পোকা
মূল : Thomas M. Disch
ভাষান্তর : সেলিনা ইব্রাহিম
কুমারী মার্সিয়া কেনওয়েলের তেলাপোকা সম্পর্কে সত্যিকার আতংক ছিল। রঙিন বিছা দেখে সে যেরকম ভীত হয়ে পড়ত, এটা ছিল তা থেকে ভিন্ন। মার্সিয়া কেনওয়েলের ক্ষুদ্র জিনিষের প্রতি ছিল অতিশয় ঘৃণা। তেলাপোকা দেখে সে নিজেকে চিৎকার করা থেকে বিরত রাখতে পারত না। তেলাপোকা দেখে সে এতটাইট বিকর্ষন বোধ করতে যে, নিজের জুতার নীচে তাদেরকে পিষে ফেলবার কথাও ভাবতে পারত না। না ! সেটা খুবই ভয়ঙ্কর। তার চে, সে দৌড়ে পালাত, স্প্রে ক্যান থেকে ঔষধ ছেটানোর জন্য বা খাবারে বিষ মিশিয়ে রাখার জন্য, যতক্ষন না পোকাগুলি দেওয়ালের ফাঁকের মধ্যে, যেখানে সম্ভবত তারা বসবাস করত, যেখানে চলে যেত। এটা ভয়ঙ্কর, বর্ণনাতীত ভাবে ভয়ঙ্কর যে তারা বসবাস করছে দেয়ালের মধ্যে এবং অপেক্ষ করছে অন্ধকারে এবং তারাপর… না।তার চেয়ে এটা চিন্তা না করাই উত্তম।
প্রতি সপ্তাহে মার্সিয়া দি ,টাইমস দেখতো, অন্য একটি বাসার খোজে। কিন্তু হয় তাদের ভাড়া অত্যন্ত বেশী ছিল, অথবা অত্যন্ত নি¤œমানের ছিল (এটা ছিল ম্যানহাটান এবং তাকে প্রতি সপ্তাহে ৬২.৫০ ডলার দিতে হতো)। মার্সিয়া জানত, সে বাসাগুলিতে, সিংকের নীচে থাকবে মরা পোকারা, চুলার, এমনকি কাপবোর্ডের সেলফের মধ্যেও তেলাপোকারা ছড়িয়ে থাকবে যেমন কিনা বিবাহ উত্তর অনুষ্ঠানের পর ভাত ছড়িয়ে থাকে। এই বাসাগুলি সে বাতিল করত বিরক্তভরে, এমনকি এই ধরনের বাসা সম্পর্কে সে ভাবতেও চাইত না, যতক্ষন না সে তার বর্তমান ঘরে না পৌঁছাত, যে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আছে পোকা মারা ঔষধ বø্যাক ফ্ল্যাগ, রোচ ইট এবং বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যে, যা ছড়ানো থাকত, আলুর ফালির উপর এবং দেওয়ালের একশটি ফোকরে যা একমাত্র সে এবং তেলাপোকারাই চিনত।
অন্তত, সে ভাবত, আমি আমার ঘরটি পরিস্কার রেখেছি এবং সত্যিকার অর্থেই, সিংকের নীচ, চুল্লীর নীচ এবং পাশ, কাপবোর্ডের সাদা আবরণের নীচ সবই ছিল নিষ্কলুষ। সে বুঝতে পারত না কিভাবে অন্য মানুষেরা এই সমস্ত ব্যাপারগুলো সাধ্যতীত, মনে করে। তারা অবশ্যই “পিয়ের্তো রিকান” সে ভাবত এবং আবার শিউরে উঠত আতংক নোংরা আবর্জনা পূর্ণ খোসাসমূহ এবং জীবাণুর কথা চিন্তা করে।
পতঙ্গদের সম্পর্কে এইরূপ তীব্র বিতৃষ্ণা, বিশেষ করে একটি প্রজাতির পতঙ্গের প্রতি, হয়ত অত্যাধিক মনে হতে পারে কিন্তু এই ব্যাপারে মার্সিয়া কেনওয়েল ছিল ব্যাতিক্রম। মার্সিয়ার মত অনেক অবিবাহিত মহিলাই এই ধরনের হয়ে থাকে কিন্তু আমরা আশা করতে পারি, অন্তত ভাল ভাগ্যের দোহাই দিয়ে, তাদের কারোরই মার্সিয়া কেনওয়েলের মত পরিনতি হয়ে ্উঠেনি।
মার্সিয়ার এই আতঙ্কগ্রস্থতা অন্যান্যদের মতই ছিল বংশানুক্রমিক। বলাই বাহুল্য মার্সিয়া এটা অধিকার করেছিল তার মায়ের কাছ থেকে, যার বিষাদিত ভয় ছিল যে কোন জিনিষের প্রতি, যা গড়িয়ে চলত বা বুকে হাটত বা ছোট গর্তে থাকত। ইঁদুর, ব্যাঙ, সাপ, কৃমি, ছারপোকা এই সমস্তই মিসেস কেনওয়েলকে হিস্টিরিয়াগ্রস্থ করে ফেলত এবং এটা হতো একটি বিষ্ময় যদি ছোট মার্সিয়া তার মায়ের অনরূপ না হোত। যদিও মার্সিয়ার জন্য অবাক ব্যাপার ছিল যে, তার আতঙ্ক ছিল নির্দিষ্ট শুধুমাত্র তেলাপোকাদের প্রতি যাদের কে সে কোনদিন দেখেনি, এমন কি জানতও না। কেনওয়েল পরিবার ছিল মিনোসোটা পরিবার এবং এসমস্ত পরিবারে তেলাপোকা ছিল না। সত্যিকার অর্থে এই বিষয়টি উদ্ভুত হয়েছিল না যতদিন না মার্সিয়ার বয়স ১৯ হয়নি এবং সে নিউইর্য়ক বিজয় করতে যাত্রা করেনি (অসত্যের মধ্যে ছিল, একটি হাই স্কুল ডিপ্লোমা এবং তার নিজের যথেষ্ট অনাকর্ষনীয়তা)।
যাত্রার দিনে, তার প্রিয় এবং একমাস জীবিত মাসি তার সঙ্গে গ্রেহাউন্ড টার্মিনাল পর্যন্ত এসেছিলেন (যেহেতু তার পিতামাতা উভয়ই প্রয়াতই হয়েছিলেন) এবং বিদায় কালে তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন এই বলে যে, পোকাদের দিকে দৃষ্টি দিও, মার্সিয়া প্রিয়তম, নিউইয়র্ক শহর হচ্ছে তেলাপোকাপূর্ণ। সে সময় মার্সিয়া তার মাসির প্রতি কদাচিৎ গুরত্ব আরোপ করত, যে কিনা শুরু থেকেই এই যাত্রার প্রতি বিরোধিতা করেছিলেন এবং কেন মার্সিয়ার অন্তত বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এ যাত্রা স্থগিত করা উচিৎ এবিষয়ে একশ এবং ততোধিক কারণ দর্শিয়েছিলেন।
সব বিষয়েই মাসির ধারনা সত্য বলে প্রমানিত হয়েছে। পাঁচ বছর এবং পনেরটি কর্মসংস্থান প্রকল্পের পরও মার্সিয়া নিউইয়র্কে অনাকর্ষনীয় কাজ এবং কম অর্থ ছাড়া আর কিছুই আবিস্কার করেনি। পশ্চিম-১৬তে বসবাস করবার সে সময়কার তার বন্ধু সংখ্যা এবং বর্তমান থমসন স্ট্রাটের বাসার কোনটারই উন্নতি ঘটেনি।
শহরটি পূর্ণ ছিল বিরাট বিরাট অট্টালিকাতে, কিন্তু তা ছিল অন্যদের জন্য। মার্সিয়া যে শহরটিকে জানত, তা ছিল পাপে পূর্ণ, ব্যতিক্রমী, নোংরা এবং ভয়ঙ্কর। প্রতিদিন সে খবরের কাগজে দেখত, মহিলারা সাবওয়েতে নির্যাতিত হয়েছে, রাস্তাতে ধর্ষিত হয়েছে, এমনকি নিজেদের বিছানাতেই ছুরিকাহত হয়েছে। শত মানুষ তাদের উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে এইসব ঘটনা দেখেছে এবং কোনরকম সাহায্যে এগিয়ে আসেনি এবং সর্বোপরি এই শহর ভর্তি ছিল তেলাপোকাতে।
তেলাপোকা ছিল সর্বত্র এবং তা মার্সিয়া নিউইর্য়কে আসার একমাস পর দেখতে পায়। নাসাও স্ট্রীটে, একটি ষ্টেশনারী দোকানে, যেখানে হয় তারা তার দিকে আসে বা সে তাদের দিকে যায়। এটাই ছিল তার পাওয়া প্রথম কাজ।
কখনও একা বা কখনও একটি ব্রনভর্তি মুখের ছেলের সাহায্যে তাকে বেসমেন্টে মালামালের হিসাবে নামতে হোত। এই মালামালের মধ্যে ছিল কাগজের বাক্স, ডায়রী, পিন ক্লিপস্ এবং কার্বন পেপার। বেসমেন্ট এত অন্ধকার এবং নোংরা ছিল যে, নীচের তাকের জন্য তাকে ফ্লাসলাইট ব্যবহার করতে হতো।
অন্ধকারতম কোনে, একটি পানির পিপে থেকে ছাইরঙের সিংকের চিরস্থায়ী ছিদ্রের মধ্য দিয়ে পানি পড়ত, সে ঐ সিংকের নিকটে দাড়িয়ে এক কাপ ইষদুষ্ণ কফি (যা ছিল নিউইয়র্কের প্রথামত চিনি এবং দুধের বন্যায় সম্পৃক্ত) পান করছিল এবং কিভাবে সে কতিপয় জিনিষকে সম্ভব করে তুলতে পারে, যা সে পারেনি ইতিপূবের্, তাই ভাবছিল, তখনই সে লক্ষ্য করল সিংকের পাশের কালো চলন্ত বিন্দুগুলিকে।
প্রথমে সে ভেবেছিল এটা তার নিজেরই চোখের ভিতরের ধুলিকণা অথবা সরষে ফুল যা প্রচন্ড গরমে একজন মানুষ অত্যাধিক পরিশ্রমের পর দেখে থাকে। কিন্তু ভ্রম হবার চাইতেও অত্যাধিক সময় অবধি সেগুলি অবস্থান করলে মার্সিয়া সত্য প্রমানে তাদের নিকটবর্তী হলো। কিভাবে আমি জানব যে সেগুলি ছিল পতঙ্গ? মার্সিয়া ভেবেছিল।
যে সমস্ত জিনিষ আমাদেরকে বিকর্ষন করে তা একই সময়ে অত্যাধিকভাবে আকর্ষন করে- এর ব্যাখ্যা আমরা কিভাবে দেব? ফনা তোলা গোখরা সাপ সুন্দর হয় কেন? নিদারুন ঘৃন্য ও বিভীষিকাজনক বস্তুর প্রতি আকর্ষণ হচ্ছে এমন কিছু যা… এমন কিছু যা কখনই হিসেবের মধ্যে পড়ে না। বিষয়টি অশ্লীল হতে পারে এবং এখানে এটি আলোচিত হবার প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র মার্সিয়ার শ^াসরুদ্ধকর বিষয়টি লক্ষ্যনীয় যা নিয়ে সে তার জীবনে প্রথম এই তেলাপোকাগুলি দেখেছিল। সিংকের এত নিকটে সে বসেছিল যে, সে তেলাপোকার গোলাকৃতি অবিভাজিত শরীরের দাগগুলি, ক্ষীন পায়ের দ্রæত নড়াচড়া এবং তাদের স্পর্শ সন্ধানী শুঙ্গের দ্রæত কম্পন দেখতে পাচ্ছিল।
তারা উদ্দেশ্যহীন ভাবে নড়াচড়া করছিল, কোন দিকেই যাচ্ছিল না, এমন কি স্থিরও ছিল না। মনে হচ্ছিল তারা অকারনেই বিরক্ত হয়েছে। যেহেতু, মার্সিয়া ভেবেছিল, আমার উপস্থিতি তাদেরকে অসুস্থ করে তুলেছিল!
শুধুমাত্র তখনই সে সতর্ক হলো, সম্পূর্ণ সতর্ক হলো যে এগুলোই হচ্ছে সেই তেলাপোকা যাদের সম্পর্কে তাকে পূর্বেই সতর্ক করা হয়েছিল। মার্সিয়া বিকর্ষিত হলো, তার শরীরের হাড়ের উপরের মাংসপেশীগুলো জমে গেলো।
সে আর্তনাদ করে উঠল, তীক্ষè স্বরে চিৎকার করল এবং একটি মালভর্তি শেলফের উপর চেয়ারশুদ্ধ পড়ে গেল। একই সময়ে পোকাগুলি সিংকের এবং নর্দমার মধ্যে অদৃশ্য হলো।
জনাব সিলভারস্মিথ, মার্সিয়ার শব্দ অনুসন্ধান করবার জন্য নীচতলাতে এস, তাকে অজ্ঞান অবস্থাতে মেঝেতে শোয়া অবস্থায় পেলেন। তিনি তার মুখে পানির ছিটা দিলেন, সে জেগে উঠেই বমনেচ্ছা প্রকাশ করল। সে কিছুতেই এসবের কারন বলতে চাইল না বরং উল্টো তাৎক্ষনিক ভাবে জনাব সিলডারস্মিথের চাকুরী ছেড়ে দেবার জন্যে জোরাজুরী করতে লাগল। তিনি ধারনা করলেন, ব্রন ভর্তি বালক যে ছিল তার নিজেরই ছেলে, মেয়েটির উপর চড়াও হয়েছিল বলেই এমন করছে এবং তিন দিনের বেতনসহ, (যা মার্সিয়া অর্জন করেছিল) কোন প্রকার দুঃখ প্রকাশ ছাড়াই তাকে বিদায় করলেন। এই সময় থেকেই মার্সিয়ার অস্তিত্বে তেলাপোকার উপস্থিতি নিয়মিত হয়ে দাড়াল।
থমসন স্ট্রীটে মার্সিয়ার অবস্থা এমন দাড়াল যে সব সময়ই তাকে তেলাপোকাদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষনা ছাড়া কোন অবস্থা ছিল না। নিয়মিত ভাবে সে তেলাপোকা মারা ঔষধ দিত, ঘর দোর পরিস্কার করত, (এক কাপ কফিও সে কখনই কফি পট ও কাপ না পরিস্কার করে খেত না) তেলাপোকাদের নৃশংস ভাবে নির্মূল করত। আপনি নিশ্চিত হতে পারেন, যে তেলাপোকাটি নীচের এপার্টমেন্ট থেকে তার পিছু নিয়ে এসেছিল, সে বেশীদিন টিকেছিল না। মার্সিয়া বাড়িওয়ালীকে নালিশ জানাতে পারত কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে এপার্টমেন্টটি ছিল বাড়িওয়ালীর এবং তেলাপোকটিও তারই ছিল। ক্রিসমাস সন্ধ্যায় এক পাত্র মদ্যপানের জন্য মার্সিয়া তার বাসাতে গিয়েছিল এবং সে স্বীকার করে সে বাসাটি অপরিস্কার ছিল না। সত্যিকার অর্থে সাধারনের চাইতে বাসাটি পরিস্কারই ছিল কিন্তু নিউইয়র্কের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। যদি প্রত্যেকে, মার্সিয়া ভাবত, আমার মত যতœ নিত, তাহলে আমি নিশ্চিত নিউইয়র্কে কোন তেলাপোকা থাকত না।
এরপর (এটা ছিল মার্চ মাস এবং মার্সিয়া সে শহরে তার ৬ বৎসর বয়সের মধ্যবর্তী সময়ে ছিল) শাপালভরা এলো পাশের এপার্টমেন্টে। তারা ছিল ৩ জন, দুইজন পুরুষ ও একজন মহিলা-সকলেই বৃদ্ধ যদিও কত বৃদ্ধ তা বোঝা মুশকিল, সম্ভবত তারা বয়সের চাইতেও বেশী বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সম্ভবত তারা চল্লিশের উপরে ছিল না। মহিলাটির যদিও তখনও বাদামী চুল ছিল, কিন্তু মুখ ছিল কুঞ্চিত এবং একাধিক দাঁত ছিল না। সে সব সময়ই রাস্তাতে বা হলওয়েতে মার্সিয়াকে থামাত, তার কোটের আস্তিন ধরত এবং সবময়ই সাধারণ কথাবার্তা বলত, আবহাওয়া সম্পর্কে যা ছিল অতি গরম, অতি ঠান্ডা, অতি আদ্র ্র বা অতি শুষ্ক। মার্সিয়া মহিলার অর্ধেক কথা কখনই বুঝতে পারত না কারন মহিলা অস্পষ্ট ভাবে কথা বলত। এরপর মহিলাটি তার থলিপূর্ণ শূন্যতা নিয়ে মুদিখানার দিকে এগিয়ে যেতো।
বুঝতেই পারছেন শাপালভরা ছিল মদ্যপ। মার্সিয়া আশ্চর্য হতো, তারা যে পরিমান মদ পান করত তার অর্থ কোথায় পেত ভেবে। কারন মদের মূল্য সম্পর্কে তার নিজের উচ্চ ধারনা ছিল। (সবচাইতে সহজলভ্য মদ হিসেবে সে ভদকাকেই ধারনা করত) তারা যে বেকার ছিল তা সে জানত কারন যে সমস্ত দিনে মার্সিয়া ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে বাসাতে পড়ে থাকত তখন তার এবং তাদের রান্না ঘরের মধ্যবর্তী পাতলা দেওয়ালের মধ্য দিয়ে তাদের মদ্য পানরত অবস্থার কথাবার্তা শুনতে পেত। তারা কল্যান ভাতা পাচ্ছে, মার্সিয়া ভেবেছিল অথবা একচক্ষু বিশিষ্ট মানুষটি কোন সাবেক সৈনিক যে অবসর ভাতা পাচ্ছে।
এমনিতে তাদের কথাবার্তার শব্দে সে বিরক্তবোধ করত না (্এমনিতেই সে খুব কম সময়ই বিকেলে বাসাতে থাকত) কিন্তু সে কখনই তাদের কথাবার্তার কোন অর্থই বুঝতে পারত না। সন্ধ্যার আগ থেকেই তারা রেডিও সেন্টারের সঙ্গে সঙ্গে বকরবকর শুরু করত। যা কিছুই সে শুনতে পারত তা তার কাছে গাই লম্বারডো মনে হতো। তবে প্রায় আটটার দিকে তারা ‘ক্যাপেলা’ গাইত। অদ্ভূৎ হৃদয়ভঙ্গকারী শব্দেরা উচ্চগ্রামে এবং নি¤œগ্রামে বিমান আক্রমনের সাইরেনের শব্দের মতো হতো। সেখানে ষাড়ের চিৎকার কুকুরের ঘেউ ঘেউ এবং ক্রন্দন শোনা যেত। একদা মার্সিয়া এরকমই শুনেছিল লোকগীতি চেক বিবাহ সঙ্গীতে। যখনই সেই বিরক্তিকর সঙ্গীত শুরু হতো, মার্সিয়া বাধ্য হোত গৃহত্যাগ করতে যতক্ষন না তারা তা শেষ করত। অভিযোগে ফল ছিলনা, শাপালভদের ঐসময় সঙ্গীত সাধনার অধিকার ছিল।
এছাড়াও কথিত ছিল যে, বিবাহসূত্রে তাদের একজনের সঙ্গে গৃহকত্রীর সম্পর্ক ছিল। সেকারনেই তারা এপার্টমেন্টটিতে আসে, যা তাদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। মার্সিয়া বুঝতে পারত না, কিভাবে তারা তিনজন ঐ অল্পস্থানে থাকতো। শুধুমাত্র একটি ঘর ও অর্ধেক, সঙ্গে একটি সংকীর্ণ জানালা, মার্সিয়া আবিস্কার করেছিল যে, সে তাদের সম্পূর্ণ বাসস্থানটিই দেখতে পেত একটি ছিদ্র দিয়ে যা রাজমিস্ত্রী শাপালভদের জন্য একটি সিংক বসানোর সময় দেয়ালে করে ফেলেছিল।
কিন্তু তাদের সঙ্গীত যদি তাকে বিমর্ষ করত, সে পোকাদের নিয়ে কিইবা করতে পারত। শাপালভদের মহিলাটি, যে একজনের ভগ্নী এবং অপরজনের স্ত্রী ছিল অথবা পুরুষদ্বয় ছিল সহোদর এবং সে তাদের একজনের স্ত্রী ছিল (কখনও কখনও দেয়ালের মধ্যে আসা কথাবার্তাতে মার্সিয়ার মনে হতো মহিলাটি হয় দুজনেরই কেউ নয় অথবা দুজনেরই স্ত্রী ছিল মন্দ গৃহরক্ষিকা। একারনে তাদের এপার্টমেন্টটি দ্রæতই ভরে উঠেছিল পোকাতে। যেহেতু মার্সিয়ার এবং শাপালভদের সিংক একই পানির লাইন দ্বারা পূর্ণ হতো এবং একই নর্দমাতে সেই পানি যে, তেলাপোকাগুলি মার্সিয়ার নিষ্কলুষ রান্নাঘরে ঢুকে পড়ত। সে আরো বেশী ঔষধ ছিটাতে পারত, কিন্তু কোনটাই কার্যকর হচ্ছিল না। শাপালভদের তেলাপোকাগুলি সর্বদাই তাদের
সিংকের নীচের ময়লা আবর্জনার ব্যাগে অন্য একলক্ষ ডিম পেড়ে ফেলত। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তারা পাইপের মধ্য বেয়ে মার্সিয়ার কাপ বোর্ডে প্রবেশ করত। বিছানায় শুয়ে সে তাদেরকে লক্ষ্য করত (এটা সম্ভব হতো কারন মার্সিয়া প্রতিটি ঘরে রাতের বাতি জ¦ালিয়ে রাখত) তারা মেঝে দিয়ে আসত এবং দেয়ালের উপর দিয়ে আসত। শাপালভদের আবর্জনা এবং অসুস্থতা তারা ছড়াত যেখানেই তারা যেত।
এক সন্ধ্যাতে পোকাগুলো ছিল বিশেষভাবে খারাপ… সে জানালাগুলো খুলে রেখেছিল এই বিশ^াসে যে পোকাগুলি হয়ত এটা পছন্দ করবে না কিন্তু সে লক্ষ্য করল যে সে নিজেই এটিকে অল্প পছন্দ করছে। যখন সে ঢোক গিলল, তার গলাতে ব্যাথা লাগল এবং সে বুঝতে পারল যে সে ঠান্ডা দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং সবটাই তাদের জন্য।
ওহ! চলে যাও! সে অনুরোধ করল চলে যাও! চলে যাও! আমার এপার্টমেন্ট থেকে চলে যাও। সে তেলাপোকাগুলিকে ঠিক সেই রকম ভাবেই সম্বোধন করল যেভাবে সে কখনও কখনও সৃষ্টি কর্তাকে প্রার্থনার জন্য আহŸান করে থাকে (যদিও সমসাময়িক সময়ে তা খুবই কম হচ্ছিল)। একবার সে সমস্ত রাত ধরে তার মুখের ব্রণ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করেছিল কিন্তু প্রত্যুষে তা স্মরনকালের সবচাইতে খারাপ অবস্থা হয়েছিল। অসহনীয় পরিস্থিতিতে মানুষ যেকোন কিছুকেই প্রার্থনার বিষয়বস্তু মনে করে। সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ শিবিরে ট্রেঞ্চে কোন নাস্তিকতাই অবশিষ্ট থাকে না। সেখানে বোমাদের কাছে মানুষ প্রার্থনা করে যেন তারা অন্য কোথাও বর্ষিত হয়।
মার্সিয়ার ক্ষেত্রে এটা একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল যে তার প্রার্থনার প্রত্যত্তর পাওয়া গিয়েছিল। তেলাপোকাগুলি তার এপার্টমেন্ট থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদেরকে সরিয়ে নিতে পারত, তত তাড়াতাড়িই চলে যেত এবং সরলরেখা ধরে যেত। তারা কি শুনেছিল তার কথা ? তারা কি বুঝেছিল ?
