ফ্লাশব্যাক-৬ঃMr.Allen এবং আমি -৩
মো. শওকত আলী
স্যুভেনীর শপ থেকে টুকিটাকি আরো কিছু জিনিস কিনে London Eye এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই যেখানে সবাই একত্রিত হয়েছিলাম।। তারপর লন্ডন আই এ উঠে লন্ডন শহরের এরিয়াল ভিউ দেখেছি।
London Eye সম্পর্কে একটু বলি। এটি লন্ডন শহরে Thames নদীর দক্ষিণে Westminster Bridge এর মোটামুটি কাছে। এটি ২০০০ সালের গোড়ার দিকে উদ্বোধন করা হয়। তাই আমরা যখন ২০০১ এ সোটাতে উঠতে যাই তখনও লন্ডন শহরের সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিষয় ছিল এটি। চাকা আকৃতির বিনোদন রাইডটির টেকনিক্যাল নাম হচ্ছে Ferris Wheel. কয়েকটি ক্যাপসুল আকৃতির চেম্বার আছে এই Ferris Wheel এ। এক একটি ক্যাপসুলে দর্শকদের বসার ব্যবস্হা আছে।খুব ধীর গতিতে চক্রাকারে এটি ঘুরে। প্রায় ৪৪০ ফুট উঁচুতে উঠে লন্ডন শহরের এরিয়াল ভিউ দেখানো হয়। তখন পর্যন্ত লন্ডন শহরকে সবচেয়ে উঁচু স্থান থেকে দেখার সুযোগ ছিল একমাত্র এই লন্ডন আই থেকে। লন্ডন আই এর চেয়ে বেশি উচ্চতাসম্পন্ন এ ধরনের রাইড পৃথিবীর আর কোথাও ছিল না।
London Eye তে রাইড শেষ করে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় ডিনারের জন্য গেলাম। আয়োজক কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন ওখানে। ইংলিশরা সাধারণতঃ সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসের ডিনারটা রেস্তোরাঁয় বেশ আয়েশ করে সারে। সন্ধ্যা নাগাদ তারা রেস্তোরাঁয় যায়, দেড়-দু’ঘন্টা গলা ভিজিয়ে আড্ডা মারে, তারপর মূল ডিনার সারে। আমরা যারা হার্ড ড্রিংকসে অভ্যস্ত ছিলাম না তারা সফট ড্রিংকস আর এপিটাইজার নিয়ে প্রথম পর্ব সেরে মূল ডিনারে অংশ নিয়েছিলাম। তারপর রাত যখন কিছুটা বাড়ে তখন যে যার গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করি।
সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে দলবেঁধে গিয়ে যার যার মতো কিছু শপিং করি। শপিং সেরে দেখতে যাই বৃটিশ রাজপরিবারের ঐতিহ্যবাহী বাকিংহাম প্যালেস। এটি রাজপ্রাসাদে রুপান্তরিত হবার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। আদিতে এটি ছিল বাকিংহাম হাউস যেটি Queen Charlotte ব্যবহার করতেন। তিনি ছিলেন ৩য় জর্জ এর স্ত্রী এবং তাদের ১৫ জন সন্তানের মধ্যে ১৪ জনই এখানে জন্ম নেয়। রাজাকে যেহেতু রাজকার্য বিশেষ করে সেন্ট জেমস প্যালেসে দিনের অনেকটা সময় দিতে হতো তাই তিনি রানীর স্বচ্ছন্দের কথা ভেবে এ ভবনটি কিনে নেন ১৭৬১ সালে। এরপরে সংস্কার, সম্প্রসারণসহ নানারকম কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে এটিতে। এমনকি ১৮৩৪ সালে অাগুনে পুড়ে যখন পার্লামেন্ট ভবনের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয় তখন রাজা ৪র্থ জর্জ এটিকে পার্লামেন্ট হাউস হিসেবে ব্যবহারের জন্যও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদিও পার্লামেন্ট সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি।
এরপর ১৮৩৭ সাল থেকে বাকিংহাম হাউস রাজপ্রাসাদ হিসেবে বাকিংহাম প্যালেস নাম ধারন করে এবং তখন থেকে রাজতন্ত্রের প্রশাসনিক সদরদপ্তরসহ রাজা বা রানীর উপস্থিতিতে নানান অনুষ্ঠান,অভ্যর্থনা এখানে অনুষ্ঠিত হয়।
বাকিংহাম প্যালেসে কক্ষের সংখ্যা ৭৭৫টি। রাজপরিবারের ব্যবহার,রাষ্ট্রীয় অাচারসহ কর্মরত রাজকর্মচারীরা কক্ষগুলো ব্যবহার করে। প্রতি গ্রীষ্মে রাষ্ট্রীয় আচারে ব্যবহৃত কক্ষগুলো দেখতে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বাকিহাম প্যালেস এর পাহারায় নিযুক্ত রাজসান্ত্রীদের পোশাক, দাঁড়ানোর ভংগিমা এবং পাহারা বদলের সময় তাদের প্যারেড রাজপ্রাসাদ দর্শনে আগত দর্শকদের জন্য একটা বিশেষ আগ্রহের বিষয়।
পরের সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে অফিসিয়াল প্রোগ্রামে গেলাম Warwickshire এর একটা অফিসে। লন্ডন শহর থেকে ঘন্টা দুয়েকের যাত্রা ছিল । সেখানে Mr.Allen আমাদের সংগে যোগ দিলেন। দিনটা বেড়ানোের জন্য উপযুক্ত ছিল না। অক্টোবর মাসে ইংল্যান্ডের আবহাওয়া মাঝে মাঝেই বৈরী আচরণ করে বলে শুনেছিলাম।সেদিনও থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল, সাথে বাতাস ছিল। প্রোগ্রাম থেকে যখন ছাড়া পেলাম তখন ভারী বর্ষনের সংগে বাতাস ছিল। মনটা খারাপ হয়ে গেল।ততক্ষণে শেক্সপিয়ারের সমাধিসৌধ্য দেখতে যাবার সূচি বাতিল করা হয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের তো বটেই বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা একজন সাহিত্যিক যার নাম ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি। যার ম্যাকবেথ নাটকের ট্রাজিক হিরো প্রিন্স হ্যামলেটের ‘To be or not to be : that is the Question ‘ সগোক্তি কতবার প্রসাংগিক আর অপ্রসাংগিকভাবে ব্যবহার করেছি। এতো কাছে এসেও তার সমাধিস্হল দেখতে যেতে পারলাম না। শেক্সপিয়ার এর জন্মভূমি ছিল এই Warwickshire এবং তাঁর সমাধিও হয়েছে এখানে। এ কারনে জায়গাটিতে পর্যটকদের আনাগোনা অনেক বেশি থাকে ।
বৃষ্টির ঝাপটা কিছুটা কমে এলে আশেপাশেই ঘোরাঘুরি শুরু করলাম । একটু দূরে রাস্তার উল্টোদিকে একটা পুরানো আমলের গ্রাম্য হাট চোখে পড়লো।কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম আমাদের দেশে গত শতকের শেষদিক পর্যন্ত গ্রাম্যহাটগুলোর আদল যেমন ছিল তেমনই। তবে পরিপাটি করে সাজানো আর বনেদী ভাবটা কিছুটা বেশি। বেশির ভাগ দোকানপাটই ছিল চারপাশ খোলা চৌচালা ঘর।হাটবার ছিল না সেদিন। বন্ধ থাকলেও ইংল্যান্ডের একটা গ্রাম্য হাট দেখার খানিকটা অভিজ্ঞতা হলো।
এরপর বিশেষ অভিজ্ঞতা হলো এলেন সাহেবের দেয়া ডিনারে অংশ নেয়ার জন্য শত বছরের বেশি পুরানো রেস্তোরাঁয় গিয়ে। রেস্তোরাঁটি ছিল গ্রাম্য হাটটির কাছাকাছি। নামটা মনে করতে পারছি না, রেস্তোরাঁর ভবনটি ছিল আকারে ছোটখাটো এবং স্হাপত্য নকঁশা সেই পুরানো ধাঁচের। তবে পুরানো খানদানি ভাবটা ছিল চোখে পড়ার মতো। ভিতরে বসার আসন এবং টেবিল কাঠের আস্ত তক্তা দিয়ে বানানো। বসার আসনে আবার কাঠের উপরের বাকল প্রায় রয়েই গেছে। সবচেয়ে অবাক হয়েছি যা দেখে তা হলো পানি কিম্বা ড্রিকংস সবই নিতে হয়েছে পুরানো আমলের পিতলের ট্যাপকল ঘুড়িয়ে।
প্রত্যেককেই নিজ নিজ পছন্দে খাবার অর্ডার দিয়ে বসেছি। এমন সময় Mr.Allen এসে আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি অর্ডার করেছি? জেনে বললেন,নামটা সুন্দর তবে তুমি ওটা খেতে পারবে না। আমি বরং তোমার জন্য অন্যকিছু অর্ডার করি আর তোমারটা আমি নিবো। আমি তো কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম হালাল-হারামজনিত কোন সমস্যা আছে কিনা অর্ডারে? উনি বললেন, হালাল খাবার তবে তুমি অপেক্ষা কর। একটু পরে যখন খাবার সার্ভ করা হলো তখন দেখি কতগুলি শাকপাতা আর সবজি আমার প্লেটে। শাকপাতাগুলো কাঁচা আর চিকণ করে কাটা। আমি কিছু বলার আগেই Mr.Allen আমার প্লেটটা নিয়ে তার প্লেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,আমি তো তোমাদের খাদ্যাভ্যেস জানি। আরও একবার তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম আমি।
Leave a Reply