মঙ্গলবার, ০৬ Jun ২০২৩, ০২:০৭ পূর্বাহ্ন

হুমায়ূন স্যারের চলে যাওয়া জীবনের বড়ো কষ্ট-ডা. এজাজ

হুমায়ূন স্যারের চলে যাওয়া জীবনের বড়ো কষ্ট-ডা. এজাজ

হুমায়ূন স্যারের চলে যাওয়া জীবনের বড়ো কষ্ট
ডা. এজাজ

রংপুর মেডিকেল কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে তখন। ১৯৭৮-৭৯ এর দিকে রেডিও বাংলাদেশ রংপুরে নিউজ কাস্টার হিসেবে অডিশন দিলাম। বেতারে খবর পড়তাম। থাকতাম রংপুর পিটিআই ক্যাম্পাসে। বাবা মরহুম শাহ ইয়াসিন ছিলেন সুপারিনটেনডেন্ট। রংপুর রেডিওতে প্রথম নাটক ডা. আশুতোষ দত্তের নির্দেশনায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চন্দ্রনাথ। চন্দ্রনাথের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। তবে রংপুর মেডিকেল কলেজ অডিটরিয়ামে প্রথম নাটক ডা. গোলাম রব্বানী স্যারের নির্দেশনায় দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ। যেখানে কৃষকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম।
ঢাকায় এলাম ১৯৮৫ সালে। বিটিভিতে নাটকের অডিশন দিলাম ১৯৮৯ সালে। আমার ব্যাচে জাহিদ হাসান, তৌকির আহমেদ, বিপাশা হায়াতের মতো তারকারা। বিটিভির তালিকাভুক্ত হলেও আমাকে কেউ ডাকতো না। আইপিজিএমআর (ইন্সটিটিউট অফ পোস্ট গ্রাজুয়েশন মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ) থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার পর সার্টিফিকেট নেবার জন্য গেলাম পিজি হসপিটালে বর্তমানে বিএসএমএমইউ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকাল ইউনিভার্সিটি)। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি প্রদান করা হতো।
প্রফেসর ডা. এম এ করিম স্যার তখন ডিরেক্টর। স্যারকে পেলাম না চেম্বারে তবে তবে তিনি তখন গিয়েছেন জননন্দিত নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের কাকরাইলের অফিসে। ছুতা খুঁজছিলাম হুমায়ূন স্যারের সাথে দেখা করার। স্যারের সইটি নেবার জন্য হুমায়ূন স্যারের রুমে প্রবেশ করলাম। স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললাম আমার চেম্বার গাজীপুর চৌরাস্তায়। হুমায়ূন স্যার বললেন গাজীপুরে সুটিং এর কাজে গেলে আমি যেন তাকে সাহায্য করি। মনে মনে তো মহাখুশি স্যারের সাথে পরিচয় হয়েছে। টিঅ্যান্ডটি নাম্বারটি দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
চেম্বারে রোগী দেখছি। হঠাৎ চেম্বারের ছেলেটি এসে বললো হুমায়ূন আহমেদ না কে যেন ফোন করেছে। আমার তো আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। হুমায়ূন স্যারের ফোন। জানালেন নতুন একটা নাটকের সুটিং করতে আসছেন। স্যারের জন্য কটেজে থাকার ব্যবস্থা করলাম।
মনে মনে নাটক করার স্বপ্ন। স্যারের অ্যাসিসট্যান্ট মিনহাজকে বললাম সুপ্ত বাসনার কথা। স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ। স্যারের কানে পৌঁছলো কথা। রাতেই তিনি ‘সবুজ সাথী’ নাটকের জন্য স্বাস্থ্যকর্মীর একটি চরিত্র লিখে ফেললেন এবং প্রথমবারের মতো স্যারের নির্দেশনায় কাজ করার সুযোগ এলো। স্যার মিনহাজকে বললেন ডাক্তার তো ভালো অভিনয় করে। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রথম প্রথম আপনি করে বললেও যখন আরো বেশি ভালোবেসে ফেললেন তখন থেকে তুমি করে বলতেন।
‘অদেখা ভুবন’ নামের সুটিং-এ সবাই যাচ্ছি বাসে করে। পেছনে বসেছিলাম। স্যার ডেকে পাঠালেন সামনে। বললেন, ডাক্তার আমার অনেকদিনের স্বপ্ন একটা বাগানবাড়ির। অনেককেই বলেছি খুঁজে দেবেন কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। ডাক্তার তোমাকে দায়িত্ব দিলাম। তিন মাসের মধ্যেই পিরুজালী এলাকায় নুহাশপল্লির জায়গাটা খুঁজে পেয়ে স্যারকে জানালাম। বললাম, জায়গা সুন্দর কিন্তু রাস্তা খারাপ। স্যার বললেন, রাস্তা খারাপ ভালোই হইছে। লোকজন রাস্তা খারাপের জন্য ডিস্টার্ব করতে সহজে আসবে না। আমার লেখালেখির জন্য সুবিধা হবে। প্রথমে নুহাশপল্লির জন্য সাড়ে তেরো বিঘা জমি কিনে দিলেও পরে বাড়ানো হয়েছে পরিধি।
স্যারের সঙ্গে ‘শ্যামল ছায়া’ ছবির সুটিং এর ঘটনা মনে পড়ে। সেটে দুপুরের খাবার আসতো সাধারণত আড়াইটা তিনটায়। আমার বেশিরভাগ রোগী গাজীপুর জেলার। সুটিং করতে গেলে রোগীদের সাথে দেখা হবে স্বাভাবিক। বিকেলে হয়ত হাটে বা বাজারে বেড়াতে গেছি সেখানে রোগীদের সাথে দেখা। অনুরোধ করে স্যার আমি খাওন দিমু। আমি জিজ্ঞাসা করি তোমার বাইত্তে আইজ কী পাক হইছে। জবাব আসে লাউ পাতা ভর্তা, শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা, কচুর লতি, বেগুন ভর্তা। ওই অঞ্চলের লোকজন ডাল একটু কমই খায়। দেখা যায় বারোটা সাড়ে বারোটায় আমার খাবার দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে আসে। আমি ক্ষেতের একপাশে বসে কামলারা যেভাবে খায় সেভাবে গামছা বিছিয়ে তৃপ্তির সাথে খেয়ে উঠি। একদিন হুমায়ূন স্যার খেয়াল করলেন ব্যাপারটি যে ডাক্তার এতো তাড়াতাড়ি খাওয়া পায় কোত্থেকে। আমি সেখানেও খেতাম আবার সেটের খাবার এলে সেখানেও খেতাম। পরে স্যার জানলেন ঘটনাটি।
পান্তা খাবার ব্যাপারে হুমায়ূন স্যারের একটা কথা মনে পড়ে। পান্তা আমার প্রিয় খাবার। নুহাশ পল্লিতে প্রতিদিন সকালে এক গামলা করে পান্তা খেতাম। এজন্য হুমায়ূন স্যার বলতেন, আমাদের ডাক্তার উটের মতো। উট যেমন একবারই অনেক খেয়ে নেয়, আমিও তেমনই খেতাম। সারাদিন আর কিছু খেতে হতো না। হুমায়ূন স্যারও খাদক ছিলেন। খেতে বসলে স্যার বলতেন ডাক্তারকে বেশি করে দাও। স্যার চিনি কম দিয়ে দুধ চা খেতে পছন্দ করতেন।
একদিন রোগী দেখছি। হঠাৎ করেই স্যার চেম্বারে এসে পড়লেন। স্যার তো রোগীর ভিড় দেখে বললেন তুমি তো দেখি রোগীর বাজার বসায়া দিছো। আর একদিনের ঘটনা। নূর ভাই মানে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার দিকে ফিরছেন। হঠাৎ তার ফোন। আসসালামু আলাইকুম নূর ভাই। আপনি এতো রাতে। নূর ভাই ফোনের ওপাশ থেকে বলছেন, এজাজ তোমারে পুলিশ দিয়া ধরানো উচিত। শত্রু তো নাই মিথ্যা মামলায় অনেকে জেল পর্যন্ত খাটে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। নূর ভাই যখন গাজীপুর চৌরাস্তা অতিক্রম করছিলেন তখন রোগীর ভিড় থেকে একটু মজা করেছিলেন আর কী। আমি তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম যত রাত হোক সবাইকে দেখে তারপর বাসায় যাব।
রোগী প্রসঙ্গই যখন এলো তখন মনে পড়ছে চেম্বারের একটা ঘটনা। ভাওয়াল মির্জাপুরে যাচ্ছি। হঠাৎ করে আমার গাড়ি উলটে গেল। ভেঙে গেল শিরদাঁড়ার একটি হাড়। প্রতিদিনই রোগীরা এসে খোঁজ নিয়ে যায়। প্রায় দুসপ্তাহ পর আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়ে চেম্বারে বসলাম। একদিন এক বৃদ্ধাকে প্রেসক্রাইব করার পর উঠে আসলেন আমার চেয়ারের কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘হুনছিলাম আজাজুল অ্যাকসিডেন কোরছে। আল্লাহপাকরে কইলাম আল্লাহ গো হের যোদি কিছু হয় আমরা কৈ যামু।’ কথাগুলো বলছিলেন আর বৃদ্ধা কাঁদছিলেন। আমারও চোখের কোণে পানি কিন্তু প্রকাশ করতে পারছি না।
হুমায়ূন স্যারের চলে যাওয়া জীবনের বড়ো কষ্ট। তবে বাবা-মা সবার আগে। স্যারের যেদিন দাফন হবে খুব ভোরে চলে গেলাম নুহাশ পল্লি। তখনও স্যারের কবর তৈরি হয়নি। ম্যানেজার বুলবুল এবং অন্যান্যরা বললো আমাকেই বিসমিল্লাহ করতে। আমিই স্যারের কবরে প্রথম কোপটি দিলাম। দুঃখ আরেকটা এতো ভিড় ছিল যে স্যারের মুখটা শেষবারের মতো দেখতে পাইনি একনজর।
দাফনের আগে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। প্রকৃতিও যেন এই মানুষটার জন্য কাঁদতে শুরু করেছিল। তবে অলৌকিকভাবে দাফনের সময় স্যারের পা দুটো পেয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম। কে যেন বলছিল এই ডাক্তার পা ছাড়ো আমি তো স্যারের পা শক্ত করে ধরে আছি। একসময় চোখের জলে হুমায়ূন স্যারকে চিরদিনের জন্য শুইয়ে দিলাম মাটির বিছানায়।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge