শুক্রবার, ০৯ Jun ২০২৩, ০৬:১১ অপরাহ্ন

রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙ্গা আমের ইতিহাস-রানা মাসুদ

রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙ্গা আমের ইতিহাস-রানা মাসুদ

রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙ্গা আমের ইতিহাস
রানা মাসুদ

শুধু রংপুর নয় বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে হাঁড়িভাঙ্গা আমের সুনাম ও কদর এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। দেশের একমাত্র আঁশ বিহীন স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই আম এখন দেশসেরা।
এই আমের অদ্ভুত নাম শুনে অনেকেই ভিরমি খান। অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন এই অদ্ভুত নামকরণের ইতিহাস জানতে। এ কারণে আমার ক্ষুদ্র এই প্রচেষ্টা।
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ১নং খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রাম। এই গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকারকে ঘিরে ইতিহাস। এই এলাকার এক জমিদার তাজ বাহাদুর সিং। তাঁর জমিদারি ছিল বর্তমান বালুয়া মাসিমপুর এলাকায়। তাজ বাহাদুর ছিলেন ভীষণ সৌখিন, প্রজাবৎসল এবং উদার মনের মানুষ। ছিল তাঁর বাড়িতে বিরাট বাগান। আর বাগানে ছিল জাত-বিজাতের নানান গাছ। ছিল অনেক প্রজাতির ফলের গাছ। এই বাগানের ফল বিশেষ করে আম কিনে নিয়ে এবং আরো বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করে নফল উদ্দিন পাইকার এবং তাঁর ছেলে তমির উদ্দিন পাইকার করতেন ব্যবসা। জমিদার তাজ বাহাদুর সিং-এর বাগানে যেসব গাছে আম পাওয়া যেত তার মধ্যে একটি গাছের আম ছিল ভীষণ সুস্বাদু, আঁশ বিহীন এবং সুমিষ্ট। শোনা কথা এই আম গাছের চারা জমিদার তাজ বাহাদুর ভারতের কোন এক স্থান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এই আম খেয়ে মুগ্ধ হয়ে পাইকার নফল উদ্দিন এর একটা চারা করে নিজ বাড়ির পাশে রোপন করেন। কোন এক বন্যার সময়(১৯৮৮) এবং পরবর্তীতে নদী ভাঙনে জমিদারের বাগান যমুনেশ্বরী নদীতে বিলীন হয়।
মিঠাপুকুরের এই এলাকা হচ্ছে খিয়ারী মাটির শুষ্ক এলাকা। এছাড়া বরেন্দ্রপ্রবণ অঞ্চল হওয়ার কারণে এখানকার লাগানো গাছে পানি দিতে হতো সবসময়।নফল উদ্দিনকে পাইকারি মানে ব্যবসার কাজে দিনভর ছোটাছুটি করতে হয়। তিনি সেই আম গাছের চারাটার প্রতি এতো যত্নশীল হয়ে ওঠেন যে ওই আম গাছের চারার গোড়ায় মাটির হাঁড়ি দিয়ে বিশেষ কায়দায় পানি রেখে তা দিয়ে সেচ দিতেন। এর মধ্যে এক রাতে কে বা কারা ওই মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে। এরপর ওই গাছে একসময়(তিন বছর পর) আম ধরে। আম প্রতিবেশীদের দিলে এবং বিক্রির জন্য পাশ্ববর্তী বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন আম খেয়ে অভিভূত হয়ে যান।তারা জিজ্ঞেস করেন কোন গাছের আম এটা। নফল উদ্দিন পাইকার তখন জানায়, যে গাছের নীচে পানি রাখা হাঁড়িটা মানুষ ভেঙেছিল সেই হাঁড়িভাঙ্গা গাছের আম এটা। এরপর এভাবেই হাঁড়িভাঙ্গা গাছের আম এটা বলতে বলতে হাঁড়িভাঙ্গা আম নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে এই চমৎকার সুমিষ্ট, আঁশহীন আমটি। এখনো ইতিহাসের ও কালের সাক্ষী হয়ে আছে তেকানী পাড়ায় সেই নফল উদ্দিন পাইকারের আম গাছটি। কলম ও চারা করে ধীরে ধীরে এর ব্যাপক বিস্তার ঘটে মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ,পদাগঞ্জসহ আশেপাশের এলাকায়। বর্তমানে এই গাছটির বয়স ৬৪ বছর বলে জানা গেছে।
অপর এক তথ্যে জানা যায় নফল উদ্দিনের পুত্র তমির উদ্দিন জমিদারের বাগান বিলীন হওয়ার পূর্বে একটি আম গাছের চারা এনে নিজ বাড়িতে রোপন করেন। শুষ্ক মৌসুম ও বরেন্দ্রপ্রবণ অঞ্চল হওয়ার আমের চারাটি একটি হাঁড়িতে রোপন করে পরিচর্যা করতে থাকেন। কিন্তু কয়েকদিন পর কে বা কারা হাঁড়িটা ভেঙ্গে ফেলে। তবে এতে চারাটার কোন ক্ষতি হয় না। আমের সেই চারা ক্রমে বৃক্ষে পরিণত হয়। তিন বছর পর আম ধরে। সুমিষ্ট সে আম খেয়ে মানুষ অভিভূত হয়ে জানতে চান কোন গাছ কি জাতের আম। তখন নফল উদ্দিন জানান হাঁড়িভাঙ্গা গাছটার আম। ‘হাঁড়িভাঙ্গা গাছটা’ থেকে হয়ে যায় হাঁড়িভাঙ্গা আম।
এই আম চাষ, ফলন ও সম্প্রসারণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন আলহাজ আব্দুস সালাম সরকার, পাইকার নফল উদ্দিন ও তাঁর ছেলে তমির উদ্দিন সরকার। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ১৯৯৩ সালে আব্দুস সালাম সরকার হাঁড়িভাঙ্গা আমের চারা সংগ্রহ ও রোপনে উদ্যোগী হন। তিনি নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে তমির উদ্দিন পাইকারের বাড়িতে যান এবং চারা সংগ্রহ করেন।
বর্তমানে রংপুরের মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ,পীরগাছা, রংপুর সদর, পীরগঞ্জ,কাউনিয়ার বেশ কিছু এলাকায় এই আমের বাগান গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও গাইবান্ধা জেলার কিছু এলাকায় এখন এই আম চাষ হচ্ছে বলে সাংবাদিক আফতাব হোসেনের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে। তবে খিয়ারী মাটির হাঁড়িভাঙ্গার স্বাদ স্বর্গীয়, অসাধারণ!
রংপুর কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার রংপুর জেলায় তিন হাজার হেক্টর জমিতে আমের ফলন হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার চারশো পঞ্চাশ হেক্টর জমিতে হয়েছে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ। গত বছরে হেক্টর প্রতি ফলন হয়েছিল ৯ দশমিক ৪ মেট্রিক টন। করোনার কারণে শ্রমিক সংকট,অযত্ন-অবহেলা, কীটনাশকের সংকটসহ নানা কারণে কৃষকরা আম বাগানের পরিচর্যা ঠিকভাবে করতে পারেনি। এছাড়া ঝড়-বৃষ্টি জনিত কারণে এবার ফলন কম হবার আশঙ্কা করা হচ্ছে বলে পত্রিকার খবরে জানা গেছে। জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে এই আম পরিপক্বতা লাভ করে। এ সময় থেকে উত্তোলন করা শুরু হবে।
হাঁড়িভাঙ্গা আম গত কয়েক বছর ধরে রংপুরের মানুষের প্রিয় জনের জন্য প্রিয় উপহার। এই উপহার অর্থাৎ হাঁড়িভাঙ্গা আম দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর জন্য একাধিক কুরিয়ার সার্ভিসের ঈদ লেগে যায়। একাধিক বিশেষ কাভার্ড ভ্যান দেয়াসহ অস্থায়ী শাখা অফিস পর্যন্ত খোলে তারা। হাঁড়িভাঙ্গা আমের জন্য পদাগঞ্জে বসে বিশাল পাইকারি আমের হাট বা বাজার। এছাড়া রংপুর শহরের আর কে রোডে বাস টার্মিনাল বাইপাস সড়কের দুই ধারে বসে হাঁড়িভাঙ্গা আমের অস্থায়ী বাজার।
রংপুরের ব্রান্ড লোগো হিসেবে অনেকেই হাঁড়িভাঙ্গা আম প্রত্যাশা করছেন। ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্র: অনলাইন, বিডিএলটিসি, এগ্রিকেয়ার ২৪ ডট কম ও সাংবাদিক আফতাব হোসেনের প্রতিবেদন।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge