বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ০৯:৫১ অপরাহ্ন

একটি লাইব্রেরি ও তারুণ্যের গল্প- মোঃ রোকনুজ্জামান

একটি লাইব্রেরি ও তারুণ্যের গল্প- মোঃ রোকনুজ্জামান

একটি লাইব্রেরি ও তারুণ্যের গল্প- মোঃ রোকনুজ্জামান

বাঙালি জাতিকে যদি আমি উদ্ভট জাতি কিংবা উত্তাল বা মাতাল জনতার অন্যতম নিদর্শন বলি, তাহলে কি খুব ভুল হবে? কেউবা হ্যাঁ বলবেন কেউবা না। আপনি জানেন কি? জাতি হিসেবে আমরা কতটা পরিপক্ব বা কতটা সংশয়ে আছি?
বছর চারেক আগের কথা বলছি, স্বপ্নবাজ তরুণদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। তখন বয়স সতেরো কিংবা আঠারো হবে। অনেকদিন থেকেই মনে মনে একটা স্বপ্নের ছক এঁকেছিলাম। আমাদের গ্রামে সুন্দর একটা পাঠাগার হবে। যেখানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবাই জ্ঞান আহরণ করবে। আমরা এই জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু থেকে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম করবো। এবং একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তুলবো।
যেই চিন্তা সেই কাজ, শুরু করে দিলাম পাঠাগার তৈরির কার্যক্রম। প্রথমে আমার সব বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আলোচনা করলাম। সবার নেতিবাচক মনোভাব দেখে আমার উদ্দীপনা আরো বেড়ে গেলো। এলাকার শিক্ষিত সমাজ ও বই পিপাসু মানুষদের নিয়ে একটা মিটিং করলাম। সেখানে আমাদের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো।
পাঠাগারের নাম দিলাম (আমার মরহুম ভাইয়ের নাম অনুসারে) রবিউল স্মৃতি সাহিত্য কেন্দ্র। প্রথমের দিক ভালোই সাঁড়া পেলাম। সবাইকে নিয়ে বার বার মিটিং করলাম কিভাবে কি করা যায়, কি করলে ভালো হয়। সবার মতামত নিয়েই এগুতো শুরু করলাম। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম সপ্তাহে একদিন (শুক্রবার) আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করবো। যেখানে থাকবে কবিতা আবৃত্তি, উপস্থাপনা, সাঃ জ্ঞান, সাহিত্য আরো নানা আয়োজনে সাজানো হলো আমাদের সাপ্তাহিক বৈঠক।
শুরু হয়ে গেলো পাঠাগারের কার্যক্রম। যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে সদস্য সংগ্রহ করেছিলো তাদের মধ্যে অন্যতম আকাশি, পাখি, আশিক, আছিয়া, স্বপ্না, সুমন, ঝিনুক, শাহিন, মেহেরুল, ফরিদ, রাসেল, অারো অনেকের উল্লেখ যোগ্য অবদানের জন্যই প্রতি বৈঠকেই ত্রিশ থেকে চল্লিশ জনের মত সদস্য উপস্থিত থাকতো। কিন্তু আমাদের ঘর নেই, বই নেই, বসার মত একটা পাটিও নেই। আছে কেবল এক ঝাঁক তারুণ্যের প্রচন্ড ইচ্ছা শক্তি। রোদ-বৃষ্টি, বর্ষা-বাদল, সব কিছুই উপেক্ষা করেও একটা লিচু গাছ তলায় আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করতাম।
এভাবেই, কার্যক্রম পরিচালনা করলাম ছয় মাস। এরই মধ্যে আমরা বিভিন্ন ভাবে অর্থ উত্তোলন করার চেষ্টা করছিলাম। যাতে করে একটা ঘর নির্মান করা যায়। অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলো তন্মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী হিরা ভাই অন্যতম অর্থনৈতিক ও মানবিক ভূমিকা রেখেছিলো । শেষ পর্যন্ত ঘর উত্তোলন করতে পারলাম সেটা দীর্ঘ এক বছর পর।
বেশ ভালো ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এক বছরের মধ্যে সরকারি গণগ্রন্থাগারের আওতায় রেজিষ্ট্রেশনও করে ফেললাম। কিন্তু বুজতেই পারিনি, সমাজের ভয়াল থাবা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে!
মাঝের দিকে সদস্য বেড়ে গেলো এবং এই সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগেই মেয়ে ছিলো। ছেলে মেয়ে যৌথ ভাবেই আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করতাম। প্রস্ফুটিত হতে লাগলো লুকিয়ে থাকা তীক্ষ্ম মেধা গুলো। এক বছরের মধ্যে এমন একটা পজিশনে রুপ নিলো যেন সবার স্বপ্ন, ভালোলাগা অন্যতম কেন্দ্র বিন্দু হলো এই পাঠাগার।
কিন্তু এই জয় জয়কার সহ্য হচ্ছিলো না এলাকার কিছু কুমন্ত্রণা ধারি ব্যক্তিদের। শুরু হয়ে গেলো অপপ্রচার ও অপবাদের কারসাজি । বিভিন্ন ভাবে আমাদের হেয় করা হলো। বলাবলি শুরু হলো আমরা নাকি প্রেমের বাজার বসিয়েছি। আমাকে মূল টার্গেট করে, সর্বস্তরে আমাকে প্রচার করা হলো দুশ্চরিত্রের অধিকারী। আমাদের মেয়ে সমস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওরা অভিযোগ শুরু করলো, যাতে কেউ ঐ পাঠাগারে না যায়। এমনকি আমার পরিবারেও অভিযোগ দিলো আপনার ছেলেকে থামান।
যেখানে প্রতি বৈঠকে চল্লিশের বেশি উপস্থিত থাকতো সেখানে পিছন ফিরে দেখি চারজনও নেই। কিন্তু অাদৌ আমি হেরে যাওয়ার পাত্র ছিলাম না। সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে শুরু করাটা যে কতটা কষ্টের কতটা ত্যাগী মনোভাব থাকতে হয় সেটা বলে বোজানো যাবে না।
ঐ সংকট কালিন সময়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তুহিন ভাই আমার সহ যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়। যার অক্লান্ত পরিশ্রম জন্যই আজ এতদূর পর্যন্ত আসা। আমাদের সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করেছিলো বেগম রোকেয়া পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক জনাব, রফিকুল ইসলাম দুলাল ভাই। ছায়ার মতো যারা আগলে রেখেছিলো সে দুইজন শ্রদ্ধিয় ব্যক্তি হলেন, বাংলা একাডেমির উপ পরিচালক জনাব ফারুক হোসের স্যার ও সড়ক ও জনপদ বিভাগের প্রধান জাকির স্যার। পাশে দাড়িঁয়েছিলো অনেক শিক্ষক, প্রভাষক সহ বেশ কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী।
আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সদস্যদের ডাকতাম। তাদের পছন্দমত বই দিয়ে আসতাম। সপ্তাহ শেষে সেগুলো আবার সংগ্রহ করতাম। এভাবেই শুরু করেছিলাম আমার নতুন পথের স্বপ্ন সারথী। আস্তে আস্তে আমার পিছনে অনেকেই দাড়িঁয়ে গেলো। মন্দ লোকের কুমন্ত্রণা থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসতে শুরু করলো। আজ প্রায় তিন বছর, পাঠাগারটা এখন প্রতিষ্ঠিত। এইতো সেদিনেই সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আমরা অনুদান পেলাম। দুই আলমারি ভর্তি এখন বই। সেখানে এখন শত শত স্বপ্নবাজ তরুণ তরুণীদের আনাগোণা।
নিন্দুক ছিলো, আছে, থাকবে। এদের কাজই হলো আপনাকে পিছন থেকে টেনে ধরা। কিন্তু শুধু একবার আপনি নড়েচড়ে বসেন। দেখবেন বেলাশেষে আপনি সফল। হাজারো তরুণ আজ নেশা, মদ, জুয়ার কবলে আসক্ত। এদের বাধা দেয়ার বা আটকানোর কোন লোক নেই । আটকানো হয় কেবল সেই সব তরুণদের যারা স্বপ্ন দেখে সুন্দর একটা আগামি সকালের, যেখানে লেখা থাকবে আমার সোনার বাংলা।
আমি কেবল ভয় পাই ঐ সমস্ত স্বপ্নবাজ তরুণদের নিয়ে। যারা প্রতিনিয়তই স্বপ্ন দেখে আকাশ ছোয়াঁর। তারা কি আদৌ টিকতে পারবে, আমাদের এই কুলষিত নগ্ন সমাজে? তবে এই ভেবে শান্ত্বনা পাই যে, তারুণ্যের বিপরীত কোন শব্দ নেই। তাদের রং নেই, তাদের ভয় নেই। তারুণ্য মানেই আকাশকে পাতাল আর পাতালকে মত্ত করে দেয়ার ক্ষমতা। পাহাড় সমান হাজারো বাধা পেরিয়ে তারুণ্যের জয় হবেই হবে। মনে রাখবেন, আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়। জয় হোক আগামীর, জয় হোক তারুণ্যের।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge