মঙ্গলবার, ০৬ Jun ২০২৩, ০১:৫২ পূর্বাহ্ন

ভাববার বিষয়-পর্ব-৫ যেতে যেতে: ঊনকোটি পর্ব-অভীককুমার দে

ভাববার বিষয়-পর্ব-৫ যেতে যেতে: ঊনকোটি পর্ব-অভীককুমার দে

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাহিত্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ কবি ও সমালোচক অভীককুমার দে’র ধারাবাহিক
ভাববার বিষয়-পর্ব-৫
যেতে যেতে: ঊনকোটি পর্ব
অভীককুমার দে

কাজ হয়নি বলে সবার মন খারাপ গতরাত থেকেই। এক সপ্তাহ কাজ হবে বলেছিল। কতোই না আশা করে বিভিন্ন জেলা থেকে আমরা কজন গতকাল সন্ধ্যেয় গেস্ট হাউসে এসে পৌঁছেছি। হঠাৎ একটা ফোন আসতেই সব পরিকল্পনা শেষ।
সকাল দশটা। খোয়াই বাস স্ট্যান্ডে চা খেয়ে একে একে সবাই চলে গেছে। চা দোকানের খোলা বারান্দায় শ্যামল সরকার ও আমি চুপচাপ বসে আছি। এতক্ষণ কারো মুখে কোনও কথা নেই। সবার চলে যাওয়া দেখছিলাম নীরবে। ভাবছি, বেকার হলে কতটা যান্ত্রিক হয়ে যেতে হয় মানুষকে। মোবাইলের বোতাম টিপে একবার বলে দিলেই কাজ শুরু, আবার শেষ হয়ে যেতেও সময় লাগে না। যেভাবে খুশি ব্যবহার করা যায় এই প্রজাতিটিকে। শ্যামলদার ডাকে ভাবনা থেকে ফেরা মাত্র শুনতে পেলাম, ‘চল ঘুরি আই। বাড়িত যাই ত কোনও কাম নাই। ঊনকোটি যামু।’ যেই বলা সেই কাজ। একটা লাইনবাসে রওনা হলাম কৈলাসহর।
কৈলাসহর বাস স্যান্ডে নেমে একটি ম্যাজিকের পেছনে উঠে পড়লাম। ঊনকোটি রাস্তার মুখে নেমে এখান থেকে হেঁটেই রওনা হলাম। এখন বেশ ভালোই লাগছে। রাস্তার দুপাশে বন দপ্তরের খাঁচায় সবুজ গাছের মিছিল। নতুন গাছগুলোর ডানে বামে ঘন জঙ্গল। আঁকাবাঁকা পথ এগিয়ে গেছে সামনে। সে পথেই নতুন চারাগাছ মাথা তুলছে আকাশের দিকে। প্রচন্ড রোদ হলেও গাছের ছায়া রাস্তা ঢেকে শুয়ে আছে। ছায়াপথ ধরে আমরাও হাঁটছি।
প্রবেশদ্বার পেরিয়ে যেতেই পরিবেশ বদলে গেছে অনেক। রাস্তার ডানপাশে টিলার ঢাল বেয়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উপরে উঠেছে। উপরে অনেকটা জায়গা জুড়ে সুন্দর শিবমন্দির। বড় বড় গাছের ছায়া হাতছানি দিয়ে ঢেকে রেখেছে।শিবমন্দিরের টিলা ঘেঁষে রাস্তাটি কিছুদূর এগিয়ে শেষ হয়েছে, তারপর রেলিং ঘেরা সিঁড়ি। নেমে গেছে নিচের দিকে। সিঁড়ির রেলিং এর পাশে বাহারী পাতার গাছগুলোতে যৌবনের রঙ এসেছে। দর্শনার্থীদের চোখে চোখ রাখতেই হেসে উঠছে বরাবর। পায়ে পর পা ফেলে যতই নামছি, ততই জমে থাকা সকালের মেঘ কেটে পরিস্কার হচ্ছে মনের আকাশ।
সামনে খাড়া পাহাড়। আকাশের বুক গেঁথে রেখেছে তীরের মতো। এই পাহাড়ের হাঁটু পর্যন্ত উন্মুক্ত। বাকি শরীর ঢেকে রেখেছে গাছগাছালির সবুজ কাপড়। বিকেলের রোদ লেগেছে বলে অদ্ভুত তেজস্বী দেখাচ্ছে এখন। শক্ত পায়ে দেবতারা কেমন পাথর হয়ে আছে ! যেন কেউ উল্কি এঁকে দিয়েছে পাহাড়ের পায়ে। এই রূপ দেখে বহু দূর থেকে ছুটে আসছে ঝর্ণা। চিৎকার করে ঘুম ভাঙার চেষ্টাও করছে। ডেকে ডেকে ক্লান্ত জল ঝরে গিয়ে যখন শান্ত ধারা, তখন নীরবেই বনবাসী। ঝরে যাওয়া ঝর্ণা বুঝতে পারে, এখানে পাথরের পাহাড়, দেবতাও পাথর। এমন বিচিত্র পরিবেশে সূর্যের আলো ফুরিয়ে আসতেই আকাশকে কেঁদে উঠতে দেখেছি। সব রোদ শুষে নিয়েও সবুজ গাছ ধীরে ধীরে কালো হয়ে যাচ্ছে, অথচ সন্ধ্যা হবার সময় হয়নি এখনও।
ক্রমশ কালো আকাশ আরও কালো হয়ে রাত ঢেলে দিয়েছে। ফিরে যাবার সুযোগ নেই আমাদের। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। হালকা বৃষ্টি মুষলধারে ঝরতে বেশি সময় লাগেনি। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে শিব মন্দিরের চাতালে আশ্রয় নিলাম আমরা। অনবরত বজ্রপাতের বিকট শব্দে আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে। হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝিলিক। এমন আকষ্মিক আলোয় গাছগুলোকে কেমন ভয়ানক ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। চাতালের খোলা মেঝেতে আমরা ছাড়াও তিন জন সন্ন্যাসী আছেন। ওনারা নিজেদের মধ্যে ঈশ্বর জ্ঞান বিতরণে ব্যস্ত। অসম্ভব অন্ধকারের কাছে নিজেদের সঁপে দিয়েছি। এখানে বিদ্যুৎ এসে পৌঁছায়নি। বিকল্প কোনও আলোর ব্যবস্থাও নেই। এমন একটি পর্যটন কেন্দ্র সন্ধ্যার পর অন্ধকারেই হারিয়ে যায়! আমাদের মতো দূর্যোগের মুখে পড়লে পর্যটকদের নিরাপত্তা কে দেখবে?
পেছন থেকে কে একজন বললেন, ‘আপনারা কোত্থেইক্যা আইসেন? কেমনে যাইবেন? গাড়ি তাড়ি আনছেন?’
শ্যামলদা বলল, ‘দক্ষিণ ত্রিপুরা থেইক্যা আইছি। যাঅনের ত অবস্থা নাই।’
লোকটির মুখে ‘উরি বাপরে’ শুনে বুঝতে পারলাম তিনি খুব অবাক হয়েছেন জেনে। বললেন, ‘কোনও ব্যাপার না। আইজকা রাইত আমার সাথে থাইক্যা যাও।’
শ্যামলদা বলল, ‘কোন খানে ?’
উত্তরে লোকটি আবার বললেন, ‘উই সামনে। দোকানে।’
কারো মুখে কথা নেই। বৃষ্টি বেষ্ঠিত চাতালের ভেতর আন্তরিকতার শব্দ শুনে কিছুটা সাহস জুটেছে। সেই শব্দের তরঙ্গে বৃষ্টিধারার সুর মিশিয়ে শরীরে মেখে নিচ্ছি। দুশ্চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতেই টের পেলাম, বেশ ঠান্ডা লাগছে। বাতাসের ঝড়োগতি এলোমেলো ছুঁয়ে যাচ্ছে লোমকূপ। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ভেতরে শব্দেরা চুপিচুপি বলছে, জগতের সব লোক মানুষ নয়। যারা মানুষ, তারা শুধু লোক হয়ে থাকতে পারেন না। কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে যাবার পর বৃষ্টির উগ্রতা যেই সামান্য কমেছে মানুষটি বললেন, ‘চলেন’। খুব তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আধভেজা শরীরে একটা দোকান ঘরে ঢুকলাম।
এখন রাত সাড়ে এগারোটা। খালি পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। মানুষটি নিজের হাতে চা করলেন। পাশের দোকান থেকে পাউরুটি কলা পাওয়া গেল। খেতে খেতেই কথা বলছি। অনেক রাত পর্যন্ত কথা হলো, অনেক কথা, জীবনের কথা। জানলাম, ঊনকোটির অন্ধকার রাতে এই যে লোকটির ভেতর মানুষ খুঁজে পেলাম, তিনি কালা সিনহা। ঊনকোটি যাঁর হাতে তৈরি তিনি ছিলেন কালু কামার। এ দুয়ের মাঝে কোথাও যেন একটা মিল রয়েছে। নামের মিল নাকি মানুষের !
এখনও আকাশ শান্ত হয়নি, বরং যতই রাত বাড়ছে বৃষ্টির শব্দও বাড়ছে।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge