শুক্রবার, ০৯ Jun ২০২৩, ০৫:১৭ অপরাহ্ন

কামাল লোহানীর ইন্তেকাল

কামাল লোহানীর ইন্তেকাল

কামাল লোহানীর ইন্তেকাল
পাতা প্রকাশ ডেস্ক

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক কামাল লোহানী আর নেই। ঢাকার শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার সকালে তার মৃত্যু ঘটে।তার ছেলে সাগর লোহানী জানান, “সকাল সোয়া ১০টার দিকে চিকিৎসকরা তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে মৃত ঘোষণা করেন।”
কামাল লোহানীর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন।
একুশে পদকপ্রাপ্ত কামাল লোহানী বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগঠনের একজন পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন। সাংবাদিক কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের বার্তা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের খবর বেতারে কামাল লোহানীই প্রথম পড়েছিলেন।
ফুসফুস ও কিডনি জটিলতার পাশাপাশি হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের সমস্যাতে ভুগে গত ১৭ মে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। পরে তার করোনাভাইরাস সংক্রমণও ধরা পড়ে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার পর পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতাল থেকে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল তাকে।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন জানান, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল থেকে দুপুর ২ টায় কামাল লোহানীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে শেখেরটেকে। সেখানে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে মরদেহের গোসল করানো হবে।
শেখের টেকের পরে মরদেহ উদীচী কার্যালয়ে নেওয়া হবে বলে ছেলে সাগর লোহানী জানিয়েছেন। সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সাবেক সভাপতির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন উদীচীর কর্মীরা।
এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সুনতলা গ্রামে। সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর পর শনিবার রাতেই সমাহিত করা হবে কামাল লোহানীকে।
কামাল লোহানীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।
কামাল লোহানীর প্রকৃত নাম আবু নাইম মোহা. মোস্তফা কামাল খান লোহানী। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া গ্রামের খান মনতলা গ্রামে ১৯৩৪ সালের জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৫২ সালে তিনি। পরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি ঘটে।
পাবনা জেলা স্কুলে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে কামাল লোহানীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে নুরুল আমিনসহ মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাকে কারাগারে যেতে হয়।
মুক্ত হতে না হতেই আবার ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তার হন কামাল লোহানী। সেই সময় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন।
পরের বছর আবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একই কারাকক্ষে তার বন্দিজীবন কাটে।
১৯৫৮ সালে কামাল লোহানী যুক্ত হন নৃত্যশিল্পের সঙ্গে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে পাকিস্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ছায়ানটের নেতৃত্বে কামাল লোহানী ও হাজারো রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কর্মী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
১৯৬২ সালে কামাল লোহানী ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। পরে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন তার রাজনৈতিক আদর্শের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’।
ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে গান গাইতেন আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান, সুখেন্দু দাশ, আবদুল লতিফসহ প্রথিতযশা শিল্পীরা ।
ষাটের দশকের শেষ ভাগে ন্যাপের (ভাসানী) রাজনীতিতে জড়িয়ে কামাল লোহানী যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে পূর্ব বাংলার শিল্পীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তার সঙ্গেও কামাল লোহানী সম্পৃক্ত ছিলেন পুরোপুরি।
১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে কামাল লোহানী একজন শিল্পী, একজন সাংবাদিক ও একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যুদ্ধে যোগ দেন।
সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ বেতারের পরিচালকের দায়িত্ব পান।
স্বাধীন বাংলা বেতারে ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ’
১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন কামাল লোহানী। ১৯৮১ সালে দৈনিক বার্তার সম্পাদকের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নতুন উদ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। পরে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
কামাল লোহানীর সাংবাদিকতার শুরু হয়েছিল দৈনিক মিল্লাত দিয়ে। এরপর আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন।
সাংবাদিক ইউনিয়নে দুই দফা যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন স্বাধীনতার ঠিক আগে। সাংবাদিকতার জন্য ২০১৫ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দুই বার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন কামাল লোহানী। ছায়ানটের সম্পাদক ছিলেন পাঁচ বছর।
মৃত্যুর সময় তিনি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা পদে ছিলেন।
১৯৬০ সালে কামাল লোহানীর বিয়ে হয় দীপ্তি লোহানীর সঙ্গে। দীপ্তি লোহানী বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ে হলেন বন্যা ও ঊর্মি লোহানী, আর ছেলে সাগর লোহানী।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge