বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ০৯:৫৮ অপরাহ্ন

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাহিত্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ কবি ও সমালোচক অভীককুমার দে’র ধারাবাহিক ভাববার বিষয়-পর্ব-২: আত্মজাল-অভীককুমার দে

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাহিত্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ কবি ও সমালোচক অভীককুমার দে’র ধারাবাহিক ভাববার বিষয়-পর্ব-২: আত্মজাল-অভীককুমার দে

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাহিত্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ কবি ও সমালোচক অভীককুমার দে’র ধারাবাহিক
ভাববার বিষয়-পর্ব-২
আত্মজাল
অভীককুমার দে

১.
বহু বছরের প্রচেষ্টাকে অভ্যেস বানিয়ে নিয়েছি কখন ঠিক মনে পড়ে না। জীবনের বিশেষ সময়টুকু কেটেই যাচ্ছিল খাতায়- কলমে আর অভীক নামের যে অস্তিত্বটুকু আমি অনুভব করছি তাকে নিয়েই। মনের কোথাও একটা সুড়সুড়ি বারংবার, আমাকে টেনেই যাচ্ছিল কোন অপরিচিত চেতনায়। খেয়ালই করিনি আমার সব ক’টা জানলায় সূর্যের উঁকি মেরে চলে যাওয়া ! দিনরাত একটাই কাজ— শুধু লেখা। কোনদিন নিজেকে প্রশ্ন করার সময়টাকেও ডেকে দেখিনি।
তখন ক্লাস নাইন, একদিন প্রথম কোন প্রিয় শিক্ষকের পড়ানোর সময় আমি ‘নকশি কাঁথার মাঠ’- এ হারিয়ে যাই। কি জানি এক মায়ার চাদরে জড়িয়ে যাচ্ছিলাম, হারিয়ে যাচ্ছিলাম আরও আরও গভীরে, অন্তরের ওখানে। আজকাল সেটুকুই আমার বাসস্থান। যদিও বা আমার সেই প্রিয় শিক্ষক গোপাল মল্লিক আজ আর নেই। এই ব্রহ্মাণ্ডের বেড়াজালে কোথাও যদি উনার রূপ অথবা বহুরূপ থাকে আমার প্রাণের পুস্প পায়ে রাখি। খেলাপড়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে বেঁচে যাওয়া সময়ের হাতে আমার হাত ধরাই ছিল, ধরাই ছিল কলমে এবং গোপনীয়তায়।
তখন আমার পড়াশোনার কাজটা গুছিয়ে নিয়েছি শেষবারের মত। তারপর বহুদিন, অনেক বছর, আমি একা হয়ে গেছি। টুকিটাকি কাজ এসে মাঝপথে মৌনতা ভাঙে, শুধু লেখাটুকুই প্রেমিকার মত ছিল। কাছে থাকে, ভালোবাসে, কথা বলাবলি প্রাণের ওখানে। আমার চলনের মাপ দেখেনি পথ। একা হাঁটি।
বন্ধু শ্যামল সরকার। যদিও আমার অন্তরের খুব কাছে তার বসতবাড়ি, তবুও টের পাইনি কখন সে টের পেয়ে গেছে ! একদিন লেখালেখির মাতামাতিতেই মেতে উঠেছি দেখে চিনিয়ে দিল মুঠোফোনের আত্মজাল। তারপর এই আমি আর একা থাকি না। পরিযায়ী পাখির মতই এই আসে এই যায়, কেউ ডাকে, আমিও ডেকেই যাই।
একটা সময়ের সন্ধিক্ষণে প্রিয় কবি অপাংশু দেবনাথ হাত তুলে দেখাতে এলেন— ‘ঐ দেখো পথ’। কমল চালানো তাঁর আঙুল ছুঁয়েছি, তালে তাল মিলিয়ে পা বাড়িয়েছি পথে। সে পথেই আরেকটি প্রিয় নাম কবি ও স্রোত প্রকাশনার কর্ণধার গোবিন্দ ধর। হাতের মুঠোয় ধরে কাছে টেনে নিলেন। আদর দিলে, ভালোবাসা দিলেন। বছরগুলো একই নিয়মে ঘুরে ঘুরেই আসছিল, ধরা আছে হাত, হাত ধরে আছি।
খবর আসলো প্রচেষ্টা অথবা নেশার পাণ্ডুলিপি আমাকে দাও, আমার স্রোতে গা ভাসাক সেই সব অনুভূতি। ঠিক তখন আরেকটা স্রোত আমার ভেতরে জেগে উঠছিল উল্লাসে, কেঁপে উঠছিলাম ‘আমি’।
প্রকৃতিস্থ সবকিছুতেই একটা ছন্দ আছে, একটা সংযোগ আছে। গোবিন্দদা আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “আমি হবো নতুন পৃথিবী” প্রকাশ করলেন। একটা কবিতার নাম গ্রন্থের উপরে স্থান দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। আপ্লুত হলাম আর আন্তরিক লয় খুঁজছিলাম।
অনেকগুলো দিন কেটে গেছে স্রোতের নানান অনুষ্ঠানে। সব ক’টাতেই কাছে ডেকেছেন। এবার ‘আত্মগুঞ্জন’ প্রকাশে সঙ্গেই নিয়ে গেছেন কলকাতায়। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিন পালন করলো “স্রোত”। গিয়েই বুঝেছি আগেও এই দিন ঘটা করে পালন করেছে, সেদিনও করলো, ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও হৃদয়ে রেখেছে।
এই শুভ প্রচেষ্টায় কাছে থেকেছিলেন কবি মৃণাল বসু চৌধুরী, সন্দীপ দত্ত, বারিন ঘোষাল, অশোকানন্দ রায়বর্ধন, দেবব্রত দেবরায়, শ্যামল ভট্টাচার্য, তন্ময় বীর এবং আরও অনেক অনেক কবি- সাহিত্যিক- প্রাবন্ধিক, সঙ্গে আমরা। ‘স্রোতে’র এই প্রচেষ্টায় স্রোত বয়ে যাবে যুগের প্রেম- প্রেম বুকে।
২.
সেদিন উনত্রিশ জানুয়ারি। প্রিটোরীয়ায় ত্রিপুরাভবনের তিনশ দশ নম্বর রুমে রাত কাটানো মানুষগুলোর মনের আকাশে বইমেলা আর অনুষ্ঠানের মিষ্টি সুখ ঢেউ ছড়ালেও ভোরের আকাশে তেমন মুক্তির সাধ দেখা যায়নি। জানালার কাঁচের ওপার থেকে আকাশটা কেমন মেঘলা চোখে তাকিয়ে ছিল। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টিবিন্দু গড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছিল রঙিন দেয়াল আর গাছের শরীর পর্দায়। কি জানি কি অভিমান ছিল আকাশের ! সময়টা যেই প্রভাত পেরুবে আকাশকেও বদলাতে দেখা গেছে। মেঘ সব উড়ে যাচ্ছি অন্য কোন বুক ছোঁবে বলে, কেননা এ আকাশকে তখন বই বই গন্ধ আর মিলনমেলার খবর ছড়াতেই হয়।
একটু আগে থেকেই বলা যাক। শহরের গা থেকে রাতের নেশা কাটতে না কাটতে ছয়তলায় ঘুমিয়েই শুনতে পাচ্ছিলাম কাকেরা ডেকে ডেকে উড়ে যাচ্ছিল কোথাও খাবারের খোঁজে। গতরাতে দেরি করেই ফিরতে হয়েছিল ভবনে। তারপর সারাদিনের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত পর্যালোচনায় ঘুমপরি চোখে এসে নেমেছে অনেক রাতে। খুব ভোরে তাই বিছানা ছাড়তে কেমন ইচ্ছেই করছিল না। তবুও উঠতেই হয়।
অশোকদার খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে যাওয়া প্রতিদিনের একটা বিধিবদ্ধ নিয়ম। আজও কোন পরিবর্তন চোখে পড়েনি। বয়সটা অনেকদূর এগিয়ে গেছে বলে নিয়ম করে প্রতিদিনই হাঁটতে হয়। বেশ ফুড়ফুড়ে ও শান্ত স্বভাবের এই মানুষটা আরেকটা দারুণ খবর শুনিয়েছেন সকাল হতেই। গেছে ক’দিনের অনুষ্ঠান সম্পর্কিত একটা বিস্তারিত খবর নাকি ছেপেছে কলকাতার কোন দৈনিক পত্রিকা। ঐ কাগজটাও সংগ্রহ করে আনবেন শুনে বেশ ভালোই লাগলো। যাবার সময় সঞ্জীবদাকেও নিলেন সাথে।
না, আর ঘুমনো যায় না। সবাই মোটামুটি উঠেই গেছে। আমি আর সুমন সবার পরে উঠে একেবারে দিশাহারা হবার উপক্রম। সবাই তৈরী। গোবিন্দদা যাচ্ছিলেন কোন এক কাজে, হয়তো প্রকাশনা সংক্রান্ত। সঞ্জীবদা আর বিল্লালদা আজ খুব মস্তিতে দিন কাটাবে এমনটাই শুনতে পাচ্ছিলাম।
সবাই যখন মোটামুটি প্রস্তুত অশোকদা আর সঞ্জীবদা ততক্ষণে ফিরে এসেছে। সঞ্জীবদার হাতে ক’টা কাগজ। সবার গোছগাছ হয়েগেলে দরজায় তালা পড়লো। বেরিয়ে পড়লাম আমরা।
সকালের টিফিন সেরে যে যার দলে বেরিয়ে পড়েছে। আমি আর সুমন তখন অশোকদার দলে। বেশ মজা লাগছিল কারণ এমন একটা মানুষের সঙ্গে আজ দেখা হবে যিনি জীবনের ত্রিশটা বছর কাটিছেন ত্রিপুয়ায়। চাকুরীসূত্রে এসেছিলেন বহুবছর আগে। বিলোনীয়া কলেজে বাংলা বিষয়ের অধ্যাপক হিসেবেই নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। গত বছর এগারো আগে বিদায় নিলেন কর্ম জীবন থেকে। তারপর কলকাতায় ফিরে আসা। আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি ত্রিপুরায়।
ঠিকানাটা খুব ভালোভাবে বুঝে নিয়েছিলেন অশোকদা। পথে কোন অসুবিধা হবার কথা নয়, তাই নিশ্চিন্তই ছিলাম কিন্তু কিছুটা হেঁটে গিয়েও যখন জানা নম্বরের বাসগুলোর একটাও আসতে দেখা যায়নি, তখন এদিক- ওদিক তাকিয়ে একটা ট্যাক্সিই ডেকে নিতে হলো। ঠিকানা শুনে ড্রাইভারের জায়গা চিনে নিতে একটুও অসুবিধে হয়েছে বলে মনে হলো না।
রাস্তার দু’দিকে সারি সারি দালান বাড়ি। চারদিকের শব্দ কেমন মুখবুজে সহ্য করছিল নীরবে। সোজা রাস্তা ধরেই ছুটছিল ট্যাক্সি। আমার তেমনটা জানাশোনা নেই এই শহর। স্বভাবতই গাড়ির কাঁচের ওপারে যেতে চায় দৃষ্টি। ড্রাইভার মাঝেমধ্যে বলে যাচ্ছি টুকিটাকি, কানে আসছিল সেসব কথা।
একটু তন্দ্রাভাব চোখে আসলেও চোখ বন্ধ করার সুযোগ হয়নি। ড্রাইভার বললো— ‘এই দেখুন স্যার চলে এসেছি’। গাড়িভাড়া মিটিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন অশোকদা— পাল ম্যাডিকেল হল কোন দিকে ? উনার উত্তরে বুঝলাম রাস্তার উল্টো দিকে।
খুব উজ্জ্বল চেহারার একটা মানুষ ওপারে মুঠোফোন হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অশোকদা এগিয়ে গেলেন তাঁর কাছে। পায়ে হাত রেখেই বললেন— ‘স্যার আমি অশোক’। সহজেই বেঝে নিয়েছি এই মানুষটাই সেই মহানুভব। পর পর আমরাও প্রণাম করালাম। এক মুহূর্তে মাথায় যেই হাত রাখলেন একটা আদরের শিহরণ শরীরের শিরায় শিরায় ছুটছিল। যেই মানুষটার কথা এতক্ষণ বলছি উনি সবার পরিচিত সাহিত্য প্রেমিক অরূপরতন মুখোপাধ্যায়।
ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়ি। দরজা খুলে আমাদের নিয়ে গেলেন দোতলায়। সিঁড়ি বেয়ে যেই উপড়ে উঠলাম দরজা খুলে ভেতরে ডেকে নিলেন উনার বসার ঘরে। অবাক হয়ে দেখছিলাম ঘরের সব কিছু। এমন একজন মানুষ খুব, অথচ সাধারণ জীবনযাপন ! ঘরে তেমন কিছুই নেই। তিনটে রুম গায়ে গা লাগিয়ে আছে। বসার জায়গা বাদ দিলে একটা শোবার রুম, আরেকটায় রান্না। যেখানে বসার জায়গা ঠিক তার কাছেই একটা আলমারিতে কিছু বই পরিপাটি করেই রাখা আছে।
চা খেতে খেতে জমে উঠলো আড্ডা। পুরনো দিনের কথা, বর্তমান শিক্ষার ধরণ, সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা, টুকিটাকি আরও কত কথা। কলেজে পড়ানোর যে সময় তিনি স্মৃতি হিসেবে জমিয়ে রেখেছিলেন সেসব বলতে বলতে কখন দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল খেয়ালই করেননি। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতই দেখছিলাম আর শুনছিলাম। এক- দু’টো কথা রান্নাঘর থেকেও আসছিল। দু’জনের কথায় দারুণ তালমিল, একই রকম ঢেউ ছড়িয়ে স্মৃতিতেই ভেসে যাচ্ছিল তখন। হাসিখুশি এই মানুষটা হঠাৎ পুরনো কথায় ইতি টেনে বললেন— ‘এবার কবিতা শোনা যাক্’। আমরা সবাই কবিতা শোনাবো বলে ব্যস্ত। মন দিয়ে শুনলেন সব ক’টা কবিতা। তারপর খুব সহজ ভাষায় বলে গেলেন কবিতার দিকমান, গতি আর ভবিষ্যত।
খাওয়া শেষ যখন হলো তখন প্রায় ক্লান্ত দুপুর। জানলার উল্টোদিক থেকে হেলে যাওয়া সূর্যের রশ্মী এসে পড়ছিল মেঝেতে। আমরা বিছানায় বসে কথার কথায় ঢুবেই যাচ্ছি। সুমন হঠাৎ বলে উঠলো এবার যেতে হয় স্যার। এ’কথা শুনে উজ্জ্বল মুখে ভেসে উঠলো কেমন বেদনার ছায়া প্রলেপ। নরম সুরে বললেন— ‘একটু বসো, বাপ্পা এসেই পড়বে একক্ষণ’।
বাপ্পা উনার ছেলে। সেও অনেক বছর ত্রিপুরায় কাটিয়েছে। মনের ঘরে এখনও ত্রিপুরার ছায়াচিত্র নিয়ে বেড়ায়। এখন সে রেল দপ্তরের কর্মী।অনেক বড় হয়ে গেছে।
কিছুটা সময় পেরিয়ে গেলে দরজায় আওয়াজ হলো। বাপ্পা এসেছে। হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়াল। আবার অনেক দূর স্মৃতি ঘুরে আমরা বিদায়বেলায়। ছেড়ে যেতে হবে ভেবেই মন কেমন কেঁদে উঠলো। দূরত্বের বাঁধা টপকে একটা দিন মনের পৃথিবী আবার সেজে উঠেছে আত্মীয়তায়, আদরে, সাহিত্যে। যাবার বেলায় সবাই সঙ্গে এসেছিল, উঠিয়ে দিয়েছিল গাড়িতে।
গাড়িটা যেই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, সন্ধ্যার কালো ছায়া নেমে এসেছে স্বপ্নময় রাস্তায় আর পেছন থেকে দেখছিল ক’টা জলেভরা চোখ।
৩.
পিংলা থানা এলাকার পশ্চিম মেদিনীপুরে বসবাস করেন গুরা চিত্রকার। অভাবের সংসার। তাই লেখাপড়া বেশীদূর চালানোর সুযোগ ছিল না। বংশপরম্পরায় ছবি আঁকার কাজ সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে শিখতেই হতো বলে তিনি নিজেও বাদ পড়েননি। আকাশের ছায়াপথে যেমন তারারা ভিড় জমায়, ঠিক তেমন গুরার মনের আকাশ। বিচিত্র ভাবনা মনের আকাশে ডানা ঝাপটায়। অসংখ্য প্রভাত মনের দরজায় কড়া নাড়ে। ফুলের মতই ফুটতে থাকে ছবি।
এখন তিনি পেশাদার চিত্রকার। কথা বলতে বলতে ছবি আঁকলেও তুলিটা ভুল রাস্তায় পা রাখে না। শুধু কাগজে বা চামড়ার সামগ্রীতেই নয়, শাড়ি, জামা, গেঞ্জি’র মত বেশ দামী জিনিসেও নিখুঁত ছবি আঁকেন।
একটু বেঁটে গোছের হালকা- পাতলা এই মানুষটা রাস্তার পাশে অস্থায়ি একটা দোকান নিয়ে বসেছেন আজ মেলার শেষ প্রান্তে। বেশ দামী কিছু শাড়ি যেমন ঝোলানো আছে দড়িতে, তেমনি গেঞ্জিও ছিল ক’টা। খুব সুন্দর সুন্দর নক্সা গ্রাহকের দৃষ্টিপথ ধরে মনের ঘরে সিঁড়ি বেয়ে রেখে আসে দৃশ্যসুখ আর ছবিছাপ।
একটু আগে থেকেই বলা যাক।খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েই দেখছিলাম। মেলার চারপাশ ঘুরে যখন পেছন দিকে এলাম চোখে পড়লো নক্সায় ভরা দোকান নামের এই শিল্পালয়গুলো। অনেকক্ষণ হাঁটছি বলে পা দু’টো খুব টন্ টন্ করছে ব্যথায়। দু’পা এগিয়ে একটা দোকানে একটু বসার অনুমতি পেতাম। পাশে দাঁড়িয়ে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ গ্রাহক ডাকছেন, মাঝে একজন মহিলা বসে বসে কাপড়ে নক্সা করছেন। চুপচাপ বসে দেখছি কাপড়ে তুলির কথা বলা। খুব সহজেই যেন এক একটা তুলির টান থেকে কতগুলো নিঃশব্দ ভাষা বেরিয়ে আসে। ইচ্ছে হচ্ছিল ঐ ভাসায় আমাকে সাজিয়ে নিই। কিছুক্ষণ পর তুলির টান না থামিয়েই ঐ মহিলা জিজ্ঞেস করলেন— ‘কি দাদা, সুন্দর হচ্ছে ?’ বলার মত কোন ভাষাই বেরুচ্ছিল না আমার। অবলীলায় যে কাজ তিনি করে যাচ্ছেন, তার মূল্য বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। আমার অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে- ‘অসাধারণ’।
হাসি হাসি মুখে আবার প্রশ্ন ‘কিছু নেবেন না ?’
জবাবে মিথ্যে বলতে সাহস হলো না, বললাম-একটা কিছু নেওয়ার খুব ইচ্ছে কিন্তু পকেটে খুব অল্প টাকা, কি করবো ভাবছি। আমার জবাব শুনে ফিরিয়ে কিছু বলেননি। তুলিটা তখনও কাপড়ের বুকে রঙ রেখেই চলছিল।
একপাশে দাঁড়িয়ে যে মানুষটা গ্রাহক ডাকছিলেন তিনি কিছুটা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। বললেন— ‘দাদা, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি এখানকার নন। আমাদের স্থানীয় মানুষের কথা বলার যে কায়দা আপনার নিজস্বতা থেকে অনেকাংশেই ভিন্ন।’ ঠিকই বলছে মানুষটা। সহজ হতে চেয়ে হাসি মুখে সম্মতি জানিয়েছি আমিও। তারপর অনেক্ষণ কথা হলো, এখন অনেকটাই পরিচিত একে অন্যের। মাঝেমধ্যে এক- দু’জন গ্রাহক আসছিল এদিকটায়। সান্ধ্যরঙ গাঢ় হতে হতে মেলায় রাতের নেশা। চারদিকে রঙ- বেরঙের বাতির মিষ্টি আলোয় চেয়ে থাকা। ভিড় বাড়ছে। আমাদের কথা বলা তখনও শেষ হয়নি। গুরা চিত্রকারের একটা হাত আমার হাতে কখন ধরা হয়েছে খেয়ালই নেই।
দোকানের সামনের দিকটায় দেওয়াল সাজানোর ছোটবড় নানারকম সামগ্রীর মাঝে বসে থাকা মহিলা গুরা চিত্রকারের স্ত্রী। গরীবঘরের সব কষ্টবেলা দেখা হয়ে গেছে এ’পর্যন্ত। সে বেলায় বাবার তুলি চালানো দেখেই আঁকার আগ্রহ জন্মেছিল। বাবার হাজার মানা এতটুকু ইচ্ছে কমেনি তখন। খুব সহজেই রপ্ত করেছে ভাববিন্যাস। যে কাজ শখের ছিল সময়ের রাস্তায় এখন খিদে মেটায়। ছেলেদেরও শিখিয়েছেন। সামনে লাইন করে সাজিয়ে রাখা এগুলো সবই গুরা চিত্রকারের ছেলের হাতে আঁকা। দুই ছেলে। বড় ছেলে মহেসিন চিত্রকার সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে, আর ছোট ছেলে সুমন চিত্রকার চতুর্থ শ্রেণীতে। বাবার কাজ অনেকটাই রপ্ত হয়েগেছে এ’বয়সে। তুলির আঁকা মাছগুলোকে কেমন জীবন্ত দেখাচ্ছে !
চিত্রকারদের সংসারে অভাবের অভাব না থাকলেও মোটামুটি দু’মুঠো খাবার জোটে এখন। যুগের বদলে মানুষের চাহিদার দৃষ্টিকোণও বদলাতে দেখা যায়। ঘর সাজানোর ইচ্ছে যত বেশী বাড়ছে গুরা চিত্রকারদের নক্সার চাহিদাও ততই বাড়ছে। আজকাল শিল্পের মর্যাদা দিতে জানে মানুষ। অথচ এই চিত্রকারদের একদিন এইদিন ছিল না। অভাবের প্রতিটি দিন ভিক্ষা করেই কেটেছে তখন। কালক্রমে শিক্ষার আলো পৌঁছালে রোজগারের রাস্তায় গা ভাসাতে আসে। এখন অন্য আলোতে প্রভাত হাসে। রঙিন মনে রঙ মিশে যায়। ওখানে মানুষেরা হৃদয়ের দরজা খুলে কিরণ রাখে। প্রতিটি চিত্রকারের জীবনযাত্রায় যদিও অভাব ছাড়েনা, তবুও সব ক’টা গুরা চিত্রকারের বাড়িই আধুনিকতার চিত্রাঙ্গন।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge