দিব্যেন্দু নাথ এর ছোটগল্প দর্জির মেয়ে
পাতের উদ্দিষ্ট এত এঁটো খাবার ফেলতে মুন্টির যন্ত্রণা আরো তীব্রতর আঁকার ধারন করে। মনে পড়ে অভুক্ত বাবার কথা! যাঁকে এনে এই প্রাচুর্যের মাঝে বন্দি করতে পারেনি সে। অথচ খাবারে সকলের অধিকার সমান থাকলেও গরিবের ত ক্ষুধা বেশি! – তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, জানে মুন্টি। খাবারগুলি ফেলতে বড় কষ্ট পায়, বিবশ হয়ে যায় তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ টেবিলের সামনে। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে দেখেছে, নেশা বাবাকে কীভাবে গিলে নিয়েছে। বাড়িতে এত লাঞ্ছনা পেয়েও কাঁদে না বাবা। কিন্তু তাকে দান দিতে গিয়ে জলছাড়া চোখে অনেক কেঁদেছে চিন্ময় দর্জি।
কুমকুমে সাজানো মেয়ের সুন্দর মুখখানি ওড়নার আড়াল করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, মালায় আবিষ্ট স্ত্রীর ছবির সামনে। ধূলা-বালিতে লেপ্টানো রুদ্ধ ঘরের দরজায় যেতেই আপত্তি উঠে। উপস্থিত সভ্যগণ সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে পাগল দর্জিকে। ভাই, আত্মীয়-স্বজনরাও ইন্ধন যুগিয়েছে বরাবরের মতো বাপ-মেয়ের মিলনে। মেয়ের বিদায় বেলায়ও বাপ ছিল জলচোখে শব্দহীন। স্ত্রী-শোকে বিবশ চিন্ময় দর্জি, বারবার নিজের মন-পায়রা-কে আহত করেছে বিষাদের মারে। সব জেনেও মেয়েকে নীরব থাকতে হয়েছে। কাকার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে।
মুন্টি দেখেছে, বাবা দু চার টাকা কাকার কাছে চাইলে, অশ্রাব্য গালাগাল শুনতে হয়েছে তড়িৎ বেগে। মদ্যপ দাদার মদ্যপান ছাড়াতে দিনের পর দিন বন্দি করে রেখেছে ভাই ঘরে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং রেগেছে দর্জি। নিজের স্বাধীনতাকে বাঁকা পথে বাঁচিয়েছে। সেইজন্যে, চুরেরও উপাধিতে ভূষিত হয়েছে বাড়িতে। তাতে বিষণ্ণ জগতের দর্জির কিচ্ছু যায় আসে না। পিতৃসম্পদে তারও সমান অধিকার।
নিরুপায় হয়ে তরল নেশা বাঁচাতে, খাবার খেয়ে থালা বাটী বিক্রি করে দিয়েছে সামান্য টাকার বিনিময়ে। সাজা হিসেবে কিছুদিন পেয়েছে কলাপাতায় খাবার। ঐ আর কি! তবে এসব নিয়ে কোনওকালে কোন দ্বন্দ্ব বা অভিযোগ নেই দর্জির।
বাবার প্রতি অমানুষিক ব্যবহার দেখে, কষ্ট পেয়েও মুন্টি আর অভিযোগ জানানোর জায়গা পায়নি। ‘দাদু যে আর বেঁচে নেই।’ কাকা-কাকিমা বারবার বলেছে মদ্যপ বাবা থেকে দূরে থাকতে। বাবার কাছে যেতে লুকিয়ে লুকিয়ে কত কেঁদেছে মুন্টি! তার ইয়ত্তা নেই। সুযোগ বুঝে বাবা কখনও কখনও কাছে টেনেছেন মেয়েকে। বুকে জড়িয়ে কেঁদেছেন, অভিমানে হেসেছেন। আর মেয়েকে বলতেন,
: আমার দর্জির কাজে তোর মায়ের হাতেই ছিল লক্ষী। কাস্টমারের জামাকাপড়ে আধুনিক ফ্যাশনে কত মনকাড়া ডিজাইন তুলে দিত। দিন দিন লম্বা হতে লাগল কাস্টমারদের লাইন। কর্মমুখর দিনরাত, কী আনন্দ! কেন জানি তোর মা! নাছোড়বান্দা হয়ে উঠল, তোকে আনতে। আমিও আর মানা করতে পারলাম না। তুই এলি ঘর আলো করে। আমি কাজ ছেড়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তোকে নিয়ে। কাস্টমারের চাপ বেড়েই চলছে। একা হাতে আর সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে কর্মচারী রাখলাম। তুই দেখতে দেখতে তিন বছরের পার করলি। ডিগবাজি খেয়ে খেয়ে এক দু পা চলতেও শিখলে। তুই ছিলে দাদুর অন্তঃপ্রাণ। নাতনির তুলতুলে গায়ে লেপার মাটি দেখে, বাবা রেগে যেতেন। ঘরটা পাকা করলাম। বাবা, মায়ের নামে বাড়ির নাম রাখলেন ‘চিন্ময়ী আবাস’। বাবা দেখে গেলেন আমাদের আনন্দ নিবাসে, তুই দিন দিন আরো আদুরে হয়ে উঠেছিস্। বাবা শূন্য বাড়িতে আমার বারবার মনে হতে লাগল তোর এখন, ছোট্ট একটা খেলার সাথী প্রয়োজন। আমি বেহুঁশ হয়ে উঠলাম, তোর মায়ের তেমন ইচ্ছা ছিল না ঠিকই, তবে মানাও ছিল না। এলো এক ফুটফুটে মুখের তুলতুলে নরম শরীর। কে যেন হাতে তুলে আমাকে দেখিয়ে ছিল, হাসপাতালের আতুঁড় ঘরে। একদম শান্ত প্রকৃতির ছিল সে, একবারের জন্যও কাঁদল না রে মা। এমন স্নিগ্ধ সরল খোকাকে কেউ বুক থেকে ছাড়তে চায় ? তোর মা ত আর ছাড়লই না, লেপ্টে রইল। কোনো সাড়া নেই! নিথর নিস্তব্ধ দেহ। মুহূর্ত পর শোনা গেলে, খোকাকে নিয়ে পালিয়েছে তোর মা! কোন এক অজানা দেশে। আর পেলাম না খুঁজে। সবাই বলে নদী পথে গিয়েছে। আমিও এখন প্রতিদিন একবার করে নদীর ঘাটে যাই। যদি একবার দেখা পাই! শুধু বলব, আমার কি অপরাধ ছিল! কেন আমাকে ছলনা করে খোকাকে নিয়ে চলে গেল ? কই আর এল না ত! নদীর উজান স্রোত বেয়ে আজ পর্যন্তও এল না রে মা। আমাকে একেবারেই ভুলে গেছে। আর বোধহয় কোনওদিন আসবেও না। বড় জেদি ছিল ত তোর মা! তবুও যাই নদীর ঘাটে। তোর অভিমানী মায়ের পথ চেয়ে এখনও বসে রই। মাঝেমাঝে ভীড় দেখি, সেই নদীঘাটের কালীমন্দিরে। আগেও একদিন, এমন একটা ভীড় লেগেছিল মন্দির ঘাটে। সম্ভবত সেদিন তোর মা খোকাকে নিয়ে পালিয়ে ছিল। তারপর কিসব ছাঁই বিসর্জন দিতে দিতে সবাই বলেছিল, এই নদীপথে তোর ‘মা’ পালিয়েছে। এসব আবছা ভাবে মনে পড়লেও সব দৃশ্য চোখে ভাসে না রে মা। কোথায় যেন বিরাট একটা ভুল রয়েছে। চেষ্টা করেও মনে করতে পারি না। বরং বুকটা আমার কেমন জ্বালাময় হয়ে উঠে। হাত-পা, কাঁপে। ক্যাঁচি ধরেতে পারি না রে মা, মেশিনের ‘পাদানিতে’ পা চলে না। মাঝেমাঝে তোর মায়ের হাসিমাখা মুখখানি ভেসে উঠে, জলছাপ ছবির মতো! চারিদিক কেমন একটা ধোঁয়া-ধোঁয়া আবছায়ায় ভরে যায়।
আমার ভীষণ ভয় হয়! যদি তোর মা জিগ্যেস করে, ‘তোকে কেন আমার সঙ্গে রাখিনি।’
তোর মায়ের উপস্থিতির কথা বলতে গেলে, কেউ আমাকে বিশ্বাস করে না। উল্টো আমাকে পাগল বলে উপহাস করে। মদনা ছাড়া সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। সে-ই শুধু দোকানে নিয়ে খেতে দেয়, আর কেউ দেয় না। চাইলে তার দোকানের ঝাঁঝালো খাবার-পানিও দেয়! খুব বোটকা গন্ধ রে মা। গলায় দিয়ে নামতে চায় না, তবুও খাই। যদি বুকের জ্বালাটা কমে…।
দোকানের এঁটো বাসনগুলি ধোয়ার নাম করে নদীমুখো হই। বুকের জ্বালা আর জমানো কথা গুলি পুঁটলি করে স্রোতে ভাসাই। যদি তোর মায়ের কাছে পৌঁছে! আর আমার কষ্ট দেখে! উজান স্রোতে ফিরে আসে। পথঘাট ত চিনবে না! কি করে চিনবে বল ত? নদীর যা রুগ্ন অবস্থা। সবাই আবর্জনা স্তুপিকৃত করে, ঢেলে দেয় তার বুকে।
সত্যি, মুন্টিও সেদিন মায়ের শ্মশানে মোমবাতি জ্বালাতে গিয়ে দেখেছিল, নদীর দুর্দশা। শহরের প্রায় প্রতিটি পরিবারের গলিত নোংরা ড্রেনের মুখ উন্মুক্ত নদী বুকে।
সত্যি, মুন্টিও সেদিন মায়ের শ্মশানে মোমবাতি জ্বালাতে গিয়ে দেখেছিল, নদীর দুর্দশা। শহরের প্রায় প্রতিটি পরিবারের গলিত নোংরা ড্রেনের মুখ উন্মুক্ত নদী বুকে। তবুও নদী নীরব থাকে, কিছুই বলে না। ভেসে যাওয়া আবর্জনার ফাঁকে ফাঁকে কত মানুষ ডুবকি লাগায়, বহতা শীতল জলে। তাদের সব দুঃখ ক্লান্তি, গহীন জ্বালা, হরণ করে ছুটছে নদী নিরন্তর। তার সাগরের খুঁজে। এত কিছু জানে নদী তবু প্রকাশ করে না মুন্টির মতো। চেতনার বহরে উথালপাথাল বুক, তবুও স্থবির। পাষাণ মূর্তি মুন্টিকে আবার বলছে বাপ, সেদিন বেশকিছু লোকের সমাগম হয়েছিল ঘাটে। আমাকে দেখে কাঁধে ব্যাগ-ঝুলিয়ে এক বাবু এগিয়ে এসে বললেন, ‘নদী আমাদের ‘মা’ আমরা তাঁর সন্তান। মাকে কেউ এমন নোংরা করে? নদী আর সুস্থ নেই রে মা। পারলে একবার দেখে আসিস্। তোর বাবার বুকের মতো, তার বুকেও অজস্র ক্ষত।
মুন্টি বাবার সারস্বত ক্ষতে কি মলম লাগিয়ে দেবে? খুঁজে পায় না। ভাবে, দানব বাড়ির অত্যাচার থেকে বাবাকে বাঁচাতে, পাড়ি দেবে গহীন অরণ্যে। পারে না অরোজগারি বাবার আগের জমানো টাকায় পড়াশোনা করলেও বিয়েটা হচ্ছে মৃন্ময় কাকার পয়সায়। চেয়ে দেখে, বাবা নেই! চলে যাচ্ছে কিছু অসংলগ্ন আচরণের ঢেউ তুলে বহতা নদীর টানে। এই মুহূর্তে মৃন্ময় কাকা এসে পিঠে হাত রাখলেন মুন্টির। ছলছল চোখে কাকার দিকে তাকাতেই বললেন,
: বাপ এসেছিল বুঝি?
: হে কাকামণি।
: দেখ-না! কাল মেয়ের বিয়ে, একটু সাড়ম্বর নেই দাদার। তুই একটু সাবধানে থাকিস্ মা। পাগল মানুষের কি ভরসা! সবাই বলে মঙ্গলাচরণের পর রক্তপাত ঘটলে, দাম্পত্য জীবন অসুখকর হয়। বলে, মৃন্ময় দেবনাথ অধিবাসের খরচ আনতে বেরিয়ে গেলেন। অনুষ্ঠানের সতেজতায় গমগম বাড়ি। যত সময় এগোচ্ছে ভো ভো করে বেড়েই যাচ্ছে আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতি। কাকিমা সেজেছেন কণে’মা।
সামাজিক নিয়মের পরিপাটি নিয়ে এগিয়ে এল বিয়ের সাতপাকের রাত্রি। প্রতিটি পাঁকে-পাঁকে দেহ বিবশ করে, নাড়ীর সম্পর্ক ছিঁড়ে মুন্টি হয়ে গেল মন্ত্রগুণে অন্য বংশের। কিন্তু প্রশ্ন হয়ে রইল মুন্টির মনে, পুরোহিতের মন্ত্র শুনে, কাশিপাতা ছিঁড়লেই কি, বাবার রক্তের সঙ্গে মেয়ের রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়? কে দেবে তার এমন কঠিন দাঁতভাঙা – উত্তর!
শত প্রশ্নের সম্মুখে বাকি সময়টুকু কাটতে লাগল মুন্টির। ঝলমল রাতে সানাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুটিয়েছে ভোরের উদ্ভাসিত সূর্য। নবদিগন্ত রাঙিয়ে তুলতেই মনে পড়ে, নতুন জীবনের নতুন অনূভূতির ছোঁয়া…। যে মানুষটা লাল টুকটুকে সিদুর ফোঁটা দিয়েছে, পোড়াকপালে! তাতে কি, রঙিন ফুল ফুটবে ? নাকি কাঁটা ভেদ করে শোভিত গোলাপ ম ম গন্ধে নতুন জীবন ভরিয়ে দেবে।
দুর্গা প্রতিমা মেয়েকে কুলবধূর তকমায় সাদরে বরণ করে নিল জেলা শহরের বণিক পরিবার। গুণে সরস্বতী রূপে লক্ষ্মী মাতৃহারা মেয়ে মুন্টি! আজ হয়ে গেল দাদুর বংশের সুনামে প্রাচুর্যের নিপুণা গৃহবধূ।
কিছুদিন যেতে শ্বশুর চিন্ময় দর্জিকে নিয়ে এল শহরের বাড়িতে ব্যপারি জামাই। মুন্টিও স্বামীর দায়িত্ববোধে আপ্লুত, বাবাকে কাছে পেয়ে।
কিন্তু যে মানুষটার প্রেম নদীর তিরতির স্রোতে। যার মনে, উজান স্রোত ধরে একদিন আবার ফিরে আসবে প্রাণের মানুষটা, ‘উৎকল-জলদিত রঙে’….। তাকে যে প্রাচুর্য দিয়ে বেঁধে রাখা দায়!
ফিরে আসে দর্জি, আবার সেই নদীর ঘাটে, মদনার দোকানের এঁটো বাসন নিয়ে বসে থাকে উদাসীন চোখে… স্ত্রীর আসার আশায় বুক বেঁধে…..
স্বামীর স্বমহিমায় সব ভুলে থাকতে চায় মুন্টি। কিন্তু পারে না! অসহায় বাবার দুর্দশার কথা ভেবে-ভেবে, ভেতর ফুটে নদী-ডহর বুঁদ-বুঁদের মতো। স্বামীও বুঝতে পারে! কুটকুটে কাঠল পাখির মতো মুন্টির বেদনা। পদে-পদে ক্ষমা করতেও স্বামীর নেই কোনো কৃপণতা।
প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও খাবার গুলি ফেলতে ভীষণ কষ্ট পায় মুন্টি। ভাবে
: বাবা কি খাবার পায়? নাকি ক্ষুধা ভুলে নদীর ঘাটে শুধু কাঁদে, মায়ের অপেক্ষায়…?
Leave a Reply