কানাডার টরন্টো থেকে
বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক জসিম মল্লিক এর কলাম পরিযায়ী
করোনা দিনের ডাইরি : পর্ব-১
আমরা এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। সারা পৃথিবীজুড়ে শঙ্কা এবং ভয়। যখন এই লেখা লিখছি তখন পৃথিবী ভয়ে কাঁপছে। একটা ট্রমার মধ্যে আছি আমি নিজেও। কি হবে জানা নেই। পুরো পৃথিবী স্তব্দ হয়ে গেছে। থেমে গেছে স্বাভাবিক জীবন। আমি এবং জেসমিন কানাডা থেকে ঢাকা এসেছি গত ৩ ফেব্রুয়ারী। উদ্দেশ্য বইমেলায় অংশ নেয়া এবং ব্যাংকের কিছু কাজ করা। আমাদের চলে যাওয়ার ডেট নিধারিত ছিল ১০ মার্চ। আমার মেয়ে অরিত্রি হঠাৎ করে ২৯ ফেব্রুয়ারী ঢাকা আসে এবং আমাদের সাথে চলে যাওয়া ঠিক করে আসে। ১০ মার্চ টিকিট থাকলেও আমার মনে হয়েছিল আমি যে কাজে এসেছি সেটা সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।
প্রথম থেকেই আমার মনের মধ্যে ছিল যে টিকিট কয়েকদিন বাড়াবো। টরন্টো বসেই এটা আমি ভেবেছিলোম। কিন্তু ঢাকা আসার পর জেসমিন বারবার এটার বিরোধিতা করছিল। কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না যে এতো অল্প সময়ে কোনো কাজ বাংলাদেশে করা যায় না। আমার ব্যংকে কিছু দরকারি কাজ আছে। সেটা ৫ মার্চ করতে হবে। সেদিন বৃহষ্পতিবার। তারপর শুক্র ও শনিবার ব্যাংক বন্ধ থাকবে। হাতে থাকবে রবি ও সোমবার দু’দিন। এই দু’দিনে এতোকিছু করা সম্ভব হবে না। সেই কারণেই টিকিট চেঞ্জ করার চেষ্টা করি।
ঢাকা ১৫ মার্চ ২০২০
অনেক দ্বিধা দ্বন্দে¦ ভুগে অবশেষে ঢাকার কুয়েত এয়ারলাইন্স অফিসে যাই কয়েকবার। তারা আমার চাহিদামতো টিকিট দিতে পারছিল না। পরে টরন্টোতে আমার ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট চেঞ্জ করতে সক্ষম হই। আমার ২৩ মার্চ রাতের ফ্লাইটে যাওয়ার ডেট ঠিক হয়। এখানে আমাকে প্রায় ৩০০ ডলার দিতে হয়। তারপর পরিস্থিতি দ্রæত বদলাতে থাকে। সারা পৃথিবীতে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে শুরু কওে মহামারি আকারে। আমি টরন্টোতে থাকতেই জানুয়ারী মাসেই চীন থেকে আসা একজন রোগি সনাক্ত হয়। টরন্টোর সানিব্রুক হসপিটালে সে ভর্তি ছিল। প্রথম এই ভাইরাস ধরা পড়ে গত বছর ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে। কেউই ভাবতে পারেনি এই ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে স্তব্দ করে দেবে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ৯ মার্চ হঠাৎ ঘোষনা আসে কুয়েত এয়ারলাইন্স ক্যান্সেল। শুরু হয় দৌড়ঝাপ আর টেনশন। অরিত্রিকে ১১ তারিখেই অফিসে জয়েন করতে হবে।
ঢাকা ১৬ মার্চ ২০২০
এমিরেটস এয়ারলাইনসে জেসমিন এবং অরিত্রিকে ডাইভার্ট করে দেয়। সন্ধ্যায় সেট্ওা ক্যান্সেল হয়ে যায়। বলা হয় ওভারবুকড। কি একটা টেনশন। তারপর কাতার এয়ারে কোড শেয়ারিং করে ওদেরকে দেয়া হয়। অতপর ১০ মার্চ ওরা ভালভাবেই পৌঁছে যায় টরন্টো। পরবর্তীতে কুয়েতের ক্যান্সেলেশন বাড়তে থাকে। ২৬ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। আমাকেও কাতারে দেয়া হয় ২৩ মার্চ রাতের ফ্লাইটে। আমার ২৫ মার্চের আগেই যাওয়ার দরকার কারন ওইদিন আমার একটা ডাক্তার এপয়নমেন্ট আছে। আমি এমআরআই করেছিলাম ব্যাকপেইনের জন্য। আমাকে নিউরো সার্জনের কাছে রেফার করা হয়।
ঢাকা ১৭ মার্চ ২০২০
আল্লাহর রহমতে দেশে আসার পর থেকে ব্যাকপেইন আমাকে তেমন ভোগাচ্ছে না। আমি অনেক কষ্ট পাচ্ছিলাম কানাডায় থাকতে। যাইহোক। পরিস্থিতি অবনতি ঘটতে থাকে দ্রæততার সাথে। ২৩ তারিখের আগে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সম্ভব হচ্ছিল না। টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না কোনোভাবেই। রিটন ভাই আকস্মিক টিকিট চেঞ্জ করে ১৭ মার্চেই ফিরে গেলেন। আমি ক্যন্টনমন্টে এলাকায় মানিক রহমানের বাসায় অবস্থান করছিলাম। মানিক নিজেও আমেরিকা থাকে। ব্যবসার কাজে দেশে এই সময়। ওর ভাই চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টের জিওসি মেজর জেনারেল মতিউর রহমান। মানিক চমৎকার একজন মানুষ। আমার সাথে অনেকদিনের সখ্যতা। মাঝে মাঝে মহাখালী যাই শুশুরবাড়ি। আমি খুবই টেনশনে পড়ে যাই। সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত প্রায় তিন লক্ষ। মৃতের সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়েছে এ পর্যন্ত। প্রতিদিন এই সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে ভয় শঙ্কা টেনশন।
ঢাকা ১৮ মার্চ ২০২০
২১ মার্চ সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনি ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব ফ্লাইট ক্যান্সেল। আমার ছেলে মেয়েরা আমাকে নিয়ে টেনশন করছে। কয়েকদিন ধরে গৃহবন্দী হয়ে আছি। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বের হইনা। কি করব বুঝতে পারছিনা। আটকে গেছি। মন খারাপ হয়ে গেছে। পরিবার এক জায়গায় আমি এক জায়গায়। কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিনা। বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে আক্রান্তর সংখ্যা। মানুষ তেমন সচেতন না। কানাডার পরিস্থিতিও খারাপের দিকে যাচ্ছে প্রতিদিন। কোথাও নিরাপদ না। সবকিছু লকডাউন হয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে কোনো মানুষ নাই। এমনকি বরিশালেও একই অবস্থা। কি একটা অবস্থা পৃথিবীজুড়ে। এরকম কেউ কখনো দেখেনি। কি হবে অজানা। একমাত্র আল্লাহ সংকট থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারেন।
২১ তারিখ রাতের দিকে আমি রাকিবকে ফোন করে জানতে চাইলাম কানাডা যাওয়ার কোনো উপায় আছে কিনা। রাকিব ঢাকার ট্রালেভ এজেন্ট। আমি ঢাকায় এলে ওর কাছ থেকে টিকিট নেই। চমৎকার ছেলে। সে তখনই চেষ্টা শুরু করে দিল। বিমান বাংলাদেশ এবং ক্যাথে প্যাসিফিক তখনও চালু আছে। ২৩ তারিখ দিবাগত রাত ১ টায় ক্যাথে প্যাসেফিকের ফ্লাইট আছে বলে জানাল। টিকিটের দাম তখনও ৬৬০০০ টাকা ওয়ানওয়ে। বিমানেও লন্ডন হয়ে চেষ্টা করেছিল কিন্তু লন্ডন থেকে টরন্টোর ফ্লাইট পাওয়া যাচ্ছিল না। দামও বেশি। আমি আশার আলো দেখলাম। আমি বুকিং দিতে বললাম ক্যাথেতে।
ঢাকা ২১ মার্চ ২০২০
পরেরদিন সকালে মানিককে সহ প্রথমে গেলাম গুলশানে কাতার এয়ারলাইন্সের অফিসে। গিয়ে দেখি শুনশান অবস্থা। লোকজন তেমন নেই। সর্বত্র্য আতঙ্ক বিরাজ করছে। কাউন্টারে যারা ছিল তারা শুধু জানাচ্ছিল এই মুহূর্তে তাদের কিছুই করার নেই। ওরা তেমন কোনো হেল্প করতে পারল না। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলল। কুয়েতে ফোন দিলে ওরা বলল, তারা ক্যাথে প্যাসিফিকে টিকিট কনভার্ট করতে পারবে না। আমি যদি পারি যেনো চলে যাই। রিফান্ডের ব্যবস্থা ট্রাভেল এজেন্ট করবে।
এরপর মানিকের সাথে গেলাম গুলশান দুই এ ক্যাথের অফিসে। এখানে বিশাল ভীড়। বেশিরভাগ কানাডার যাত্রী। এখানে কোনো টিকিট নাই। এদিকে আমার আর মানিকের বুকিং ক্যান্সেল হয়ে যাচ্ছে বারবার। রাকিব সারারাত বুকিং ধরে রেখেছে। রাকিব আমাদের দুজনেরই টিকিট কনফার্ম করে ফেলে। ওইদিন ২২ তারিখ দুপুরে আমরা টিকিট নেই। সন্ধ্যায় সেই টিকিটের দাম হয় প্রায় দেড়লাখ টাকা।
ঢাকা ২২ মার্চ ২০২০
২৩ তারিখ রাতে ঢাকা এয়াপোর্ট পৌঁছে দেখি শুনশান অবস্থা। একজন বলল, গত ৩০ বছরে এরকম দেখেনি কেউ। শুধু ক্যাথের যাত্রীদের লাইন। কানাডার যাত্রীই বেশি। আমরা হংকং পৌঁছলাম সময়মেেতাই। সেখানেও নিরবতা। যেখানে প্রতি পাঁচ মিনিটে একটা ফ্লাইট ওরে সেখানে খুব অল্প ফ্লাইট চলছে। সব ক্যান্সেল। হংকং এ ১২ ঘন্টা স্টপওভার ছিল। সুন্দর এয়ারপোর্ট। আগে কখনো আসিনি। আমরা একটা লাউঞ্জে সময় কাটালাম। তারপর হংকং সময় সোয়া ছয়টায় টরন্টোর ফ্লাইট উড়ল। আল্লাহর রহমতে ঠিকমতো টরন্টো পৌঁছলাম ২৪ তারিখ রাত পৌনে নটায়। চমৎকার ফ্লাইট ছিল। মানিক গেলো নিউইয়র্ক কাছকাছি সময়ের ফ্লাইটে। ওর ফ্লাইট ছিল ৬.৫৫ মিনিটে। আমার ৬.১৫ মিনিটে।
হংকং এয়ারপোর্ট ২৪ মার্চ ২০২০
স্নেহিথ আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে আনল। না হলে কোনো ট্যাক্সি পাওয়া কঠিন হতো। স্নেহিতের কাছে কৃতজ্ঞ। টরন্টোর রাস্তাঘাটও নীরব। হাইওয়েতে তেমন গাড়ি নাই। আমার লাগেজ পেতে রাত দশটা হয়ে গেছিল। টরন্টো এয়ারপোর্টে দুটো ফ্লায়ার দিল ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে। এটা ম্যান্ডেটরি। টরন্টোতেও সবকিছু থমেক গেছে। ছেলে মেয়ে যার যার ঘরে। পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি এটাতেই আমার শান্তি। এখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ছাড়া কিছুই করার নাই।
রাতে ঘরে ফিরে জেসমিন সাথে সাথে বলল, সব কাপড় চেঞ্জ করো। আমি চেঞ্জ করে কাপড় চোপড় লন্ড্রিতে ফেললাম। জেসমিন দূরত্ব বাজায় রাখছে। দুই মিটারের মধ্যে আসছি না কেউ। বেডরুম আলাদা, ওয়াশরুম আলাদা। ছেলে মেয়েরা কেউ বাসায় আসছে না। জেসমিন টেবিলে খাবার দেয় আমি খাই। ১৪ দিন আমার জন্য একটা ক্রুশিয়াল টাইম পিরিয়ড। মনের মধ্যে ভয়। নানামুখী ভীতি। কিভাবে যে বেঁচে আছি।
ভাল ভাবেই টরন্টো পৌঁছেছি কাল রাতে। দুইবার ফ্লাইট ক্যান্সেল হওয়ার পৱ সৌভাগ্যক্ৰমে পৱিবাৱেৱ কাছে আসতে পেৱেছি। ক্যাথে প্যাসেফিকেৱ ঢাকা থেকে এটাই ছিল লাষ্ট ফ্লাইট। হংকং এ ১২ ঘন্টাৱ স্টপ ওভাৱ ছিল। বন্ধু মানিক ছিল বলে খাৱাপ লাগেনি। কাছাকাছি সময় মানিক নিউইয়ৰ্ক চলে গেছে আমি টৱন্টো।
টরন্টো ২৫ মার্চ ২০২০
আমার কেবলই মনে হয় এই সুন্দর পৃথিবীটার প্রতি আমরা অনেক অত্যাচার করেছি। যাচ্ছেতাইভাবে পৃথিবীটাকে ধ্বংসের কাজ করেছি। ধ্বংস করছি বৃক্ষ, পশু, পরিবেশ। বিষাক্ত করেছি নদী, সমুদ্র, আকাশ। নদী মেরে ফেলছি, বুক্ষ ধ্বংস করছি, সমুদ্র ধ্বংস করছি। মানুষ মারছি বোমা আর মিসাইল মেরে। জলে, স্থলে অন্তরিক্ষে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছি। পারমানবিক বোমা বানানোর প্রতিযোগিতা করছি। কে কতভাবে মানুষ হত্যা করতে পারে সেই প্রতিযোগিতা চলছে পৃথিবী জুড়ে। অথনৈতিক অবরোধ করছি। দেশ দখল করছি। ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে গেছি। জেলে পুড়ে দিচ্ছি বিনা দোষে। একে অপরকে ঠাকাচ্ছি। লুটপাট চালাচ্ছি। নাস্তিকতা করছি। এক দেশ আর দেশের উপর অবোরোধ দিচ্ছে, মানুষ না খেয়ে মরছে। সম্পদের পাহাড় গড়ছি। পাচার করছি গরীবের সম্পদ।
প্রকৃতি এসব সহ্য করতে পারেনা। প্রকৃতি তার শোধ নিবেই। চেক এন্ড ব্যালেন্স নাই পৃথিবীর। পৃথিবীর মানুষের জন্য আজ একটা শিক্ষা। আল্লাহ সবময় ক্ষমতার অধিকারী। এই কথাটা আমরা ভুলে গেছি। এই বিপযয় থেকে মানুষের শিক্ষা হোক। আল্লাহ তার সৃষ্টিকে ভালবাসেন। তাদের বোধদয়ের জন্য এই পরীক্ষায় ফেলেছেন। পৃথিবী আবার একদিন সুন্দর হবে। ধনী গরীবের বৈষম্য ঘুচে যাবে। কেউ কারো সম্পদ কেড়ে নেবে না। মানুষ না খেয়ে থাকবে না। সম্পদের বৈষম্য ঘুছে যাবে। কেউ কাউকে হত্যার জন্য মারণাস্ত্র তৈরি করবে না। এক নতুন পৃথিবী গড়ে উঠবে। ততদিন আমরা অনেকেই হয়ত থাকব না। মৃত্যু অনবিায। সবাইকেই যেতে হবে, যেতে হয়। আমরা সবাই যেনো সবাইকে ক্ষমা করি। আল্লাহর কাছে আমাদের কুতকমের জন্য ক্ষমা চাই।
টরন্টো ২৬ মার্চ ২০২০
আজ সেলফ আইসোলেশনের তৃতীয় দিন শুরু। কানাডায় এটা বাধ্যতামূলক। আমি আইন মেনে চলা লোক। রাষ্ট্রের যেমন তেমনি গৃহের। সব জায়গারই একটা নিয়ম কানুন আছে। এটা মেনে চলতে হবে। এখন কোয়ারেন্টাইনে থেকে ঘরের আইন কানুন মেনে চলছি। জেসমিনের বানানো আইন। আমার খারাপ লাগছে নাতো! আইসোলেটেড থাকায় আমি অভ্যস্ত। অতীতেও আমি অনেক সেলফ আইসোলেশনে থেকেছি। গতবছর হজ্জ থেকে ফিরে এসে প্রায় দু’সপ্তাহ ঘরেই ছিলাম। তখন ছেলে মেয়েদেরও আসতে মানা করেছি। এছাড়াও অসুস্থ্য হয়ে ঘরে অন্তরীন থেকেছি কত।
প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। এখন অবশ্য জেটল্যাগ চলবে কিছুদিন। ফজরের নামাজ পড়ে নিজেই চা বানাই। নিজের চায়ে নিজে মুগ্ধ। আগে যেমন অরিত্রির জন্যও চা বানাতাম এখন শুধু নিজের জন্য বানাই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাবি জীবন কত অনিশ্চিত! মৃত্যুকে পরোয়া নাই। প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কিন্তু অন্য সবাই ভাল থাকুক। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুরা সবাই ভাল থকুক। সুস্থ্য ও সুন্দর থাকুক। দুযোগ আসে আবার কেটেও যায়। সামনেই সুদিন অপেক্ষা করছে। বিজ্ঞান অনেক মহামারী মোকাবেলা করেছে। এটাও করতে যাচ্ছে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। এইসব ভাবতে ভাবতেই পূবাকাশ কখন রঙিন ওঠে নতুন সূযোদয়ে যেমন আমাদের মন আবার রঙিন হয়ে ওঠার অপেক্ষায়।
টরন্টো ২৭ মার্চ ২০২০
যথারীতি ছয়টায় ঘুম ভেঙ্গেছে আমার। নামাজ, চা ইত্যাদির পর একবার পদা সরিয়ে বাইরেটা দেখলাম। নীরব প্রকৃতি। নীরব বৃক্ষরাজি, আকাশ, বাতাস। যেনো বলতে চায় আমার উপর তোমরা মানবজাতি অনেক নিযাতন করেছো। এবার থামাও। সেলিব্রেটি নীতি বন্ধ করো। মন্ত্রী, এমপি, এমডি, জেনারেল, সচিব এইসব বৈষম্য তৈরী করেছো। মানুষ কেনো সেলিব্রেটি তকমা পাবে! কেনো ভিসা, পাসপোট, ইমিগ্রেশন দরকার হবে! কেনো কাঁটাতারের বেড়া! করোনা ভাইরাসের তো কোনো পাসপোট ভিসা লাগে না! সে প্রিন্স সালস বা টম হ্যাঙ্কসকে চেনো, বরিস জনসনকেও চেনেনা। পাখীর যেমন ভিসা পাসপোট লাগেনা। তার করোনার ভয় নেই। এই আকাশ, এই মাটি, এই সমুদ্র ভাগাভাগি করার তুমি কে! সীমানা প্রাচীর একটি ভ্রান্তধারণা।
একজন খেলোয়াড় কোটি কোটি পাউন্ড পারিশ্রমিক পায় বা একজন অভিনেতা অনেক বিলাসী জীবন যাপন করে! সুপার স্টার! কিন্তু আমিতো মনে করি চিকিৎসক, নাস, স্বাস্থ্যকমীরা হচ্ছে প্রকৃত হিরো। তারাই সেলিব্রেটি, তারাই সুপার স্টার। লাল কাপেট পেলে তারাই পাবে। এই দুযোগে তারাই একমাত্র ভরসা। তাদের পিছনে কত টাকা খরচ করে পৃথিবী! হাসপাতালের পিছনে কত বাজেট! পৃথিবী অন্যায় আর অনাচারে ভরে গেছে। চারিদিকে শুধু পাপ। হত্যা, মারণাস্ত্র, খুন, গুম, লুটপাট, ক্ষমতার দাপট, মিথ্যার বেসাতি।