মার্সিয়া এরপরও দেখেছিল একটি তেলাপোকাকে কাপবোর্ড থেকে নেমে আসতে। ‘থাম’। সে নির্দেশ দিল! এবং সেটা থেমে গিয়েছিল।
মার্সিয়ার উচ্চারিত নির্দেশে তেলাপোকাগুলো এগোত এবং পিছিয়ে যেত, ডাইনে এবং বামে যেত। তার আতঙ্কগ্রস্থতা ক্রমান্বয়ে তাকে উম্মাদ করছে ভেবে সে তার উষ্ণ বিছানা ছেড়ে আলো জ¦ালাল ঘরে এবং সাবধানে সেই তেলাপোকাটির কাছে আসল যেটা গতিহীন ভাবে অপেক্ষা করছিল যেমনটি সে তাকে নির্দেশ দিয়েছিল। “তোমার শুঙ্গগুলি নড়াও” সে নির্দেশ দিল। তেলাপোকাটি তার শুঙ্গ দুটি নাড়াল।
মার্সিয়া আশ্চর্যাম্বিত হলো যে তারা সকলেই কি তাকে মান্য করবে এবং অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই দেখল যে, তারা সকলে তাকে মান্য করছে। তারা সবকিছুই করত মার্সিয়া যা তাদেরকে করতে বলত। তারা মার্সিয়ার হাত থেকে বিষ খেতেও পারত। হ্যাঁ সত্যি সত্যিই তার হাত থেকে নয় তবে এটা একরকম তাই হতো। তারা তার প্রতি দাসদের মত পুরোপুরি বাধ্য ছিল।
সে ভাবল এটাই সমস্যার সমাধান, সে ভাবল তেলাপোকা সমস্যার। কিন্তু অবশ্যই তা ছিল কেবল মাত্র শুরু। কেন তেলাপোকাগুলি তাকে মান্য করছে এটা সম্পর্কে মার্সিয়া গভীরভাবে চিন্তা করেনি। তত্ত¡গত সমস্যা নিয়ে সে কখনও নিজেকে কষ্ট দিত না। তাদের পিছনে যথেষ্ট সময় এবং গুরুত্ব দেবার পর এটা স্বাভাবিক হয়ে দাড়াল যে সে একটি বিশেষ ক্ষমতা তাদের উপর প্রয়োগ করবে। যাই হোক এই ক্ষমতা সম্পর্কে কাউকে না বলার বিষয়ে সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী ছিল এমন কি ইনসুরেন্স অফিসের মিস বিসমুথ কে পর্যন্ত নয়। মিস মিসমুথ নিয়মিত ভাবে হরোস কোপ ম্যাগ্যাজিন পড়ত এবং দাবী করত যে সে তার মায়ের সঙ্গে টেলিপ্যাথিক ভাবে যোগযোগ করতে পারে, যার বয়স ছিল আটষট্টি। তার মা বাস করত ওহিও তে। কিন্তু মার্সিয়া কি ই বা বলতে পারত? যে সে তেলাপোকাদের সঙ্গে টেলিপেথিক ভাবে যোগাযোগ করতে পারে? অসম্ভব!
মার্সিয়া তার এই বিশেষ ক্ষমতাটি শুধুমাত্র তেলাপোকাদেরকে তার এপার্টমেন্ট থেকে বের করা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত না। যখনই সে একটিকে দেখতে পেত তাকে নির্দেশ দিত শাপালভদের এপার্টমেন্টে যেতে এবং সেখানেই থাকতে। অবাক ব্যাপার এটা ছিল যে সবসময়ই পাইপের মধ্য দিয়ে অন্য তেলাপোকারা আসত। মার্সিয়া ধারনা করত যে তারা হচ্ছে নবজাতক। তেলাপোকারা দ্রæত বংশ বিস্তার করে জানা কথাই। কিন্তু তাদেরকে শাপালভদের কাছে ফেরৎ পাঠানো সহজ ব্যাপার ছিল।
‘তাদের বিছানাতে’ সে যোগ করত ‘তাদের বিছানাতে যাও’। যদিও ব্যাপারটি বিরক্তিকর ছিল, এই ধারনা তাকে অস্বাভাবিকভাবে শিহরিত করত। পরদিন সকালে শাপালভ মহিলাটি বিধস্থ অবস্থায় (সে যাই হোক, মার্সিয়া ধারানা করত তারা কি মাতাল ছিল?) তার এপার্টমেন্টের খোলা দরজাতে দাড়িয়ে ছিল। সে মার্সিয়ার সঙ্গে সে কাজে যাবার পূর্বে কথা বলতে চাচ্ছিল। তার পরিহিত কাপড়টি ঘর মোছার কারনে কর্দমাক্ত ছিল এবং সে যতক্ষন কথা বলছিল সে কাপড় থেকে পানি নিংড়ানোর জন্য কাপড় মোচড়াচ্ছিল।
“ধারনাতীত”! আকষ্মিক ভাবে সে চিৎকার করে উঠল ‘তুমি ধারনাই করতে পারবে না কত খারাপ! ভয়াবহ!” æকি? ” বিষয়টি সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা স্বত্বেও মার্সিয়া প্রশ্ন করল। “তেলাপোকা” সবখানেই রয়েছে। মিস্টি মেয়ে তোমার ওখানে ওরা নেই? আমি জানি না, কি করা দরকার। আমি চেষ্টা করি ঘর কে পরিচ্ছন্ন রাখতে, ঈশ^র জানেন… “সে তার ফোলা চোখ দুটি দিয়ে স্বর্গের দিকে দৃষ্টিপাত করল” কিন্তু আমি জানি না কি করা দরকার” যেন গোপনীয় কথা বলছে এভাবে সে সামনে ঝুকে আসল” তুমি বিশ^াস করবে না এটা মিস্টি মেয়ে কিন্তু গত রাত্রে…”
একটি তেলাপোকা চুলের বেশ গুচ্ছ বেয়ে মহিলাটির চোখের দিকে আসছিল। “…তারা আমাদের সঙ্গে বিছানাতে ছিল ! তুমি কি এটা বিশ^াস করবে? তারা সংখ্যাতে নিশ্চয়ই শতাধিক ছিল। আমি অসিপকে বললাম, আমি বললাম… কি হোল মিষ্টি মেয়ে?”
মার্সিয়া আতঙ্কে বাকরুদ্ধ হয়ে তেলাপোকাটির দিকে আঙ্গুল তুলল যেটি মহিলাটির নাকের উপরে পৌছে গেছিল তখন। “ইয়াক !” মহিলাটি আঙ্গুল দিয়ে পোকাটিকে পিষে ফেলল এবং নোংরা হাতটি তার নোংরা কাপড়ে মুছল। “শয়তান পোকারা আমি তাদেরকে ঘৃণা করি, ঈশ^রের নামে বলছি। কিন্তু একজন মানুষ কি করে উঠতে পারে। এখন, আমি তোমার কাছে আসলে জানতে চেয়েছিলাম মিষ্টি মেয়ে তুমিও কি পোকাদের নিয়ে একই সমস্যাতে পড়েছ ? তুমি ত ঠিক আমাদের পাশেই থাক আমি ভাবলাম”। যদিও দুজন মহিলা এটি আলাপ করছিল তবু সে সতর্কভাবে হাসল। মার্সিয়া ত ভেবেই বসেছিল যে তার আটকে রাখা দাঁতের মধ্য দিয়ে একটি পোকা বের হয়ে আসবে।
“না”-সে বলল। “না, আমি বø্যাক ফ্ল্যাগ ব্যবহার করি”। সে দরজার কাছ থেকে নিরাপদ সিঁড়ির দিকে সরে আসল। ‘বø্যাক ফ্ল্যাগ’ সে আবার বলল উচ্চস্বরে ‘বø্যাক ফ্ল্যাগ’ সিঁড়ির নীচ থেকে সে চিৎকার করে বলল। তার হাটুদ্বয় এমনভাবে কাপছিল যে সে সিঁড়ির রেলিং আটকে ঘরেছিল।
সে দিন ইন্সুরেন্স অফিসে মার্সিয়া পাঁচ মিনিটও একভাবে কাজে মন বসাতে পারছিল না। লভ্যাংশ প্রদান কিভাবে তার কাজ ছিল দুই সংখ্যার দীর্ঘ সারিকে বারিংস মেশিনে যোগ করা এবং তার সহকর্মীদের একই ধরনের কাজ পরীক্ষা করা।
সে সবসময়ই ভাবতে লাগল শাপলভদের মহিলাদের জটবাধা চুলে তেলাপোকারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, মহিলাটির বিছানাতে তেলাপোকার বন্যা এবং অন্যরা-জ্ঞান এবং অজ্ঞানতার সীমান্তে আতংকিত অবস্থায়। তার চোখের সামনে তেলাপোকারা কিলবিল করছিল, অবস্থা এত খারাপ হলো যে তাকে দুবার মহিলাদের ঘরে যেতে হলো। দুবার তাকে মহিলাদের বাথরুমে যেতে হলো, কিন্তু প্রত্যেকবারই তা ছিল মিথ্যা সংকেত। এছাড়া, দুপুরে তার খাবারের রুচি ছিল না। কর্মচারিদের খাবার ঘরে যাবার পরিবর্তে সে ২৩ নং রাস্তাতে এপ্রিলের বিশুদ্ধ বাতাসে ঘুরে বেড়াতে লাগল। যদিও এটা ছিল বসন্ত, মনে হচ্ছিল তা বয়ে এনেছে শোচনীয় বার্তা, নোংরা দূর্নীতির আগাম খবর। ফলটিরন বিল্ডিং থেকে আদ্র অন্ধকার নিঃসৃত হচ্ছিল। নর্দমাগুলি ভরে উঠেছিল নরম আবর্জনাতে। সস্তা বন্ধ ঘর থেকে যেভাবে সিগারেটের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে সেভাবেই সস্তা রেস্তোরা থেকে পোড়া তেলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল।
বিকালটি ছিল খুবই খারাপ। যতক্ষন পর্যন্ত না সে মেশিনের দিকে তাকাচ্ছিল, ঠিক সংখ্যাগুলি তার হাত খুজে পাচ্ছিল না। তার মাথার মধ্যে একটি বাক্য পুনরাবৃতি হচ্ছিল কিছু একটা করতে হবে’, কিছু একটা করতে হবে’। সে একেবারেই ভুলে গিয়েছিল যে সে তেলাপোকাগুলিকে আগের স্থানে, শাপালভদের বিছানাতে ফেরত পাঠিয়েছিল।
সে রাত্রে সে ঘরে ফেরার পরিবর্তে ৪২ নং রাস্তাতে একটি সিনেমা দেখতে গেল। সিনেমাতে তার মনসংযোগ হলো না। পরবর্তীতে সে শুধু এটুকুই মনে করতে পারল যে, সুশান হেওয়ার্ডের ছোট্ট বাচ্চাটি চোরাবালিতে প্রায় ডুবেই যাচ্ছিল। এরপর সে যা করল, সে জীবনে তা করেনি। একটি বারে বসে সে মদ খেলো। সে দুই গøাস মদ পান করেছিল। তাকে কেউ বিরক্ত করে নি, এমন কি কেউ তার দিকে তাকিয়েও দেখেনি। যেহেতু এত রাত্রে সাবওয়ে নিরাপদ ছিল না এজন্য সে থমসন স্ট্রীট পর্যন্ত একটি ট্যাক্সি ভাড়া করল এবং রাত এগারটার সময় বাসাতে এসে পৌঁছল। ড্রাইভারকে বকশিস দেবার মত কোন অবশিষ্ট তার কাছে ছিল না, ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল সে বুঝেছে তা।
শাপালভদের দরজার নিচ থেকে আলো বের হচ্ছিল এবং তারা গান গাচ্ছিল। রাত্রি এগারটার সময় মার্সিয়া নিজেকে বলল কিছু একটা করো। তার নিজের ঘরের আলো না জ¦ালিয়ে, এমনকি তার নিজের বসন্তের জ্যাকেটটির যা সে ওরব্যাকর্স থেকে কিনেছিল তা না খুলে মার্সিয়া সিংকের নীচে হামাগুড়ি দিয়ে নীচু হলো, সে পাইপের চতুর্পাশের ফাকা অংশে যে সমস্ত জিনিষ দিয়ে ভর্তি করে আটকে রেখেছিল তা ছিড়ে ফেলল।
শাপালভরা ৩ জন সেখানে মদ পান করছিল, একচক্ষু বিশিষ্ট মানুষটির কোলে কেউ বসেছিল, এবং অন্য মানুষটি যে নোংরা গেঞ্জি পরেছিল, গানের তালে তালে মেঝেতে পা ঠুকছিল। ভয়ংকর, তারা অবশ্যই মদ পান করছিল, এরপর মহিলাটি তেলাপোকাভর্তি মুখ দিয়ে একচক্ষু বিশিষ্ট লোকটিকে চুমু খাওয়া শুরু করল। ভয়ংকর, মার্সিয়া তার চুলে গিট পাকাচ্ছিল এবং ভাবছিল, নোংরা, রোগ ! কেন তারা গত রাত থেকে শিক্ষা গ্রহন করেনি।
অল্পসময় পর (মার্সিয়া সময়জ্ঞানও হারিয়েছিল) শাপাালভদের ঘরের আলো বন্ধ হলো। যতক্ষন পর্যন্ত না তাদের সাড়াশব্দ বন্ধ হলো মার্সিয়া অপেক্ষা করল। এরপর মার্সিয়া বলল “তোমরা সকলে যারা এই বাসভবনে আছ, তোমরা সকলে বিছানার চতুপাশে জড় হও, এবং অপেক্ষা করো, ধৈর্য্য ধর। তোমরা সকলে…“তার আদেশের শব্দগুলি ছোট ছোট অংশে ভেঙ্গে আসছিল, জবমালার গুটিগুলির মত, বাদামী কাঠের গুটিগুলি জড় হচ্ছিল গোলাকৃতি হয়ে… অপেক্ষা করছিল ক্ষনকাল… “তোমরা সকলে’…” ধৈর্য্য ধর”…“জড় হও”… তার হাত ঠান্ডা পানির পাইপে আঘাত করছিল, তাল ঠুকছিল, এবং মনে হচ্ছিল, সে তাদের শব্দ শুনতে পারছে—- তারা জড় হচ্ছিল, দেয়াল বেয়ে আসছিল। কাপবোর্ড থেকে বের হচ্ছিল, ময়লার ব্যাগ থেকে। সৈন্যদল এবং সে তাদের প্রকৃত রাণীমাতা এখন। সে বলল… ঢেকে ফেল তাদের, তাদের উপরে উঠ, খেয়ে ফেল তাদের।
সে তাদের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল তখন। সে তাদের স্পর্শ করার মত অনুভব করতে পারছিল। তাদের শব্দ ছিল বাতাসে ঘাসের শব্দের মত, ট্রাক থেকে প্রথম পাথর পড়ার শব্দের মতন। এরপর ছিল শাপালভ মহিলাদের কান্না এবং পুরুষদের মুখ হতে উচ্চারিত অভিশাপ, এত কঠিন অভিশাপসমূহ যা মার্সিয়া সহ্য করতে পারছিল না।
একটি আলো জ¦লে উঠল এবং মার্সিয়া তাদেরকে দেখতে পেলো, তেলাপোকাগুলিকে, সর্বত্র। প্রতিটি জায়গায়, দেওয়ালে, মেঝেতে, ফার্নিচারের নোংরা কাঠি, সবই ছিল পুরু হয়ে বøাটিলি জারমানিতে। সেখানে একটি স্তরের চাইতেও বেশী ঘন ছিল।
শাপালভ মহিলাটি, তার বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে একভাবে কাঁদছিল। তার গোলাপী নাইট গাউনটিতে ছিল বাদামী কালো বিচিত্র ফোটা।তার ফোলা আঙ্গুলগুলি চেষ্টা করছিল তার চুল থেকে পোকাগুলি ফেলে দিতে, তার মুখ থেকেও। যে পুরুষটি অন্তর্বাস পরিহিত অবস্থায় কিছুক্ষন আগেও সঙ্গীতের সঙ্গে প ায়ের তাল ঠুকছিল, সে এখন আরো জরুরীভাবে পা নাড়াচ্ছিল, তার হাত তখনও ধরেছিল লাইট কর্ডটি। অল্প সময়ের মধ্যেই মেঝে গলিত তেলাপোকাতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল, এবং পুরুষটি তাতে পা পিছলিয়ে পড়ল, আলো চলে গেল, মহিলাটি তখন কান্নারুদ্ধ হয়ে গেছিল যদিও…
কিন্তু মার্সিয়া তা চিন্তা করছিল না, সে ফিসফিস করে বলল আর নয়, থাম।
সে সিংকের কাছ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে সরে আসল তার বিছানার কাছে যেটাকে কতগুলো কুশন দিয়ে দিনের বেলা কোচ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছিল। তার গলাতে একটি কৌতুহলী সংকোচন তৈরী হয়েছিল। সে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে ঘামছিল।
শাপালভদের ঘর থেকে হাতাহাতির শব্দ আসছিল, দরজা ধাক্কার শব্দ আসছিল, চলন্ত পদশব্দ এবং এরপর একটি উচ্চ পতনের শব্দ পাওয়া গেল, সম্ভবত নীচ তালাতে শরীর পতনের শব্দ। গৃহকত্রীর আওয়াজ ভেসে আসল “কি ভেবেছ কি তোমরা?” অন্যদের শব্দ তার আওয়াজকে অতিক্রম করে গেল। অসঙ্গতিপূর্ণ পায়ের আওয়াজ সিঁড়িতে দৌড়ে গেল।
আবার গৃহকত্রীর আওয়াজ, এখানে কোন তেলাপোকা নেই, স্বর্গদ্যানের দোহাই। তেলাপোকা আছে, তোমাদের মাথাতে। তোমাদের মাথা খারাপ আছে, এটাই হচ্ছে কারন। এবং যদি তেলাপোকা থেকেও থাকে, সেটাও আশ্চর্যের বিষয় নয়, জায়গাটি নোংরা। মেঝের উপর দেখ, নোংরা। আমি তোমাদের যথেষ্ট সহ্য করেছি। আগামীকাল তোমরা বের হয়ে যাবে, শুনেছ, এটা ছিল একটি পরিস্কার, ভদ্র বাসা।
শাপালভরা তাদের উচ্ছেদের কোন প্রতিবাদ করেনি। এমন কি তারা চলে যাবার জন্য আগামীকালেরও অপেক্ষা করেনি। তারা তাদের এপার্টমেন্ট থেকে পালিয়ে গিয়েছিল শুধুমাত্র ১টি স্যুটকেস একটি লন্ড্রি ব্যাগ এবং একটি ইলেকট্রিক টোষ্টার সহ। মার্সিয়া তার অর্থ খোলা দরজা দিয়ে তাদের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া দেখেছিল। হয়েছে, সে ভেবেছিল, সব শেষ হয়েছে। আনন্দের নিশ^াস ফেলে সে তার বিছানার দুপাশের আলো জ¦ালিয়েছিল। ঘরটি আলোতে উদ্ভাশিত হলো।
সে ভাবল তার বিজয় উৎযাপন করবে এজন্য সে কাপবোর্ডের কাছে গেল, যেখানে সে ক্রীম ডি মেন্ডলের একটি বোতল রেখেছিল। কাপবোর্ডটি পরিপূর্ণ ছিল তেলাপোকাতে। শাপালভদের এপার্টমেন্ট ছাড়ার সময় সে তাদেরকে বলেনি যে, কোথায় যেতে হবে, কোথায় যেতে হবে না। এটা ছিল তার নিজের দোষ।
তেলাপোকার বিশাল নিঃশব্দ বহর মার্সিয়াকে শান্তভাবে শ্রদ্ধা জানাল। এবং শংকিত মেয়েটির মনে হয়েছিল যে ,সে তাদের ভাবনাকে বুঝতে পারছে। বিশেষ করে তাদের একটি বিশেষ ভাবনাকে। সে এই ভাবনাটিকে এত স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছে যেমনটি সে তার জানালার পাশের প্রষ্পুটিত চকফুল ও নাটের বিল বোর্ডটি বুঝতে পারে। এটি এত সুক্ষè যেম ন সহ¯্র সুক্ষè নলের মধ্য দিয়ে সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ে। প্রাচীন সঙ্গীত বাক্স যা শতাব্দীর স্তব্ধতার পর নোংরা হয়েছে। আমরা তোমাকে ভালবাসি, আমরা তোমাকে ভালবাসি।
মার্সিয়ার ভিতর তখন কিছু একটা অদ্ভুত হতে লাগল, কিছু একটা যা আগে হয়নি কখনও। সে সাড়া দিল, ‘আমিও তোমাদের ভালবাসি ’ সে উত্তর দিল, ‘ওহ আমি তোমাদের ভালবাসি, আমার কাছে এস, তোমরা সকলে, (আমার কাছে এসো, আমি তোমাদের ভালবাসি) আমার কাছে এসো’
ম্যানহাটনের প্রতিটি কোনা থেকে, হার্লেম এর ভাঙ্গা দেয়াল থেকে, ৫৬ স্ট্রীটের রাস্তাগুলি থেকে, নদীর ধারের ওয়ারহাউজ থেকে, সিউরাস থেকে এবং গার্বেজ ক্যানগুলির কমলার খোসা থেকে, প্রিয় পোকাগুলি সামনে এগিয়ে আসতে লাগল, তাদের স¤্রাজ্ঞীর দিকে।
Thomas M. Disch: জন্ম : ফেব্রæয়ারী ২, ১৯৪০, মৃত্যু : জুলাই ৪, ২০০৮। আমেরিকান বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক এবং কবি, ১৯৯৯ সনে ‘হুগো পুরস্কার’ পেয়েছেন। ১৯৬০ সন থেকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লিখছেন। বিখ্যাত গল্পগুলির মধ্যে রয়েছে ‘দি জেনোসাইডস, ক্যাম্প কনসেনট্রেশন, ৩৩৪ এবং অন উইং অফ সন্স। অন্য কয়েকটি ছোটগল্পের সঙ্গ্ ে‘দি রোচেস’ গল্পটি ১৯৬৫ সনে একই শিরোনামের বই-এ প্রকাশিত হয়।
সেলিনা ইব্রাহিম : কানাডা সরকারের অধীনে ‘Epidemiologist’ হিসেবে IQALUIT, NUNAVUT এ কর্মরত।
Leave a Reply