দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া-৬
মো. শওকত আলী
রুপকথার যাদুনগরের মতই আমাদের সোনারগাঁ এর ইতিহাস। প্রথম যেবার সোনারগাঁ যাই তখন শুধু জানতাম একসময় সোনারগাঁ ছিল বাংলার রাজধানী। কালের গর্ভে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে তার সেই ঐতিহ্য, গৌরবগাঁথা। কিন্তু পরে জানলাম, ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ ১৩৩৮ সালে বাংলার প্রথম স্বাধীন মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী তৈরি করেন এ সোনারগাঁ এ। এরপর সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দার শাহের শাসনামলেও পূর্ববংগ প্রদেশের রাজধানী ছিল এ সোনারগাঁ।পরবর্তীতে গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের আমলেও সোনারগাঁ ছিলরাজধানী।
ইতিহাসের সুপ্রাচীন এ জনপদের একদা নাম ছিল সুবর্ণবিথী বা সুবর্ণগ্রাম। রাজধানী ছাড়াও সোনারগাঁর বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ছিল মসলিন নগরী হিসেবে। বিদেশি খ্যাতনামা অনেক পরিব্রাজক ও ব্যবসায়ীর আকর্ষণীয় জায়গা ছিল সোনারগাঁ। আবার বার ভূঁইয়ার প্রধান মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁ এর আমলে রাজনৈতিকভাবে খ্যাতি লাভ করে সোনারগাঁ।তিঁনি তাঁর সামরিক সদরদপ্তর সোনারগাঁ এর পানাম নগরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দিল্লির শাসক শের শাহ এর ঐতিহাসিক গ্রান্ড ট্রান্ক রোড শেষ হয়েছিল এ সোনারগাঁ এ – যেটির শুরু ছিল সিন্ধু এলাকায়।
আসলে মধ্যযুগে সোনারগাঁ ছিল একটি সমৃদ্ধ শহর। কিন্তু ১৬০৮ সালে মুঘল সুবেদার ইসলাম খান যখন সোনারগাঁ থেকে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন তখন থেকে সোনারগাঁ তার জৌলুস হারাতে থাকে। বৃটিশ নীলকরদের অত্যাচারে সোনারগাঁয়ের পৃথিবী খ্যাত মসলিনও শেষ হয়ে যায়।
বর্তমানে ঢাকা থেকে প্রায় ২৬ কি.মি দূরে নারায়ণগন্জ জেলার একটি উপজেলা হচ্ছে সোনারগাঁ। আশির দশকের শেষভাগে আমি প্রথম সোনারগাঁ এ যাই দুটি দর্শনীয় স্হান দেখতে। এক, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন দুই, পানাম সিটি। এরপর দীর্ঘ বিরতিতে আরও দু’একবার গিয়েছি।তবে গত চার বছরে অনেকবার যেতে হয়েছে। কিন্তু এসব যাওয়া-আসা ছিল পুরোপুরি দাপ্তরিক। যার কারনে অধিকাংশ সময়ে ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক ভবনের বাইরে কোথাও তেমন যাওয়া হয়নি। তারপরও ফাঁকে ফাঁকে দু’একবার তো রথ দেখা আর কলা বেচার কাজটাও সেরে ফেলেছিলাম।
সোনারগাঁ একদিকে যেমন ইতিহাস -ঐতিহ্য, লোক ও কারুশিল্প -সংস্কৃতিতে ছিল সমৃদ্ধ, তেমনি নদী -নালা, খাল-বিল পরিবেষ্টিত গাছপালার সবুজ শ্যামলীমায় ছিল ঢাকা । আশির দশকের শেষভাগে যখন সোনারগাঁ যাই তখনও এসবের কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যেত।কিন্তু এখন ঘন জনবসতি আর ইট-পাথরের উন্নয়ন কাঠামোয় প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্য অনেকটাই ম্রিয়মান হয়ে গেছে।
বর্তমানে সোনারগাঁ এর অন্যতম মূল আকর্ষন হচ্ছে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের আগ্রহে জাতির পিতা বংগবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের প্রথমদিকে সোনারগাঁ এ বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্টার অনুমোদন দেন। সোনারগাঁওয়ে এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পিছনে যে প্রবল যুক্তি ছিল তা হচ্ছে বাংলার লোকশিল্প ও লোকজ সাংস্কৃতিক চর্চা,ধারন,বিকাশ ও প্রসারে সোনারগাঁও এর অবদান ছিল অপরিসীম। একসময় এখানকার লোক ও কারুশিল্প পণ্য যেমন- মসলিন, ঝিনুক,মুক্তা,কাঠের চিত্রিত হাতি, ঘোড়া,পুতুল ইত্যাদির সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল এবং সেগুলো বিদেশে রপ্তানিও হতো। মধ্যযুগে বহু বিদেশি ব্যবসায়ীর ও পরিব্রাজকের আগমন ঘটেছিল সমৃদ্ধ এ জনপদে। আমাদের দেশের লোক- সংস্কৃতি ও লোকজ ঐতিহ্যের নিদর্শনাদি সংগ্রহ করা, সেগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং প্রদর্শন করা এবং সর্বোপরি এসব বিষয়ে গবেষণা করার জন্য এই জাতীয় প্রতিষ্টানটি স্হাপনের মূল উদ্দেশ্য ছিল।
মোট প্রায় ১৭০ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্টিত এ প্রতিষ্টানটির ফুলের বাগান, ফলজ ও বনজ বৃক্ষরাজি, লেক আর সবুজের সমারোহে প্রাকৃতিক পরিবেশ এক কথায় অপূর্ব। লাল সিরামিক ইটের মনোগ্রাহী স্হাপত্যশৈলীতে তৈরি প্রশাসনিক ভবন ছাড়াও ময়ূরপঙ্খী মঞ্চটিও অনেক দৃষ্টিনন্দন। জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা নামে একটি জাদুঘর রয়েছে এখানে। যেখানে বাংলার লোকজ কারুশিল্পের ঐতিহ্যগত বহু নির্দশন প্রদর্শনের ব্যবস্হা রয়েছে। এর বিশাল মাঠে বছরে একবার মাসব্যাপী লোকজ মেলা হয় যেখানে লোকসংগীতসহ বাংলার ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত গ্রামীণ কারুশিল্পীদের উৎসাহ দেবার জন্য তাদের পণ্য বিক্রির সুবিধা থাকে। তাছাড়া, এখানে আগত দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে এবং গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যমন্ডিত কারুপণ্য যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য মেলার সময় ছাড়াও ফাউন্ডেশনের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র এবং কারুপণ্য বিক্রির কিছু দোকান রয়েছে।
ফাউন্ডেশন চত্বরে আরও রয়েছে বংগবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য, জয়নুল আবেদীনের তৈলচিত্র ‘সংগ্রাম’ এর আদলে একটা ভাস্কর্য, ঐতিহ্যিক স্হাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন ‘বড় সর্দার বাড়ি’। (চলমান…)
Leave a Reply