি, মড়ক-মহামারী কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীর মাহত্মকথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন, বসন্তের দেবী শীতলাকে নিয়ে শীতলামঙ্গল কাব্য এবং কলেরা বা ওলাউঠার নিয়ন্ত্রণকারী দেবী হিসেবে দেবী ওলাইচণ্ডীকে নিয়ে উলামঙ্গল বা চন্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে। এসব কাব্যে শীতলা দেবী বা দেবী ওলাইচণ্ডীর উপাসনার মধ্যদিয়ে সেই সেময়ে বসন্ত, কলেরার মড়ক-প্রতিরোধ কামনারই কথা বলা হয়েছে।
যেমন, শীতলামঙ্গল কাব্যে দেখা যায়, শিবের পরম ভক্ত বিরাটরাজা লৌকিক দেবী শীতলাকে যথেষ্ট ভক্তি করতেন না, এই অপরাধে শীতলা দেবী বসন্তসহ নানা রোগব্যাধির এমন মহামারী লাগিয়ে দেন যে, রাজা শেষ পর্যন্ত নতিস্বীকার করে তার পুজা দিতে বাধ্য হন।
বঙ্গভূমি যেমন প্রকৃতির উদারহস্ত আশীর্বাদের ফলে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’, তেমনি আবার নানা প্রাকৃতিক-সামাজিক কারণে এখানে রোগবালাইয়ের আবির্ভাবও কম ঘটেনি। কলেরার মতো ভয়াল রোগ মহামারীরূপে বাংলায় দেখা তো দিয়েছে, এমনকি সাধারণ জ্বরজারির প্রকোপে গণমৃত্যুর ঘটনা এককালে দুর্লভ ছিল না। কলেরা বা জনমানসে ওলাওঠা বলে পরিচিত রোগের অভিঘাত পড়েছিল ব্যাপক আকারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এ নিয়ে বাংলা ভাষায় বড় উপন্যাস বা মহাকাব্য কখনো লেখা হয়নি।যেমনটি আমরা আমরা পাই আমেরিকায় রেড ডেথ মহামারীতে একটি জনপদ উজাড় হওয়ার পরে বেঁচে যাওয়া মানুষের জীবন-আখ্যান নিয়ে ১৯১২ সালে জ্যাক লন্ডন [১৮৭৬-১৯১৬] রচিত ‘দ্য স্কার্লেট প্লেগ’ উপন্যাসে। যেমন করে কালজয়ী হয়েছে ১৯৪৫ সালে আলবেয়ার ক্যামু [১৯১৩-১৯৬০] রচিত প্লেগ মহামারীকালে কোয়ারেন্টিনে অবরুদ্ধ ফরাসি-আলজেরিয় ওরাণ শহরের চার দেয়ালের ভেতর ঘটা আখ্যানভিত্তিক উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’। আলজেরিয়ার ওরাণ শহরে ইঁদুরের উপদ্রব হতে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ মহামারীতে মৃত্যুর মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়ে সূচিত ‘দ্য প্লেগ’ আজও সাহিত্যে কিংবদন্তী হয়ে আছে।অপরদিকে, ১৯৬৭ সালে নোবেলজয়ী স্পানিশ সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ রচিত ‘লাভ ইন দ্য টাইম অভ কলেরা’ উপন্যাসেও কলেরা মহামারীর চিত্র বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে নোবলজয়ী পর্তুগিজ সাহিত্যিক হোসে সারামাগো (১৯২২-২০১০) রচিত ‘ব্লাইন্ডনেস ’ উপন্যাসটিও মহামারী কালের চরিত্র বোঝার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত।বিশ্বসাহিত্যে সাড়া জাগানো কল্পবৈজ্ঞানিক উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টেইন’ এর লেখিকামেমরি শেলি ‘দ্য লাস্টম্যান’ উপন্যাস রচনা করে মহামারী নিয়ে ব্যাপক কৌতূহলের জন্ম দিয়েছেন। এ ছাড়া ,মহামারি নিয়ে আরেক বিখ্যাত উপন্যাস হোসে সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’।
তবে বাংলা কথাসাহিত্যে কাহিনীর মূল উপজীব্য হিসেবে না হলেও নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গে মড়ক-মহামাররি কথা বর্ণিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের অগ্রপথিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের সেলিনা হোসেনসহ শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যিকদের রচনায় বিশেষ করে কথা সাহিত্যে মড়ক-মহামারীর বর্ণনা পাই নানা প্রসঙ্গে-অনুষঙ্গে।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসে ১৭৭৬-এর মন্বন্তর এবং মন্বন্তরের সঙ্গী হিসেবেই মারি বা মড়কের বিবরণ পাওয়া যায়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের মন্বন্তর কালে সমগ্র বাংলায় কলেরা-বসন্ত মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। আনন্দমঠ উপন্যাসে এর বর্ননায় পাই : ‘১১৭৬ সালে গ্রীষ্মকালে একদিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল। গ্রামখানি গৃহময়, কিন্তু লোক দেখি না। বাজারে সারি সারি দোকান, হাটে সারি সারি চালা, পল্লীতে পল্লীতে শত শত মৃন্ময় গৃহ। মধ্যে মধ্যে উচ্চ-নীচ অট্টালিকা। আজ সব নীরব। বাজারে দোকান বন্ধ, দোকানদার কোথায় পালাইয়াছে ঠিকানা নাই। আজ হাটবার, হাটে হাট লাগে নাই। ভিক্ষার দিন, ভিক্ষুকেরা বাহির হয় নাই। তন্তুবায় তাঁত বন্ধ করিয়া গৃহপ্রান্তে পড়িয়া কাঁদিতেছে। ব্যবসায়ী ব্যবসা ভুলিয়া শিশু ক্রোড়ে করিয়া কাঁদিতেছে। দাতারা দান বন্ধ করিয়াছে। অধ্যাপকে টোল বন্ধ করিয়াছে; শিশুও বুঝি আর সাহস করিয়া কাঁদে না। রাজপথে লোক দেখি না, সরোবরে স্নাতক দেখি না, গৃহদ্বারে মনুষ্য দেখি না। বৃক্ষে পক্ষী দেখি না। গোচারণে গরু দেখি না। কেবল শ্মশানে শৃগাল-কুকুর।’ এরপরই দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ নানা অখ্যাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে কীভাবে ছোঁয়াচে রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছে সে প্রসঙ্গে লিখছেন -‘খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। ইতর ও বন্যেরা কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। রোগ সময় পাইল, জ্বর, ওলাওঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষতঃ বসন্তের প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না, মরিলেও কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে। যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে, সে গৃহবাসীরা রোগী ফেলিয়া পলায়।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবদ্দশায় ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, প্লেগের মতো প্রাণঘাতী বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে এসব মহামারীর জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথের গোরা ও চতুরঙ্গ উপন্যাসে এবং বিভিন্ন ছোটগল্পে কলেরা, প্লেগ, ম্যলেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি ও মহামারীর উল্রেখ করা হয়েছে। মহামারীর ছায়ার ভেতরেই রচিত হয়েছিল গোরা বা চতুরঙ্গের মত উপন্যাস ও গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো।
‘গোরা’ উপন্যাসে পালক পিতা-মাতার ঘরে কট্টর হিন্দু হিসেবে বড় হওয়া আইরিশ যুবক গৌরচাঁদ বা গোরা মড়কের সময় গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখতে পায় ও কষ্ট হলেও নিজের মনের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে দুর্যোগ-দুর্বিপাক বা মড়কের সময় বাংলার গ্রামে মুসলিম সমাজ যেমন তাদের ধর্মীয় শিক্ষাতেই একতাবদ্ধ, হিন্দু সমাজ জাতিভেদ প্রথার কারণে ঠিক ততটাই অনৈক্যে ভরা ও পরস্পরের প্রতি অসংবেদী।
‘গোরা’ উপন্যাসে হরিমোহিনীর বয়ানে পাই, “কলেরা হইয়া চারি দিনের ব্যবধানে আমার ছেলে ও স্বামী মারা গেলেন।”
‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে মহামারীর উল্লেখ রয়েছে। শচীশের কাকা কলকাতার প্লেগের সময় রোগীদের চিকিৎসার্থে তাদের বাড়িটিকে আরোগ্য-নিকেতন করে গড়ে তুলেছিলেন। কলকাতায় প্লেগের প্রসংগ ১৮৯০-এর দশকে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু লেখাতেই এসেছিল।
‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের উদার ও ঋজু চরিত্রের জ্যাঠামশাই জগমোহন প্লেগ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য তাদের বাড়িতে প্রাইভেট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।রোগীদের সেবা দিতে গিয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় : ‘পাড়ায় প্লেগ দেখা দিল। পাছে হাসপাতালে ধরিয়া লইয়া যায় এজন্য লোকে ডাক্তার ডাকিতে চাহিল না। জগমোহন স্বয়ং প্লেগ-হাসপাতাল দেখিয়া আসিয়া বলিলেন, ব্যামো হইয়াছে বলিয়া তো মানুষ অপরাধ করে নাই।’
জ্যাঠামশাইএর প্রাইভেট হাসপাতালে শচীশ, শ্রীবিলাস শুশ্রুষার কাজে নিয়োজিত ছিল, সঙ্গে ছিলেন জনৈক ডাক্তারও। যদিও তাদের ভাগ্য প্রসন্ন হয়নি। শ্রীবিলাসের উক্তি : ‘আমাদের হাসপাতালে প্রথম রোগী জুটিল একজন মুসলমান, সে মরিল। দ্বিতীয় রোগী স্বয়ং জগমোহন, তিনিও বাঁচিলেন না।
মহামারীর পদধ্বনি বেশি করে শোনা যায় তার ‘গল্পগুচ্ছে’। সেখানে গল্পের পর গল্পে পাত্র-পাত্রীরা মারী, মহামারী বা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত।
‘পোস্টমাষ্টার’ গল্পের পোস্টমাস্টার একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বেশ ভালো জ্বর আসল তার গায়ে। পরিবার পরিজনহীন বিভূয়ে অবস্থা এমনই দাঁড়ালো যে গৃহপরিচারিকা বালিকা রতনকেই তার সেবা-শুশ্রূষার ভার নিতে হলো। সেই জ্বর সাধারণ জ্বর নয়। অনেক দিন ধরে বলেছিল এই সেবাকার্য। লেখক জানিয়েছেন, ‘বহুদিন পরে পোস্টমাস্টার ক্ষীণ শরীরে রোগশয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিলেন’ এবং ‘মনে স্থির করিলেন, আর নয়, এখান হইতে কোনোমতে বদলি হইতে হইবে।’ কর্তৃপক্ষকে যে-চিঠি লিখলেন তাতে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন ‘স্থানীয় অস্বাস্থ্যের কথা’। লেখকের বিবরণ শুনে ধারণা হয় যে ম্যালেরিয়া জ্বরের কবলেই তখন পড়েছিলেন পোস্টমাস্টার । ‘এই ঘোর প্রবাসে রোগযন্ত্রণায় স্নেহময়ী নারী-রূপে জননী ও দিদি পাশে বসিয়া আছেন এই কথা মনে করিতে ইচ্ছা করে এবং এ স্থলে প্রবাসীর মনের অভিলাষ ব্যর্থ’ হয় নাই। বালিকা রতন ‘আর বালিকা রহিল না। সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথা সময়ে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাঁধিয়া দিল এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি?” তারপরে স্থানীয় মারী-মহামারীর ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে আমাদের শহরের আধমরা ‘ভদ্রসন্তান’ কী করে সমস্ত মায়া-দায়িত্ব ছিন্ন করে রতনকে পল্লীগ্রামের অন্ধকারে রেখে নতুন কর্মক্ষেত্রে চলে গেলেন, সে কথা সকলেরই জানা।
ব্যাধির কালো প্রভাব রবীন্দ্রনাথের অনেক বিখ্যাত ছোটগল্পের নেপথ্যে কাজ করেছে। ‘ছুটি’ গল্পে ফটিক হঠাৎ করে জ্বরে পড়ল। সেই জ্বর এমনই তা ক্রমেই বেড়ে চলল। ডাক্তার এসে বললেন, ‘অবস্থা বড়ই খারাপ।’ এভাবেই এক-পর্যায়ে ফটিক অনন্ত ছুটির অবকাশে চলে গেল।
‘সম্পাদক’ গল্পে মূল চরিত্রটি লেখক। নিজের লেখালেখি নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলেন মা-মরা একমাত্র মেয়েটির প্রতি তাকানোরও ফুরসুৎ ছিল না তার। মেয়েটির নাম প্রভা, সে বাবার অযত্নে মানুষ। একবার লেখার সময় প্রভা স্নান-করার কথা বলাতে লেখক হুংকার দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন যা, এখন বিরক্ত করিস নে।’ সেই থেকে প্রভা নিজের খেলার জগতেই থাকে। গল্পের শেষটায় আমরা প্রভাকে অসুস্থ অবস্থায় দেখি: ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পেও হরসুন্দরীর জ্বর হয়েছে, কিন্তু এবারে স্পষ্ট যে ম্যালেরিয়াই হয়েছে তার। ‘জ্বর আর কিছুতেই ছাড়িতে চাহে না। ডাক্তার যতই কুইনাইন দেয় বাধাগ্রস্ত প্রবল স্রোতের ন্যায় জ্বরও তত ঊর্ধ্বে চড়িতে থাকে। এমনি বিশ দিন, বাইশ দিন, চল্লিশ দিন পর্যন্ত ব্যাধি চলিল।’ হরসুন্দরী একপর্যায়ে ভালো হলো বটে, কিন্তু তার যৌবনের সৌন্দর্যদীপ এই রোগের আক্রমণে চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেল। সন্তান ধারণের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিল। দ্বিতীয়বার বিয়ে করল তার স্বামী নিবারণ। কিন্তু দ্বিতীয় স্ত্রী শৈলবালাও মারা গেল- অবশ্য মহামারীতে নয়, গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতায়।
‘দৃষ্টিদান’ গল্পে দৃষ্টিহারা কুমু শুনেছে যে তার ডাক্তার স্বামীর কাছে এক ‘বৃদ্ধ মুসলমান তাহার পৌত্রীর ওলাওঠার চিকিৎসার জন্য’ এসেছেন।
আরেকটি বিখ্যাত গল্প ‘মাল্যদান’-এ সরাসরি প্লেগের প্রসংগ টেনেছেন রবীন্দ্রনাথ। মাল্যদান যে-সময়ে লেখা সে সময়ে কোলকাতা শহরে প্লেগের আক্রমণ হচ্ছিল মাঝে মাঝেই। লেখক জানিয়েছেন যে, ‘পটলের স্বামী হরকুমার বাবু ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট…প্লেগের ভয়ে বালিতে একটি বাগানবাড়ি ভাড়া লইয়া থাকেন, সেখান হইতে কলিকাতায় যাতায়াত করেন।’
অপরদিকে এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘কুড়ানিকে’ও বাঁচানো যায়নি প্লেগ থেকে। ‘মাল্যদান’ গল্পে কুড়ানিকে খোঁজার প্রসঙ্গে আছে, “সেবারে প্লেগ-দমনের বিভীষিকায় এত লোক এত দিকে পলায়ন করিতেছিল যে, সেই-সকল পলাতকদলের মধ্য হইতে একটি বিশেষ লোককে বাছিয়া লওয়া পুলিসের পক্ষে শক্ত হইল।” গল্পের নায়ক যতীনও ছিলেন প্লেগ হাসপাতালের ডাক্তার।
‘হৈমন্তী’ গল্পে হৈমন্তীর শক্ত অসুখ করেছিল। তারপরও সে বাপের বাড়ি যেতে পারেনি। তার বাবাকে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে যেতে হয়েছিল। কথোপকথনটি এরকম :’বউমার শরীর ভালো নাই! এত বড়ো অন্যায় অপবাদ। শ্বশুরমশায় স্বয়ং একজন ভালো ডাক্তার আনিয়া পরীক্ষা করাইলেন। ডাক্তার বলিলেন, “বায়ু পরিবর্তন আবশ্যক, নহিলে হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামো হইতে পারে।” বাবা হাসিয়া কহিলেন, হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামো তো সকলেরই হইতে পারে। এটা কি আবার একটা কথা।” আমার শ্বশুর কহিলেন, “জানেন না তো উনি একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার, উঁহার কথাটি কী-” বাবা কহিলেন, “অমন ঢের ডাক্তার দেখিয়াছি। দক্ষিণার জোরে সকল পন্ডিতেরই কাছে সব বিধান মেলে এবং সকল ডাক্তারেরই কাছে সব রোগের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।”
‘ভাইফোটা’ গল্পটিতে মারণাত্মক ব্যাধির প্রসংগ এসেছে বাল্যকালের বন্ধু অনুসূয়ার সম্পর্কের সূত্র ধরে। গল্পের বর্ণনাকারীর সাথে বিয়ের সম্বন্ধ হওয়ার আগেই অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় অনুসূয়ার। কিছুদিন পরে লেখক শুনতে পেলেন যে ‘অনু একটি ছেলে লইয়া বিধবা’ হয়েছে। অনুর স্বামী মরবার আগে কিছু ধন-সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন। ব্যবসায় পুঁজির আশায় লেখক যান অনুসূয়ার সাথে দেখা করতে। বিবরণীটি এরকম :
‘স্বামীর সঙ্গে মফস্বলে ফিরিবার সময় বার বার ম্যালেরিয়া জ্বরে পড়িয়া অনুর এখন এমন দশা যে ডাক্তাররা ভয় করিতেছে, তাকে ক্ষয়রোগে ধরিয়াচে।…আমি গিয়া দেখিলাম, অনুর রোগটি তাকে এই পৃথিবী হইতে তফাত করিয়া দিয়াছে। আমি যেন তাকে অনেক দূর হইতে দেখিতেছি। তার দেহখানি একেবারে স্বচ্ছ হইয়া ভিতর হইতে একটি আভা বাহির হইতেছে। যা-কিছু স্থূল সমস্ত ক্ষয় করিয়া তার প্রাণটি মৃত্যুর বাহির দরজায় স্বর্গের আলোতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।’ তাঁর ‘দুর্বুদ্ধি’ এবং ‘দিদি’ গল্পে এক বালিকা ও এক নারী কলেরায় মারা যায়, দুজনের নামই শশী। ‘শেষের রাত্রি’ গল্পের নায়ক যতীনের মৃত্যু হয় দুরারোগ্য ব্যাধিতে।
রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন চিঠিপত্রেও কলতার প্লেগের প্রসঙ্গ এসেছে।পদ্মা বোট থেকে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখেছিলেন, ‘কলকাতায় প্লেগ ত খুব জেগে উঠচে। আপনার বুঝি স্থানত্যাগ করতে সম্মত নন?’
এ প্রসংগে নিবেদিতার কথাও উল্লেখ করা যায়। বিবেকানন্দের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে মিস মার্গারেট নোবল আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন। বিবেকানন্দর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। বিবেকানন্দ ওর নাম দেন- ‘নিবেদিতা’। নিবেদিতা যখন ১৮৯৮ সালে কলকাতায় পা রাখলেন, তখন চতুর্দিকে প্লেগের পদধ্বনি। ১৮৯৯ সালে বোম্বাই শহরে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দাঙ্গাও হয়। কলকাতা তথা বঙ্গদেশেও এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি। ‘নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ : এক বিতর্কিত সম্পর্কের উন্মোচন’ বইতে দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত জানিয়েছেন যে, ‘পূর্ববঙ্গের দুর্ভিক্ষে অমানুষিক সেবাকাজ চালিয়ে কলকাতায় ফিরে নিবেদিতা ম্যালেরিয়া ও “ব্রেন ফিভারে” [সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া অথবা এন্কেফেলাইটিস] শয্যাশায়ী।’ সেসময় মানে ১৯০৬ সাল। রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী অবলা বসুকে লিখেছিলেন- ‘নিবেদিতা যে আপনার ওখানে পীড়িত অবস্থায় তাহা আমি জানিতাম না – আমি একখানা বই চাহিয়া তাঁহাকে কলিকাতার ঠিকানায় কয়েকদিন হইল পত্র লিখিয়াছি। আপনি দয়া করিয়া এমন ব্যবস্থা করিবেন যে, পত্রের যেন তিনি কোন নোটিস না লন। তাঁহাকে আমার সাদর নমস্কার জানাইবেন এবং বলিবেন যে, উৎসুক চিত্তে তাঁহার আরোগ্য প্রত্যাশায় রহিলাম।’
মহামারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনুভূত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তির’ প্রবন্ধমালায় -স্বদেশী সমাজ, লোকহিত প্রভৃতি প্রবন্ধে, এমনকি তার এই সময়কার দেশাত্মবোধক গানের বিচ্ছিন্ন চরণে। রোগক্লিষ্ট আর্তমানবতার বেদনাকে অনন্ত শক্তির বোধে রূপান্তরের জন্যই রচিত হয় তার নৈবেদ্য ও গীতাঞ্জলি পর্বের কবিতা ও সংগীত। মারী ও মহামারী তার সৃষ্টিশীলতাকে মানবতাবাদের দিকে প্রভাবিত করেছে।
রবীন্দ্রনাথ ‘ওলাওঠার বিস্তার’ নামে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধও লিখেছি্লেন। এই প্রবন্ধে তিনি জানাচ্ছেন, “ভারতবর্ষ যে ওলাওঠা রোগের জন্মভূমি, এ সম্বন্ধে সন্দেহ অতি অল্পই আছে। ১৮১৭ খৃস্টাব্দে এই ভীষণ মড়ক বঙ্গদেশ হইতে দিগ্বিজয় করিতে বাহির হইয়া সিন্ধু, য়ুফ্রাটিস, নীল, দানিয়ুব, ভল্গা, অবশেষে আমেরিকার সেন্ট লরেন্স এবং মিসিসিপি নদী পার হইয়া দেশবিদেশে হাহাকার ধ্বনি উত্থিত করিয়াছিল।”
সে সময়ে বৃটিশ শাসিত এদেশে সরকারি উদ্যোগে জনস্বাস্থ্য রক্সায় গৃহীত উদ্যোগ ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। ফলে মড়ক-মহামারী খুব সহজেই বিস্তার ঘটেছে।বিষটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন প্রবন্ধ ও চিঠিপত্রে লেখালেখি করেন।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘স্বদেশী সমাজ’ পর্বের বিভিন্ন প্রবন্ধে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি চেয়ে আলোচনা করেছেন নানা প্রসংগ ক্রমে। রাস্তা নির্মাণ, পুকুর খনন, পানীয় জলের ব্যবস্থা, স্টু্কল, পয়ঃনিস্কাষন ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এসবের প্রতিটি ক্ষেত্রেই শুধু সরকারবাহাদুর বা বিত্তবান শ্রেণীর ওপরে নির্ভর না করে জনগণ নিজেরাই এগিয়ে আসুক-অর্থাৎ এক ধরনের ‘পার্টিসিপেটরি ডেভেলপমেন্ট’ ঘটুক, এটা রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন। ১৯১৫ সালে অতুল সেনকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি পল্লী-উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকিকে গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন:
‘পতিসরে আমি কিছুকাল হইতে পল্লীসমাজ গড়িবার চেষ্টা করিতেছি, যাহাতে দরিদ্র চাষি প্রজারা নিজেরা একত্র মিলিয়া নিজেদের দারিদ্র্য অস্বাস্থ্য ও অজ্ঞান দূর করিতে পারে। নিজের চেষ্টায় রাস্তাঘাট নির্মাণ করে, এই আমার অভিপ্রায়।…[তবে] গ্রামে ওলাওঠা ব্যাপ্ত হইয়া পড়িতেছে- আমি স্বয়ং উপস্থিত থাকিলে তাহার ভালরূপ প্রতিকার হইতে পারিবে। এমন অবস্থায় আমি কাহার খাতিরে একদিনও যদি বিলম্ব করি তবে অপরাধ হইবে।’ এ ধরনের জন-প্রচেষ্টার রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। গান্ধীর স্বরাজ আন্দোলন রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজ আন্দোলন থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিল- এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। গান্ধী এ প্রসংগে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘My Swaraj movement is the natural child of your Swadeshi movement.” আজকে এই করোনাকালের দুর্যোগ মোকাবেলায় জনগণের ‘নিজস্ব স্বাধীন উদ্যোগকে’ তাই গুরুত্ব দেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে। দল-মত নির্বিশেষে স্থানীয় পর্যায়ে জরুরী ত্রাণ ও স্বাস্থ্য কমিটি এবং নাগরিক উদ্যোগ গ্রহণ করা ছাড়া শুধু সরকারী দল, রাষ্ট্রতন্ত্র এবং কর্পোরেট প্রাইভেট সেক্টরের ওপরে নির্ভর করে করোনা পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।
পদ্মাপারের পতিসরেই ১৮৯৪ সালে (অর্থাৎ ছিন্নপত্রের পর্বেই) লিখিত হয় তার বিখ্যাত ‘এবার ফেরার মোরে কবিতা, যেখানে তিনি জনস্বাস্থ্যের কথা বললেন বড় করে : ‘বড়ো দুঃখ, বড়ো ব্যথা-সম্মুখেতে কষ্টের সংসার
বড়োই দরিদ্র, শূন্য, বড়ো ক্ষুদ্র, বদ্ধ অন্ধকার। অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু, চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু,সাহস বিস্তৃত বক্ষপট। এ দৈন্য-মাঝারে কবি, একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি।’
১৯২৬ সালে ময়মনসিংহে এসে রবীন্দ্রনাথ যে-ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি ‘ত্যাগের ভিক্ষা’ চেয়েছিলেন তার স্বদেশবাসীর কাছে। তার বক্তব্য ছিল এরকম : “কেন তৃষ্ণার্তের কান্না গ্রীষ্ফ্মের রৌদ্রতপ্ত আকাশ ভেদ করে ওঠে? কেন এত ক্ষুধা, অজ্ঞানতা মারী? সমস্ত দেশের স্বাভাবিক প্রাণচেষ্টার গতি রুদ্ধ হয়ে গেছে। যেমন আমরা দেখতে পাই, যেখানে নদী-স্রোতের প্রবাহ ছিল সেখানে নদী যদি শুস্ক হয়ে যায় বা স্রোত অন্যদিকে চলে যায়, তবে দুকূল মারীতে দুর্ভিক্ষে পীড়িত হয়ে পড়ে।…প্রাণের ক্ষেত্র যেখানে, জাতি যেখানে জন্মলাভ করেছে, সমাজের ব্যবস্থা হয় যেখানে, সেই পল্লীর প্রাণকে প্রকাশিত করো- তা হলেই আমি বিশ্বাস করি সমস্ত সমস্যা দূর হবে।’
গত শতাব্দীর প্রারম্ভে গুটিবসন্তে ভারতবর্ষে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে। এই মহামারিতে প্রাণ হারায় অগণিত মানুষ। রবীন্দ্রনাথের ‘অভিসার’ কবিতায় রাজনর্তকী বাসবদত্তা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল। কবির ভাষায়- ‘নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ/রোগমসী-ঢালা কালি তনু তার/লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখার/বাহিরে ফেলেছে করি পরিহার বিষাক্ত তার সঙ্গ।’ সন্ন্যাসী উপগুপ্ত এই দুঃসময়ে সেবা করে বাসবদত্তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।
‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতায় পুরাতন ভৃত্য কেষ্টার মৃত্যুও হয়েছিল গুটিবসন্তে আক্রান্ত মনিবকে মনপ্রাণ দিয়ে সেবাযত্নের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলার পর।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখেছেন, “শ্যামসুন্দর চলে গেল, রাধিকা গোঁসাই সমাজে কাজ নিলে, আর আসে না কেউ, দিনু তখন গানবাজনা করে, কলকাতায় প্লেগ, মহামারী, তার পরে এল স্বদেশী হুজুগ। ঠিক কিসে যে আমার বাজনাটা বন্ধ হল তা মনে পড়ছে না।“ (‘ঘরোয়া’)
তাঁর মেয়ে প্লেগে মারা যান। ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’-তে সেই সময়টা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, “সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারি চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্সপেক্শনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল। সেই প্লেগ লাগল আমারও মনে। ছবি আঁকার দিকে না ঘেঁষে আরো গানবাজনায় মন দিলুম। চারদিকে প্লেগ আর আমি বসে বাজনা বাজাই। হবি তো হ, সেই প্লেগ এসে ঢুকল আমারই ঘরে। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে গেল। ফুলের মতন মেয়েটি ছিল, বড় আদরের। আমার মা বলতেন, ‘এই মেয়েটিই অবনের সবচেয়ে সুন্দর।’ ন-দশ বছরের মেয়েটি আমার টুক করে চলে গেল; বুকটা ভেঙে গেল। কিছুতে আর মন যায় না। এ বাড়ি ছেড়ে— চৌরঙ্গিতে একটা বাড়িতে আমরা পালিয়ে গেলুম।” (চলবে)
অপরাজেয় কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন উপন্যাসে মড়ক-মহামারীর কথা বর্ণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই শ্রীকান্ত উপন্যাসের কথা বলা যেতে পারে। পুরো উপন্যাস জুড়েই মহামারী, মারী বা জনস্বাস্থ্য নিয়ে দুর্বিপাকের কথা ছড়িয়ে আছে। শ্রীকান্ত উপন্যাসে আমরা চার চারটি মারণ-ব্যাধির উল্লেখ পাই- কলেরা, প্লেগ,,বসন্ত ও ম্যালেরিয়া।
এ উপন্যাসের প্রথম পর্বে শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনাথের রোমাঞ্চকর নৈশ- নৌঅভিযাত্রা কালে কলেরার মড়কে প্রাণ হারানো এক অজ্ঞাত পরিচয় শিশুর লাশ দেখতে পায় তারা- “কিছুক্ষণ হইতে কেমন একটা দুর্গন্ধ মাঝে মাঝে হাওয়ার সঙ্গে নাকে আসিয়া লাগিতেছিল…। নাকে কাপড় চাপা দিয়া বলিলাম, নিশ্চয় কিছু পচেছে, ইন্দ্র!
ইন্দ্র বলিল, মড়া। আজকাল ভয়ানক কলেরা হচ্ছে কিনা! সবাই ত পোড়াতে পারে না- মুখে একটুখানি আগুন ছুঁইয়ে ফেলে দিয়ে যায়। শিয়াল-কুকুরে খায় আর পচে। তারই অত গন্ধ।”
এরপর কলেরায় মৃত সেই অজ্ঞাতপরিচয় শিশুটির লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করার এক মানবিক কাহিনী বর্ণিত হতে দেখা যায়। ইন্দ্রনাথ সেই ছয়-সাত বছরের শিশুর মৃতদেহটিকে ডিঙিতে তুলে দূরের চরের ঝাউবনের মধ্যে ফেলে রেখে এলো। তখনই আসে জাত-পাতের প্রশ্ন : “কুণ্ঠিত হইয়া যেই জিজ্ঞাসা করিলাম- কি জাতের মড়া- তুমি ছোঁবে? ইন্দ্র সরিয়া আসিয়া একহাত তাহার ঘাড়ের তলায় এবং অন্যহাত হাঁটুর নীচে দিয়া একটা শুস্ক তৃণখণ্ডের মত স্বচ্ছন্দে তুলিয়া লইয়া কহিল… মড়ার কি জাত থাকে রে? আমি তর্ক করিলাম, কেন থাকবে না?
ইন্দ্র কহিল, আরে এ যে মড়া। মড়ার আবার জাত কি? এই যেমন আমাদের ডিঙিটা- এর কি জাত আছে? আমগাছ, জামগাছ যে কাঠেরই তৈরি হোক- এখন ডিঙি ছাড়া একে কেউ বলবে না- আমগাছ, জামগাছ- বুঝলি না? এও তেমনি।”
যে সময়ের কথা- সে সময়ে সনাতন সংস্কার অনুযায়ী কোন জাতের মানুষের মৃতদেহ, সে ছোঁয়াচে রোগে বা অন্য কিছুতে মরেছে কিনা তা না জেনে মৃতদেহের সংস্কার করা যেত না। কিন্তু ইন্দ্রনাথ জাত-পাতের বিচার না করে মানবিক তাগিদে সেই ছয়-সাত বছরের শিশুর মৃতদেহটিকে ডিঙিতে তুলে দূরের চরের ঝাউবনের মধ্যে ফেলে রেখে আসে ।
শ্রীকান্ত উপন্যাসের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে মহামারী অথবা গুরুতর ব্যাধি প্রবেশ করেছে। রাজলক্ষ্মীকে যখন পাঠকদের সামনে পরিচয় করানোর উপক্রম চলছে, তখন লেখক তার বাল্যকালের সখীকে স্মরণ করছে এভাবে- ‘স্বামী-পরিত্যক্তা মা সুরলক্ষ্মী ও রাজলক্ষ্মী দুই মেয়ে লইয়া বাপের বাড়ি চলিয়া আসে। ইহার বয়স তখন আট-নয় বৎসর, সুরলক্ষ্মীর বারো-তেরো। ইহার রঙটা বরাবর ফর্সা; কিন্তু ম্যালেরিয়া ও প্লীহায় পেটটা ধামার মত, হাত-পা কাঠির মত, মাথার চুলগুলো তামার শলার মত-কতগুলি তাহা গুনিয়া বলা যাইত।’
অন্যের শুশ্রূষা করতে গিয়ে শ্রীকান্ত নিজেও একবার মহামারীর কবলে পড়েছিলেন। তাকে অচেতন জ্বরে রেখে সঙ্গী-সাথীরা সবাই সে জায়গা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কোন মতে পিয়ারী বাইজী তথা রাজলক্ষ্মীর কাছে খবর পৌঁছানোতে তারই সেবা-যত্নে লেখক ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠেন। সেবারে প্লেগ বা কলেরা নয়, উঠে আসে আরেক মহামারীর কথা : ‘সকাল বেলা শোনা গেল, আরও পাঁচ-সাতখানি গ্রামের মধ্যে তখন বসন্ত মহামারীরূপে দেখা দিয়েছে।’ অন্যত্র, লেখক স্মরণ করছেন যে, এরই মধ্যে জীবনের সুখ-দুঃখগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে সাধারণ মানুষ :
‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে প্লেগ মহামারীর কখা আমরা জানতে পাই। রাজলক্ষ্মীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বর্মাদেশে (মিয়ানমার) যাচ্ছে শ্রীকান্ত। কলকাতার জাহাজঘাটায় পৌঁছে দেখতে পায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে চৌদ্দ-পনেরো শ’ মানুষ। শ্রীকান্ত তাদের কাছ থেকেই জানতে পারে প্লেগের কথা।
“একজন হিন্দুস্থানীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, বাপু, বেশ তো সকালে বসেছিলে, হঠাৎ এমন কাতার দিয়ে দাঁড়ালে কেন?
সে কহিল, ডগদরি হোগা?
ডগদরি পদার্থটি কী বাপু?
লোকটি পিছনের একটা ঠেলা সামলাইয়া বিরক্তমুখে কহিল, আরে, পিলেগকা ডগদরি।”
এই ‘পিলেগ’ যে আসলে প্লেগ, তা তখনো বোঝেনি শ্রীকান্ত। কিছুক্ষণ পরে অবশ্য সে আরও খোঁজখবর করে জানতে পারে- “বর্মায় এখনও প্লেগ যায় নাই, তাই এই সতর্কতা। ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া পাশ করিলে তবেই সে জাহাজে উঠিতে পাইবে।”
প্লেগের পরীক্ষা কেমন, তাও প্রত্যক্ষ করে শ্রীকান্ত। যেমন : “সকলেই অবগত আছেন, প্লেগ রোগে দেহের স্থান বিশেষ স্ফীত হইয়া উঠে। ডাক্তারসাহেব যেরূপ অবলীলাক্রমে ও নির্বিকার-চিত্তে সেই সকল সন্দেহমূলক স্থানে হস্ত প্রবেশ করাইয়া স্ফীতি অনুভব করিতে লাগিলেন, তাহাতে কাঠের পুতুলেরও আপত্তি হইবার কথা।”
শ্রীকান্ত উপন্যাসের এই পর্বেই আমরা প্রথম ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দটির সাথে পরিচিত হই। জাহাজ যেদিন রেঙ্গুন পৌঁছবে সেদিনই সকালে শ্রীকান্ত দেখল যে, সমস্ত লোকের মুখে ভয় ও চাঞ্চল্য। শরৎচন্দ্রের বর্ণনায় : “পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুন পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফূট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা quarantine : তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়।”
রেঙ্গুন সরকারের নিয়ম অনুসারে নতুনদের কিছুদিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়, যদিও সেই আইন কুলিদের জন্যই, ভদ্রলোকের জন্য নয়। যেমন : “যে-কেহ জাহাজের ভাড়া দশ টাকার বেশি দেয় নাই, সেই কুলি।’ জনৈক ডাক্তার শ্রীকান্তকে জানান, ‘Quarantine-এ নিয়ে যেতে এরা মানুষকে এত কষ্ট দেয় যে গরু-ছাগল-ভেড়াকেও এত কষ্ট সইতে হয় না।”
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পণ্ডিতমশাই’ উপন্যাসেও মহামারির প্রসঙ্গ এসেছে। গ্রামের একমাত্র পুকুরে কলেরা রোগীর পোশাক ধোওয়া হতে থাকে পণ্ডিতমশাই বৃন্দাবনের চোখের সামনে। এই পুকুর সারা গ্রামের জলের চাহিদা যোগায়। ফলে সেই জল পান করে গ্রামে মড়ক লাগে। তিনি গ্রামে কলেরা দূর করতে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করছেন। শরৎচন্দ্রের লেখায় : ‘সেদিন তারিণী মুখুয্যের দুর্ব্যবহারে ও ঘোষাল মহাশয়ের শাস্ত্রজ্ঞান ও অভিসম্পাতে অতিশয় পীড়িত হইয়া বৃন্দাবন গ্রামের মধ্যে একটা আধুনিক ধরনের লোহার নলের কূপ প্রস্তুত করাইবার সঙ্কল্প করে। যাহার জল কোন উপায়েই কেহ দূষিত করিতে পারিবে না এবং যৎসামান্য আয়াস স্বীকার করিয়া আহরণ করিয়া লইয়া গেলে সমস্ত গ্রামবাসীর অভাব মোচন করিয়া দুঃসময়ে বহু পরিমাণে মারীভয় নিবারণ করিতে সক্ষম হইবে…।’ কিন্তু ঠিক তখনই ঘরে তাঁর মা কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। নিজের সন্তানকেও কলেরায় হারান পণ্ডিতমশাই।
তার ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসের কাহিনীতে ম্যালেরিয়া ম্যালেরিয়া কখনো প্রকাশ্যে, কখনো আড়ালে-আবডালে উঁকি দিয়ে গেছে। পল্লীসমাজের কেন্দ্রীয় চরিত্র রমেশ। আদর্শবাদী এই যুবক গ্রামের ভালো করতে চায়। সে জাতপাতের প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে; হিন্দু ও মুসলমান সব ধর্মের গরিব কৃষককে নিয়ে গ্রামাঞ্চলের জনস্বাস্থ্য-বিধি পরিবর্তন করতে চায়। এমনকি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও মানুষের মধ্যে জনস্বাস্থ্য-সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে চায়। আর এটা করতে গিয়ে সনাতনী হিন্দুপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয় তাকে।
‘বর্ষা শেষ হইয়া আগামী পূজার আনন্দ এবং ম্যালেরিয়াভীতি বাঙ্গালার পল্লী-জননীর আকাশে, বাতাসে এবং আলোকে উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল, রমেশও জ্বরে পড়িল। গত বৎসর এই রাক্ষসীর আক্রমণকে সে উপেক্ষা করিয়াছিল; কিন্তু এ বৎসর আর পারিল না।…তিন দিন জ্বরভোগের পর আজ সকালে উঠিয়া খুব খানিকটা কুইনিন্ গিলিয়া লইয়া ভাবিতেছিল, গ্রামের এই সমস্ত অনাবশ্যক ডোবা ও জঙ্গলের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীকে সচেতন করা সম্ভব কি না। এই তিন দিন মাত্র জ্বরভোগ করিয়াই সে স্পষ্ট বুঝিয়াছিল, যা হউক কিছু একটা করিতেই হইবে। মানুষ হইয়া সে যদি নিশ্চেষ্টভাবে থাকিয়া প্রতি বৎসর মাসের পর মাস এই রোগভোগ করিতে দেয়, ভগবান তাহাকে ক্ষমা করিবেন না। সে এইটুকু বুঝিয়াছিল, ইহার ভীষণ অপকারিতা সম্বন্ধে গ্রামের লোকেরা যে একেবারেই অজ্ঞ তাহা নহে; কিন্তু পরের ডোবা বুজাইয়া এবং জমির জঙ্গল কাটিয়া কেহই ঘরের খাইয়া বনের মোষ তাড়াইয়া বেড়াইতে রাজী নহে।…রমেশ সন্ধান লইয়া জানিয়াছিল, এমন অনেক গ্রাম পাশাপাশি আছে যেখানে একটা গ্রাম ম্যালেরিয়ায় উজাড় হইতেছে, অথচ আর একটায় ইহার প্রকোপ নাই বলিলেই হয়।…তাহার নিশ্চিত ধারণা জন্মিয়াছিল এই ম্যালেরিয়াহীন গ্রামগুলির জল-নিকাশের স্বাভাবিক সুবিধা কিছু আছেই, যাহা এমনিই কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করিয়াও চেষ্টা করিয়া চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিলে লোক দেখিতে পাইবে। অন্তত তাহার নিতান্ত অনুরক্ত পিরপুরের মুসলমান প্রজারা চক্ষু মেলিবেই। তাহার ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা এতদিন পরে এমন একটি মহৎ কাজে লাগাইবার সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে মনে করিয়া সে মনে মনে প্রফুল্ল হইয়া উঠিল।’ এক হিসেবে, পাবলিক হেলথ্ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম অঘোষিত, অস্বীকৃত কর্মী ছিল পল্লীসমাজের রমেশ।
শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র সুরেশ প্লেগ আক্রান্ত অঞ্চলে মানুষের সেবা করতে গিয়ে নিজেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মাঝুলি নামের একটি গ্রামে প্লেগে কি ভয়াবহ দশা হয়েছিল তার করুণ চিত্র গৃহদাহ উপন্যাসে বিধৃত আছে। শরৎচন্দ্রের ‘পথেরদাবী’ উপন্যাসেও মহামারীর বর্ণনা আছে।
শরত্চন্দ্রের বিভিন্নর গল্পেও মড়ক-মহামারী প্রসঙ্গ এসেছে।তার ‘লালু’ গল্পে ইন্দ্রনাথের মতো এমন আরেক সাহসী ও পরোপকারী ব্যক্তির দেখা মেলে, নাম তার গোপালখুড়ো। তার মতে, কলেরা রোগীর সেবা করার ‘চেয়ে পুণ্যকর্ম সংসারে নেই’। কলেরার ভয়াবহতা ও তার বিরুদ্ধে লড়া গোপালখুড়োর চরিত্র শরৎচন্দ্র অঙ্কন করেছেন এভাবে: ‘আমাদের শহরে তখন শীত পড়েছে, হঠাত্ কলেরা দেখা দিলে। তখনকার দিনে ওলাউঠার নামে মানুষে ভয়ে হতজ্ঞান হতো। কারও কলেরা হয়েছে শুনতে পেলে সে-পাড়ায় মানুষ থাকতো না। মারা গেলে দাহ করার লোক মেলা দুর্ঘট হতো। কিন্তু সে দুর্দিনেও আমাদের ওখানে একজন ছিলেন যাঁর কখনো আপত্তি ছিল না। গোপালখুড়ো তাঁর নাম, জীবনের ব্রত ছিল মড়া-পোড়ানো। কারও অসুখ শক্ত হয়ে উঠলে তিনি ডাক্তারের কাছে প্রত্যহ সংবাদ নিতেন। আশা নেই শুনলে খালি পায়ে গামছা কাঁধে তিনি ঘণ্টা-দুই পূর্বেই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেন।’
জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে মহামারির বর্ণনা এসেছে। উপন্যাসের নায়ক সত্যচরণের মুখে সেই বিবরণ : ‘সেবার শুয়োরমারি বস্তিতে ভয়ানক কলেরা আরম্ভ হইল, কাছারিতে বসিয়া খবর পাইলাম। শুয়োরমারি আমাদের এলাকার মধ্যে নয়, এখান থেকে আট-দশ ক্রোশ দূরে, কুশী ও কলবলিয়া নদীর ধারে। প্রতিদিন এত লোক মরিতে লাগিল যে, কুশী নদীর জলে সর্বদা মড়া ভাসিয়া যাইতেছে, দাহ করিবার ব্যবস্থা নাই।’
কাছারির কিছু লোককে সঙ্গী করে সত্যচরণ সেই বস্তিতে যায়, ভেবেছিল, ‘এইসব ডাক্তার-কবিরাজশূন্য স্থানে দেখি যদি কিছু উপকার করিতে পারি।’ সেখানে রাজু পাঁড়েও উপস্থিত ছিল, সে সত্যচরণকে বাড়িগুলি ঘুরিয়ে দেখায়। সত্যচরণের কথায়, ‘কি ভয়ানক দারিদ্র্যের মূর্তি কুটিরে কুটিরে। সবই খোলার কিংবা খড়ে বাড়ি, ছোট্ট ছোট্ট ঘর, জানালা নাই, আলো-বাতাস ঢোকে না কোনো ঘরে। প্রায় সব ঘরেই দু-একটি রোগী, ঘরের মেঝেতে ময়লা বিছানায় শুইয়া। ডাক্তার নাই, ওষুধ নাই, পথ্য নাই।’
মুমূর্ষু স্বামীকে দেখবার কেউই নেই স্ত্রী ছাড়া। সেই কুটিরে গেছে সত্যচরণ। রোগীর তখন শেষ অবস্থা, শয্যার পাশে তার স্ত্রী। এমন সময় সত্যচরণের চোখে পড়ে : ‘তাকের উপর একটা আঢাকা পাথরের খোরায় দুটি পান্তা ভাত। ভাতের উপর দু-দশটা মাছি বসিয়া আছে। কী সর্বনাশ! ভীষণ এশিয়াটিক কলেরার রোগী ঘরে, আর রোগীর নিকট হইতে তিন হাতের মধ্যে ঢাকাবিহীন খোরায় ভাত।’
গ্রাম্য স্ত্রীলোকের খাদ্য সেই ভাতই। সত্যচরণ তাকে বলে, ‘যাও, এখুনি ফেলে আসো’। স্ত্রীলোকটি ভয়ে ভয়ে তা ফেলেও আসে। আরও কিছু বাড়িতে ঘুরে সত্যচরণ বুঝতে পারে, এখানে সংক্রামক রোগ ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। ভাগ্যে যার মৃত্যু আছে, তার হবেই। সেই মুমূর্ষু স্বামীটি তো আগেই মারা গেছিল, তার বউটিও একদিন মারা যায়। খবর শুনে নিজের আক্ষেপ জানাচ্ছে সে : ‘আমার মনে কষ্ট রহিয়া গেল যে, আমি তাহাকে তাহার মুখের অত সাধের ভাত দুটি খাইতে দিই নাই। ’
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যসে কলেরা মহামারীর প্রসঙ্গ পাই। উপন্যাসের নায়ক শিবনাথকে কলেরা আক্রান্তের সেবা করতে গিয়ে নানান বিরুদ্ধতার শিকার হতে হয়েছে। বৃন্দাবনের মতো একই দৃশ্য দেখতে হয়েছে তাকেও। ‘অস্পৃশ্য’দের সেবা করা নিয়েও হতে হয়েছে সামাজিক প্রতিরোধের শিকার। গ্রামের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র রেহাই দেয়নি।
তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে কলেরার বিস্তৃত উল্লেখ রয়েছে। নায়ক দেবনাথ যুবক সঙ্গীদের নিয়ে অনেক চেষ্টা করেছিল গ্রামে ছড়িয়ে-পড়া কলেরা রুখতে। তার ছোট ছেলেকেও ধরেছিল সংক্রমণ, সে-খবর দেবনাথ পায় প্রতিবেশিনী দুর্গার কাছে। লেখকের বর্ণনায় :
“হ্যাঁ, দুর্গাই। অন্ধকার পথের উপর আলো হাতে দুর্গাই দাঁড়াইল।
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে দুর্গা বলিল, ‘হ্যাঁ, বাড়ী এস শীগগির। খোকার অসুখ করেছে, একেবারে জলের মতন।’
দেবু বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো একলাফে পথে নামিয়া ডাকিল, ‘ডাক্তার!’
শুধু খোকা নয়, কলেরায় মারা যায় খোকার মা বিলুও। ‘দেবু পাথরের মত অশ্রহীন নেত্রে নীরব নির্বাক হইয়া সব দেখিল, বুক পাতিয়া নিদারুণ আঘাত গ্রহণ করিল। বিলুর সৎকার যখন শেষ হইল, তখন সূর্যোদয় হইতেছে।”
তারাশঙ্করের ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে দেখা যায় যে, ‘শিক্ষিত ছেলেরা’ বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা করে কলেরায় মৃত্যু আটকাতে চাইছে। কুয়ো খুঁড়তে কোদাল ঘাড়ে নিয়েছে। তাদের নাম হয়েছে ‘কোদালি ব্রিগেড। সেবাব্রতের সঙ্গী তারা। কলেরার মড়ক থেকে গ্রাম বাঁচাতে তৎপর। লেখক জানাচ্ছেন, ‘শুকনো পুকুরের তলায় কুয়ো কেটে তার জল বের করলে। তাই তো! কথাটা তো কারুর মনে হয়নি! স্যানিটারি ইনস্পেক্টরেরা পুকুরে ব্লিচিং পাউডার গুলে দিয়ে জলকে শোধন করলে। অ্যান্টি-কলেরা ভ্যাকসিন ইনজেকশন দিলে। কলেরার টিকে!’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের গাওদিয়া গ্রামে প্রায়ই মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়ত কলেরা, টাইফয়েড, কালাজ্বর ও বসন্তের মতো রোগগুলো।
নায়ক শশী নিজের গ্রামেই থেকে রোগ-পীড়িত দুঃখী মানুষগুলোর সেবা করতে চেয়েছিল।শশী তার সাধ্যের সীমা অবধি চেষ্টা করেছিল, কাউকে কাউকে সারিয়েও তুলেছিল, কিন্তু তার একার পক্ষে কতদূর সম্ভব? গ্রামের মানুষেরা নিমজ্জিত ছিল অশিক্ষায়, কুসংস্কারে। স্বাস্থ্যবিধির কোনো নিয়মই তারা জানত না, জানালেও পালন করত না। গাওদিয়ার বর্ষা ও বসন্ত ঋতু তাই সুন্দর ছিল না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর্দ্র-কর্দমাক্ত পল্লিকে দেখেছেন ‘জীবাণুর তীর্থ’ হিসেবে; শশী ডাক্তারের কাছে গাওদিয়া গ্রাম ছিল অনন্ত নরক-পর্যটন।
মহীয়সী বেগম রোকেয়ার রচনাতেও প্লে মহামারীরর কথা পাই। ‘সুলতানার স্বপ্ন’-তে বেগম রোকেয়া যে ইউটোপিয়ার দেশ নির্মাণ করেছেন তাতে মহামারির আসল কারণ বর্ণিত হয়েছে । সারার সঙ্গে গল্পের কথকের কথোপকথনের অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে – “ভারতের প্লেগ সম্বন্ধেও অনেক কথা হইল, তিনি বলিলেন, ‘প্লেগ- ট্লেগ কিছুই নহে—কেবল দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত লোকেরা নানা রোগের আধার হইয়া পড়ে। একটু অনুধাবন করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, গ্রাম অপেক্ষা নগরে প্লেগ বেশি—নগরের ধনী অপেক্ষা নির্ধনের ঘরে প্লেগ বেশি হয় এবং প্লেগে দরিদ্র পুরুষ অপেক্ষা দরিদ্র রমণী অধিক মারা যায়। সুতরাং বেশ বুঝা যায়, প্লেগের মূল কোথায়—মূল কারণ দেশে অন্নাভাব। আমাদের এখানে প্লেগ বা ম্যালেরিয়া আসুক তো দেখি!”
তাই তো, ধনধান্যপূর্ণা নারীস্থানে ম্যালেরিয়া কিংবা প্লেগের অত্যাচার হইবে কেন- “প্লীহা-স্ফীত উদর ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট বাঙ্গালায় দরিদ্রদিগের অবস্থা স্মরণ করিয়া আমি নীরবে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলাম।”
জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে কলেরার মড়ক এবং এ নিয়ে গ্রামবাংলার অজ্ঞ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের মধ্যে আবহমান কাল ধরে প্রচলিত অন্ধ বিশ্বাস ও সংস্কারের ইতিকথা বর্ণিত হয়েছে। হাজার বছর ধরে উপন্যাস থেকেই তা উদ্ধৃত করা যোক-
“ভর সন্ধ্যায় মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে এলো মকবুল। ….গায়ের ফতুয়াটা খুলতে খুলতে মকবুল বললো, বাপু তোমরা সক্কলে একটু সাবধানে থাইকো। ও বিন্তির মা, বঁইচির মা শোনো, তোমরা একটু সাবধানে থাইকো।
গেরামে ওলা বিবি আইছে।
ইয়া আল্লা মাপ কইরা দাও। আতঙ্কে সবাই শিউরে উঠলো।
গনু মোল্লা ওজু করছিলো, সেখানে থেকে মুখ তুলে প্রশ্ন করলো, কোন্হানে আইছে। ওলা বিবি? কোন্ বাড়িতে আইছে?
মকবুল বললো, মাঝি-বাড়ি।
মাঝি-বাড়ি? এক সঙ্গে বলে উঠলে সবাই। কয়জন পড়ছে?
তিনজন।…
বাড়ির সবাইকে আরেক প্রস্থ সাবধান করে দিলো বুড়ো মকবুল, তোমরা সক্কলে একডু হুইসারে থাইকো বাপু। একডু দোয়া দরুদ পাইড়ো।… বড় খারাপ দিন কাল আইছে বাপু। যেই বাড়িডার দিকে একবার নজর পড়ে সেই বাড়িডারে এক্কেবারে শেষ কইরা ছাড়ে ওলা বিবি। বড় খারাপ দিন-কাল আইছে।… ইতিমধ্যে মন্তু, সুরত ফিরে এসেছে।
কাঁধের উপর থেকে কুড়োলটা মাটিতে নাবিয়ে রাখতে না রাখতে টুনি একপাশে টেনে নিয়ে গেলো ওকে।
মাঝি-বাড়ি যাও নাই তো?
মন্তু ঘাড় নাড়লো, না, ক্যান কী অইছে।
টুনি বললো, ওলা বিবি আইছে ওইহানে। বলতে গিয়ে মুখখানা শুকিয়ে গেলো ওর।… মাঝি-বাড়ি থেকে করুণ বিলাপের সুর ভেসে এলো সেই মুহূর্তে। একজন বুঝি মারা গেলো। কলজেটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠলো মন্তুর। মাঝি-বাড়ির দেউড়িটা পেরিয়ে ভেতরে আসতে সারা দেহ কাঁটা দিয়ে উঠলো ওর। নন্তু শেখ মারা গেলো। হাঁপানি জর্জর করিম শেখ মৃত বাবার পাশে বসে কাঁদছে। আম্বিয়া কাঁদছে তার বিছানায় শুয়ে। ওলা বিবি তাকেও ভর করেছে। তাই বিছানা ছেড়ে ওঠার শক্তি পাচ্ছে না মেয়েটা। সেখান থেকে কাঁদছে সে।
দাওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে রইলো মন্তু।
মাঝি-বাড়ির ছমির শেখ ওকে দেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে উঠলো। এই কি মুছিবত আইলো মিয়া, আমরা বুঝি এইবার শেষ অইয়া যামু। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলো মন্তু। তারপর ওর কাছ থেকে বাকি খোঁজ-খবর নিলো সে। ছোট ভাই জমির শেখ কবিরাজ আনতে গেছে দুক্রোশ দূরে রতনপুরের হাটে। এখনো আসেনি; ভোরের আগে যে আসবে তারও কোনো সম্ভাবনা নেই। এই একটু আগে ছমির শেখ, পরিবারের ছেলেমেয়ে সবাইকে তার মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বুড়োরা মরে গেলেও ছেলেমেয়েগুলো যাতে বাঁচে। নইলে বাপ-দাদার ভিটার ওপর বাতি দিবার কেউ থাকবে না। ছমির শেখের দুগণ্ড বেয়ে পানি ঝরছে। তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজের চোখজোড়াও ভিজে এলো ওর। আম্বিয়ার ঘরের দিকে তাকাতে দেখলো, বিছানায় শুয়ে বিলাপ করছে মেয়েটা।
পরদিন ভোরে একটা খন্তা আর কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মন্তু।
পরীর দীঘির পাড়ে জায়গাটা আগেই দেখিয়ে গেছে ছমির শেখ। কথা ছিলো একটা কবর খোঁড়ার। এখন দুটো খুঁড়তে হবে। একটা নন্তু শেখের জন্য, আরেকটা ছমির শেখের জন্য। রাতে কবিরাজ আনতে যাওয়ার সময় ভেদবমি শুরু হয় ওর। বাড়িতে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরে মারা গেছে ও। …..
ও যখন বাড়ি ফিরে এলো, তখন বেশ রাত হয়েছে। বারবাড়ি থেকে মন্তু শুনতে পেল গনু মোল্লা ওরা বসে বসে কী যেন আলাপ করছে।
গনু মোল্লা বলছে, সব অইছে খোদার কুদরত বাপু। নইলে এই দিনে তো কোনদিনই ওলা বিবিরে আইতে দেহি নাই।
মকবুল বললো, ওলা বিবির আর আজকাইল দিনকাল কিছু নাই। যহন-তহন আহে।
আমেনা বললো, এক পা খোঁড়া বিবির। তবু যেন কেমন কইরা এত বাড়ি বাড়ি যায়, আল্লা মালুম।
ওর কথা শেষ না হতেই টুনি জিজ্ঞেস করলো, কেমন কইরা ওর এক পা খোঁড়া অইল বুয়া?
তখন টুনিকে বোঝাতে লেগে গেলো আমেনা।
ওলা বিবি, বসন্ত বিবি আর যক্ষ্মা বিবি ওরা ছিলো তিন বোন এক প্রাণ। যেখানে যেত এক সঙ্গে যেতো ওরা। কাউকে ফেলে কেউ বেরুতো না বাইরে।
একদিন যখন খুব সুন্দর করে সেজেগুজে ওরা রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলো, তখন। হঠাৎ হজরত আলীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো ওদের। রঙ্গিন শাড়ি পরে বেরুলে কি হবে, ওদের চিনতে এক মুহূর্তও বিলম্ব হলো না হযরত আলীর। তিনি বুঝতে পারলেন এরা একজন কলেরা, একজন বসন্ত, আর একজন যক্ষ্মা বিবি। মানুষের সর্বনাশ করে বেড়ায় এরা। আর তহনি এক কাণ্ড কইরা বইসলেন তিনি। খপ কইরা মা ওলা বিবির একখানা হাত ধইরা দিলেন জোরে এক আছার। আছাড় খাইয়া একখানা পা ভাইঙ্গা গেলো ওলা বিবির। আহা সব খোদার কুদরত।
মকবুল সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, একখানা পা দিয়া দুনিয়াডারে জ্বালাইয়া খাইছে বেটি। দুই পা থাকলে তো দুনিয়াডারে একদিনে শেষ কইরা ফালাইতো।
ওর কথা শেষ হতেই হঠাৎ ফাতেমা জানালো গত রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে।
দেখেছে একটা খোঁড়া কুকুর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওদের গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে।
বড় ভালা দেখছ বউ। বড় ভালা দেখছ। ফকিরের মা পরক্ষণে বললো, ওই খোঁড়া কুত্তা, খোঁড়া মোরগ আর গরুর সুরত ধইরাই তো আহে ওলা বিবি। এক গেরাম থাইকা অন্য গেরামে যায়। বলে সমর্থনের জন্যে সবার দিকে এক নজর তাকালে সে।
মকবুল জানালো, শুধু তা-ই নয়, মাঝে মাঝে খোঁড়া কাক, শিয়াল কিম্বা খোঁড়া মানুষের রূপ নিয়েও গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাতায়াত করে ওলা বিবি।
হ্যাঁ মিয়ারা। বুড়ো মকবুল সবাইকে সাবধান করে দিলো। খোঁড়া কিছুরে বাড়ির ধারেকাছে আইতে দিয়ো না তোমরা। অচেনা কোনো খোঁড়া মানুষও না। দেখলেই ওইগুলোরে তাড়ায়ে খাল পার কইরা দিয়ো।
সকলে ঘাড় নেড়ে যায় দিলো। হ্যাঁ তাই করবে।…….
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরুতেই আমেনা জিজ্ঞেস করলো, নন্তু শেখের বাড়ির কোনো খবর জানো।
না।
ওমা জানো না? নন্তু শেখের ছেলে করিম শেখ পড়েছে আজ।
মন্তু কোনো কথা বললো না।
আমেনা বলে চললো, কবিরাজে কিছু কইরবার পারলো না। তাই ও গনু মোল্লারে ডাইকা নিছে। একটু ঝাড়ফুঁক দিয়া যদি কিছু অয়।
মন্তুকে চুপ করে থাকতে দেখে আমেনাও চুপ করে গেলো।
অবশেষে আরও দশটি প্রাণ হরণ করে তবে গ্রাম থেকে বিদায় নিলেন ওলা বিবি।
গ্রামের সবাই মসজিদে সিন্নি পাঠালো। মিলাদ পড়ালো বাড়ি বাড়ি।
ওলা বিবি গেলেন। আর দিন কয়েক বৃষ্টি এলো জোরে। আকাশ কালো করে নেমে এলো অবিরাম বর্ষণ। সারা রাত মেঘ গর্জন করলো। বাতাস বইলো আর প্রচণ্ড বেগে ঝড় হলো ।”
মড়ক-মহামারীর দোর্দণ্ড তান্ডবের পরেও জীবন থেমে থাকেনা মানুষের। নতুন করে বাঁচার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষ। জহির রায়হানের হাজার বছর পরে উপন্যাসেও কলেরা মহামারীর তাণ্ডব শেষে আবুল, মন্তু, সুরত আলী, রশীদ, বুড়ো মকবুল আর গ্রামের সবাই আবার সে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়-
“আগের দিন বিকেলে আকাশে মেঘ দেখে বুড়ো মকবুল তার পুরনো লাঙলটা ঠিক করে নিয়েছে। গরু নেই ওর। রওশন ব্যাপারীর কাছ থেকে এক জোড়া গরু ঠিকে নেবে। যে কদিন হাল চলবে, সে কটা দিনের জন্যে নগদ টাকা দিতে হবে। তা ছাড়া গরুর ঘাসবিচালির পয়সাও জুটাতে হবে তাকে।
ভোর না হতেই সবাই বেরিয়ে পড়লো মাঠে।
আবুল, মন্তু, সুরত আলী, রশীদ, বুড়ো মকবুল আর গ্রামের সবাই।”
শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসে বসন্ত রোগের প্রকোপের সময় মানুষের এ পলাতক মনোভাব ফুটে উঠেছে, ‘কবর আর কবর। মুশকিল হচ্ছে, যারা বেঁচে আছে, তারাও পালাচ্ছে ভয়ে।’
‘সংসপ্তক’ উপন্যাসে রাবু বসন্ত রোগীর সেবা করতে গিয়ে নিজেও বসন্তে আক্রান্ত হয়ে গেছেন। শহীদুল্লা কায়সার সে রাবুর অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘গায়ে হাত রেখে চমকে উঠলো ওরা। এখন কোঁকাচ্ছে না রাবু। অচেতন পড়ে আছে, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গাটা। ডাক্তার এলো। দেখল। গম্ভীর মুখে বলল পক্সের আলামত।’ আবার সেবা দিতে গিয়ে অনেক ডাক্তারকে সংক্রমিত হতে দেখা গেছে। অনেককে পাঠানো হয়েছে হোম কোয়ারেন্টাইনে।
শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তকে জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে দেখা যায়, আরো দেখা যায় ঘর পরিষ্কার করতে। ‘ঝেড়ে-মুছে নতুন চাদরে, নতুন পর্দায় ঝকঝকে করে ফেলল রাবুর ঘরটি। সারা বাড়িতে ছড়িয়ে দিলো জীবাণুনাশক।’
আহমদ ছফার ‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাসে কলেরা থেকে পলায়নপর মানুষের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে, ‘কলেরার সময় গাঁ ছেড়ে পালাচ্ছে ডরে মানুষ। এক বাড়িতে কারো কলেরা লাগলে পাশের বাড়ীর মানুষ উধাও।’
হাসান আজিজুল হক ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে মেতর বউ-এর জবানীতে লিখেছেন, ‘এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে। ডাক্তারবদ্যিও ছিল না তেমন। মরবার আগে মুখে যেদি ওষুধ পড়ত, তাই কত! পেরায় পিতি বছর কলেরা-বসন্তেই কত যি লোক মরত, তার সীমাসংখ্যা নাই।’
সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসে ‘বুধা’ তার পরিবারের চারজনকে হারিয়েছে। বুধার মানসিক বিপর্যস্ততার ইঙ্গিত লেখিকার কলমে ধরা দিয়েছে, ‘চোখের সামনে মা-বাবা, চার ভাই-বোনকে মরে যেতে দেখলে কেউ কি নরম থাকতে পারে?’ হয়তো পারে না। তাই পৃথিবীব্যাপী আজ কান্নার রোল। কলেরা মহামারি কীভাবে মৃত্যুর পর মৃত্যু উপহার দিয়েছে সেলিনা হোসেন তারও উল্লেখ করেছেন। ‘সেবার কলেরায় মহামারিতে উজাড় হয়ে যায় গাঁয়ের অর্ধেক লোক।’
বাংলা ছোটগল্পেও মড়ক-মহামারীর প্রসঙ্গ এসছে নানা প্রেক্ষিতে। মুজতবা আলী ‘পাদটীকা’ গল্পের শশুরুতেই মড়কের প্রসঙ্গ এসেছে এভাবে- “গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়।”
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ে গল্প ‘পুষ্করা’-তেও বাংলার মন্বন্তর পরবর্তী মড়ক থেকে উদ্ধার পাবার চিত্র প্রতিফলিত।
জগদীশ গুপ্তর ‘পয়োমুখম’ গল্পে ভূতনাথ নিজের স্ত্রীদের হত্যার পিছনে তার অর্থলিপ্সু কবিরাজ বাবার দুষ্কর্ম ধরে ফেলে শেষ পর্যন্ত। শেষতম বউ বেঁচে যায়। ভূতনাথ বলে, “এ বৌটার পরমায়ু আছে তাই কলেরায় মরল না, বাবা! পারেন তো নিজেই খেয়ে ফেলুন।” মানুষের এক অন্ধকার অধ্যায় বেরিয়ে পড়ে।
শিব্রাম চক্রবর্তীর ‘দেবতার জন্ম’ গল্পের কথক যে-পাথরে হোঁচট খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল বসন্ত রোগ থেকে বাঁচতে সেই পাথরেই মাথা নোয়ায়। এই সময়ের সঙ্গেও বেশ মিল পাওয়া যায় না কি?
সুকুমার রায়ও তাঁর ‘নানাগল্পে’-র ‘পেটুক’-এ লিখেছেন, “চারদিকে যে রকম প্লেগ আর ব্যারাম এই পাড়াসুদ্ধ ইঁদুর না মারলে আর রক্ষা নেই।”
কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ার সংবেদনশীল (যদিও সংক্ষিপ্ত) বিবরণ আরও অনেক লেখক ধরে রেখেছিলেন তাদের কলমে। ঢাকা গবেষক মুনতাসীর মামুনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে মহামারী নিয়ে এসব রচনার কথা।
বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিঠিপত্র ও প্রতিবেদনেও মড়ক-মহামারীর চিত্র বর্ণিত হতে দেখা যায়। ‘ঢাকায় ওলাউঠা’ শীর্ষক লেখায় দীনেশচন্দ্র সেন কলেরার মড়কে ভয়াবহ মনের অবস্থার কথা জানিয়েছেন, “একটা উৎকট দুঃস্বপ্নের মত দিনটা চলিয়া গেল। স্কুলে গেলাম, দেখিলাম সহপাঠীরা প্রায় সকলে পলাইয়া গিয়াছে, মাষ্টারবর্গও প্রায়ই অনুপস্থিত। রাস্তা দিয়া আসিতে পথে পথে কেবল ‘হরিবোল’, কান্নার রোল, অনাথ ছেলেমেয়েদের চিৎকার, দোকানপাঠ বন্ধ। ‘বলহরি’ মিষ্ট কথাটা বুকের মধ্যে বজ্র নিনাদের মত বাজিতে লাগিল।” (‘ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য’)
মড়কে মৃতদেহ সৎকারের জন্য পাওয়া যেত না কাউকে। কিন্তু সব সময় একদল মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতো, দেশসেবার অংশ হিসেবেই হোক বা মানবতার খাতিরে। বিবেকানন্দ’র এক চিঠিতে দেখি, “বুদ্ধের পরে এই আবার প্রথম দেখা যাচ্ছে যে, ব্রাহ্মণ সন্তানেরা অন্ত্যজ বিসূচিকা-রোগীর শয্যাপার্শ্বে সেবায় নিরত। ভারতে বক্তৃতা ও অধ্যাপনায় বেশি কাজ হবে না। প্রয়োজন সক্রিয় ধর্মের। আর মুসলমানদের কথায় বলতে গেলে খোদার মর্জি হলে -আমি তাই দেখাতে বদ্ধ পরিকর।” (পত্রাবলী, ৩৫০, স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী) কলেরা বা বিসূচিকা রোগীর সেবা ভারত সেবারই অঙ্গ হয়ে উঠছে।
মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করাও ছিল বড়ো চ্যালেঞ্জ। জলবাহিত কলেরা আক্রান্ত গ্রামের মূল সমস্যা ছিল ব্যবহৃত জল। তখন যে পুকুরের জল খাওয়া হত সেই পুকুরেই চলতো স্নান, পোশাক কাচাও। তাই কলেরার মড়ক পরবর্তী গ্রামে গ্রামে ডাক্তার পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে টিউবওয়েল বসানোটাও সরকারি পরিকল্পনার মধ্যে আসে। স্থানীয় উদ্যোগে শুরু হয় নতুন কুয়ো খোঁড়া বা ব্লিচিং দিয়ে জল পরিশোধনের কাজও। সে প্রসঙ্গ এসেছে অনেক গল্প উপন্যাসে।
বাংলা কবিতাতেও বাদ যায়নি মড়ক-মহামারী প্রসঙ্গ।উনিশ শতকের ঢাকার এক ‘বটতলার কবি’ কুশাই সরকার লোকমুখে প্রচলিত বুলিতে ওলাওঠার মহামারী নিয়ে ককবিতা লিখেছেন। তার লেখা একটি কবিতা ‘ওলাওঠা’র পুরোটাই এখানে উদ্ধৃত করা গেল:
‘আমার এ সময়ে একবার দেখা দেও হে নারায়ণ
আমার হৈতেছে ঐ ভেদবমী অবশ্য মরণ।
১২৯৭ সনে অর্দ্ধ উদয় গঙ্গাস্থানে কত
লোক মৈরেছে প্রাণে না যায় গপন।
ওলাওঠা হৈলে পর প্রথম জীবে বমী কৈরে,
তত্পরেতেমার্গ ঝরে হয় প্রসাব বন্ধন।
তত্পরে হয় শরীর জ্বালা, সর্ব্ব অঙ্গ ব্যাপিত কালা,
ভাই বন্ধুকে ডেকে বলা কর কষ্টের আয়োজন।
জন্ম, মরণ, দেখ বিয়া, তিন থাকলো নিবন্ধ নিয়া,
আমার বুঝি আয়ু খুইয়া হইয়াছে মরণ।
এইটা কেবল মনের ভ্রান্তি, এ রোগের নাকো যে শান্তি
কোটীতে গুটীকো বাঁচে কেবল দুই একজন।’|
কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তো বহু আগেই তাঁর ‘বোধন’ কবিতায় বলে গেছেন- ‘মারী ও মড়ক মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার/ আঘাতে আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন/ ভাঙা নৌকার পাল/ এখানে দারুণ দুঃখে কেটেছে সর্বনাশের কাল’-এর কথা।
কবি জীবনান্দ দাশের আট বছর আগে একদিন কবিতায় -“ এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!/ রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি” উপমায় প্লেগের জীবাুিবাঞী হিসেবে বর্ণির্ত
পল্লীকবি জসীমুদ্দীনের ‘আসামনী’ কবিতায় পাই- ‘ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে।’
অদৃশ্য ঘাতক করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট চলমান বৈশ্বিক মহামারী কোভিট-১৯ এর থাবায় বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে আমাদের প্রিয় স্বদেশও। এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিণতি ভাবনায় সমাজের আর দশজনের মত আমাদের কবি-সাহিত্যকরাও উদ্বিগ্ন উৎকন্ঠিত। কবি-সাহিত্যিকরা করোনাকে ঘিরে তাদের অনুভব-অভিব্যক্তিকে তুলে ধরে রচনা করছেন ছড়া, কবিতা, গল্প।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে এগুলো প্রকাশিতও হচ্ছে। করোনা কালে রচিত কবিতা নিয়ে ইতোমধ্যে সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। কারও কারও কবিতার আবৃত্তিও স্থান পেয়েছে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউবে।
করোনা বিপর্যয়ে পুরো বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত, ঠিক সে সময় কবিতার মাধ্যেমে মানুষের কাছে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন এই সময়ের কবিরা। এছাড়াও কবিতার মাধ্যমে উঠে এসেছে মানুষের নানা কর্মকাণ্ড। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়ে উঠছে দারুণ জনপ্রিয়।
মহামারি করোনার কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। তার পরেও আশাবাদী কবিরা। এই মৃত্যুর যাত্রা হতে ফিরে আশার প্রার্থনা জানিয়ে তরুণ কবি সহস্র সুমন লিখেছেন কবিতা ‘এ যাত্রায় বেঁচে গেলে’। এই কবিতাটি গত ৮ এপ্রিল তার ফেসবুক টাইমলাইন থেকে প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে কবিতাটিকে আবৃত্তি করেছেন দেশের ২১ জন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। আর এই অবৃত্তি পরিচালনা করেন নাট্য অভিনেতা টনি ডায়েস। পরবর্তীতে এই আবৃত্তিটির ভিডিও অংশগ্রহণকারী অভিনেতা-অভিনেত্রীর ফেসবুক পেজে প্রকাশিত হয়েছে।কবি সহস্র সুমন রচিত এ যাত্রায় বেঁচে গেলে কবিতাটি উদ্ধৃত করা হলো :
“এ যাত্রায় বেঁচে গেলে, ভীষণ করে বাঁচবো,
সবাইকে জড়িয়ে ধরে অনেক করে কাঁদবো।
এ যাত্রায় রেহাই যদি পাই, অন্যের কথা ভাববো।
যার যেখানে অংশ আছে হিসেবগুলো চুকিয়ে দেবো,
একাকী নিড়ের ছানা, দু মুঠো খেলো কিনা- খবর নেব,
এ যাত্রায় বেঁচে যদি যাই, অন্যদের আগে বাঁচতে দেব।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথম নদীর কাছে ক্ষমা চাবো,
বন পাহাড় আর সাগর দেশে বিনয় হেসে নত হবো,
এ যাত্রায় বেঁচে গেলে আমি ঋণ না হয়ে পরিশোধ হবো।
আর হবো না অহংকারী, আর হবো না রাশভারী,
থামিয়ে দেব লোভ লালসার রাহাজানি, ধর্ম নিয়ে মহাজনী,
পবিত্র প্রাণের ইবাদত হবো।
এ যাত্রায় বেঁচে বর্তে গেলে, মানুষের তরে মানুষ হবো।
নতুন করে স্কুলে যাবো, কলেজে যাবো,
মামার হাতের ফুচকা খাবো, চায়ের কাপে ঝড় ওঠাবো।
বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেব, হাসিগুলো ছড়িয়ে দেব,
ঘুড়ি ওড়াবো রংবেরঙের, নৌকা হবো মুক্ত পালের।
এ যাত্রায় বেঁচে যদি যাই,
দূর্বলের কাছে আর যম হবো না,
হরিণ ঘাতক তীর হবো না,
অসৎ পথের ভিড় হবো না,
সত্যি যদি রেহাই পাই, বেঁচে যদি যাই এ যাত্রায় একটি বার,
যত অন্যায় পুষিয়ে দেব, যত হিংসা মিটিয়ে দেব।
বাড়ি ফিরলে এবার,
মায়ের শাড়ির আঁচল হবো, বউ এর চোখের কাজল হবো, ছেলের কাছে ঘোড়া হবো।
আর যদি না বাঁচি, যদি হারিয়ে যাই ওই একাকী অন্ধকারের দেশে,
অন্তত দূর আকাশের চাঁদটি হবো, যতটুকু পারি আরো ছড়াবো।”
করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর করুণ অসহায় চিত্র তুলে ধরে রংপুরের প্রতিশ্রুতিশীল কবি মিনার বসুনিয়া লিখেছেন ‘ঈশ্বর হোক সবার’ শিরোণামে একটি কবিতা। তার এই কবিতা ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। কবি কামাল চৌধুরী রচিত ‘তোমার পৃথিবী চিনতে পার না’ শিরোণামে একটি কবিতাও এ প্রসঙ্গে উল্রেখ করা যেতে পারে।
করোনা নিয়ে রচিত এদুটি কবিতা আবৃত্তি করেছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অভিনেতা ও আবৃত্তিকার আসাদুজ্জামান নূর। মিনার বসুনিয়ার লেখা কবিতাটি নিয়ে ভিডিও নির্মাণ করেছেন সঞ্জয় সরকার মুক্তনীল।
মিনার বসুনিয়া ‘ঈশ্বর হোক সবার’ কবিতায় বলেন-
“তিনি তো তোমাদের একার ঈশ্বর নন-
তিনি হয়তো ডলফিনের আবেদন মঞ্জুর করেছেন-
তিনি হয়তো সাগরের হাহাকার গ্রহণ করেছেন-
তিনি হয়তো বনের প্রার্থনা মন দিয়ে শুনেছেন-
তিনি হয়তো পাহাড়ের দাবিগুলো যৌক্তিক ভেবেছেন-
তারাও হয়তো টিকে থাকার জন্য দু’হাত বাড়িয়েছিল!
হয়তো তারাও বাঁচতে চেয়ে কেঁদেছিলো রাতের পর রাত-
নইলে আজ আকাশ কেন হবে এতো নীল!
