আবিদ করিম মুন্নার ছোটগল্প নয় থেকে তিন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা মিথুনদের অফিস।
দশ বছর সেখানে কেটে গেল।
জীবনের ধারাবাহিকতায় চাকরি থেকে অবসর নিলেন অনেকে। শুধু বুড়ো বটগাছটি রয়ে গেল আগের মতো।
ওদের স্টাফ বাসটি এসে থামে পুকুর পাড়ে। সেই পুকুরে ভেসে বেড়ায় ছটি রাজহাস।
আছে নানা প্রজাতির মাছ। মাঝে মাঝে বাসা থেকে আনা চিড়া, মুড়ি, খই এবং বাসিভাত পানিতে ফেললে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে জড়ো হয় মাছ।
ভারী সুন্দর লাগে!
জীবনটা ধন্য মনে হয় মিথুনের।
একদিন লক্ষ করল অফিসের সহকর্মী হাসানকে। কিছুদিন আগে কাজে যোগ দিয়েছে।
তাকে ফলো করছিল একটা মাদী কুকুর। সপ্তাহের সব কর্মদিবসেই হাসান কুকুরটির জন্য কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসে।
কোনোদিন খেতে পেরে সন্তুষ্ট না হলে এমনও দেখেছে হাসানের সঙ্গে অফিস ভবনের লিফট পর্যন্ত যেতে। হাসানের ইশারায় এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করে চলে যেত। এটাই বুঝি প্রভুভক্তি।
মিথুন অবশ্য আগুন, পানি, সাপ, কুকুর এবং রক্ত দেখলে ভয় পায়। হাসান খেতে দিত পাউরুটি, কেক অথবা বিস্কুট।
তবে নোনতা বি¯ু‹ট কুকুরের বেশি প্রিয় ছিল।
অল্প কদিনের মধ্যে কুকুরটি প্রেগনেন্ট হলো।
একদিন খেয়াল করল কুকুরটি অফিস প্রাঙ্গণে নেই।
এদিক সেদিক খোঁজাখুজি করেও পাওয়া গেল না।
বেশ কদিন পর পাওয়া গেল শরীরের চামড়া ঝলসানো অবস্থায়।
ধারণা করা হলো কেউ হয়তো গরম পানি তার উপর ঢেলে দিয়েছে।
মিথুন শুনেছে কুকুরেরা যদি মরা প্রাণীর মাংস খায় তবে নাকি চামড়া ঝলসে যেতে পারে।
প্রেগনেন্ট কুকুরের ঝলসানো দেহ দেখে হাসানের খুব মায়া হলো। নেয়া শুরু করল বাড়তি যত্ন। অফিসের অনেকেই ব্যাপারটি খারাপ চোখে দেখল। কুকুরের জন্য কেন এত ভালোবাসা!
ওর ভালোবাসা দেখে মিথুনও খাবার নিয়ে আসত। কিন্তু কুকুরটির কাছে ঘেষতো না, যদি আবার আক্রমণ করে বসে। মিথুনের ভীষণ বিরক্ত লাগে যখন কুকুরটি কারো প্যান্ট জিব দিয়ে চাটত।
কুকুর নিয়ে মিথুনের জানার শেষ নেই। প্রতিদিন সালেহ্ বায়েজীদ নামের যে ছেলেটির সঙ্গে ওর কথা হয় সে দিত অনেক তথ্য।
কুকুরের জীবনকাল ১২ বছর অর্থাৎ মানুষের জীবনের সাত ভাগের এক ভাগ।
ক্যানিনাস জাতের কুকুর নাকি রোগ ছড়ায়।
কুকুরের স্পার্ম আসে অসংখ্য নালি দিয়ে যার কারণে তারা দীর্ঘক্ষণ সেক্স করতে পারে। আরো জানায়, শিয়াল ও কুকুর এখন পরিবেশের সমঝোতায় এসেছে। কারণ শেয়ালের থাকার জায়গাটা মানুষ নষ্ট করে ফেলছে। যার জন্য অনেক সময় চোখে পড়ে শেয়াল আর কুকুর একই ডাস্টবিনে খাবার খাচ্ছে। যা আমাদের জন্য এক চরম শিক্ষা।
জানায়, চীনে চালু আছে ওয়ান ডগ পলিসি। ব্যাপারটা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। একসময় বিপুল জনসংখ্যার ভার কমাতে চীন সরকার ওয়ান চাইল্ড পলিসি করতে বাধ্য হয়েছিল। মানুষের কম বা একটি বাচ্চা থাকবার কারণে মানব বাচ্চার তৃষ্ণা কুকুরছানা দিয়ে মেটানোর চেষ্টায় অধিকসংখ্যক কুকুরছানা লালনপালন শুরু করেছিল।
এখন অতিরিক্ত কুকুর সংখ্যার ভার কমাতে ওয়ান চাইল্ড ওয়ান ডগ পলিসি অর্থাৎ একটি মানুষ একটি কুকুর রীতি চালু করতে বাধ্য হয়েছে।
গেল কোরবানি ঈদের ছুটির পর অফিসে এসে দেখল সাতটি বাচ্চাকে বুকে নিয়ে পরম মমতায় দুধ খাওয়াচ্ছে মা কুকুরটি। দৃশ্যটি সত্যিই বিরল ছিল। মোবাইল ক্যামেরায় অনেকেই বন্দি করছিল আর গল্পের ছলে বলছিল ফেসবুকে শেয়ার করবে।
কুকুরটি বাচ্চা প্রসব করেছিল নয়টি। জন্মের কিছুপর দুটি মারা যায়।
সময় যায়। অফিসে এসে একদিন আরেকটি বাচ্চার মারা যাবার খবর শুনতে পেল। রইল বাকি ছয়। বাচ্চাগুলোকে মা কুকুরটি দৌড় শেখাত।
অফিস প্রাঙ্গণে দুদিনব্যাপী সেমিনারের আয়োজন করা হলো। বাংলাদেশে বসবাসরত অনেক বিদেশি ছাড়াও দেশের বাইরের অনেকেই আমন্ত্রিত হয় সেখানে। বিদেশিদের গাড়িচাপায় একটি কুকুরছানার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনা অনেককে বিষণ্ন করে তোলে।
অফিসের সুইপার এবং গার্ডদের সঙ্গে কথা বলে আরো জানতে পারে, মানুষের বাচ্চাকে যেমন পরম মমতা দিয়ে আদর করে স্বজনেরা, তেমনি বিদেশিরাও কুকুরছানাগুলোর কম যত্ন করেনি দুদিন। খাইয়েছে এমনকি উন্নত চিকিৎসার জন্য পশু হাসপাতালে নিয়েও গিয়েছিল। বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিরা সেমিনার শেষে তিনটি বাচ্চাকে লালনপালনের জন্য নিয়ে যায়।
অন্য কুকুরছানাগুলো বড় হবার সাথে সাথে অফিস সহকর্মী অনেকের বিরক্তি প্রকাশের মাত্রাটা আরো বেড়ে যায়।
একদিন মেজাজি এক নারী সহকর্মীকে আক্রমণ করে বসে মা কুকুরটি। তার ব্যাগে ছিল খাবার। খাবারের গন্ধ পেয়েই বোধকরি আক্রমণ। হাতের সবকিছু ফেলে হাসান আর মিথুনকে মৃদু গালমন্দ করে কটুস্বরে কথাও বলতে থাকেন। তখনই বাচ্চাসহ কুকুরটিকে ফেলে দিয়ে আসতে সিকিউরিটিকে আদেশ করেন। সিকিউরিটির লোকজন কষ্ট পেলেও আদেশ অমান্য করতে পারেনি। বেশ কিছুদূরে একটি পার্কে বস্তাবন্দি করে ফেলে দিয়ে আসে মা কুকুরসহ বাচ্চাগুলোকে।
কুকুরের ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রবল। খুঁজে খুঁজে দুদিন পরে ঠিকই ফিরে এসেছিল প্রিয় সেই জায়গায় তিনটি বাচ্চাকে সাথে নিয়ে। যেখানে তাদের প্রভু হাসান থাকেন। ভালোবেসে যিনি মুখে তুলে দিতেন খাবার।
বিবর্তনবাদ তত্ত্বানুসারে একসময় কুকুর ছিল নেকড়ে। বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের এই কুকুর। ভারতীয় সংগীতশিল্পী কবীর সুমনের একটি গানও আছে- আদিম নেকড়ে অধুনায় পোষ মানা…।
বাংলাদেশে মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি, আবেগ এবং ভালোবাসা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। অথচ প্রভুভক্ত কুকুর যদি জলাতঙ্কে আক্রান্তও হয় তার প্রভুকে কখনও আঁচড় পর্যন্ত দেয় না।
সেদিন ঢাকার বাইরে থেকে ফিরছিল মিথুন। খবরের কাগজের আন্তর্জাতিক পাতায় একটি রিপোর্ট দেখে চোখ আটকে গেল।
ইরানে পোষা প্রাণি হিসেবে কেউ কুকুর লালনপালন করতে পারবে না। জনসমক্ষে কেউ যদি কুকুর নিয়ে পায়চারী করে তবে সেটা হবে ফৌজদারী অপরাধ। আর জরিমানা গুনতে হবে ১০০-৫০০ ডলার।
বাংলাদেশে আমরা এখনও ভালো আছি।
আমাদের অনেকের চেয়ে ভালো আছে কুকুরেরা।
Leave a Reply