অনুগল্প : মানুষ
সেজান মাহমুদ
রেলগাড়ি আমার কাছে মোহময় একটি অভিজ্ঞতা। ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসতো আর চলার সময় অদ্ভূত সম্মোহনী কু-ঝিক ঝিক সুর! আমি অবাক হয়ে রেলগাড়ির চলা দেখতাম। ছোটবেলায় একবার রেলগাড়ির দূর্ঘটনা দেখেছিলাম; রাতের অন্ধকারে গাড়িটি বগিচ্যুত হয়েছিল। মানুষ আহত, মৃত, চারিদিকে শুধু শিশু, নারী, আহতজনের কান্না। আমি আমার বাবার হাত ধরে দৌড় দিয়েছিলাম রেললাইনের দিকে। বাবার হাতে হ্যারিকেন। স্বল্প আলোর আঁধারি খেলায় বাবার দীর্ঘ প্রতিবিম্ব কেমন অপার্থিব আর অলৌকিক মনে হয়েছিল। আমার চেনা অচেনা মানুষগুলো যখন আহতদের উদ্ধার করছিল, শিশুদের তুলে নিচ্ছিল কোলে, আমি এবার আমার হতে-ধরা হ্যারিকেনের আলো আর জ্বলন্ত বগির আলোয় দেখতে পাই আমাদের চেনা একজন মানুষ আহত লোকজনের গা থেকে গয়না, ঘড়ি খুলে নিচ্ছে, স্যুটকেস হাতড়ে বের ক’রে নিচ্ছে দামি কিছু। আমার বিষ্মিত বালক-চোখের দৃষ্টি তাকে আটকাতে পারেনি।
আমাদের ফ্ল্যাটে নানান রকমের মানুষ থাকে; বেশ টাকা পয়সা না থাকলে এখানে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব না। আমি বড় একটা ব্যাংকের উচ্চ পদে কাজ করি। আমাদের ব্যাংক থেকেই লোন নিয়ে ফ্ল্যাট টা কিনেছি। এখানে কেউ ব্যবসায়ী, কেউ ডাক্তার, কেউ বা সরকারী উচ্চপদের কর্মকর্তা। সবাই ধনী বলা যায়, আমি ছাড়া। কোভিড-১৯ নামের বিশ্বমহামারীর গৃহবন্দীর দিনে আমাদের নিজেদের জানতে সুযোগ পেয়েছি, না হ’লে সবাই যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। দূর থেকে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একে ওপরের খোঁজ নিতে পারি। কার কোন আত্মীয় কোথায় থাকেন, করোনা শেষ হলেই কে কোথায় ভ্যাকেশনে যাবেন, আরো কতো রকমের তথ্য!
ডাক্তার দম্পত্তি সমাজসেবী। তাঁরা দু’জনে মিলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে কোভিড রোগীদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন। পাঁচ থেকে আট হাজার টাকায় ফলাফল দেন। লোকজন তাদেরকে দেবতা জ্ঞান করেন। সরকারি চিকিৎসা বা টেস্ট সেন্টারে অমানুষিক ভীড়। সে তুলনায় একটু খরচ করেই যদি টেস্ট করা যায়, ঘরে বসেই ফলাফল পাওয়া যায় তাতে প্রশংসা না ক’রে পারা যায়?
আজ সকালে এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে পুলিশের ভীড়। সেই ডাক্তার দম্পত্তি কে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ তারা মানুষের রক্তের নমুনা নিয়ে ফেলে দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে করোনার সার্টিফিকেট দিতন! আমি দেখলাম পুলিশ ভ্যানে ওঠার আগে দু’জনের নতজানু মুখ। কিন্তু আমি আর বাল্য বয়সের রেলগাড়ির দূর্ঘটনার মতো অবাক হই না-
আমিও তো বড় হ’য়ে মানুষ হয়ে গেছি!
Leave a Reply