নইলে পাখিরা কেন আজ মুখরিত হবে দূরন্ত কোলাহলে
তিনি তো মানুষের একার ঈশ্বর নন
আর পৃথিবীও নয় তোমাদের একার।”
মিনার বসুনিয়ার লিখা কবিতাটি চলমান করোনাসংকটের সময়ে খুবই তাৎপর্য ও সঙ্গতিপূর্ণ। এই পৃথিবী যে শুধু মানুষের জন্য নয়, সে বিষয়টিই উঠে এসেছে ‘ঈশ্বর হোক সবার’ এই কবিতায়।কবিতার প্রতিটি শব্দে মানুষ ছাড়া জগতের প্রাণিকূলের এক ধরণের আর্তনাদই যেনো ফুটে উঠেছে।
কবি কামাল চৌধুরী রচিত ‘তোমার পৃথিবী চিনতে পার না’ শিরোণামের কবিতাতেও করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, করোনার আঘাতে জনশূন্য পৃথিবীর বড় বড় সব শহর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে। কবি তার পঙক্তিমালায় বলেছেন, একটি ভাইরাস কীভাবে মানুষের ক্ষমতার দম্ভকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। কবিতার শেষাংশে রয়েছে আশার বাণী।
করোনায় বিপর্যস্ত ঘরবন্দি মানুষের বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থার কথা ভাবনায় এনে কবি আল-মাসুম পাঁচটি কবিতা লিখেছেন। করোনার বিভিন্ন দিককে উপজীব্য করে রচিত এসব কবিতা আবৃত্তি করেছেন এপার বাংলা ও ওপার বাংলার জনপ্রিয় বাচিক শিল্পীরা।একটি কবিতা ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করেছেন গবেষক সাংবাদিক আফসান চৌধুরী। ইংরেজী করার পরে কবিতাটি মোট ১৩ টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে, করা হয়েছে আবৃত্তি।
করোনা নিয়ে রয়েছে আরও কবিতা। যেসব কবিতা জনপ্রিয়তা পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অবশ্য করোনা নিয়ে লেখা প্রায় সব কবিতায় উঠে এসেছে মানুষের কর্ম ও তার প্রতিফল। মানুষ যে কত অসহায়, তা উঠে এসেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়রে তরুণ কবি ইমরান ইমন রচিত ‘আবার সুদিন আসবে’ কবিতায়। যেখানে করোনা সচেতনতায় দেয়া হয়েছে নানান বার্তা। করোনার এই দুঃসময়কে জয় করে মানুষ আবার উঠে দাঁড়াবে, সে প্রত্যাশাও প্রতিধ্বনিত ‘আবার সুদিন আসবে’ কবিতায়-
“পৃথিবীটা আজ নেই ভালো,
নিভে গেছে জীবনসঞ্চারি আলো।
কত স্বপ্ন, কত আশা নিহত হলো,
কত সাজানো বাগান ধসে গেল!
শুভ্র বাতাস আজ হয়ে গেছে কালো।
চারদিক থেকে ক্ষণে ক্ষণে
বইছে মহাত্রাসের ধ্বনি,
প্রতিনিয়ত আমিও
মৃত্যুর জয়ডাক শুনি।
একদিন পৃথিবীটা আবার
প্রাণে ভরে উঠবে,
গোলাপ আবার তার
সুবাস দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেবে।
সেদিন হয়তো পৃথিবীটা
একটু বদলে যাবে।”
করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে মানুষ যখন ঘরে বন্দী, ঠিক তখন পৃথিবী সেজে উঠেছে আপনরূপে। যেখানে মানুষ ছাড়া পৃথিবীর সব প্রাণ উপভোগ করছে নতুন এই বিশ্বকে। মানুষ যে প্রকৃতির প্রতি অন্যায় করে আসছিলো, সেই উপলব্ধি উঠে এসেছে কবি আবু সুফিয়ান রচিত ‘শূন্য দিনের পৃথিবী’ কবিতায়।
করোনা নিয়ে কবি রকিবুল হাসান লিখেছেন-‘পৃথিবী আর কবে কেঁদেছে এমন করে’ শিরোণামে কবিতা।
কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু তার ফেসবুক স্টাটাসে লিখেছেন “গোলার্ধভেদী মৃত্যু” শিরোণামে ‘নিদানকালের কবিতা’-
‘শোক ও সমবেদনা’ কথাটা এখন
কপি করে রেখে দিই!
এখন তা শুধু পেস্ট করি!
নিদানকালে এতটা মৃত্যু–
এত দ্রুত কপি হচ্ছে!
আমি আর কিছুই লিখতে পারছি না!
সমব্যথী হওয়ার ধৈর্য্য
হারিয়ে ফেলছি!
শোকার্ত হওয়ার ধৈর্য্য
হারিয়ে ফেলছি!
ব্যাকুল হওয়ার ধৈর্য্য
হারিয়ে ফেলছি!
বিচলিত হওয়ার ধৈর্য্য
হারিয়ে ফেলছি!
পরিবেদনার মধ্যে কাতরতা হারিয়ে যাচ্ছে
বিলাপধ্বনির মধ্যে শোকতাপ হারিয়ে যাচ্ছে
আর্তনাদের মধ্যে অশ্রুজল হারিয়ে যাচ্ছে
কী মর্মভেদী–গোলার্ধভেদী মৃত্যু!
মৃত্যুর কাছে মৃত্যু দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না!
বার্লিন প্রবাসী বাংলাদেশের নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দারের কলমে উঠে এসেছে করোনাকালীন পরিস্থিতির বর্ণনা।তিনি লিখেছেন একগুচ্ছ কবিতা। কবির ভাষায়- “চলছে ‘করোনা’-কাল। এই ‘কাল’ নিয়ে এক লহমায় (যাকে বলে ‘এক সিটিং-এ’), ছোট ছোট পদ্য লিখলুম কয়েকটি। আসলে, এই ‘কাল’-এর দলিল”। আসুন আমরা দাউদ হায়দারের ‘এই ‘কাল’ নিয়ে এক লহমায় (যাকে বলে ‘এক সিটিং-এ’), ছোট ছোট পদ্য’গুচ্ছের সাথে পরিচিত হই।
দোহাই মা কালী
বন্দীজীবন কাকে বলে অজানা নয়,
জেলে ছিলাম মাসের পর মাস,
একাকীত্বের প্রহার, নিষ্ঠুর শৃঙ্খল
যুগপৎ সন্ত্রাস আর বীভৎস ভাইরাস
আদ্যিকাল থেকে মানুষের আর্তনাদ
ক্ষুধাব্যাধির যন্ত্রণা
প্রহরে-প্রহরে মৃত্যু, কবর-শ্মশান
দোহাই মা কালী, রক্তমাখা জিভ ব্যাদান কোরো না
আমার পতাকা
বলো হে ঈশ্বরী পাটনী, কীভাবে তোমার সন্তান
বাঁচবে দুধেভাতে মুমূর্ষু বিশ্বদেশে?
যেদিকে তাকাই তীক্ষ্ণ মৃত্যুবাণ।
বাঁচার সমস্ত পথ রুদ্ধ, বাঁচাও দুঃসহ বদ্ধ পরিবেশে
জীবন নিমেষে উধাও, বাতাস বিষমাখা
খাদ্যাভাব ঘরে ঘরে, দূষিত পানীয়
জলের অতলে ক্রন্দন, মানুষ দিশেহারা। আমার পতাকা
বহনের কেউ থাকবে না, হে স্বজন, প্রিয়?
দিনগুলো
আনা ইসলাম বললেন, “মানুষ বান্ধব নয় আর
দেখাসাক্ষাতে ওজর আপত্তি, আত্মীয়কুল দূরে, এই যন্ত্রণার
অবসান কবে, কোন নিয়তি দুয়ারে, তল্লাটে?”
বললুম, “যে পাপ হাড়েমজ্জায়-গাগতরে
কী করে ঢাকব প্রকাশ্যে, গহ্বরে?
“দিনগুলো হিসেব নিচ্ছে কড়ায় গন্ডায়, পাল্লাতে।”
আমরা
ঘরবন্দি, ক্রমশ কাহিল।
সবাই বিষাদে আচ্ছন্ন।
এদেশে দুর্ভিক্ষ প্রতিদিন, শকুন ও চিল
চক্রাকারে, চেতনে-অচেতেনে দুঃস্বপ্ন
আমরা বুভুক্ষু, আমরা সাহায্যপ্রার্থী
আমাদের চিৎকার, আমাদের ক্রন্দন
আমাদের কাতরতা-আর্তি
শুনছে না কেউ, অরণ্যে রোদন
স্তরে-স্তরে
আজ বেঁচে আছি, কালকের কথা বলা অসম্ভব।
জীবে আর দয়া নেই, মায়ার জগতে শুধু শোক।
প্রকৃতি মেতেছে প্রতিশোধে, ঘাটেবাটে নাচে মহামারী, শব
কেন কী করে এই দুর্যোগ, ছিন্নমস্তাও বলতে অপারগ
আসন্ন ধ্বংসের সব লীলাখেলা শূন্যের গহ্বরে?
কে পাতক কে শ্মশানযাত্রী অমানিশার কুটিল স্তরে, স্তরে-স্তরে?
একদা ছিলেন
চারদিকে ছড়ানো অসুখ
মৃত্যুর দেখা-না-দেখা নানা মুখ
পৃথিবীর চেহারা মলিন, অস্তগামী
ধনতন্ত্রের বড়াই শেষ, সাম্যবাদ-সমাজ জরুরি আজ
একদা ছিলেন যাঁরা রক্তচক্ষু, দুর্দান্ত মস্তান জাঁহাবাজ
ভাবেন নি, আমি নই আর গৃহস্বামী।
ওপার বাংলার নন্দিত কন্ঠশিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী কবিতাও লিখেন। তিনি ‘করোনা’শিরোণামে একটি কবিতা রিখে ঝড় তুলেছেন । নিজের ফেসবুক পেইজে একটি কবিতার ভিডিও প্রকাশ করেছেন নচিকেতা। নচিকেতা নিজেই আবৃত্তি করেছেন কবিতাটি। এই কবিতায় নচিকেতা বলেছেন সাম্যবাদের কথা। করোনা কবিতায় নিজের মতাদর্শ তুলে ধরেন ছন্দে ছন্দে। এটি প্রকাশের পাঁচ ঘন্টার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষবার দেখা হয়েছে ভিডিটি। আর প্রশংসায় ভেসেছেন এই শিল্পী। কবিতাটি উদ্ধৃত করা হলো:
“করোনা নামের মহামারী তুমি যাও, তুমি যাও
একটা বিনীত অনুরোধ তোমার ভয়টাকে রেখে যাও
ওগো ভয়
তোমারই হোক জয়
তুমি নির্ভীক তরবারী
তুমি নির্মেদ অক্ষয়
তোমারই হোক জয়।
তোমার নামে বন্ধ হয়েছে সভ্যতা নামে দুষণ
তোমার জন্য বহুদিন পরে আকাশে হাসছে পুষণ
তোমার জন্য মানুষ ভুলেছে পুষে রাখা বিদ্বেষ
শুধু ভয় করে দিলো বিভেদহীন এক দেশ।
কারোর মুখই যাচ্ছে না দেখা আল্লাহ অথবা রাম
সবার মুখই মাস্কেতে ঢাকা সবার কপালে ঘাম
হাতে নাগরিক পঞ্জির খাতা কাগজে চায় প্রমাণ
এখন তারা কোথায় দিতে পারেন সন্ধান।
মৃত্যুর কোনো দেশ তো লাগে না কাঁটাতার ছিঁড়ে যায়
নগর থাকলে নাগরিক, সে নগরকে কে বাঁচায়
রোজ আমাদের হিংসে মন্ত্র শেখায় যে পুরোহিতি
যুগ যুগ ধরে আমরা তো জানি তার নাম রাজনীতি।
পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও তার ফেসবুক পেজে করোনা সঙ্কট নিয়ে কবিতা লিখে আলোড়ন সৃস্টি করেছেন।
এমনিভাবে দেখা যাচ্ছে সেই আদিকাল থেকে বর্তমান অবধি বাংলা উপন্যাস, ছড়া, কবিতা, গানে মড়ক-মহামারীর কথা বর্ণিত হয়েছে নানা প্রসঙ্গে-অনুষঙ্গে। তারই ধারাবাহিকতায় চলমান করোনা মহামারীর প্রভাব ও প্রতিফলন নিয়ে বাংলা সাহিত্যেও যে ধারার সঞ্চরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, “এ যাত্রায় বেঁচে গেলে” তা ভবিষ্যতে মহৎ সৃষ্টিসম্ভারে আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে আশা করা যায়।
ঋণ স্বীকার : ফেসবুক ও ইন্টারনেটে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত বিভিন্ন কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রতিবেদন।
Leave a Reply