মঙ্গলবার, ০৬ Jun ২০২৩, ০২:৫২ পূর্বাহ্ন

ফ্লাশব্যাক-৪:বৃটিশ মিউজিয়াম দেখার অভিজ্ঞতা-মো. শওকত আলী

ফ্লাশব্যাক-৪:বৃটিশ মিউজিয়াম দেখার অভিজ্ঞতা-মো. শওকত আলী

ফ্লাশব্যাক-৪
বৃটিশ মিউজিয়াম দেখার অভিজ্ঞতা
মো. শওকত আলী

দেশ-বিদেশে সুযোগ পেলে আমি জাদুঘরে যাই।এর একটি কারন হচ্ছে যে আমার কাছে মনে হয় জাদুঘরে সে সমাজ বা জাতির পুরান খানদানের সংগে আমি কিছুটা হলেও পরিচিত হতে পারি। আমাদের দেশে গ্রাম্য সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে। যদি কোন পরিবারের সংগে আত্মীয়তা(ছেলে বা মেয়ের বিয়ে) করতে চান তাহলে সে বাড়ির রান্নাঘর,শৌচাগার আর তৈজসপত্র যেগুলো আপ্যায়নের জন্য ব্যবহার করা হয় সেগুলো লক্ষ করবেন।তাতে ঐ পরিবারের রুচি,মনমানসিকতা আর খানদান বুঝতে পারবেন।এ বিষয়ে অনেকেই হয়তো দ্বিমত করবেন।কিন্তু এটি বেশ প্রচলিত ছিল। হয়তো এখনও কেউ কেউ অনুসরণ করেন। যা’হোক,ফিরে আসি জাদুঘরের কথায়। জাদুঘর হচ্ছে একটা সমাজ তথা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের নৃতাত্বিক,পূর্বপুরুষদের সামাজিক, আর্থিক,বৈষয়িক জীবন যাপন,শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পরিবেশ,পশুপাখি এমনকি ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থারও প্রতিনিধিত্ব করে।সুতরাং,অল্প সময়ের মধ্যে এসব সম্পর্কে ধারনা পাওয়ার এরকম মওকা আর কি হতে পারে? আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন ১৯৮৩ সালে জাতীয় জাদুঘর শাহবাগে স্থানান্তরিত হয়।তার আগে এটি নিমতলিতে ছিল ঢাকা জাদুঘর হিসেবে। ছাত্রাবস্থায় দেখেছি শাহবাগে নির্মিতব্য জাদুঘর ভবনের নির্মাণকাজ।ভবনটির ‘সাইলোটাইপ’ (?) স্থাপত্যশৈলী দেখে তখন আমরা এর বেশ সমালোচনা করতাম।(আমার এরকম মন্তব্যের জন্য হয়তো কেউ কেউ কড়া সমালোচনাও করতে পারেন আমার।) তবে একারনে জাদুঘরে যাওয়া থেমে থাকেনি আমার। নিজের আগ্রহের কারনে আর পরবর্তীতে ভাগ্নে-ভাগ্নী, ভাতিজা-ভাতিজি,ছেলে-মেয়েদেরকে সংগে নিয়ে ওখানে গিয়েছি বারকয়েক। আর নিয়তি এখন আমাকে নিয়ে এসেছে ঐ সংস্থাটির শীর্ষকর্তা হিসেবে সাময়িকভাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের।সৌভাগ্য আমার মুদ্রার উভয় পিঠই দেখার সুযোগ হলো।আগে দেখেছি দর্শক হিসেবে আর এখন দেখছি প্রশাসক হিসাবে। কি যে বিরাট পার্থক্য এ দু’ভাবে দেখার অভিজ্ঞতার।আমাদের জাতীয় জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে মোটামুটিভাবে এক লক্ষ নিদর্শন।কিন্তু একসঙ্গে প্রদর্শন করার সামর্থ্য আছে চার হাজারের মত। এবারে বৃটিশ মিউজিয়ামের প্রসংগে আসি।এটি আমি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম ২০০১ সালে যেবারে ব্যাংকক থেকে লন্ডন যাবার শুরুতে ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল।লন্ডন শহরে National Gallery,National History Museum, Albert Museum, Science Museum সহ মোট তেরটি জাদুঘর রয়েছে যার মধ্যে বৃটিশ মিউজিয়াম প্রাচীনতম এবং বৃহৎ ।বৃটিশ মিউজিয়ামের যাত্রা শুরু ১৭৫৩ সালে। একজন আইরিশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী Sir Hans Sloane এর ব্যক্তিগত সংগ্রহ দিয়ে। ১৭৫৯ এটি সর্বসাধারনের জন্য এটি উন্মুক্ত করা হয়। বিশ্বে এটিই প্রথম জাতীয় জাদুঘর এবং এখনও পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জাদুঘর । বৃটিশরাজ তখন সারাবিশ্বে দোর্দান্ত প্রতাপে তাদের উপনিবেশ বাড়াতে ব্যস্ত।সময় এমন এলো যখন তারা দম্ভ করে বলতো, বৃটিশ সাম্রাজ্যে কখনও সূর্য অস্ত যায় না। ঠিক এমনি সময়ে মানব ইতিহাস, শিল্প, সংস্কৃতির দালিলিক নিদর্শন সংগ্রহের লক্ষ নিয়ে জাদুঘর হিসেবে বৃটিশ মিউজিয়াম কাজ শুরু করে এবং পরে আড়াইশ’ বছর ধরে এর ব্যাপক প্রসার ঘটায়। বর্তমানে প্রায় ৮০ লক্ষাধিক নির্দশন রয়েছে এ জাদুঘরে। এ জাদুঘরে যাবার আগে শুনেছিলাম ওখানে মমি আর কোহিনূর হীরক পাথরটি আছে।এ দুটি বিষয়ে ছেলেবেলা থেকেই শুনেছি। তাই আগ্রহের পারদটা উর্ধ্বমূখিই ছিল। জাদুঘরে গিয়ে জীবনে প্রথম স্বচক্ষে মমি দেখলাম। মমির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি উঠালাম।মিসরীয় সভ্যতার সেসব মমির কথা আগে শুধু বইপত্রে পড়েছিলাম।বাস্তবে দেখে অন্যরকম একটা অনুভূতি হলো।কিন্তু দূর্ভাগ্য,কোহিনূরের দেখা পেলাম না। আগে আসলে ভুল শুনেছিলাম।কোহিনূর আসলে বেশ সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা আছে লন্ডন টাওয়ারের Jewel House এ। এটি হচ্ছে ব্রিটিশ রাজমুকুট রাখার ভোল্ট।কোহিনূর হীরকটি মোগল সম্রাটদের ময়ূর সিংহাসনে বসানো থাকলেও বৃটিশরা এটিকে রানী ভিক্টোরিয়ার রাজমুকুটে এটেছিল।জুয়েল হাউসে বিশেষ ব্যবস্হাপনায় জনসাধারণকে সেটি দেখানো হয়।দ্বিতীয়বার যাবার মত সময় ছিল না হাতে।তাই আফসোসটা সংগী হিসেবে রয়েই যায়। ব্রিটিশ মিউজিয়ামও ভালোভাবে দেখতে গেলে একদিন সময় যথেষ্ট ছিল না। ওরা একটা বড় ধারণা( Theme) নিয়ে জাদুঘরটি সাজিয়েছে।আর সেটা হলো মানব ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির দালিলিক সংগ্রহ । এটি সম্ভব হয়েছে তাদের উপনিবেশের ব্যাপ্তির কারনে।থিমেটিক এবং অঞ্চল দুভাবেই জাদুঘরটি সাজানো।যেমন-মুদ্রা ও পদক,অলংকার,অস্ত্র ইত্যাদি ডিপার্টমেন্ট যেমন আছে তেমনি আছে মিসর ও সুদান, মধ্যপ্রাচ্য ডিপার্টমেন্ট ইত্যাদি। কলোনি দেশগুলো থেকে যেভাবে পেরেছে তারা নিদর্শন সংগ্রহ করেছে।তাই তাদের সংগ্রহে রক্ষিত কিছু নিদর্শনের মালিকানা নিয়ে পরবর্তীতে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে Elgin Marbles Of The Greece এবং Rosetta Stone Of Egypt. গ্রিসের Elgin Marble Sculpture গুলো এথেন্সের Acropolis এর মন্দিরে ব্যবহার করা হয়েছিল।বৃটিশরা ওগুলো সেখান থেকে পাচার করে সমুদ্রপথে জাহাজে করে নিয়ে আসে।ঐ মন্দিরগুলো খৃষ্টের জন্মের প্রায় সাড়ে চারশ বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল বলে প্রত্নতত্ববিদগণ ধারনা করেন।গ্রিস সরকার এগুলো ফেরত প্রদানের জন্য বহুদিন থেকে দাবী জানিয়ে আসছে।মিসরও Rosetta Stoneটি ফেরত দাবি করছে। এই শিলালিপিতে প্রাচীন গ্রীক এবং তারও আগের দুটো সভ্যতার সময়কালে ব্যবহৃত বর্ণ চিত্র ব্যবহার করে তিনটি ডিক্রী উৎকীর্ণ রয়েছে। ১৭৯৯ সালে এটি আবিষ্কৃত হয় এবং পরবর্তীতে কোন এক উপায়ে বৃটিশ মিউজিয়ামের অধিকারে আসে। কোহিনূর হীরক পাথরটি যদিও বৃটিশ মিউজিয়ামে নেই এটির মালিকানাও কিন্তু দাবি করা হচ্ছে ভারত,পাকিস্তান,আফগানিস্তান এবং ইারন কতৃর্ক।তবে বৃটিশরা পরের ধনে পোদ্দারি করে তাদের আভিজাত্য ভালই দেখাচ্ছে।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge