বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ০৯:৫৬ অপরাহ্ন

কানাডার টরন্টো থেকে বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক জসিম মল্লিক এর কলাম পরিযায়ী করোনা দিনের ডাইরি : পর্ব-৫

কানাডার টরন্টো থেকে বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক জসিম মল্লিক এর কলাম পরিযায়ী করোনা দিনের ডাইরি : পর্ব-৫

কানাডার টরন্টো থেকে
বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক জসিম মল্লিক এর কলাম পরিযায়ী
করোনা দিনের ডাইরি : পর্ব-৫

বই এবং ভয়ের হাত থেকে মুক্তি
নানা শঙ্কা আর ভয়ের পৃথিবীতে সময় কাটানোও একটা দূরহ ব্যাপার এখন। গৃহবন্দী জীবন আর মৃত্যুউপত্যকার মধ্যে বেঁচে আছি। জীবন্মৃত কি একেই বলে! সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রার্থনা করি সর্বক্ষন। সবার মঙ্গল হোক। পৃথিবী আবার স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে আসুক। প্রতিদিন এতো এতো আক্রান্ত, মৃত্যু, রিকোভারি, লকডাউন, আইসোলেশন, কোয়ারেনটাইন, মাস্ক, গøাভস, সোশ্যাল ডিসট্যান্স, এম্বুলেন্স, হাসপাতাল, আইসিইউ, ভেন্টিলেশন, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, মন্দা, দুর্ভিক্ষ এই শব্দগুলো বেঁচে থাকা জীবনকে অবশ করে দিয়েছে। এগুলো এখন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কম দিনতো বাঁচলাম না, যদি আর নাও বাঁচি আমাদের সন্তানরা যেনো নিরাপদ থাকে এই প্রার্থনা করি।
সময় কাটানোর জন্য আমার কাছে বই হচ্ছে এখন সবচেয়ে বড় আশ্রয়। যতক্ষন বইতে ডুবে থাকি ততক্ষনই মুক্তি। ভয়ের হাত থেকে মুক্তি, ট্রমা থেকে মুক্তি, দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থতার হাত থেকে মুক্তি। অনেকদিন এই থেকেই বইটি পড়ব পড়ব করছিলাম। কিন্তু পড়া হয়ে ওঠেনি। এখন পড়ছি। বইটি সম্পর্কে বাঙাল নামার লেখক তপন রায় চৌধুরী তাঁর লেখা মুখবন্ধে ’বরিশাল সমগ্র’ নামে অভিহিত করেছেন। ক্লেদমুক্ত মানসিকতায় অলংকৃত, স্বচ্ছ মানবতাবোধে সমৃদ্ধ, মর্মন্তদ অভিজ্ঞতায় আপন্ন তাঁর প্রতিটি রচনাই অসামান্য।
ভাটিপুত্রের পত্র বাখোয়াজ, ভাটিপুত্রের অপবর্গ দর্শন, চান্দ্রদ্বীপি শোলোক শাস্তর পাল্কি কথা, সিদ্ধিরগঞ্জের মোকাম এবং বিষাদবৃক্ষ এই পাঁচটি রচনা রয়েছে বইটিতে। তার মধ্যে বিষাদবৃক্ষ তুলনাহীন। “উজানি খালের সোঁতা” সব মিলিয়ে যে নিদারুণ কাল এর ভেতর দিয়ে আমরা চলেছি, তারই প্রতিলিপি যেনো।
টরন্টো ২৩ এপ্রিল ২০২০
এবার যদি বেঁচে যাই
মৌন থাকা সকলের জন্যই ভাল। আত্মা তাতে শান্ত হয়। আমার কন্ঠস্বরের জোর কম বলে আমি বেশিরভাগ সময় মৌন থাকি। মৌনব্রত আমার জন্য নিরাপদ। জেসমিন প্রায়ই আমার কথা শুনতে পায় না। আমি পাশে বসেই কথা বলছি কিন্তু সে বলবে, কি বলছ! আমি বলি একটা শুনছে আর একটা। হয়ত বললাম একটু চা বানাও, উত্তরে বলবে তোমার কোনো চিঠি আসে নাই। দোষ আমার ভয়েসের। আমি কখনো কোনো ইন্টারভিউ দেওয়ার পর যখন সেই ইন্টারভিউ শুনি তখন আমার নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। কন্ঠস্বর কেমন ফ্যাস ফ্যাসে লাগে শুনতে। অথচ অনেকেই বলেছে ফোনে আমার কন্ঠ নাকি অনেক সুন্দর। যার নয়নে যারে লাগে ভাল টাইপৃ। কোথায় যেনো পড়েছি মৌন থাকলে চিন্তার ক্ষমতা বাড়ে। সমুদ্রে দিশেহারা নাবিকের মতন যখন অবস্থা হয় তখন আমার মতো গৃহীর, সঠিক দিক নির্ণয়ের জন্যে মৌনতা অবশ্যই ভাল কাজ দেয়।
এখন এই করোনাকালে আরো বেশি মৌনতায় পেয়েছে আমাকে। কথা বলার মানুষ নাই। গৃহে দু’জন মানুষ আমরা তাও কথা হয় কদাচিৎ। যেনো দুজন দুই গ্রহের বাসীন্দা। শুধু গ্রোসারি লাগবে কিনা, ফেসবুকে কে কি ট্রল করল বা ট্রুডুকে নিয়ে কোন মেয়ে ক্রাশ খেয়েছে এই রকম এলেবেলে কথা হয়। কথা না বলার পক্ষে রবীন্দ্রনাথ তার পুত্রবধূ মীরাদেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন,” ঠিক করেছি এখন থেকে দীর্ঘকাল প্রচ্ছন্ন থাকব। কারও সঙ্গে কোনো কারণেই দেখা করব না। কেবল বুধবার দিনে নিজেকে প্রকাশ করা যাবে। আত্মীয়দের চিঠি ছাড়া পড়ব না।” এখানে আত্মীয় বলতে কবিগুরু কাদের বুঝিয়েছেন জানি না, কিন্তু মধ্যজীবনে এসে সাধক রবীন্দ্রনাথ এই কথাটি বুঝেছিলেন যে, রক্তসূত্রের আত্মীয়তাটা আসল আত্মীয়তা নয়।
সংসারের মধ্যে থেকে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিটা মানুষের নিজেকে খোঁজার দরকার আছে। নিজেকে পেতে হলে সংসার বিবাগী হতে হয়। বৈরাগ্য দরকার আছে। সংসার শুধু কোলাহল। কবিগুরু এক জায়গায় বলেছেন, ”গভীরভাবে, সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিয়ে থাকব। যদি লেখা জমে আসে তো লিখব। পন্ডিচেরিতে অরবিন্দর সঙ্গে দেখা করে আমার মনে হল আমারো কিছুদিন এইরকম তপস্যার খুবই দরকার। নইলে ভিতরকার আলো ক্রমশই কমে আসবে। প্রতিদিন যাতা কাজ করে যাতা কথা বলে মনটা বাজে আবর্জনায় চাপা পড়ে যায়। নিজেকে দেখতে পাইনে।” রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে বিদেশ থেকে একবার কবি লিখেছিলেন,” দেশে গিয়ে সম্পূর্ণ নির্জনবাসের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে দীর্ঘকাল বাক্য ও কর্ম থেকে সম্পূর্ন নিস্কৃতি নেব ঠিক করেছি।”
আমিও ঠিক করেছি এবার যদি বেঁচে যাই তাহলে নির্জনতার সন্ধান করব। নির্জনতা কখনো আমাদের শূন্য হাতে ফেরায় না। লেখাও নির্জনতার অবদান। কোলাহলে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। নিরবচ্ছিন্ন নির্জনতার সন্ধান করব। ঘোর লাগানো নির্জনতা। নির্জনতার মধ্যে না গেলে, নিজের মন নির্জন না হলে কোনো কিছু ভাবা সম্ভব না। আমাদের মতো সাধারন মানুষ মেন্টাল-ওয়াল্ড-এর গন্ডির বাইরে যেতে পারে না প্রায়ই। তাইত নির্জনতা আর জনতার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। ম্যারি এ্যান শেফার বলেছেন, I don’t want to be married just to be married. I can’t think of anything lonelier than spending the rest of my life with someone I can’t talk to, or worse, someone I can’t be silent with.
টরন্টো ২৯ এপ্রিল ২০২০
খবর ভাল না
কালকে টরন্টোর জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেল সিপি২৪ এর স্ক্রলে বার বার বাংলাদেশের খবর দেখাচ্ছিল। সম্ভবত আক্রান্তের সংখ্যা দশ হাজার ক্রস করেছে বলেই খবরটি গুরুত্ব পেয়েছিল। কানাডার মতো প্রো এক্টিভ দেশেও এখন পর্যন্ত ৬২ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, ২৬ হাজার রিকভারি করেছে এবং ৪ হাজারের মতো মারা গেছে। কানাডার লোক সংখ্যা সাড়ে তিন কোটির কিছু কম। আয়তন প্রায় ১ কোটি বর্গ কিলোমিটার। জনঘনত্ব ৪ জন প্রতি বর্গ কিলোমিটারে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সতেরো কোটির মতো। আয়তন দেড়লাখ বর্গ কিলোমিটার। জনঘনত্ব বারোশোর কিছু বেশি প্রতি বর্গ কিলোমিটারে। সেখানে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮৭ জন মারা গেছে এবং ১১ হাজারের মতো আক্রান্ত হয়েছে।
আপাতঃ দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থা কানাডা বা ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় খুবই ভাল মনে হয়। সেকথা সরকার বারবার বলছেও। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী! পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন করোনা সামান্য সর্দি জ্বরের মতো। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন কিছু পত্রপত্রিকা এবং বিএনপি করোনা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মন্ত্রীদের কথা সত্যি প্রমানের জন্যই হয়তবা লক ডাউন শিথীল করা হচ্ছে। গার্মেন্টস খুলে গেছে, শপিং মল খুলবে। এরপর অন্যরাও দাবী করবে। পরিবহণ দাবী করবে, হোটেল রেষ্টুরেন্ট দাবী করবে, কোর্ট কাছারি খুলবে। কিন্তু লোকজন মারাত্মক ভয় এবং শঙ্কার মধ্যে আছেন। প্রতিদিন বেড়েই চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা!
টরন্টো ৬ মে ২০২০
নতুন করে পাব বলে
আমার মধ্যে সব সময়ই একটা ছন্নছাড়া আমি আছে। সন্ন্যাসী টাইপ আমি। ছোটবেলা থেকেই এই বাউল আমিকে লালন করি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই নিজেকে মনে হতে লাগল আজব। অর্থহীন জীবন যাপন। শৈশব থেকেই আমি নির্জন হয়ে পড়ি। একলা একলা ঘুরতাম যেখানে সেখানে। বাড়িতে আমার খেলার সাথী বা পাড়ার সম বয়সীদের সাথে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠেনি কখনো। আমি খুব নিঃসঙ্গ একজন ছিলাম। আমি বুঝতে পারতাম আমি ওদের মতো না। ওদের মতো আমার কোনো স্বপ্ন নাই, উচ্চাশা নাই, বড় হওয়ার চেষ্টা নাই। ওসব বোধ তৈরী হয়নি। তখন থেকেই আমি মানুষের বড় হওয়ার চেষ্টাকে, জীবন ফেনানোকে ঘৃণা করতাম। সংসারী প্রতিটি মানুষের প্রতি আমার অনুকম্পা হতো। আমাকে নিয়ে কেউ কোনো আশা করেনি কখনো। কোনো অহংকার ছিল না কারো। সংসারের কিছুই আমি গ্রহণ করতে চাইনি, পৈত্রিক সম্পত্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলাম। বয়স নিয়ে মাথা ঘামাইনি, ধার্মিক না হয়েও সন্ন্যাসী মনে হতো নিজেকে।
চোখ বুজলেই একটা নদী দেখতে পেতাম, অথৈ নদী, ঘোলা জল, উঁচু বালিয়াড়ি, সাপের খোলস। এখনও সেই নদী আমার সঙ্গে আছে। দূর দিগন্তে চলে গেছে সমান্তরাল পথ, কাঁধে রুক-স্যাক, পায়ে ময়লা স্যান্ডেল, নোংরা জামা কাপড়, গালে খোঁচা দাড়ি-আমি চলছি। চোখে কোনো কামনা বাসনার বাস নেই, পরিষ্কার চোখ, সেই চোখে পাহাড়, অরণ্য, সমুদ্র। আজকাল প্রায়ই মনে হয় আরে অনেকিদিনতো বেঁচেছি! মৃত্যু ভয়ও কাজ করে। নিজেকে পুরনো মনে হয়, বয়ষ্ক একজন মনে হয়। বাউন্ডেলে স্বভাবটা কোথায় গেলো! যেনো আমার দৌড় সাজ ঘর থেকে স্টেজ পর্যন্ত।
কারো কাছে কখনো আইডল হতে চাইনি। এই যে আমি সংসারী- স্ত্রী, সন্তানদের কাছেও না। সন্তানরাই আমার আইডল। সব সময় মনে হয় বেরিয়ে পড়ব। রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় মুখে কয়েকটা সর্পিল রেখা ফুটে উঠে, আর ভিতর থেকে কেউ বলে উঠে বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়। মৃত্যুভয়, ধ্বংসের ভয়, হারানোর ভয় সঞ্চারিত হয়না আর। কবেই নিজেকে নিজে মেরেছি। ভালবাসাই আমাদের দুঃখের কারণ কেননা সব ভালবাসার জিনিষেরই মৃত্যু আছে। আকাশ, বাতাস, মাটি অনেক নিয়েছি, সেটা শোধ করতে হবে। পৃথিবী আমার জন্য পড়ে আছে..।
টরন্টো ৯ মে ২০২০
মাদার্স ডে এবং একটু ছুঁয়ে দেখা
অরিত্রি এমনই। সব মেয়েরাই তাই। বাবা মায়ের জন্য মন কাঁদে। বাবা মায়েরও কি কাঁদে না! খুব কাঁদে। অন্য সময় সপ্তাহে দুই তিনবার আসত অরিত্রি। ইউকএন্ডে তো কথাই নেই। হোক শনি বা রবি আসতোই। এসেই নিজের রুমে ঢুকবে, কিছুই তো চেঞ্জ হয় নাই। যেভাবে রেখে গেছিল সবকিছু সেভাবেই আছে। কিছুই নিয়ে যায় নাই। এমনকি কসমেটিকসও রয়ে গেছে। বাসার চভবির গোছাও একই আছে। এসে চেঞ্জ হবে, শাওয়ার করবে, খাবে।
একটু পরই বলবে বাবা চা বানাও।
আমি চা বানাই।
তুমি কিন্তু জীমে যাবা, কার্ব নিবানা।
আমি বলি ওকে।
সেই অরিত্রি গত প্রায় পঞ্চাশ দিন আসেনি। আসতে চায় কিন্তু আমি সায় দিইনা। আমি আর জেসমিন মাঝে মাঝে ডাউনটাউন যাই অরিত্রির এপার্টমেন্টের নিচে। অরিত্রি নেমে আসে। জেসমিন খাবার দাবার দিয়ে আসে। বেশিক্ষন থাকি না। অরিত্রি ¤¬ান মুখে তাকিয়ে থাকে। আহারে! মনটা হুহ হু করে ওঠে।
অর্ক একটু বেশি সাবধান। সেও বাসার নিচে পর্যন্ত আসে। আমি দূর থেকে দেখি। তারপর চলে যায়। কিন্তু কাল ছিল মাদার্স ডে। অরিত্রি নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। আমরা গিয়েছিলাম গ্রোসারি করতে। এসে দেখি অরিত্রি বাসায়। মনে মনে আমি খুব খুশী। মায়ের জন্য গিফ্ট, ফুল ইত্যাদি নিয়ে এসেছে।
আমি বললাম, আম্মু ইফতার করে যেও।
অরিত্রি বলল, আচ্ছা।
অনেক কিছু তো শিখে ফেলেছো রান্না বান্না তাই না!
অরিত্রি আমাকে বৃত্তান্ত দেয় কি কি শিখেছে।
অর্ক আজকে এসেছিল ফুল নিয়ে। কিন্তু বাসায় ঢোকেনি।
আহা জীবন। নিজের সন্তানকে ছুঁয়ে দেখতে পারি না! গায়ের ঘ্ৰাণ নিতে পারি না!
টরন্টো ১১ মে ২০২০
মাথায় মধ্যে ভুতুরে একটা আকাশ ঢুকে পড়ে
আজকাল মানসিক স্বাস্থ্যের কথা খুউব উচ্চারিত হচ্ছে। শুধু শারীরিক নয় মানসিক সুস্থ্যতাও জরুরী হয়ে পড়েছে। এই বিষয়টির উপর আগে কেউ জোর দেয়নি তেমন। কিন্তু এখন যে কঠিন পরিস্থিতি পৃথিবীতে তাতে মানসিক সুস্থ্যতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এরকম আরো অনেক দিন থাকলে কোটি কোটি লোক মানসিক ঝুঁকিতে পড়বে। অনেক মানুষ পাগল হয়ে যাবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করবে। আমি নিজেও সেটা টের পাচ্ছি। খুব অস্থির লাগছে প্রতিদিন। কোনো কিছুতে স্বস্তি পাচ্ছি না। মনে হয় মাথার মধ্যে বিশাল একটা আকাশ ঢুকে পড়েছে। মেঘের মতো আবছা সবকিছু। পে¬ন যেমন মেঘের উপরে উঠে গেলে সবকিছু ধোঁয়াটে দেখায় আমারও তেমন অবস্থা। দিকচিহ্নহীন আকাশের দিকে তাকালে যেমন অপার্থিব লাগে তেমন।
মনে হয় আমি এই পৃথিবীর আর কেউ না। আমার আর কোনো অধিকার নেই। পৃথিবীর অনেককিছু ভোগ করেছি অনেকদিন। পৃথিবী এখন তার শোধ তুলছে কড়ায় গন্ডায়। আকাশের ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছি পালকের মতো। বোধবুদ্ধি কিছু কাজ করছে না। মাথার মধ্যে ঝম্ ঝম্ একটা শব্দ হয়। তখন পাগল পাগল লাগে। আজকাল যখনই কিছু পড়তে বসি, একটানা কিছুক্ষণ পড়ার পর মাথায় কোথাকার কোন সাজঘর থেকে দু’খানা নূপূর-পরা পা মাথার মঞ্চে চলে আসে নাচতে নাচতে। কীরকম রিম্ঝিম্ শব্দ হতে থাকে। সেই শব্দে একধরণের সম্মোহন জাগায়। চোখের সামনের সব দৃশ্য মুছে গিয়ে ফুটে উঠে এক শূন্যতার দৃশ্য। কেবল শব্দ আর শব্দ। রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ -দু’খানা নাচের পা ঘুরছে, উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিম দিচ্ছে সব গুলিয়ে। সেই শব্দে সব বোধ বুদ্ধি ডুবে যায়।
পাখিদের মতো মানুষের পালক নেই যে উড়ে গেলেও দু’একটা পালক পড়ে ধাকবে। কিন্তু পালকের মতোই হালকা মিহি নরম কী যেনো সব পড়ে আছে চারিদিকে টের পাওয়া যায়। হাওয়া দিলে সেগুলো উড়ে উড়ে বেড়ায়। চোখে দেখা যায় না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখা যায় জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না এসে বিছানা ভাসিয়ে দিচ্ছে। সেই জ্যোৎস্নার দিকে অনেকক্ষন চেয়ে থাকলে হঠাৎ দেখতে পাওয়া যায় হাল্কা কুয়াশার মতো কী যেন ভেসে আছে। ঘুরছে ফিরছে উঠছে নেমে আসছে। এসবই হয়তবা মানুষের অদৃশ্য পালক। যেখানে মানুষ কিছুদিন বাস করে সেইখানে তার কথার স্বর বাতাসে থেকে যায়। থাকে কামনা বাসনার ছাপ, ইচ্ছে অনিচ্ছা থেকে যায়। সে সবই হালকা মিহিন পালকের মতো ঘোরে ফেরে, বাতাসে ভেসে বেড়ায়।
জানালার ডালে একটা নিমডাল ঝুঁকে পড়েছে। নতুন বর্ষার পাতা এসেছে। সতেজ পাতা। তাতে রোদ পড়ে সবুজ আলো দিচ্ছে চারধারে। পোকামাকড়ের আনন্দের শব্দ ওঠে চারিদিকে। একটা কেন্নো জানালার শিক বায়। সতেজ নিমগাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে ঐ দূরের মেঘহীন আকাশ দেখা যায়। ঐখানে থাকে স্বপ্নের শিশুরা। লাল নীল বল। চারদিকে ওড়াওড়ি করে মানুষের ফেলে যাওয়া পালক। জানালা দিয়ে মেঘভাঙা রোদ এসে পড়ে। চারদিকে আলোয় আলোময়। চড়াই পাখিরা উড়ে আসে ঘরে। আসে এক-আধটা মৌমাছি, ফড়িং। পিঁপড়েরা দেয়ালে বায়, কেন্নো আসে, সবুজ পোকা একটা জানালার শিক বেয়ে ওঠে। ভেজা জঙ্গলে রোদ পড়ে একটা বুনো মিষ্টি গন্ধ ছড়াতে থাকে। বকুলগাছ যখন অন্ধকারে তার বকুল ঝরায় তখন সেই পতনশীল বকুলের শব্দে গন্ধে পুরনো সব কথা জীবন্ত হয়ে ওঠে।
রাতে অদ্ভুৎ সব স্বপ্ন দেখি। কোনো মাথা মুন্ড নাই যার। এমন এমন সব মানুষদের এমন সব অবস্থায় দেখতে পাই যা কখনো ভাবিনি। অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়, বিদঘুটে, হাস্যকর ঘটনা ঘটে স্বপ্নে। নিজেকে অচেনা লাগে। জেসমিনকেও মনে হয়ে একটা চলমান শরীর আমার আশ পাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করছে। স্বপ্নে বিদঘুটে সব ব্যাপার ঘটে, হরর মুভির মতো গাড়ির পিছনের সীটে একটা মৃতদেহ বসে আছে। কে যেনো কখন অলক্ষ্যে মৃত দেহটি পাচার করে গেছে। একটা মৃত লোক বসে আছে পিছনের সীটে। ঘাড় লটকে-লট্পট্ করছে দুলুনিতে। হঠাৎ পিছনের সীটে মচ করে শব্দ হয়। পরিষ্কার শব্দ। কোনো ভুল নাই। ঐ ডেডবডিটা। বস্তুত ডেডবডিটা দেখা যায় না কখনো। কিন্তু শালা আছে ঠিকই। ডাকটিকিটের মতো সেঁটে আছে।
এভাবেই আধাভৌতিক দিন যায়, দুপুর গড়ায়, ভোর নামে। আর প্রতিদিন একটু একটু করে মাথায় মধ্যে একটা ভুতুরে আকাশ ঢুকে পড়ে..।
টরন্টো ১৫ মে ২০২০
ঈদের ঘুম
ঘরবন্দী ঈদ আমার জন্য নতুন কোনো ঘটনা না। এরকম অনেক ঈদ আমার জীবনে এসেছে। তাই ঈদে বাইরে যেতে পারব না বলে খারাপ লাগছে না। কোলাকুলির ব্যপারেও আমি একটু শাই। প্রিয়জনদের বাড়িতে সেমাই আর পোলাও মাংস খাওয়া হবে না বলে খারাপ লাগছে না। জীবন এমনই। কত ঈদ এভাবে পার হয়েছে! মনে আছে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতাম প্রায়ই বরিশালে ঈদ করতে যেতে পারতাম না। হল খালি হয়ে যেতো। খা খা শূন্য হল। আমার মতো দু’চারজন হলে পড়ে থাকত। তারা কেনো যেতোনা তা কখনো জানা হয়নি। আমি যেতাম না কারন আমার যাওয়ার লঞ্চভাড়া থাকত না তাই। নতুন কাপড় কেনা হয় নাই তাই। জানি মা পথের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। কবে আসব আমি। কিন্তু মাকে বলতাম, মা, ঈদের পর পরই আমার টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা তাই আসতে পারব না। মা কষ্ট পেতেন কিন্তু কিছু বলতেন না। ঈদের দিন অদ্ভুত ঘুম পেতো আমার। ঘুম থেকে উঠে হলের বিশেষ ফীষ্ট খেতাম মজা করে।
টরন্টো ২৪ মে ২০২০
এ কেমন ঈদ!
এমন করুন আর দুঃখী ঈদ আর আসেনি। তবুও কাল ঈদের দিন টরন্টোতে একটা ঈদ ঈদ আবহ ছিল। আমি যে এলাকায় থাকি সেটা মুসলিম সংখ্যাধিক্য বলেই এমনটা মনে হয়েছে। আমার অন্য ধর্মের বন্ধুরাও ঈদ উৎসবে সামিল হয়েছে, শুভেচ্ছায় ভাসিয়েছে, ছবি পোষ্ট করেছে। অনেকেই সীমিত পরিসরে প্রিয়জনদের সাথে দেখা করেছে। অতি সহসীরা খানিকটা কাছেও গিয়েছে। বাংলাদেশ আর এক ধাপ এগিয়ে ছিল। যদিও গন পরিবহন বন্ধ আছে তা সত্বেও অনেকে নাড়ীর টানে ছুটে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। যাৱা সচেতন তাৱা ঘরেই আছেন।
আমাদের ঈদ ছিল ভিন্নমাত্রার। আমি একা একা ঈদের নামাজ পড়েছি। নতুন কাপড় পড়া হয়নি। কোথাও যাওয়া হয়নি। ঈদের দিন অরিত্রি এসেছিল গিফট নিয়ে। অরিত্রি আসবে এটা জানা কথা। একজন কেউ না এলে ঈদ ১০০ ভাগ দুঃখের হতো। রান্না করে বসে আছে জেসমিন কে খাবে! অর্ক অতিরিক্তি সতর্ক তাই বাইরে থেকে দেখা করে চলে গেছে। তবে সারপ্রাইজ হচ্ছে অর্ক আর খাতিজা ফুল সহ মজার মজার খাবার- রোষ্ট, কোফতা, গাজরের হালুয়া, কুকি ইত্যাদি বানিয়ে নিয়ে এসেছে। ওয়াও! আমি দূর থেকে ছবি তুলে রেখেছি।
টরন্টো ২৫ মে ২০২০
আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না
মিনেসোটা অঙ্গরাজ্জ্যের জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ছয় মিনিটের ভিডিওটি দেখে চমকে গেছি! নির্মম, নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড। একজন প্রতক্ষদর্শী ভিডিওটি করেছে। তাতে দেখা যায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওফিন ফ্লয়েডের গলায় হাটু চেপে ধরায় ফ্লয়েড নিশ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার বলছেন, ’আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না’। কুৎসিত বর্ণবাদের জঘন্যতম ঘটনা এটি। এই পৈশাচিক ঘটনায় পুরো আমেরিকা ফুঁসে উঠেছে। শ্বেতাঙ্গরাও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। অনেক শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। কানাডায়ও প্রতিবাদ হয়েছে। উত্তাল আন্দোলনে চাপা পড়েছে করোনা ভীতি। ডেরেক চাওফিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তার কমপক্ষে ১২ বছরের জেল হবে বলে খবরে বলা হয়েছে। বর্ণবাদকে আমি ঘৃণা করি। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বর্ণবাদ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র্য। পৃথিবী থেকে বর্ণবাদকে সমূলে উচ্ছেদ করতে হবে এবং এখনই সময়। আর যেনো কেনো ফ্লয়েডকে বলতে না হয় আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।
টরন্টো ৩১ মে ২০২০

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge