দেখার চেষ্টা চক্ষু খুলিয়া : ৪
মো. শওকত আলী
মহেশখালীর নাম শুনেছিলাম তরুণ বয়সে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক গানের তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী শেফালী ঘোষের একটা গানে “যদি সুন্দর এক্কান মুখ পাইতাম মইশহালির পানর খিলি তারে বানাই হাবাইতাম” (ভুল হবার সম্ভবনা প্রবল।ভুল হলে ক্ষমা করে দিবেন।তবে ভুল সংশোধনযোগ্য)।এর পরে চাকরির সুবাদে চট্টগ্রাম শহরে কিছুদিন ছিলাম।চট্টগ্রাম শহরের লাভ লেইনের খিলি পান খুব বিখ্যাত। এর রহস্য ভেদ করে জানতে পারি মহেশখালীর আসল পান দিয়ে তৈরি করা হয় এ খিলি পান।মহেশখালী আমার কাছে তখন পর্যন্ত পান,শুটকি, লবণ তৈরির জায়গা এসব কারনেই পরিচিত।তাই কখনও সেখানে যাবার তেমন কোন তাগিদ অনুভব করিনি।তার উপর আবার সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে মহেশখালী যেতে। এটি জেনে কক্সবাজার থেকে যাবার জন্য বারকয়েক মনস্থ করেও ক্ষান্ত দিয়েছি। তবে এবারে গত ফেব্রুয়ারী’২০ মাসের প্রথম সপ্তাহে দাপ্তরিক একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের আনুষ্ঠানিকতা সারার জন্য যখন কক্সবাজারে আমি তখন প্রশিক্ষণার্থী সহকর্মীরা অনুমতি চাইলেন মহেশখালী যাবার জন্য। নানা রকম শর্ত আরোপ করে অনুমতি দিলাম। পাশাপাশি মনে হলো এবারে ওদের সমভিব্যাহারী হলে ক্ষতি কী? যদিও জানি সমুদ্রের অকুল পাথারে তাদের শারীরিক শক্তি কোন কাজেই আসবে না তবে মানসিক শক্তি কিছুটা জোগাবে বটে। তাই যেমন চিন্তা তেমন কাজ। কক্সবাজার থেকে নিদিষ্ট ঘাটে জনপ্রতি পাঁচ টাকা দিয়ে টার্মিনালে প্রবেশ করলাম আমরা।সময় বাঁচানোর জন্য তিনটি স্পীডবোট ভাড়া করে রওয়ানা হলাম মহেশখালীর দিকে।শুরুতে বুকটা ঢিপঢিপ করছিল।আমি উজানের মানুষ, সাতার জানি না মোটেও। প্রথম কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলাম। মাঝে মাঝে স্পীডবোট এমন ঝাঁকি দিচ্ছিল তখন কয়েক বছর আগের ঢাকা-ময়মনসিংহের ভাংগা রাস্তার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।একটু পরে ভাবলাম ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে থেকে চারদিক দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে লাভ কী? তারচে ‘ বরং সাহস সন্চয় করে মাথা উঠাই।শুধু মাথাই উঠালাম না মাঝে মাঝে দাঁড়িয়েও আশেপাশের অবস্থা দেখলাম, সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।’সৌন্দর্য ‘ শব্দটার মধ্যে একটা ভাব আছে। কা’কে যে কি সুন্দর লাগে তা’ বলে বোঝানো মুশকিল। কারো কাছে সমুদ্র বেশি সুন্দর তো আর একজনের কাছে পাহাড়। শরৎচন্দ্র তো অন্ধকারেও সমুদ্রের সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিলেন! প্রায় ৩০ মিনিটের এ সমুদ্র যাত্রাপথে যতই কাছাকাছি হচ্ছিলাম মহেশখালীর দিকে ততই সৌন্দর্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। ঘন সবুজের ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদ দ্বীপটিকে ঘিরে রেখেছে আপন করে। ঘাটে থেকে প্রায় এক কি.মি লম্বা একটা সেতু নতুন বাজারকে সংযোগ করেছে। ঘাটে পৌঁছে পায়ে হেটে সেটি পার হলাম।সেতুর দুপাশে গাছপালা,ঝোপঝাড় আর পিছনে সমুদ্র অপূর্ব সুন্দর একটা প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করেছে। শুনেছি অনেক সিনেমায় নাকি এ স্হানে নায়ক -নায়িকার রোমান্টিকতার নাচের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করা হয়। মহেশখালীর পান নিয়ে বলেছি।এবারে মহেশখালী নিয়ে কিছুটা বলি।এটি বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ। এটি একসময় মূল ভূখণ্ডেরই অংশ ছিল। জনশ্রুতি আছে ১৫৫৯ সালের প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের ফলে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ দ্বীপের সৃষ্টি। অনেকের ধারনা প্রায় দুশো বছর আগে বৌদ্ধ সেন মহেশ্বর এ দ্বীপটির নামকরণ করেন।আরও একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে এর নামকরণ নিয়ে যেটি আবার এখানকার আদিনাথ মন্দিরের সঙ্গে জড়িত। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী মহেশখালীর প্রভাবশালী জনৈক নুর মোহাম্মদ সিকদার স্বপ্নের অলৌকিক নির্দেশমতে জানতে পারেন যে স্বপ্নে তিনি যে শিলাখন্ড দেখেন সেটি আসলে হিন্দুদের ‘দেববিগ্রহ’। এ দেববিগ্রহের অনেকগুলো নামের মধ্যে ‘মহেশ’ ও ‘আদিনাথ’ নাম দুটো অন্যতম।দেববিগ্রহের নামানুসারে দ্বীপের নাম মহেশখালী আর মন্ডপের নাম ‘আদিনাথ মন্দির’ নামকরন করা হয়। আদিনাথ মন্দিরের কথা যেহেতু এলো তাহলে এ মন্দিরের কথা বলি। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দির মধ্যে আদিনাথ মন্দির প্রতিষ্টিত হয় বলে ধারনা করা হয়। তবে পৌরাণিক একটি বড় কাহিনী আছে এ মন্দিরকে ঘিরে।সংক্ষেপে হলো,রামায়ণের বর্ণনা অনুযায়ী ত্রেতাযুগে কৈলাস থেকে শিবরুপী ‘শিবলিঙ’রাবণের ঘাড়ে চেপে লংকার উদ্দেশ্যে যাত্রাপথের এই ‘মৈনাক’ পর্বতে অধিষ্ঠান হন।সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা মনে করে ছেলেমেয়ে পাওয়া কিম্বা প্রাপ্ত ছেলেমেয়ের দীর্ঘায়ুসহ মোক্ষলাভ এবং মানসকামনা পূরণের জন্য আদিনাথ দর্শন সর্বশ্রেষ্ঠ পূণ্য। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে এখানে আদিনাথ শিব চতুর্দশী মেলা হয়।সুপ্রাচীন মন্দির দর্শনের ইচ্ছায় দেশ থেকে তো বটেই ভারত,নেপাল, শ্রীলংকা, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন ঐ সময় মেলায় আসে। মৈনাক পাহাড়টি মহেশখালী চ্যানেল সংলগ্ন পশ্চিম পাশে নতুনবাজার থেকে সামান্য এগিয়ে অবস্হিত। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ২৮৮ফুট উচ্চতাসম্পন্ন। এরই প্রায় চূড়ায় আদিনাথ মন্দির অবস্থিত। এ মন্দিরটি ছাড়াও আরও উঁচুতে বৌদ্ধেদের একটি প্রাচীন প্যাগোডা রয়েছে। প্যাগোডাটি যখন দেখতে যাই তখন পাহাড় থেকে ডানদিকে নীচে তাকিয়ে অনেক পানের বরজ দেখতে পাই।আবার কিছুটা এগিয়ে বাঁ দিকে পাহাড়ের পাদদেশে নীচের দিকে তাকিয়ে ভংগ্নদশা অবস্হায় একটা বৌদ্ধবিহার দেখি। জানতে পারি যে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্হানী বাহিনীর নির্মম তান্ডবলীলার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এখনও ঐ বৌদ্ধবিহারে গলাকাটা কয়েকটি শ্বেতপাথরের বুদ্ধমূর্তি স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে। কিন্তু পরে নীচে নেমে সেটি দেখার মতে শক্তি ও সময় কোনটিই ছিল না আমাদের হাতে। যাকগে পাহাড়ি পথ ঠেলে আরও উপরে উঠে যে ছোট আকারের প্যাগোডাটি দেখলাম সেটির ইতিবৃত্ত কিছু জানতে পারলাম না।সেটিতে যে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যে হয় না তা’ বেশ বুঝা গেল। তবে মনে হয় তারপরও কেউ কেউ তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে দু-একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখে।ঠিক এমনি দেখেছিলাম মিসরের পিরামিড দেখতে গিয়ে। সেখানে একটি স্হাপনার ধ্বংসাবশেষ যা দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেটা এক সময় ধর্মীয় উপাসনালয় ছিল, সেটির একটা স্থান রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। অনেক পয়সা পড়ে থাকতে দেখি সেখানকার মেঝেতে। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে মানসকামনা পূরণ করার অভিপ্রায়ে মানত করে কেউ কেউ পয়সা রেখে যান সেখানে। সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাসমতে কয়েক হাজার বছর আগে আদিনাথ মন্দিরের গোড়াপত্তন হয় মৈনাক পাহাড়ে।আদিনাথ মন্দিরের কাছাকাছি একটি মসজিদ আর একটা প্যাগোডা থাকায় সাম্প্রদায়িক সহমতের প্রতীক হিসেবে দেখে এ অন্চলের মানুষ ঐ এলাকাটিকে।তাই ওখানে যে মেলাটি হয় সেখানে প্রতি রাতে গান,নাটক হয় যা সব ধর্মের মানুষ উপভোগ করে।এমনকি শিবের প্রভাবের কারনে হিন্দুদের প্রধানতম দূর্গাপূজাও সেরকম সারম্বড়ে উদযাপন করা হয় না ওখানে। মৈনাক পাহাড় থেকে নেমে অটোরিকশা করে দেখতে যাই স্বর্ণ মন্দির।এটি উপজেলা সদরের কাছাকাছি এবং মৈনাক পাহাড় থেকে প্রায় দু কি.মি দূরে।যাবার পথে লবণ তৈরির জমি দেখলাম পথের ধারে। স্বর্ণ মন্দিরটি আসলে একটা বৌদ্ধ বিহার।সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো। দারুণ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এ মন্দিরটির ইতিহাস বৃত্তান্ত কোথাও লিখা পেলাম না। জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে খুঁজেও পেলাম না।নতুনের পাশাপাশি টীনের ছাদের পুরাতন ভবন দেখলাম।দেখে মনে হল এটিও বেশ পুরাতন একটি ধর্মীয় উপাসনালয়। মহেশখালী দ্বীপটি মহেশখালী উপজেলার প্রধান দ্বীপ। মাতারবাড়ী,সোনাদিয়া নামে আরও দুটি দ্বীপ আছে এ উপজেলায়। মহেশখালীর পান ছাড়াও এ অঞ্চল লবন,মুক্তা চাষ আর শুঁটকির জন্য বিখ্যাত।
Leave a Reply