ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাহিত্যাঙ্গনের পরিচিত মুখ কবি ও সমালোচক অভীককুমার দে’র ধারাবাহিক
ভাববার বিষয়-পর্ব-১
ভ্রমণবৃত্ত
১.
উষসী’র ৩৬ বছর পূর্তি
সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, বিশ্বের কাছে পরিচিত করাবার জন্য, শিল্প- সাহিত্য- সংস্কৃতিকে বিকশিত করার জন্য সংঘবদ্ধ মানুষ যুগে যুগে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে; আজও চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। সংগ্রামময় জীবনের প্রতিটি দিনরাত থেকে সময় বাঁচিয়ে রাখে সংগ্রামের জন্যই। সে সংগ্রাম পরিচয়ের। পরিচয় কেবল আকৃতির গায়ে মার্জিত অবয়ব নয়, বরং আকৃতির ভেতর জীবিত প্রকৃতির অদৃশ্য অবয়ব, যা প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তি বা সমষ্টি সুন্দর করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। এমনই একটি সামাজিক সংগঠন ‘উষসী’ শিল্প, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন।
২০১৮ সালের ১৩ ই জানুয়ারি। আজ উষসী’র গৌরবময় ৩৬ বছর উদযাপন করবে উষসী পরিষদ, কুমিল্লা। সীমান্তের ওপার থেকে উষসীর ডাক এসেছিল বলে ভেতরের নদীতে ঢেউ উঠেছিল খুব।
আখাউড়া বর্ডার পেরিয়ে ওপারে যেতেই দেখি দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের পরিচিত একজন। কুমিল্লার অতি সাধারন মানুষ তিনি, অথচ কবিতার শব্দকে সুরে বেঁধে তরঙ্গ তুলতে পারেন মনে। তিনি আবু নাসের মানিক। আবৃত্তিকার মানিকদা। কবি গোবিন্দ ধর, কবি অপাংশু দেবনাথ, আবৃত্তিকার স্মিতা ভট্টাচার্য ও আমি তাঁর সাথে চলতে চলতে পুরোনো স্মৃতির উদ্যানে ফড়িং হয়ে উড়ছিলাম বারংবার।
আখাউড়া স্টেশন থেকে নানান কথার কথায় কথায় যখন কুমিল্লায় পৌঁছেছি তখন সন্ধ্যা বিদায়ের আয়োজন। উষসীর গায়ে উৎসবের যৌবন। সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে আলোড়িত হতে দেখেছি উষসীকে। দেখেছি উষসীও গাছ। সবুজ, সতেজ, ঘনিষ্ঠতার বিস্তার। এমন বিস্তার যাঁদের আয়োজিত কবি জহিরুল হক দুলাল, অধ্যাপক রতন ভৌমিক প্রণয়, অধ্যক্ষ মু. সফিকুর রহমান, কবি গাজী মো. ইউনুস, ফরিদ উদ্দিন সিদ্দিকী, ছড়াকার নাসির আহমেদ বাদল, অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান, হুমায়ুন কবীর, শাহজাহান শাজু, এ কিউ আশিক, রহিম খান, লুৎফুর রহমান, সাংবাদিক শাহ আলম শফি, কামরুজ্জামান চৌধুরী ফারুক, মজিবুল হক দুলাল, অধ্যক্ষ এমদাদুল হক পলাশ, সাংবাদিক মো. শহিদুল্লাহ, শোয়েব আহমেদ মজুমদার, মো. রামিজ খান সহ আরও অনেক।
উষসী তুমি আন্দোলিত হও ধারাবাহিকতায়।
২.
আগের দিন সকালবেলায় কোন এক দুর্ঘটনার পর অনেকগুলো ট্রেন ঠিকঠাক সময়সীমা ধরে রাখতে পারছিল না পরদিনও। সকালের টিফিন পর্ব সেরে খুব তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠেছি আমরা। কুমিল্লা থেকে আখাউড়া স্টেশনে যখন নামলাম তখন প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই। স্টেশন থেকেই আবৃত্তিকার স্মিতা ভট্টাচার্যের কাছ থেকে বিদায় নিতে হলো। তাঁকে বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সঙ্গে গেলেন আবৃত্তিকার আবু নাসের মানিক। মানিকদা সেই গতদিন থেকেই আমাদের সঙ্গে আছেন। কেমন যন্ত্রের মতো দ্বিধাহীনভাবে সহযোগিতা করে চলেছেন, অথচ অনেক আগেই বাড়ি থেকে ফোনে ভেসে আসে মেয়ের অসুস্থতার খবর। গোবিন্দ ধর, অপাংশু দেবনাথ ও আমি স্টেশনেই অপেক্ষায়।
ঢাকা যাওয়ার ট্রেন তখনও আসেনি। স্মিতা ভট্টাচার্যকে পৌঁছে দিয়ে আসার পর একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে স্টেশনের ভিআইপি প্রতীক্ষালয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর জানলাম তিনটা পনেরোতে ট্রেন আসবে।
চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম তিন নম্বর প্লাটফর্মে। চা শেষ হতে না হতেই কর্ণফুলী এসে থামলো। গতদিনের চাপ তখন ভিড়ভারে টের পাওয়া যাচ্ছিল। উঠে পড়লাম। চলতি ট্রেনে ঘন্টা চারেকের আড্ডার পর ট্রেন যখন এয়ারপোর্ট স্টেশনে থামালো তখন আবারও বিদায়ের পালা। এখানেই মানিকদাকে ছেড়ে যেতে হবে। সবার মুখেই ঘন ছায়ার প্রলেপ বসে যাচ্ছিল কেমন !
তখন থেকে আমার তিনজন। ঠাসা ভিড়ের গমগমিতেও তিনটি মানুষের নীরব চেয়ে থাকা কিছুক্ষণ পেছনে ফেলে আসা সময় ঘেঁটে বেড়িয়েছে। তারপর আবার সব সহজ। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ সব সহ্য করে নিতে পারে। যতই কষ্ট হোক, কষ্টের বাইরে কষ্ট সহ্যের প্রলেপ বুনে নিতে কিছুটা সময় লাগলেও একসময় ঠিক হয়েই যায়। আমাদেরও হয়েছে। জানি, তিনিও একই প্রচেষ্টায় ছিলেন। স্বাভাবিক তাঁকেও যে হতেই হয়, বিদায়ের পর মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছেও তো যেতে হবে।
ট্রেন ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছে গেছে। স্টেশন থেকে বেরোবার পথে দু’জন পুলিস কয়েকজন যাত্রীর সাথে হাতাহাতি করছিল। চারপাশে প্রচুর ভিড়। সবমিলিয়ে কেমন অস্বস্তি লাগছিল। বইয়ের ব্যাগসহ স্বাভাবিকভাবে হাঁটতেও পারছিলাম না। এভাবেই কোনোরকমে স্টেশন থেকে বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। অপাংশুদা একটা সিএনজি (অটোরিক্সা) থামালে উঠে পড়লাম আমরা।
কবি ঝর্ণা মণি আগে থেকেই হোটেলে রূম ঠিক করে রেখেছিলেন। বেশি সময় লাগেনি খুঁজে বের করতে। জিনিসপত্র রেখে যখন নিচে এলাম ততক্ষণে কবি সাংবাদিক ঝর্ণা মণি ও সাংবাদিক সোহেল ভাই এসে গেছেন। অপাংশুদা ও গোবিন্দদার সঙ্গে পরিচয় থাকলেও আমার সাথে কোন পরিচয় ছিল না; তবুও একজন অপরিচিত মানুষকে কত সহজে আপন করে নেওয়া যায় তার প্রমাণ দিলেন উনারা। পরিচয় পর্বের পর রাতের খাওয়া হলো একসাথে। অনেক রাত হয়েছে, তাঁদের ছেড়ে যখন হোটেলে ঢুকলাম তখন রাত প্রায় একটা।
৩.
খুব রাত করে ঘুমোতে গেলেও পরদিন খুব সকালেই ঘুম ভাঙল। দশটায় এলিফ্যান্ট রোডে দেশপ্রসঙ্গ পত্রিকার সম্পাদক ইমদাদুল হক সূফী দাদার বাসায় যাবার কথা। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে হোটেল থেকে নেমে একটা সিএনজি অটোরিকশায় উঠে পড়লাম আমরা তিনজন। চলতে চলতে ভাবনায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। আজ সারাদিন খুব ব্যস্ততায় কাটবে। খুব বেশি সময় নিয়ে আসতে পারিনি কেউ। অল্প সময়ে সবার সাথে দেখা করা খুব মুশকিল, এমনকি সব অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকা ঠিকঠাক হয়ে ওঠে না। জানি, অনেক প্রিয় মানুষের সাথে দেখা করতে না পারায় কষ্ট পাবেন অনেকেই।
সূফীভাইয়ের সাথে দেখা করার পর অপাংশুদা ও আমি বেরিয়ে পড়লাম। দুজন লোক সূফীভাইকে নিয়ে যেতে এসেছে, গোবিন্দদাও ওদের সাথে যাবেন কোন এক মিটিংয়ে।
শহর তখনও এতটা উষ্ণ নয়। মিঠে রোদের আদর গায়ে মাখতে ভালোই লাগছিল। পাশাপাশি হাঁটছি আমি আর অপাংশুদা। যতক্ষণ না গোবিন্দদা আসছেন শহর ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে আমাদের।
‘চা খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই অপাংশুদা বললেন– ‘চলো, খাওয়া যাক’।
ফুটপাতের পাশে রেলিংয়ের ভেতর একটা চা দোকান। বাইরে দাঁড়িয়ে রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিচ্ছিল অনেকেই, আবার ভেতরেও ঢোকা যায়। খোলামেলা একটু জায়গা। একটা মাঝবয়সী কাঁঠাল গাছ ছায়া টেনে দিয়েছে। বসার তেমন কোন জায়গা নেই। দাঁড়িয়েই খেতে হয়। চা খেয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
কিছুদূর এগিয়ে উড়ালপুল বেয়ে রাস্তার বিপরীত দিক ধরে হাঁটছি। অচেনা রাস্তা, অচেনা মানুষের ভিড়ে নিজেকেও কেমন অচেনা মনে হচ্ছিল। মাঝারি গতির তালে তাল মেলাতে পারছিলাম না মোটেও। হাঁটছি আর দেখছি অচেনাকে। অচেনাকে চিনে নেবার সবকটি কৌশল সক্রিয় হচ্ছিল ভেতরে। হাঁটাপথের ডানদিকে আপনাআপনি ধরা দিল বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম আমরা।
কড়া নিরাপত্তায় বেশ নিরাপদ জাদুঘর ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ। এই দেশের সংস্কৃতির অতীত থেকে বর্তমান, শিক্ষায় শিলালিপি থেকে পরবর্তী পরিবর্তিত বর্ণের ধারাবাহিক রূপান্তরণ, পশু- পাখি, গাছগাছালি, জীবাশ্ম, পাথর আরো কত কি জীবনযাত্রার সামগ্রী। একবার তাড়াহুড়ো করে দেখে মন ভরে না। বেরিয়ে আসার পথে নৌকোর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারিনি। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উঠোনেই রাখা ছিল নদীমাতৃক এই দেশের নিজস্ব নৌকো।
৪.
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের কিছু ছায়া ছবি মনের তথ্য বাতায়নে মিশে যাচ্ছিল আর আমি অন্যমনস্ক হতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে মফস্বলের আমি এই ভিড়ভার শহরে অপরিচিত হয়ে যাচ্ছি আমার ভেতর। চলতে চলতে বরাবর পিছে পড়ে গেলে একটু এগিয়েই অপাংশুদাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। রাস্তার ডান পাশ ধরে হাঁটছি আর মাঝেমধ্যে অচেনা পথচারীকে জিজ্ঞেস করছি কোনদিকে ‘বাংলা একাডেমী’।
তখনও অনুষ্ঠান শুরু হতে অনেক দেরি। দুটো গেটের একটা বন্ধ, একটা খোলা। নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন আছে পথ দুটোতেই। আমাদের দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধেয় প্রণব মুখার্জি এসেছেন বাংলায়। উপস্থিত থাকবেন বাংলা একাডেমীতে। তাই প্রচুর নিরাপত্তাকর্মী ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাডেমীর চতুর্দিকে। একাডেমীর সামনের রাস্তায় সাধারণভাবে গাড়ি চলাচল বন্ধ। পথচলতি মানুষের ভেতর থেকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু ভেতরে যাবার সুযোগ নেই আমন্ত্রণপত্র ছাড়া। ভারত থেকে প্রায় শ’তিনেক লোক অনুষ্ঠানে যোগদান করেছে। আমন্ত্রিত আমরাও।
গোবিন্দদা তখনও মিটিং শেষ করে আসতে পারেননি। আমরা দুজন অপেক্ষায়। সারাক্ষণ হেঁটে একটু বসতে ইচ্ছে করছিল খুব। একাডেমীর উল্টো দিকে বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে হিন্দুদের শক্তির দেবী বসবাস করেন। এমন ভিড়ভারের বাইরে ওখানে অনেক শান্তিতে বসা যাবে। মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করে অবাক আমি। এখানে ভগবানের মিশ্র বসতি। কোন ভগবানের একার নয় এই মন্দির। ক্ষমতা ও উগ্রতার কারণে হয়তো প্রবেশদ্বারের নামকরণ কালি নিজের নামে করিয়ে নিয়েছে। যাইহোক তাতে আমার কিছু যায় আসে না, বরং আমি বা আমরা ওদের ভাগাভাগির অংশ হলে মানবযন্ত্র বেসামাল হয়ে উঠবে। মন্দিরের বাইরে বসার স্থায়ী জায়গা আছে। বসে খুব ভালোই লাগছে। শরীর কেমন সেঁটে যাচ্ছে আসনের সাথে। এমন অবস্থায় এই সামান্য আসনের কাছে হাজার সিংহাসনের মাথা নত হতে পারে।
মাথায় ঝুড়ি, হাতে চায়ের কেটলি নিয়ে আমাদের দিকেই আসছিলেন এক বয়স্কা। ঝুড়ি কেটলি নামিয়ে আমার বাঁ দিকে বসলেন। চা আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে বললেন– ‘আছে মামা’। শুধু আমাকে না, কিছুক্ষণের মধ্যে যারা এসেছে সবাইকে একই ভাবে বলছিলেন। আমি অবাক। এই বৃদ্ধা যেভাবে চতুর্দিকে মাতৃবংশীয় আত্মীয় তৈরি করছেন, তাদের মধ্যে অল্পকিছুও যদি স্বজন পেতেন, তবে এই বয়সে তাঁর চা, বিস্কুট, পান, সিগারেট বিক্রি করার কথা নয়।
আমাদের পেছনে যে পুকুরটি ছিল, সেটা মন্দিরের সম্পদ। পুণ্যার্থীরা ধুলোবালির সাথে আত্মার সবরকম মলিন পোষাক ধুয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন, যদিও এমন আত্মসমর্পণের পিছে মনের ভিন্ন রকম থিয়েটারি মঞ্চ থাকতে পারে; কেননা মন্দির ত্যাগের পর প্রায় সবার অবয়ব আবার বাইরের পরিবেশের সাথে অল্প সময়েই মিলে মিশে যেতে দেখেছি। বৃদ্ধা ঐ পুকুরে হাত পা ধুয়ে এসে কয়েকজনকে চা দিলেন। আমরাও নিলাম। চা দেওয়া শেষ করে ঝুড়িতে রাখা ভাত হাতে নিয়ে নিজে নিজেই বলছিলেন– ‘পুলিস মামারা দিছে। আল্লা তাগোর ভালা করব’।
৫.
বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠান প্রায় শেষ। হঠাৎ প্যান্টের ডান পকেটে রাখা মোবাইলের কম্পমান অবস্থা আমাকে জানান দিলো কেউ কথা বলতে চায়। ঠিক, গোবিন্দদার ফোন এসেছে। কল রিসিভ করে বুঝতে পারলাম উনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের পশ্চিম দিকে খালি জায়গায় আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমি আর অপাংশুদা হেঁটে রওনা হলাম সেদিকে।
সারাদিন তেমন কিছুই পেটে পড়েনি কারো। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে এসেছে। এ’সময় ভাত খাওয়া ঠিক হবে না। রাস্তার পাশে পিঠেওয়ালার দোকান থেকে গরম গরম ভাবের পিঠে খেয়ে পেটটাকে শান্ত করা গেলো।
বাংলাদেশ সময় অনুসারে ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা চল্লিশ। আমরা তিনজন পাশাপাশি হাঁটছি। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়লো এক ফল বিক্রেতা একটা ঠেলায় কিছু অপরিচিত ফল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার মুখে শুনতে পেলাম এগুলো কাঠবাদাম। এই নাম অনেক শুনেছি, আজ চোখে দেখলাম। খাওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি। বাইরের দিকটা দেখতে অনেকটাই আতাফলের মতো। ভেতরে বীজগুলো সারিবদ্ধভাবে খোসায় লেগে থাকে। একটা কাঠবাদাম ফলের দাম কুড়ি টাকা। খোলস কেটে বীজের চামড়া ছাড়িয়ে দিলেন বিক্রেতা। খেতে বেশ ভালো। বাড়িতে নিয়ে আসার ইচ্ছে থাকলেও ওজন বহনের ভয়ে আর কিনতে সাহস হয়নি কারো।
আজ ১৫ ই জানুয়ারি। সন্ধ্যা ছয়টায় পরিবাগ সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে বিশ্ব কবিমঞ্চ আয়োজিত বাংলাদেশ- ভারত কবিতা সন্ধ্যা। এই অনুষ্ঠানে কবি পুলককান্তি ধর কবিতা পাঠের জন্য আমাদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পরিবাগ রাস্তার মোড়ে একজন অপরিচিত লোক আমাদের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে পৌঁছে দিলেন।
দোতলার একটি রুম খুব সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো। ফুল দিয়ে বরণ করে নিলেন আমাদের। এই অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ার পাশাপাশি কবি ও দার্শনিক সৈয়দ আজিজ, মীর লিয়াকত, দিল আফরোজ আতিক, লিপি শেঠ, ফেরদৌসী মাহমুদ, তিথি আফরোজ, উম্মুল খায়ের, সৈয়দা সানজিদা শারমিন, শেখ আব্দুল হক চাষী, সরোবর নাসরিন সিমি, সরোবর সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক আকন আবু বকর ও আবৃত্তিকার সিক্ত রাণী সাহা’র সাথে পরিচিত হবার সুযোগ হয়েছে। মৌলভীবাজার থেকে এতদূর ছুটে এসে কবি পুলককান্তি ধর যে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা ভোলার নয়।
৬ .
পরিবাগের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্র থেকে যখন বড় রাস্তার মোড়ে এসেছি তখন প্রায় আটটা। শীতের সময়। তখন-ই মনে হচ্ছিল অনেক রাত হয়ে গেছে। সোডিয়াম লাইটের মায়াবী আলো ছুঁয়ে দেখছে রাস্তা। দ্রুতগতির গাড়ি সেই স্পর্শের গভীরতা বুঝে নেবার চেষ্টায় উপর নিচু করে যাচ্ছে লালচে আর সাদা আলো। সবই দেখছে এই মহানগরের পাথুরে শরীর। তীর্যক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বড় বড় দালানবাড়ির চোখ। সোডিয়াম লাইটের তাতে কিছু আসে যায় না। নরম আলোয় রাতভর কাছে থেকে ভালো বাসাবাসি। কোন ককটেল পার্টির ভেজা অনুভূতি নেই এমন স্পর্শে। শরীর অথবা অশরীরী সব মায়াময় আবরণ বেরঙ হয়ে যায় এমন আলোয়।
একটা মোটররিক্সায় চড়ে বসলাম আমরা তিনজন। আজকাল রিক্সাও আর আগের জমানার নয়। কোনো একসময় অনেক কষ্ট করতে হতো রিক্সা চালকদের। তখন আধুনিকতার ছোঁয়া ঐপর্যন্ত এসে পৌঁছোয়নি। আধপেট খাওয়া গরিব শরীর হাড়- মাংস ভাঙিয়ে উপার্জন করতো। এখন চালকের তেমন পরিশ্রম নেই। অধিকাংশ রিক্সাতেই মোটর।
দেশপ্রসঙ্গ পত্রিকা অফিসের কাছেই একটি প্রাইমারি স্কুলের সামনে রিক্সা থামালো। নেমে কয়েক কদম হেঁটে এলাম রাস্তার চৌমাথায়। এখানেই সুমন নামের একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অপেক্ষায়। তার পিছু পিছু একটি দালান ঘরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। পত্রিকা অফিস। সম্পাদক ইমদাদুল হক সুফি কাঁটাবনের এই ঘরেই দেশপ্রসঙ্গ পত্রিকার যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।
অপাংশুদা, গোবিন্দদা ও সুফিদা পরিমার্জিত আলোচনায় যখন মেতে উঠেছেন তখন আমি দেশপ্রসঙ্গের শেষ সংখ্যায় ডুব দিয়েছি। আড্ডায় চা- টিফিনের ব্যবস্থাও রেখেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা এসে গেছে।
কেউ একজন আমাদের সাথে দেখা করতে আসছেন, এখানেই; ফোনে অপাংশুদার কথা বলা থেকে বুঝতে পারছিলাম। অপাংশুদা ও সুফিদা নিচে গিয়ে উনাকে নিয়ে এলেন। মানুষটির নাম নবিরুল ইসলাম বুলবুল। সবার সাথে পরিচিতি বিনিময়ের পর আবেগের আলোচনায় সীমানা- কাঁটাতার- মুক্তিযুদ্ধ- রিফিউজি ক্যাম্প- মৈত্রী উদ্যান ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘড়িতে যখন প্রায় দশটা কাছাকাছি তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতেই হলো, কেননা তখনও কেউ আমাদের অপেক্ষায় পথ দেখছিলেন এবং আরও অনেককেই বসিয়ে রেখেছিলেন।
৭.
বুলবুলদা (নবিরুল ইসলাম বুলবুল) গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। ওনার গাড়িতেই রওনা হলাম। কাঁটাবনের রাস্তা পেরিয়ে ছুটন্ত গাড়ির দৃষ্টি রাতের শরীর ছুঁয়ে দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। শহুরে দিনের অলিগলিকে রাতে মায়াবী হতে দেখেছি, আর এই নগর আরও সাজগোজে কেড়ে নিতে চায় সব, যদিও আকাশে তখনও চাঁদ ছিল, কটা বাদুড় উঁচু দালানবাড়ির ছাদ পেরিয়ে চাঁদের আলো মেখে উড়ে যাচ্ছিল দূরে, বহুদূরে।
গাড়ি এসে থামলো ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকা অফিসের সামনে। বুলবুলদা এগিয়ে গিয়ে সিকিউরিটিকে জানালেন। সিকিউরিটির একজন খবর পৌঁছে দিলেন ভেতরে। একটু পরেই কবি ও সাংবাদিক ঝর্ণা মণি আর সাংবাদিক সোহেলভাই নিচে নেমে এলেন। ঝর্ণা মণির খুব প্রিয় মানুষের একজন বুলবুলদা। কাছের মানুষকে কাছে পেলে কাছাকাছি পরিবেশও কাছের হয়ে ওঠে। এমনই আনন্দঘন পরিবেশে যোগ দিলেন উত্তরভাবনা’র সম্পাদক ও সাংবাদিক সিদ্ধার্থশঙ্কর ধর। রাত বাড়ছিল, কারো সেদিকে নজর নেই। বুলবুলদা অফিসে ঢুকবেন না। বারকয়েক সবার সাথে করমর্দন করেও যাই যাই পা যেতে চায় না মন দেখেছি। হাসির আকাশে ধূমকেতুর শরীরচ্যুতি দেখেছি বুলবুলদার চলে যাবার সাথে সাথে।
অফিসে তখনও কয়েকজন কাজ করছেন। খুব সাজানো গোছানো সবকিছু। প্রথমে যে রুমে গিয়ে ঢুকলাম, সেখানে কাঠের তৈরি প্রচুর যুক্তআসবাব বা ফার্নিচার। পাশাপাশি ডেস্কে বসে অনেকজন একসাথে কাজ করার ব্যবস্থা রয়েছে। মনিদি (ঝর্ণা মণি) একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রত্যেকেই সাদরে গ্রহণ করে নিলেন। যদিও এটা কোন আবাসিক এলাকা নয়, কাজ আর পত্রিকার মতো দায়বদ্ধতার জায়গায় দাঁড়িয়ে সমাদরে আপন করে নিতে পারার এই মুহূর্ত কোন যান্ত্রিক জগতের হতে পারে না। পরিচয় ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের শেষে মিটিং হলে আমাদের বসতে দেওয়া হলো। অফিস ও সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত এমন অনেকেই এলেন। জমজমাট আড্ডার আসর বসেছে। ভাবতে অবাক লাগে, সারাদিন খবর সংক্রান্ত দৌড়ঝাপের পরও ক্লান্তিহীন মুখ। এমন মুখশ্রী শুধুই হৃদয়বানেরই হতে পারে।
ঘরবাড়ি, সংসার, পরিজন, পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি এসবের টুকরো আলোচনার পর কবিতা পাঠের আসর। বার্তা সম্পাদক এখতিয়ার উদ্দিন নিজেই অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। সহজ মানুষ। সাধারণ সাজপোশাক। গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ভারি গলা। যখন কথা বলছিলেন বন্ধ ঘরে কেমন শব্দের সার্কাস।
অপাংশুদাকে দিয়েই শুরু। ইতিমধ্যে চা এসে গেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে তাজা মন কবিতার শব্দকে জড়িয়ে অনুভবের অনুভূতিতে ক’টা মানুষ। তারপর শব্দের পর শব্দ। কবিতার পর কবিতা। উপস্থিত সবাই পড়েছেন। যিনি কবিতা লেখেন না তিনিও পড়েছেন অন্য কারো। কবিতাপাঠ শেষে সিদ্ধার্থশঙ্কর ধর সবার হাতে উত্তরভাবনা ম্যাগাজিনটি তুলে দিলেন।
রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। তারিখ বদলে গেলেও পত্রিকা অফিসের কাজ শেষ হয় না। চব্বিশ ঘণ্টা করেই ত্রিশ × বারো মানুষের কাছে, মানুষের খবর। সময়ের সঙ্গে সময়ের জন্য যে মানুষগুলো নিজের সময়কে অন্যের বা সমাজের জন্য কাজে লাগান এমন কিছু মানুষ এখতিয়ার উদ্দিন, মিল্টন মোল্লা, ঝর্ণা মণি, সোহেল রহমান, সিদ্ধার্থশঙ্কর ধর, বাবলু রহমান, শামসুজ্জামান শামস, খন্দকার কাউছার হোসেন। দুদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতির মেলবন্ধনকে আরও প্রাণের কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য কবি ঝর্ণা মণির এই আয়োজন শ্রেষ্ঠ আয়োজন।
৮.
ভোরের আলো কাঁচের জানলায় এসে উঁকি দিলেও মেঝেতে তখনও রাতের কালো চাদর জড়িয়ে ঘুম ঘুম নেশা। হোটেলের তিনতলার পশ্চিমের চারশ আট নম্বর রুম থেকে সূর্যের অবস্থান ততটা বোঝা যাচ্ছিল না। বিছানা ছেড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি আটটা বেজে গেছে। গোবিন্দদারও ঘুম ভেঙেছে। দরজা খোলার আগেই বাইরে থেকে কারো টোকা পড়লো। দরজা খুলে দেখি দুজন অপরিচিত মানুষ। হাসি মুখে ভেতরে প্রবেশ করলেন। রুমে আলাদা কোন চেয়ার ছিল না বলে অপাংশুদার বিছানায় বসতে দিলাম ওনাদের। অপাংশুদাও তড়িঘড়ি উঠে স্বাগত জানালেন। ততক্ষণে বুঝে গেছি একজন অপাংশুদার বন্ধু সাংবাদিক সামসুদ্দিন হীরা ও অন্যজন তাঁর সহকর্মী সাংবাদিক ওবায়েদ হক মারুফ। আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন। সকালের টিফিন আমাদের সঙ্গেই করবেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়েছেন।
সাধারণভাবে তৈরি হয়ে নিচে নেমে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম সবাই। যার যার পছন্দের খাবার চেয়ে নিলাম, অবশ্য বিলটা হীরাভাই পরিশোধ করলেন। চা পর্ব বাইরে কোথাও হবে বলে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। ডিলাক্স হোটেলের দিকে একটু পেছনে হেঁটে এলে একটা ছোট্ট গলি। কয়েক কদম পেরিয়ে রাস্তার পাশেই একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেছে। চা খেতে খেতে যা একটু কথা হলো। বেশ মজার মানুষ। সারাক্ষণ হাসি লেগেই আছে হীরাভাইয়ের। কথা বলতে বলতেই কখনো কখনো জড়িয়ে ধরছিলেন। যে কাউকে আপন করে নিতে পারেন সহজে।
খুব কাজের চাপ। সকালের ডিউটি। তার মধ্যেও প্রিয় মানুষের সাথে একটু দেখা করার জন্য সব ভুলে ছুটে আসতে পারেন হিরা ভাইয়ের মতো মানুষেরা। তেমন কিছু দেবার ছিল না কারো, তবুও কি যে পাবার আনন্দ চোখেমুখে লেগেই ছিল। কাপের চা যেই ফুরিয়ে গেছে সময়ও ছোট হয়ে এলো। আমরা একটা একটা বই-ই শুধু দিতে পেরেছি তাঁকে। তারপর কটা ছবির কাছে আকৃতি সঁপে দিয়ে ঢাকা শহরের ভিড়ে মিশে যেতে দেখেছি এমন প্রিয়জন।
অল্প সময়ের মধ্যেই অপরিচিত থেকে খুব চেনা হতে পারে কেউ, তার প্রমাণ রেখে গেছেন হীরাভাইরা। একটা মেঘলা ব্যথা বুকে উঁকি দিচ্ছিল। শীতের সকালেও কিছু উষ্ণ বাতাস বেরিয়ে আসছিল ভেতর থেকে।
৯.
জিনিসপত্র প্রায় সবকিছু গোছগাছ করাই ছিল। হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। হোটেলের সামনে থেকে একটা অটোরিকশায় উঠলাম আমরা তিনজন। প্রধান সড়কে সকাল থেকে বেশ ভিড়, তাই গলির রাস্তা ধরেই চলছিল আমাদের অটোরিকশা। প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট চলার পর শ্যামলীর দু’নম্বর রাস্তার কাছে যেখানে রাস্তা পারাপারের ব্রিজটি দাঁড়িয়ে আছে, তার একটু আগেই নেমে পড়লাম আমরা। সামান্য কিছু কেনাকাটা সেরে রাস্তার ওপারে গিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই হাসিমুখে সামনে এসে দাঁড়ালেন একজন। গোবিন্দদার মুখ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি এই মানুষটাকেই একটু আগে ফোন করেছিলেন। পরিচয় হলো। তিনি জেনিস আক্তার। কবিতার মানুষ। গবেষণার কাজও করেন।
দুটো রিক্সা ডেকে নিলেন তিনি। একটায় গোবিন্দদা ও জেনিস আক্তার, অন্যটিতে অপাংশুদা আর আমি। বেশি দূর যেতে হয়নি। দুটো মোড় ঘুরে রিক্সা যে বাড়িটির সামনে এসে থামালো, সেখান থেকে দু’কদম হেঁটে একটা দালানবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলাম।
বসার ঘর। খুব পরিপাটি করে সাজানো। আসবাব বলতে কয়েকটা বসার আসন ছাড়া দুটো আলমারি। একটায় সারাজীবনের অর্জিত সম্মান স্মারক। অন্যটিতে বই। হাতে আঁকা কোন প্রিয় শিল্পীর ছবি দেয়ালে ঝুলছে। আমরা চারজন গিয়ে বসলাম। একটু বাদেই এলেন তিনি। ঘরে ঢুকে ডানদিকের আসনটিতে বসলেন। আমাদের সাথে আগে থেকেই জানাশোনা আছে তাঁর, শুধু জেনিসের সঙ্গেই পরিচয় ছিল না, যদিও জেনিস তাঁকে ভালোভাবেই পড়েছিলেন এবং সামনাসামনি পরিচয়টা এই প্রথম। হাসি হাসি মুখ। এক স্নেহময়ী মায়ের দৃষ্টি নেমে আসছিল চোখ থেকে চোখে। খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই মানুষটিই সেলিনা হোসেন।
সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে টুকিটাকি আলোচনা চলছে তখন। চুপচাপ শুনছি সব। মনে হলো একটি সমুদ্রের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। বিস্তীর্ণ সৈকতে আমরা চারজন। তাঁর মুখে শান্ত দুপুরের হালকা ঢেউ ঊর্ধ্বমুখী বয়সের জানান দিচ্ছে। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ যেন চেহারায় বিকেল আঁচড়ে পড়লো। পরপর কাশতে লাগলেন। অনেক ব্যস্ততায় শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তবুও সৃষ্টিশীল গর্জন ভেতরে তোড়ফোড় করেই চলছে সবসময়।
জেনিস আক্তারকে খুবই খুশি খুশি দেখাচ্ছিল। একই এলাকায় বাড়ি হলেও খুব ব্যস্ত মানুষ বলে কখনও দেখা করার সুযোগ করতে পারেনি। আজ জেনিসের যেন স্বপ্নপূরণ হলো। বিকেলের সূর্য যেমন বুক নামিয়ে আনে সমুদ্রের জলে, রঙ ছড়িয়ে দেয় ঢেউয়ের তালে, তেমনি জিনেসও মিশে গিয়েছিল সেলিনা হোসেনের বুকে। এই সুখ কতটা স্বর্গদুয়ার খুলে দিতে পারে খুশির, তা ঠিক যেমন জানে সমুদ্র, যেমন জানে সূর্য, তেমনই জানে সেলিনা হোসেন, যেমন জানে জেনিস। আমরাও ডুবুরি তখন। কাঁটাতারের দুদিকের শব্দ একটা ছোট্ট ঘরে মিলেমিশে এক হয়ে ভাসমান মনপাখি দেখছিল চোখ। এই মায়া ভরা চোখে কিছু স্বপ্ন ছায়াঘন ডানায় ভর করে আকাশ দেখছিল।
বিদায় নেবার আগে শব্দহৃদয় সেলিনা হোসেন আদরস্বরূপ তাঁর ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ বইটি তুলে দিলেন আমাদের হাতে, আর লিখে দিলেন– “ভালোবাসার সরোবরে ভালোবাসার ফুল থাকুক আমাদের জীবনে”।
১০.
এই উপমহাদেশের সাহিত্যে যিনি জ্বলজ্বল করছেন, যিনি এ সময় তাঁর কাজের আলোয় অনায়াসে পথ দেখাতে পারেন, তেমন নক্ষত্র সেলিনা হোসেন। তাঁর দেওয়া উপহার বুকে আর কথাগুলো মনে জমিয়ে বেরিয়ে এলাম। কবি অপাংশু দেবনাথ, জেনিস আক্তার, গোবিন্দ ধর ও আমি পাশাপাশি হাঁটছি। অল্প কিছুক্ষণ সময় তখনও আছে। কবি জেনিস আক্তার একটা বিশেষ জায়গা দেখাতে চান, বললেন– খুব কাছেই আছে।
কবি অপাংশু দেবনাথ ও আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক পাশেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। ব্যাগপত্র খুব ওজন ছিল বলে আমরা দুজন রিক্সায় এলাম। কবি জেনিস ও গোবিন্দদা হেঁটে এলেন। বর্তমান থেকে অতীতের পথে হাঁটবো বলে এগিয়ে যাচ্ছি জাদুঘরের দিকে। ভেতরে প্রবেশ করার আগে চোখে পড়লো একটি শিখা জ্বলছে। দালানের বুকে জ্বলন্ত শিখাটি যেন কিছু বলছে। আলোয় প্রথম তলার চারপাশ নীরব, শান্ত। কবি জেনিস বললেন– ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়ে অম্লান রাখার প্রতীক।’ এটি নাকি ১৯৯৬ সাল থেকে সেগুনবাগিচায় জ্বলছিল। চির অম্লান এই শিখা। তিনি বললেন– ‘জাতীয় শহীদ মিনার হয়ে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনী হয়ে, ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, সকল অপশক্তি রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশীর্বাদ নিয়ে, ৭১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে স্বাগত জানিয়ে শিখা অনির্বাণ প্রথম তলায় আলো ছড়াচ্ছে।’
জেনিসকে যতই দেখছি আর যতই শুনছি মনে হচ্ছিল পরিচিত হতে হতে এই মানুষটি আবার কেমন অপরিচিত। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসে বরাবর চঞ্চল হয়ে উঠছেন। সবকটি দৃশ্য দেখিয়ে ইতিহাস তুলে ধরছিলেন। অনর্গল বলছিলেন। ছবি তুলছিলেন, তুলেও দিচ্ছিলেন। ঐ মুহূর্তে তাঁর আচরণ আমাকে যেমন অবাক করেছে, তেমনি মুগ্ধ করেছে।
যতই ভেতরে ঢুকছি একটু একটু করে মূল স্রোত থেকে ইতিহাসে হারিয়ে যাচ্ছি। জাদুঘরের নিঃশব্দ সব ছবির ভেতর অতীত শব্দের চিৎকার। আবেগ এসে জড়িয়ে ধরছে। দেয়ালে চিহ্নিত ছিদ্রগুলোই কেমন বুকের আনাচেকানাচে জমা হচ্ছে। স্পন্দনের তালভঙ্গ হচ্ছিল খুব। দর্শনার্থীদের একেকটি মুখের আদল কোন অপরিচিত মুক্তিযোদ্ধার মতোই বদলে যাচ্ছে, মনে হয় না রাজধানীর আগারগাঁও-এ পঙ্গু হাসপাতালের উল্টো দিকে (এফ-১১/এ-বি, সিভিক সেক্টর) মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ভবনের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। এমন আবেগাপ্লুত কবি অপাংশু দেবনাথ দর্শনার্থীর মতামতের পাতায় লিখেছেন– ‘কতটা দিন ভেবে ভেবেও, চেষ্টা করেও আসতে পারিনি এখানে, এই বাংলাদেশে। এখানে আমার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কোন এক সময়। বড় হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে এক গভীর হৃদয়ের টান অনুভব করতে থাকলাম এই দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি।’ তিনি আরও লিখেছেন– ‘দেওয়ালের গায়ে স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখতে দেখতে চোখে জল এসে যায়। এমন ভাবেও শহীদের প্রতি সম্মান জানানো যায়, নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন না। চোখের জল মুছে নিলেও, ভেতরে ভেতরে মনে হয় আমার পূর্বপুরুষ ছিলেন এঁদেরই কেউ।’
কবি গোবিন্দ ধর লিখেছিলেন– ‘এখানে কবি জেনিস আক্তার নিয়ে এলো, না হলে বাংলাদেশকে কাছে থেকে দেখতে আরো সময় লাগতো।
আমার পূর্বপুরুষ মৌলভীবাজার থেকে দেশ ভাগের যন্ত্রণা নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। তাঁর স্মৃতিকাতর আমি আবারও একইভাবে ভেঙে পড়ি।
আসবো, বারবার আসবো।’
তখন দুপুরের রোদে মিঠে স্পর্শ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর থেকে বেরিয়ে গাড়ির জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখানে জনঢলের কোলাহলে শব্দেও যান্ত্রিকতা। মিশ্রিত একটা শব্দ জীবিত শব্দকে গিলে খায়। কংক্রিটের ইমারতের গায়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে পতনশীল শব্দেরা দরিদ্র হতে হতে নিচে নেমে আসছে কোন প্লাস্টিকের একচালার ভেতর। বাইরে শব্দেরা যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় যানজটে মিশে অথবা লুকিয়ে অচেনা পরিচয় তৈরি করছে, একচালার ভেতরে এমন নয়। এখানে শব্দগুলো অতি প্রাচীনতায় ভুগছে, অথচ খুব কাছাকাছি থাকে। একই বাতাসে দোলন খায়, তবুও শব্দে কেমন বিপরীতধর্মীতা ও বৈরিতা। তবে একথা যে কেউ সহজেই বলে দিতে পারে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সব শব্দ মিলেমিশে এক হয়ে আছে।
কবি জেনিস আক্তারের মতো এমন একটি মানুষকে ছেড়ে যেতে কারোরই ভালো লাগার কথা নয়, কিন্তু ফিরতে হবে। জেনিসেরও এখান থেকে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে হবে। আমরা অটোরিকশায় উঠে বসলে একটা ভাঁজ করা কাগজ কবি গোবিন্দ ধরের হাতে দিলেন। ঝড়ো হাওয়ার মতোই এক অচেনা জেনিস এসে পরিচিত হয়, পরিচয়টুকু এক টুকরো জায়গা কিনে নেয় গোপনে। এই গোপন গোপনীয়তা কখনো কবিতা- চিঠি হয়ে উড়ে আসে কারো ভিড়- ভারাক্রান্ত মনের উঠোনে। কিছু দোলন রাখে, যদিও কবি জেনিস আক্তারের ভেতর জাদুঘরের বিশালতা দেখেছি। আচমকা বিচ্ছেদের ঝড় এলে কোন অপরিচিত ভিড় নিয়ে যায় পরিচিত জেনিসদের।
Leave a Reply