কানাডার টরন্টো থেকে
বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক জসিম মল্লিক এর কলাম পরিযায়ী
করোনা দিনের ডাইরি : পর্ব-৩
একটু আগে অর্ক আর খাতিজা এসেছিল। না বাসায় ঢোকেনি। গাড়ি থেকে নামলে আমি দূর থেকে দেখলাম, কথা বললাম। অর্ককে দুই মাস আটদিন পর দেখলাম। এর আগে ভার্চুয়ালি দেখা হয়েছে। আজ দেখলাম সরাসরি। করোনা আমাদেরকে কেড়েই নিচ্ছেনা দূরেও সরিয়ে দিয়েছে! প্রতিদিন ১১.১৫ মিনিটে জাস্টিন ট্রুডো আসেন টিভির সামনে। তার অটোয়ার রিডো হাউজ থেকে ব্রিফীং দেন। তার সরকারের বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো জনগনকে অবহিত করেন প্রতিদিন। ডেপুটি প্রাইম মিনিষ্টার ক্রিষ্টিয়া ফ্রীল্যান্ড এবং হেলথ মিনিষ্টার কথা বলেন। এছাড়াও অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ড বা অন্যান্য কমকর্তা যেমন চীফ হেলথ অফিসার, তার ডেপুটিরা সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করেন। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন তারা।
এভাবেই দিন আসে দিন যায়। করোনা দিন। জেসমিন রাত দিন টিভির সামনে বসে থাকে। আমি টিভির সামনে দশ মিনিটের বেশি থাকি না। ইচ্ছে করে না। কি হবে বসে থেকে! জানিতো কি ঘটছে। সংখ্যাটা জানা আছে। সারা পৃথিবীতে কতজন আক্রান্ত হলো, কতজন মারা গেলো এই তো! আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য.. তালিকা দীর্ঘ। এবং বাংলাদেশ। ক্রমেই বাড়ছে আক্রান্ত এবং মুত্যু। অন্টারিওতে আক্রান্তের সংখ্যা কত বাড়ল গত ২৪ ঘন্টায়, কতজন মারা গেলো বা টরন্টোতে কতজন এবং পুরো কানাডায় কতজন মারা গেলো বা আক্রান্ত হলো এই হিসাবইতো! এর বেশি কিছু না! আমি শুধু খেয়াল করি সংখ্যাটা কোথায় কোথায় কমে আসছে। শুধু অপেক্ষা। অপেক্ষা। অপেক্ষা। অপেক্ষা..! কিন্তু অপেক্ষার প্রহর ঘোচেনা..।
টরন্টো ৮ এপ্রিল ২০২০
আমি জানি এই মুহূর্তে সবারই অনুভূতি এক ও অভিন্ন। আমাদের প্রার্থনা একটাই সবাই ভাল থাকি, নিরাপদ থাকি। পৃথিবী আবার সুন্দর হোক। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। এই পরিস্থিতি খুবই অচেনা আমাদের জন্য, খুবই অপ্রত্যাশিত। কোনো দুঃখজনক সংবাদই আমরা শুনতে চাই না। কিন্তু আমাদের শুনতে হচ্ছে। করোনা ভাইরাস কেড়ে নিচ্ছে আমাদের আপনজনদের। আমার বন্ধুকে, আমার চেনা মানুষকে। এই কষ্ট আমরা সহ্য করতে পারছিনা। মেনে নিতে না পারলেও মেনে নিতে হচ্ছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছি। এ আমাদের জীবনে এক কঠিন পরীক্ষা। নির্মম, কষ্টকর এবং অবর্ননীয়।
এখন আমরা যেটা পারি সাবধান থাকতে। অন্যকে সাবধান করতে। আমরা যেটা পারি পরষ্পরের পাশে থাকতে, সাহস যোগাতে, ভালবাসতে, সহমর্মী হতে, ক্ষমা করে দিতে। আমারা মনে যত রাগ ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান, প্রতিহিংসা পুষে রেখেছিলাম সব ভুলে যেতে। সব ভুলে যেতে। গোটা পৃথিবীকে এই ভাইরাস একবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। কেউ নিরাপদ না আজ। মুত্যৃ যেমন অমোঘ, যে কোনো সময়, যত বড় ক্ষমতাবানই হোক একদিন দরজায় এসে কড়া নাড়বে। এও যেনো তেমনি। একমাত্র সতর্কতাই আমাদের পরিত্রান দিতে পারে। একদিন আমরা এই দুঃসময় জয় করবোই। আবার সুন্দর দিনের আলো ফুটবে। জন্মদিনে শুধু এটাই প্রত্যাশা।
