আবিদ করিম মুন্না’র গল্প স্বপ্নযাত্রা
উৎসব উপদ্বীপে কাল পিকনিক। ইচ্ছে ছিল দুপুরেই যাবে। মাসুদ ভাইয়ের জোরাজুরিতে না গিয়ে পারা গেল না। সকালে না যাবার শক্ত একটা অজুহাতও দাঁড় করিয়েছিল। মাঘের এই সকালে চুলে নাকি মেহেদি মাখাবে। মাসুদ ভাই বললেন, কাল সাতসকালে যেতে রাজি না হলে এখনই মেহেদি মাখা শুরু করবেন। দারুন রসিক মানুষ। টেকো মাথা; চুল গোনার জন্য যার কোনো গণনা যন্ত্রেরই প্রয়োজন হয় না, তিনি নাকি মেহেদি…। কী আর করার! ফ্রিজে মেহেদিবাটা পলিথিনে পেঁচিয়ে রাখলেন। শনিবার অফিস ছুটি আছে কথাটা মনে করিয়ে দেবার সাথেই জাবেদের জবাবÑ জো হুকুম।
সবাইকে যেতে হলো নিজ দায়িত্বেই। এমনকি প্রবেশ মূল্যটাও…। ঢাকার আকাশে আজ চমৎকার মিষ্টি রোদ উঠেছে! সালাহ্উদ্দিন ভাই নাস্তার একটা বস্তা ভেতরে নিতে অনুরোধ করলেন। এখানে আগে কখনও আসা হয় নি। পাশের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে রিপাকে নিয়ে বহুদিন আগে এসেছিল। বিয়ের আগে না পরে স্পষ্ট মনে করতে পারছিল না। বিয়ের পরই হবে কারণ একটা ঘটনা…।
মিরপুর চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচা পেরিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে বেশ কিছুদূর পর সিংহের খাঁচা। পেছনেই সাপের খাঁচা। কত ভয়ংকর সাপ সেখানে! আগুন, পানি, সাপ, কুকুর, রক্ত আর লাশ দেখলে জাবেদের গা ছমছম করে। বানরের খাঁচা কেন সামনে থাকেÑ হতেই পারে গবেষণার বিষয়।
২৫ বছর আগে স্কুলে যখন পড়ত তখন রূপপুর চিড়িয়াখানার প্রায় সব খাঁচাই তৈরি ছিল। স্কুলের বাংলা স্যার দুষ্টু ছেলেদের বলেছিলেন, কিছুদিন পরই তো চিড়িয়াখানা চালু হচ্ছে আর বানরের খাঁচাটা সামনেই এবং খালি পড়ে আছে। সেটাই তোদের উপযুক্ত জায়গা মনে করছি। প্রতিদিন দর্শনার্থীরা পথ চলতে গিয়ে বিনে পয়সায় দেখবে তোদের বাঁদরামি। আজ অনেকদিন পর খন্দকার মাহফুজুর রহমান স্যারের কথা মনে পড়ল।
উৎসব উপদ্বীপের চারিদিকেই লেক। ভারী সুন্দর। স্বচ্ছ পানি। বেশ কয়েকটা রাজহাঁস ঘুরছে আপন মনে। শবনম আপা সেলফোনের ক্যামেরায় বন্দী করছিলেন জলকেলী। জাবেদও দু-একটি ¯œ্যাপ নিয়ে ফেলল। সীমানা ঘেঁষেই মহাসড়ক স্পষ্ট চোখে পড়ে। দুপাড়েই যানবাহন সাঁই সাঁই ছুটছে।
নাস্তা বিতরণের মূল দায়িত্বটা ছিল জাবেদের। খুব খিদে পেয়েছে তার। রিংকু ভাইকে কথাটা বলতেই বললেন, বিতরণ করুন আর যত খুশি খেতে থাকুন। নাস্তার পর্ব চলল প্রায় সোয়া এগারোটা পর্যন্ত। তারপর শুরু হলো বাচ্চাদের খেলা এবং অতিথিদের দড়ি টানাটানি। দড়ি টানাটানিতে অংশ না নিয়ে জাবেদ প্রস্তুতি নিচ্ছিল কালচারাল প্রোগ্রামের। ক্যারিক্যাচার টাইপের কিছু একটা করতে চায়। দেখলে কেউ বুঝবেই না নিরস এই মানুষটি আবার হাসাতে জানে। সাইফ ভাই উপভোগ করছিলেন আর মিলিয়ে নিচ্ছিলেন এ যে দেখি হুবহু হচ্ছে। কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির কণ্ঠস্বরকে হুবহু কপি করতে জাবেদের জুড়ি নেই। প্রায় আট রকমের হাসির আইটেম মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করলো সবাই। দর্শকপর্বে অংশ নিয়েও প্রথম হলো। আজ শুধু চারিদিকে আনন্দ আর খুশি…। বহুদিন এমন সাফল্যর মুকুট পরা হয় নি।
চিড়িয়াখানায় পিকনিক অথচ চিড়িয়া দেখতে যাবার কারো ইচ্ছে জাগছে না। জুম্মার বিরতির সময় একটা কাঠবিড়ালীর মনের সুখে লম্ফঝম্ফ দেখছিল আকাশমণির ডালে। ছোটোবেলায় পড়া কাঠবিড়ালীর সেই ছড়াটিই মনে পড়ছিল।
কামরুন্নেসা আন্না আপাকে দেয়া হয়েছে দুপুরের খাবারের মূল দায়িত্ব। আজকে অনেক পরিশ্রম করেছেন এমনটি বলে জাবেদকে আলাদা খাতিরযতœও করলেন।
দুপুরে খাবারের সময় এল রিপার ফোন। একদমই ভালো লাগছে না তার। জাবেদ বুঝে গিয়েছিল আজই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পিকনিকের আনন্দ মনে হয় মাঠেই মারা গেল।
বেশ টেনশন হচ্ছে। ওয়াফার পৃথিবীতে আগমনটা সুন্দর হবে তো! জাবেদ ফেসবুক ফ্রেন্ড তারানা তাবাসসুম তুলনার সাথে বিষয়টি শেয়ার করে। তুলনা সাহস জুগিয়ে বললেন, দেখবেন খুব সুন্দরভাবে ওয়াফা পৃথিবীতে আসবে। শুভকামনা সবসময় ভাবী আর নতুন অতিথির জন্য।
বিউটি আপা এবং হাবীব ভাইকে কানে কানে কিছু একটা বলে স্পট থেকে অনেকটা উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গেল জাবেদ।
শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ডাক্তারদেরও পারিবারিক জীবন বলে কিছু একটা আছে। তারপরও রোগীর জীবন মরণের প্রশ্নটি সবার আগে। রিপা ডা. নারমীন সোহানা লাকীকে ফোন দেয়। দ্রæত চলে এসে একটা আলট্রাসনোগ্রাম করতে বললেন। আরো জানালেন বিকেল ঠিক পাঁচটায় চেম্বারে আসবেন।
এদিকে রক্তের ব্যাপারে লিনির সাথে কথা হয় জাবেদের। জানায়Ñ নিজে না থাকলেও কাউকে পাঠিয়ে হলেও চেষ্টা করবে সবকিছু সহজ করতে।
রিপোর্ট নিয়ে চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করছে রিপা তার ভাবীকে নিয়ে। রিপোর্ট দেখেই ডাক্তার বললেন, আজ রাতেই অপারেশন করবো।
কালবিলম্ব না করে রিপা লিনিকে ফোন করে। রিপার কাজিনের পুত্রবধূ ডা. তানহা সবার আগে ছুটে আসে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে লিনিও এসে পড়ে।
সকালে লিনির পরীক্ষা। জাবেদ জানালোÑ লিনি, তোমার তো অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে! বলল, মানুষের জীবন সবার আগে। পরীক্ষায় খারাপ করলে আবার দিতে পারবো কিন্তু…। একটু পর জানালো, এই মুহূর্তে বøাড ব্যাংক থেকে নতুন রক্ত ক্রস ম্যাচিং করে এনে ওটিতে দিলাম। অপারেশন চলছে এখন। আমার রক্তের গ্রæপ ও পজিটিভ। নিজে দিতে পারলে খুব ভালো হতো। কিন্তু আমার শরীরের এক ব্যাগ রক্ত বিনিময় করে এ পজিটিভ রক্ত এনে দিলাম। এতেই খুশি। মনে হচ্ছে ম্যাডামের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করা হলো। ওয়াফা সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসুক…। ইনশাআল্লাহ ভালো কিছুই হবে।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তারাভরা রাত আলোকিত করে এল ওয়াফা। ওয়াফা যখন পৃথিবীর আলোতে বেরিয়ে আসলো তখন ওর সামনে দাঁড়িয়েছিল লিনি। পুরো সিজারের সময়টা পাশে থেকে রিপাকে দেখেছে রক্তের ¯্রােতে ভেসে যেতে।
ওয়াফাকে প্রথমবারের মতো দেখতে জাবেদ রাজধানী ছেড়েছে।
বাস ছুটছে যমুনা ব্রিজের দিকে।
রাত একটা। লিনির এসএমএসÑ খুব খারাপ লাগছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। রক্ত দিয়েছি তো। বøাড দিয়ে প্রিজার্ভ করে না রাখলে যদি আবার কারো লাগে কে দেবে? তার ওপর পড়ার লোড নিতে হচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। ওয়াফার পাশাপাশি আমার জন্যও দোয়া করবেন।
ওয়াফা দেখতে খুবই সুন্দরী হয়েছে। কথাটা জানায় লিনি। সে নিজেও কম নাÑ প্রায় পাঁচ ফুট সাড়ে পাঁচ। ওয়াফা বোধহয় বাবা-মাকেও ছাড়িয়ে যাবে। কেননা তাদের গড় উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত। মিস ইউনিভার্স সুস্মিতা সেন পাঁচ ফুট এগারো। ওয়াফা আবার সেটাকে অতিক্রম করবে নাতো! তালগাছ টাইপের মেয়ে যতই সুন্দরী হোক মোটেই পছন্দ না জাবেদের।
লিনি জানালোÑ আপনাদের মেয়ে দেখবেন সব স্বপ্নকে সার্থক করে তুলবে। ও বড়ো হতে হতে আল্লাহ বেঁচে রাখলে আমি নিজেও বুড়ো হয়ে যাব। হয়ত আপনি যখন নানু হবেন আজকের মতো ওয়াফার সন্তান আমার হাত ধরেই পৃথিবীতে আসবে… সেই অপেক্ষায়। ঘুমোবো সাড়ে তিনটায় এক ঘণ্টার জন্য। ভোর সাড়ে চারটায় উঠে আবার পড়তে হবে।
জাবেদের অফিস প্রধান এসএমএস করেছেÑ কনগ্রাচুলেশন্স। কন্যা ইজ অলওয়েজ এ সাইন অফ গুড ফরচুন।
লিনিকে এ কথা বললে সেও সুর মিলিয়ে বলে, অবশ্যই ফরচুন ফেভার করবে। মেয়ে বলে কথা!
সারাদিন এত লোড নিতে পারে লিনি। জাবেদ বলেই বসলো, তোমার হৃদরোগ হবে। তখন তো তোমাকে ছুটতে হবে আমার মেয়ে ডা. ওয়াফার কাছে। মেয়েকে কার্ডিওলজিস্ট বানানোর স্বপ্ন। কথাটা কেড়ে নিয়ে লিনি বলে, এত সহজে হৃদরোগ হবে না আমার। আমি সবসময় ফিট থাকি মেনটালি এবং ফিজিক্যালি। মেলা স্ট্যামিনা আমার। আজ বøাড দিয়ে এসে রেস্ট না করেই হোস্টেলে জুনিয়রদের প্রবলেম সলভ করে আসলাম। তখন এক সিনিয়র আপুর ল্যাপটপ এর প্রবলেম দূর করলাম। এখন পড়ছি… ঘুম নাই। কাল এবং তার পরদিনও ঘুমাবো না। টানা পরিশ্রম। তবুও ইনশাআল্লাহ্ আই উইল বি ফিট। আমি হার্ডওয়ার্ক করতে পারি। আমার ওপর রাগ করে আজ একজন কাছের মানুষ না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই খুব কষ্টে আছি।
লিনির কথা জাবেদ প্রথম শুনেছিল স্ত্রী জিনাত শাহীন রিপার মুখ থেকে। স্বপ্ননীড় মহাবিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান পড়ান। বাংলাতেও কম যান না। কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক, সংগীত, নৃত্যে সেরা ছিলেন। ছিলেন সেরা অ্যাথলেট।
প্রিয় ছাত্রী লুসিয়াত মাহ্নাজ লিনির মাঝে নিজেকে খুঁজে পান। মেয়েটার একটা বড়ো গুণ মুহূর্তেই যুক্তি দিয়ে কথা বলতে পারা। শুধু তাই নয়, চমৎকার লেখার হাত- গল্প এমনকি কবিতাও। ছবিও আঁকে দারুন।
তখনই ইচ্ছে জাগে একদিন দেখা হলে ধন্যবাদ জানাবে। কলেজ ম্যাগাজিনে সম্পাদনা পর্ষদের সদস্য ছিল। এ জীবনে অনেক মেধাবীকে কাছ থেকে দেখেছে। মাঝে মাঝে ভাবে জাত প্রতিভা ছাড়া শুধুমাত্র পরিশ্রম করে হয়ত ভালো ফলাফল করা যায় কিন্তু অন্য সব গুণ অর্জন করাটা মোটেও সহজ কাজ নয়।
জাবেদের একাডেমিক ফলাফল কোনোকালেই ভালো ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ত তখন অধ্যাপক নজরুল বেশ গর্ব করেই বলতেন, ‘ইউ আর লাস্ট ইন…, বাট অল সাইডস্ আই নো ইউ আর দা ফার্স্ট এন্ড দেয়ার ইজ নো কমপিটেটর টু ফাইট এগেইনস্ট ইউ।’
অন্যের সেলফোন নাড়াচাড়া করা মোটেও সমীচীন নয় জেনেও রিপার ফোনটি প্রায়ই নাড়াচাড়া করে জাবেদ। ভাবতে অবাক লাগে আধুনিক নারী হয়েও এসএমসএম করাটা শিখলো না।
এসএমএস এলে প্রতিউত্তর দেয়া তো দূরের কথা একটাবার ইনবক্সটা খুলে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। পুত্র ওয়াসির সেলফোনের রিংগার টোন না শুনলে খেতে বসা এমনকি ঘুমও আসে না।
একদিন রিপার সেলফোনের মেসেজ ইনবক্সে দেখলো লিনিরই পাঠানো ঈদ এসএমএস। বলা যায় সেদিনই নাম্বারটি নিজের সেলফোনে সেভ করে নেয়। সুযোগ পেলে একদিন কথা বলবেই। এমন উছিলাই খুঁজছিল। শেষ পর্যন্ত সফল হলো জাবেদ ইমরান।
ওয়াফার পৃথিবীতে আগমনই সেই পথটা খুলে দিল। রিপার দ্বিতীয় সন্তান আসবার আগে থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল রক্তের প্রয়োজন হবে। রক্ত দিতে প্রস্তুত ছিল রিপার ঘনিষ্ঠ অনেকেই। তারপরও রূপপুরে একজনের প্রস্তুত থাকাটা জরুরি মনে করলো জাবেদ।
ওয়াফার পৃথিবীতে আসার ঠিক ৭ দিন আগে লিনিকে ফোন করা হলে কিছুতেই রিসিভ করছিল না। পরদিনও একই অবস্থা। কিছুক্ষণ পর লিনিই ফোনে কলব্যাক করে। যখন বলে আমি জাবেদ ইমরান…। তখন স্যার বলবে না আঙ্কেল বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না।
জাবেদ জানায়, গতকালও ফোন করেছিলাম আপনাকে। স্যার, একটু ঘুমিয়েছিলাম।
কথা শেষ হবার পরপরই জাবেদ এসএমএস পাঠায় লিনিকে।
জবাবÑ ম্যাডামকে অনেক বেশি সম্মান করি কারণ আমার লাইফ-এ দেখা অন্যরকম একজন টিচার যিনি মায়ের মতো উপদেশ দিতেন আর কেয়ার নিতেন… স্পেশালি উনি আমাকে যতটা কেয়ার করেছেন সারাজীবন ট্রাই করেও তা শোধ করা যাবে না… কোনো টেনশন করবেন না। বøাড ব্যাংকে কথা বলে রেখেছি। কোনো প্রবলেম হবে না ইনশাআল্লাহ্… আর ধন্যবাদ সব শুভেচ্ছার জন্য। আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন কারণ আমি আপনার অনেক ছোটো। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। নিয়মিত যোগাযোগ থাকলে আমারও অনেক ভালো লাগবে।
জাবেদ মনে মনে ভাবছে ওয়াফা যেন আরেকটা লিনি হয়েই পৃথিবীতে আসে।
লিনির গার্ডিয়ান হতে ইচ্ছে হয়। গার্ডিয়ান হিসেবে জাবেদকে পেলে তারও নাকি ভালো লাগবে। ছোটোবেলা থেকেই মেয়েটা পড়াশোনা করে খুবই কম। আর মেডিকেল লাইফে প্রচুর পড়াশোনা। খুব কষ্ট হয় তার। ফেল করে না কখনও তবে রেজাল্ট চমৎকার হয় না। এ নিয়ে কোনো আফসোস নেই। লিনি ভালো করেই জানে পেশাটা পুরোপুরি হাতযশের ওপর।
জাবেদকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে অনুরোধ করে একসেপ্ট করবার জন্য। জাবেদ কিছু গিফট পাঠায়। লিনি বলে, এত কিছু পাঠালে নাকি ঋণী হয়ে থাকবে। এমনিতেই ম্যাডামের কাছে তার অনেক ঋণ। জানে না কিভাবে শোধ করবে বা আদৌ শোধ করার সামর্থ্য হবে কিনা।
দুপুরে ক্লাস শেষ করে কুরিয়ার রিসিভ করে। প্যাকেট খুলে আনন্দে উৎফুল্ল লিনি। এসএমএস করেÑ দারুণ দারুন সব জিনিস। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ। বইগুলো খুব ভালো হয়েছে কিন্তু পড়ছি না পরীক্ষা চলছে বলে। ওয়াফা ভালোই থাকবে আশা করি। ম্যাডাম একজন কেয়ারিং মা।
ঘড়িতে রাত পৌনে একটা। ঘুম আসে না, ঘুম আসে না। ঘুম বড়ো স্বার্থপর।
লিনি ঘুমোবে ঠিক করেছে। প্রতিদিন ভরাসন্ধ্যায় মেয়েটির ঘুমানোর বাজে একটা অভ্যাস গড়ে উঠেছে। ঘুম থেকে উঠে আবার পড়তে বসবে। আড্ডার আগে ডাইনিং-এ দলবেঁধে খেতে যাবে। ওদের হোস্টেলের খাবারের মান একবারেই খারাপ। তবু কষ্ট করে রোজ গিলতে হয়। রাত একটু বাড়লে বান্ধবীদের সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেবে।
মাঝখানে যোগাযোগ নেই কয়েক ঘণ্টা। ফেসবুকে বসেছে জাবেদ। এসএমএস পাঠায়Ñ হারিয়ে গেলে নাকি ডা. লিনি। জবাব আসে, হারিয়ে যাই নি স্যার। ঘুমিয়েছিলাম। মোটামুটি ভালোই অসুস্থ হয়ে পড়েছি। গ্রæপ স্টাডি করছি। এখন ফেসবুকে আসতে পারবো না। একটু পর আসি। যদি থাকেন তখন কথা হবে। আমি সবসময় মোবাইলের কাছে থাকি। যখন তখন এসএমএস দিতে আমার প্রবলেম হয় না।
কাল রাতটা জঘন্য গেছে লিনির। দিনটা বাজেভাবেই শুরু হয়েছে। প্রচুর জ্বর নিয়েই কলেজে যাচ্ছে।
দুদিন পর পরীক্ষা। ওর অবস্থা অনেকটা এই রকমই। অনেক কিছু করতে চায়। কিন্তু আসলে করা হয় না কিছুই।
বায়োক্যামিস্ট্রি ক্লাসটা ভীষণ বোরিং লাগে। ক্লাসটা করবে না লিনি। রুমে গিয়ে গোসল সেরে হয় লম্বা ঘুম দেবে, নয়তো পড়াশোনা করবে। অসুখের মাত্রাটাও বেড়ে চলছে… ইচ্ছে করছে বাবা-মার কাছে গিয়ে দুদিন থেকে আসবে। কিন্তু মেডিকেল লাইফটাতো বোধহয় এমনই। অনুভূতিগুলো বিসর্জন দিয়ে মনকে পাথর করে দিনের পর দিন থাকতে হয় মেডিকেলের রোগ-শোকে ভোগা ক্যাম্পাসে।
একবার জাবেদদের বাসায় রিপা ওদের নিয়ে গিয়েছিল যখন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। লিনিকে জাবেদ বলে, তুমিতো ইংরেজিতে স্ট্রং। ও বলে, বাংলাতে ভালো।
ইচ্ছে ছিল ম্যাডামের মতো লেকচারার হবে কিন্তু বাবা-মার ইচ্ছে মেয়ে নামকরা গাইনোকলজিস্ট হোক।
খুব বকবক করতে পারে বলে ফ্রেন্ড সার্কেলে ওর নাম চেন্নাই এক্সপ্রেস। দ্রæত বেশি লজিক দিয়ে কথা নাকি বলতে পারে।
ওয়াফাকে নিয়েও স্বপ্ন মেয়েটি যদি লিনির মতো মেডিকেল স্টুডেন্ট হতে পারতো। জাবেদ ভাবে এইভাবেÑ ২০৩৭ সাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৮৮তম ব্যাচের এমবিবিএস এর ফলাফল বেরিয়েছে।
জাবেদের সেলফোনটা বেজে উঠল।
বাবা আমি ডা. সানজানা ওয়াফা সম্প্রীতি বলছি। তোমার আম্মু।
লিনি এরকম এসএমএস পেয়ে জানায়Ñ হোয়াট অ্যান ইমাজিনেশন। অসাম। আপনাদের সন্তান দেখবেন অনেক ভাগ্যবতী হবে। বাবা-মার দোয়া কখনও বিফলে যায় না। বাবা-মার দোয়াই আল্লাহর দরবারে সবার আগে কবুল হয়। আর ছোটোবেলা থেকে কারো ভেতর এইম ঢুকিয়ে দিতে পারলে সেটা নিয়েই সে বড়ো হয়।
তুমি কি আমার ঘনঘন এসএমএস পাঠানোতে বিরক্ত হচ্ছো লিনিÑ না, মোটেই বিরক্ত হচ্ছি না। বরং বেশ ভালোই লাগছে।
লিনির মতো জাবেদের বোধকরি জ্বর আসবে। যদিও ডাক্তার হয় নি লিনি তবুও প্রেসক্রাইব করলোÑ একটা নাপা খেয়ে ঘুম দিন। সামনে একজন আসছে। এই সময় অসুস্থ থাকলে চলবে।
শুভ সকাল। অসুখের খবর কী? লিনি জানালোÑ আজ টিফিনের পর অ্যানাটমি তারপর ফিজিওলজি ক্লাস। সকালে নাস্তা খাওয়া হয় নি। রাতে বান্ধবীদের সঙ্গে পাশের রুমে ঘুমিয়েছিল। নিজের রুমে নক করতে গিয়ে দেখে সিনিয়র আপু ঘুমাচ্ছে। তাই আর বিরক্ত করে নি।
চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে জাবেদের তৃষ্ণার শেষ নেই। ভাবটা এমন করে থাকে যেন কিছুই জানে না। অনেক তথ্যসমৃদ্ধ বইপত্র সংগ্রহে আছে। সব যতœ করে রেখেছে মেয়ে ওয়াফার জন্য।
ওয়াফার জন্মের পর এ থেকে জেড পর্যন্ত বর্ণমালা মেডিকেল টার্ম দিয়ে কী হয় তা বানানো শুরু করে জাবেদ। এ তে অ্যাপ্রন, বি তে বøাড, সি তে চেস্ট, ডি তে ডক্টর, ই তে আই, এফ তে ফিভার, জি তে জার্ম, এইচ তে হার্ট, আই তে ইনজেকশন, জে তে জন্ডিস, কে তে কিডনি, এল তে লাং, এম তে মর্গ…।
খুব ইচ্ছে মেয়েকে মেডিকেল টার্ম দিয়েই ইংরেজি শিক্ষার হাতেখড়িটা দেবে। এ থেকে এম বর্ণমালা পর্যন্ত করতে পেরেছিল সেলফোনে যখন ওয়াফার মুখটা প্রথমবারের মতো দেখতে যাচ্ছিল। বাকিটা লিনি করে দেবে বলে কথাও দিয়েছিল। কথা রাখে নি…।
একটিবারই লিনির সঙ্গে জাবেদের দেখা হয়েছে। ওয়াফাকে যেদিন বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে সেদিন নার্সিং হোমে দেখতে আসবে বলেছিল। আর আসে নি।
এরপর ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় অনেকবার, কিন্তু লিনি আর কোনোদিন ফোন রিসিভ করে নি।
Leave a Reply