প্রকৃতি এসব সহ্য করে না। তাইতো চারদিকে মৃত্যুর মিছিল। একটা ট্রমার মধ্যে আছি। নেগেটিভ খবর পড়তে পারি না। বেছে বেছে ভাল খবরগুলো দেখি, যেখানে আশার আলো আছে। জানি একদিন এই দুযোগ কেটে যাবে এবং তা অতি শীঘ্রই। জীবন আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কমচাঞ্চল্যে ভরে উঠবে এই পৃথিবী। দুযোগ পরবতী পৃথিবী কেমন হবে! মানুষ কি শিক্ষা নেবে! কে জানে। এইসব ভেবে দিন যায়
টরন্টো ২৮ মার্চ ২০২০
৫.৫৯ মিনিটে ঘুম ভেঙ্গেছে আজ। রাতভর কি সব স্বপ্ন দেখছিলাম। কোনো মাথা মুন্ড নাই যার। বাইরে তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। পৰ্দা সরিয়ে টের পেলাম ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। সুনসান নিরবতা। পাঁচদিন হলো এসেছি। জানালাটাই ভরসা। পৰ্দা সৱিয়ে আকাশ দেখি। কখনো টিভি দেখি, কখনো কখনো টোষ্ট বিস্কিট দিয়ে চা খাই। মুভি দেখি। খবর পড়তে ভাললাগে না। বন্ধুদের সাথে চ্যাট করি। সবাই বলে ভাল থাক, সাবধানে থাক, আমিও তাই বলি। আর কিইবা বলার আছে। পরষ্পরকে শান্তনা দেওয়া, সাহস দেওয়া ছাড়া! অদ্ভুত এক অন্ধকার এসেছে পৃথিবীতে। কিন্তু অন্ধকার কেটে গিয়ে শীঘ্রই আলোর দেখা মিলবে। যেমন আজকের মেঘলা আকাশ কেটে গিয়ে সূর্য উঠবেই।
২৪ মার্চ রাত পৌনে ন’টায় ক্যাথে প্যাসিফিকের ফ্লাইট ল্যান্ড করে টরন্টো পীয়ারসন এয়ারপোর্ট। ঢাকা থেকে এটাই ছিল ক্যাথে ড্রাগনের লাষ্ট ফ্লাইট। ২৬ ও ২৮ মাৰ্চরে টিকিটও বিক্রিী হচ্ছিল। কিন্তু এয়ারপোৰ্ট এসে শুনলাম সব ফ্লাইট ক্যান্সেল! এইমাত্র ঘোষনা দিয়েছে। তখন রাত এগারোটা। আমি যে যেতে পারছি সেজন্য অনেকখানি কৃতিত্ব ট্রাভেল এজেন্ট রাকিবের। সে সারারাত আমার বুকিং ধরে রেখেছে। ক্যান্সেল হয়ে যায় আবার রি-বুকিং করে। আমার মূল টিকিট ছিল কুয়েত এয়ারে। সেটা ক্যান্সেল হওয়ায় কাতার এয়ারে ডাইভাৰ্ট করেছিল। ২১ মাৰ্চ কাতার সহ দশটি এয়ারলাইন্স ক্যান্সেল হয়ে গেলে আমার টরন্টো ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ভাগ্যক্রমে আমি আসতে পেরেছি।
২৫ মিনিট আগেই ল্যান্ড করল আমার ফ্লাইট। আগেই কথা ছিল ছেলে মেয়েরা কেউ এয়ারপোৰ্ট যাবে না। পরিচিত উবার চালক স্নেহিথ আমাকে এয়ারপোৰ্ট থেকে পিক করল। স্নেহিতের প্রতি কৃতজ্ঞ। ট্যাক্সি পাওয়া নিয়ে সমস্যা হতো সে ৱাতে। টরন্টোর রাস্তাঘাট নীরব। হাইওয়েতে তেমন গাড়ি নাই। আমার লাগেজ পেতে রাত দশটা হয়ে গেছিল। টরন্টো এয়ারপোৰ্টে দুটো ফ্লায়ার দিল ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে। এটা ম্যান্ডেটরি। সবকিছু থমকে গেছে।
ঘরে ঢুকতেই জেসমিন কাপড় চোপড় সব লন্ড্রিতে ফেলতে বলল। জুতা আলাদা কৱতে বলল। লাগেজ সেনিটাইজ কৱলাম। জেসমিন নিরাপদ দূরত্ব বাজায় রাখছে। দুই মিটারের মধ্যে আসছে না। সব আলাদা। ছেলে মেয়েরা কেউ বাসায় আসছে না। পরশু রাতে একবার দূর থেকে হ্যালো দিয়ে গেছে অরিত্রি। অৰ্কর সাথে এখনও দেখা হয় নাই। ১৪ দিন আমার জন্য একটা ক্রুশিয়াল টাইম পিরিয়ড। মনের মধ্যে নানামুখী ভীতি। কিভাবে যে বেঁচে আছি! কানাডার জন্য কোনো ভাল খবর নাই। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। আজকে পৰ্যন্ত ৫৬৫৫ জন আক্রান্ত, ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ভাল থাক সবাই। নিরাপদে থাক। ঘরে থাক।
টরন্টো ২৯ মার্চ ২০২০
প্রতিদিন সকাল এগারোটায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাষ্টিন ট্রুডো করোনা নিয়ে একটা ব্রিফিং দেন। সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। সেইসব প্রশ্ন তৈল মদন টাইপ না। সরকারের উদ্যাগগুলো সম্পকে জনগনকে অবহিত করেন। তারপর কানাডার চীফ হেলথ অফিসার, ডেপুটি চীফ হেলথ অফিসার কথা বলেন। ট্রুডো যখন কথা বলেন মনে হয় আমি একা না। আমার সাথে পুরো একটা সরকার আছে। নিজের অসহায়ত্ব কমে যায়। মাঝে মাঝে খারাপ ব্যাধি থেকে আশ্রয় প্রাথনা করে দোয়া পড়ি..”আল্লাহুম্মা ইন্নী আ’উযুবিকা মিনাল বারাসি ওয়াল জুযা-মি ওয়া সাইয়্যিইল আস্কা-ম।
প্রতিদিন যতটুকু সম্ভব বন্ধুদের খবর নেই। আত্মীদের খবর নেই। সাহস জোগাই, সাবধানে থাকতে বলি, ঘরে থাকতে বলি। এরচেয়ে বেশি কিইবা করার আছে। আমাকেও সবাই সাহস জোগায়। দোয়া করে যেনো ভাল থাকি সাবধানে থাকি। ২৫ মাচ তারিখে পূব নিধারিত একটা ডাক্তার এপয়নমেন্ট ছিল আমার। এপয়নমেন্টা আমার জন্য জরুরী ছিল। ঢাকা বসেই শুনেছি ডাক্তার আমাকে দেখবেন তবে সরাসরি না ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। ব্যাকপেইনের জন্য এমআরআই করেছিলাম। তারাই আমাকে নিউরোসাজনের কাছে রেফার করে। তাও প্রায় তিনমাস আগে। এবার ঢাকা যতদিন ছিলাম খুউবই ভাল ছিলাম। ব্যাকপেইন আমাকে একদমই ভোগায়নি। সম্ভবত ওয়েদারের জন্য।
২৫ মার্চ সকালে ডাক্তার অফিসে ফোন করলাম। সেক্রেটারি ইমেইলে নিয়মকানুন সহ ’ইনফিনিটি কানেক্ট’ নামে একটা এ্যাপস পাঠালেন। ফোনে ডাউনলোড করলাম। বিকেলে চারটায় আমার এপয়নমেন্ট। ডাক্তার রস ঠিক চারটায় আমাকে ফোন করে ভিডিও ইন্টারভিউয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আমার সব কথা শুনলেন,দেখলেন আমার মুভমেন্ট। পরেরদিন ডাক্তারের সেক্রেটারি জানালেন, তোমার ফ্যামিলী ডাক্তারের কাছে সব তথ্য চলে গেছে। আসলে এই মুহূতে ব্যাকপেইন গৌন আমার কাছে। আমার মন প্রাণ জুড়ে শুধু ভাবনা কবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে। কবে সবাই প্রানভরে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াবে। খারাপ খবরগুলো আর নিতে পারছি না! সেই দিন খুব দূরে নয়। ততদিন সবাই সবাধানে থাক, ঘরে থাক, কানেক্ট থাক পরষ্পরের সাথে।
টরন্টো ৩০ মার্চ ২০২০
ছয়টার মধ্যেই ঘুম ভাঙ্গে আমার। আজকে একবার ঘুম ভেঙ্গে দেখি চারটা বাজে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ঢক ঢক করে পানি খাই। ওয়াশরুমে যাই। জেসমিনের ঘরের দরজার দিকে উঁকি দেই। মুদৃ নাক ডাকার শব্দ হচ্ছে। আহা জীবন কত বদলে গেছে! ৃদুটি পাখী একটি ছোট্ট নীরে কেউতো কারো পানে চায় না ফিরেৃটাইপ জীবন। কালকে অৰ্কৱ সাথে ভিডিওতে কথা বলেছি। আহা বাছাকে দেখিনা ঢাকা থেকে আসার পর।
আবার ঘুমিয়ে ছয়টাৱ মধ্যে উঠে যাই। জানালাৱ পৰ্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই। অন্ধকার বাইরেটা। কোনো জনমানুষ্যি নাই। অন্য সময় হলে অনেকেই এই সময়ে কাজে যায়, গাড়ির চলাচল থাকে। ওজু করে নামাজ পড়ি। নামাজে বসে মনোযোগ হারাই বারবার। মনে মনে বলি এতো ছোট্ট একটা জিনিস, অনু পরমানুর চেয়েও ক্ষুদ্র এক চীজ সেটার ভয়ে মানুষ আজ দিশেহারা। কুকড়ে আছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। কে কখন আক্রান্ত হবে জানা নাই। অনেক চেনা মানুষের মত্যুর খবর শুনতে পাই। তখন নিজের বানানো চা বিস্বাদ লাগে।
রাতে স্বপ্নে দেখলাম কৱোনার ভয়ে ব্যাংকক চলে যেতে চাচ্ছি। মনে মনে বলছি ওখানে কি নিরাপদ! কোথায় নিরাপত্তা! কোথাওতো নিরাপত্তা নাই। আবার স্বপ্নে দেখলাম আমি আর জেসমিন সিডনি গেছি। যে বাসায় উঠেছি সেখানে অনেক লোকজন দেখে আমি হোটেল খুঁজছি। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, হোটেল কতদূর! সে বলল ধারে কাছে কোনো হোটেল নাই। যেটাওবা আছে সেটা অনেক দামী হোটেল। একবারতো ভুল বাসায় ঢুকে পরেছি। বাসার লোকটা খুব জেরা কলল আমাকে। তারপর কি হলো আর জানি না..। আবার দেখি একটা কবিতা উৎসবে গেছি। সেখানে পরিচিত মানুষরা হৈ হল্লা করছে খুউব..।
এইসব এলেবেলে ভাবনা রাতের ঘুম নষ্ট করে দিয়েছে। ফেসবুক খুলতে ভয় পাই। টেলিভিশনের পৰ্দায় বা সংবাপত্রের পাতায় চাখে বুলাতে ইচ্ছা করে না। শুধু নেগেটিভ খবর। ইউরোপ আমেরিকায় মত্যুর মিছিল। কানাডায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, মুত্যুর সংখ্যাও। আগামী দুই সপ্তাহ খারাপ হবে আরো বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ সেই তুলনায় ভাল আছে। সেখানে জনসংখ্যা অনুয়ায়ী আক্রান্ত এবং মত্যুর সংখ্যা নগন্য। এটা মনে আশা জাগায়।
মানুষও বসে নেই। বিজ্ঞানীরা করোনাকে জয় করবেই একদিন। মনে মনে ভাবি কাল সকালেই শুনব করোনা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। করোনা যেমন মানুষের কাছে ছিল অচিন্তিনীয় তেমনি যদি কাল সকালে শুনি আর করোনা নাই, আক্রান্ত বা মৃত্যুর ঘটনা নাই সেটা মোটেও বিস্ময়ের হবে না। পৃথিবীতে কত মিরাকলইতো ঘটে। যিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনিই ভাল জাানেনৃ। আমি আশাবাদী মানুষ।
আল্লাহ তুমি সবাইকে ভাল রাখ। সবাই নিরাপদ থাক, ঘরে থাক।
টরন্টো ৩১ মার্চ ২০২০ (পর্ব-২ আগামী মঙ্গলবার)
Leave a Reply