টরন্টো ৯ এপ্রিল ২০২০
জীবন আসলে চলমান আছে, সজীব আছে। মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা, শ্রদ্ধা, সহমর্মীতা এসবও অটুট আছে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। মানবজাতির এই দুর্যোগ, এই বিপর্যয় সাময়িক। পৃথিবীতে এর আগেও বড় বড় বিপর্যয় এসেছে। সে সব প্রতিকুলতার মধ্য দিয়েই মানব সভ্যতা এগিয়েছে। এবারও মানুষের জয় হবে। কিছু মানুষ থাকবে না এটা সত্যি। হয়ত আমিও। তাতে কি! মৃত্যু এমন কিই বা! একটি মহান ঘুম এর বেশি কিছু না। পৃথিবীর বাকী মানুষ সুন্দর মতো বাঁচুক। ভালবাসায়, মমতায় বাঁচুক। আমি একজন খুবই অকিঞ্চিতকর মানুষ, আবেগী মানুষ। তা সত্বেও মানুষের যে ভালবাসা পেয়েছি তা সৃষ্টিকর্তার আর্শীবাদের কারণে। আমার জন্মদিনে আপনজনদের এতো এতো শুভেচ্ছা পেয়ে আমার একটা কথাই মনে হয়েছে কোনো দূর্বিপাকেই মানুষের ভালবাসাকে পরাভুত করা যায় না। মানুষেরই জয় হবে। একসময় হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার চোখ ভেজা..
টরন্টো ১০ এপ্রিল ২০২০
কানাডায় এ পর্যন্ত ২২ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, ৬ হাজারের মতো রিকভারড করেছে এবং ৬০০ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ৪ জন বাংলাদেশী আছেন। কানাডা বিশাল বড় দেশ। আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। রাশিয়ার পরেই কানাডার অবস্থান। জনসংখ্যা ৩৮ মিলিয়নের কাছকাছি। প্রতি স্কয়ার কিলোমিটারে মাত্র ৪ জন বাস করে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১২০০ জন মানুষ বাস করে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেক ভাল। আইইডিসির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৪৮২ জন, সুস্থ হয়েছেন ৩৬ জন এবং মৃত্যু ৪০ জন।
ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স মেনে চলার জন্য কানাডায় আইন করা হয়েছে। না মানলে ফাইন। সবাইকে ঘরে থাকতে বলছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বার হতে বার বার মানা করা হচ্ছে। এসেনশিয়াল জব ছাড়া কেউ বাইরে যাচ্ছে না। সপ্তাহে একদিন গ্রোসারি করতে বলছে। সবাই আইন মেনে চলছে। না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারত। সরকার সব ধরণের আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে। বাংলাদেশেও সরকার যে উদ্যোগুলো নিয়েছে সেগুলো যথাযথভাবে মেনে চললে বাংলাদেশ করোনা অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারবে। কিছুদিন কষ্ট করতে হবে। ঘরে থাকতে হবে। গরীব মানুষের ত্রাণ চুরি বন্ধ করতে হবে। চুরির সংস্কৃতি থেকে জাতি কিছুতেই বের হতে পারছে না।
পৃথিবীর মানুষের জন্য আশার কথা হচ্ছে ইউরোপের চারটি দেশ লক ডাউন উঠিয়ে নিয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে অষ্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, নরওয়ে এবং চেক প্রজাতন্ত্র।
টরন্টো ১১ এপ্রিল ২০২০
এক ভয়ঙ্কর দানবের সাথে লড়ছে মানুষ। লড়ছে ফ্রন্টলাইন কর্মীরা। এই দানবের কাছে হার মেনেছে পৃথিবীর সেরা মারনাস্ত্রগুলো। হার মেনেছে ট্রেসার বোম্বা, মিরভি,আইসিবিএম, এফওএবি, চিমেরা ভাইরাস, আরপিজি, ডিএসআর ইত্যাদি নামের ভয়ঙ্কর অস্ত্র। এগুলো এখন হাস্যকর হয়ে গেছে। গার্বেজে ফেলে দেওয়ার সময় হয়েছে। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, গুস্তভ ট্যাঙ্ক, ফ্লেমথ্রোয়ার. একে ৪৭ বা নিউক্লিয়ার গাইডেড মিসাইল দিয়ে থামাতে পারছে না এই দানবকে। আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি এই সঙ্কটে সত্যিকার হিরো হচ্ছে ডাক্তার, নার্স আর স্বাস্থ্যকর্মীরা।
করোনা চিকিৎসা দিতে গিয়ে তাদের মৃত্যু হলে আমি তাদের পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে অনুরোধ করি। আগেও এই অনুরোধ করে লিখেছি। তাদের ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরে পাঁচতারকা সহ বড় হোটেলে এনে রাখতে হবে। তাদের থাকা খাওয়া ফ্রী করে দিতে হবে। যেটা করেছেন ভারতের রতন টাটা। বিলাসবহুল তাজ মহল প্যালেস স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। যে হোটেল একদিন থাকলে খরচ ১৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১৫ লক্ষ টাকা,এককাপ চা এর দাম ৬০০ টাকা, সেই হোটেলে করোনার চিকিৎসা র জন্য ডাক্তার নার্সেদের পুরোপুরি ফ্রিতে দিচ্ছেন। এই মহান মানুষটিকে স্যালুট।
আমাদের দেশের বিত্তবানরা এগিয়ে আসবেন কি! সবাই সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং লুটপাটও করে!
টরন্টো ১২ এপ্রিল ২০২০
সকালে ঘুম ভেঙে দেখি আমার ইনবক্স টইটুম্বুর। শুভেচ্ছায় ভরে গেছে। কাল রাত থেকেই শুভেচ্ছা আসতে থাকে। নতুন বছরের শুভেচ্ছা। এমন একটা উৎসবের দিনে কারো পক্ষেই দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে থাকা সম্ভব না। তাই সবাই উৎসবে মেতেছে। আগে যেমন মাতত। তবে এবারের উৎসব ভার্চুয়াল। কেউ কেউ অবশ্য ঘরেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে উৎসব করবে, নতুন কাপড় পড়বে, ভাল ভাল রান্না করবে, ইলিশ পান্তা থাকলেও থাকতে পারে। ইতিমধ্যে তার কিছু ছবিও পোষ্ট করেছে কেউ কেউ। হুমায়ূন আহমেদ তার মায়াবতী উপন্যাসে লিখেছেন, বাঙালি দুঃসময়েও উৎসব খুঁজে বেড়ায়। কথাটা সত্য।
জেসমিন কাল রাতে জিজ্ঞেস করল, আমরা দু’জন মানুষ, কিছু কি করতে হবে আলাদা!
আমি বললাম, কেনো!
নববর্ষ তাই।
আমি বললাম, কিছু করতে হবে না। প্রতিদিনের মতো জীবন চলবে।এরচেয়ে আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে পৃথিবীর মানুষের জন্য প্রার্থনা করি।
ওকে।
পৃথিবী জুড়ে চলছে মহামারি। লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত। লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আমাদের অনেক পরিচিতজন প্রাণ হারিয়েছে। তাদের পরিবার দুঃখের সাগরে ভাসছে। অনেক মানুষের কাজ নাই, ঘরে খাবার নাই। মানুষ এক ধরণের ট্রমার মধ্যে আছে। লক ডাউন চলছে দেশে দেশে। এর মধ্যে আমি উৎসবের কোনো আমেজ খুঁজে পাচ্ছি না।
বরং এ বছর রমনার সবুজ ঘাস পদ দলিত হওয়ার হাত থেকে বেঁচেছে। ইলিশের প্রজনন বাড়বে সাগরে। আমি অপেক্ষায় আছি মানুষ কবে আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে। নতুন জীবন ফিরে পাবে। তখন নতুন উদ্যমে নববর্ষ পালন করতে পারবে! সেই পর্যন্ত আমরা নিরাপদ থাকি। ঘরে থাকি।
তবুও শুভকামনা, শুভেচ্ছা সবাইকে।
টরন্টো ১৪ এপ্রিল ২০২০
Leave a Reply