ত্রিপুরার লেখক যখন প্রকাশক একটি সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত
গোবিন্দ ধর
ত্রিপুরায় লেখক সম্পাদকরাই পরবর্তী সময় প্রকাশনায় আসেন গ্রন্থ নির্মানকে ভালোবেসে।লাভালাভের জন্য প্রথমত কোন প্রকাশনা বই ছাপতে প্রকাশ করতে আসেননি।সময়ের নিরিখে কোন কোন প্রকাশনা লাভের মুখ দেখলেও অধিকাংশ প্রকাশনা প্রকাশনায় আসেন লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে করতেই। বিষয়টিকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসেন বলেই।তার কিছু কিছু তুলে ধরলাম।বিস্তৃত নয় এগুলো।কারণ এর থেকে শুধু স্রোতের অবস্থান চিহ্নিত করার প্রয়াস থেকেই এই আয়োজন।
পিলাক প্রকাশনী ও শঙ্খপল্লব আদিত্য
শঙ্খপল্লব আদিত্যের পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই।তিনি আমাদের রাজ্যের কবিদের মুখ। তিনিও পিলাক প্রকাশনী থেকে পীযূষ রাউতের, জন্মজুয়াড়ী প্রকাশ করেন।নামগুলো তাৎক্ষণিক মনে পড়ছে না।তিন চারখানা বই পিলাকের সম্মানকে আজও অস্বীকার করার কোন জায়গা ত্রিপুরার হয়নি।পিলাক তার প্রকাশনা চালু রাখলে হয়তো অনেকেরই প্রকাশনায় আসতে হতো না।
পিলাক থেকে প্রকাশ হয়েছিল কবি বিজনকৃষ্ণ চৌধুরীর ‘সেতুবন্ধ ও অন্যান্য কবিতা’ নামক কাব্যগ্রন্থটিও।
শঙ্খপল্লব আদিত্য প্রকাশনায় এসে অনেকগুলো গ্রন্থের প্রকাশ করেন।তিনি পীযূষ রাউতের নষ্ট আশ্বিনের কবিতা নামে সম্ভবত একটি বই করেছিলেন।কবি পীযূষ রাউত বইটি বাতিল করেন ভুলে ভরা প্রকাশ ছিলো বলে।অথচ পীযূষ রাউত এর সেই বইয়ের কবিতাগুলে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ছিলো।সুখময় ঘোষের সুরেন মহাজনের সমুদ্র যাত্রা,(গল্প),রমাপ্রসাদ দত্তের ত্রিপুরায় রবীন্দ্র সংঙ্কৃতি(প্রবন্ধ),দুটি বইও প্রকাশ পেয়েছিল পিলাক প্রকাশনা থেকে।শঙ্খপল্লব আদিত্যের ছাপাখানার নাম ছিল পাণ্ডুলিপি।আগরতলার প্যারীবাবুর বাগানে ছিল এটি।
হ্যাঁ পিলাক বিষয়ে আরো লেখা দরকার।আমাদের একজন শক্তিশালী কবি শঙ্খদা। তিনি প্রকাশনায় না এলে কি এমন ক্ষতি ছিলো।কিন্তু রাজ্যে প্রকাশনায় তিনি প্রথম দিকের সৈনিক।তখন লেটার প্রেসের আমল।লিনোকোটে প্রচ্ছদ হতো।
পৌনমী প্রকাশন ও নিলিপ পোদ্দার
আমাদের রাজ্যের লেখকের মধ্যে উল্লেখ্য গল্পকার নিলিপ পোদ্দার। প্রথম দিকে রাতুল দেববর্মণও এর যৌথ সম্পাদনার সাথে যুক্ত।১৯৭৩সালে লিটল ম্যাগাজিন,পৌনমী শুরু করেন কবি রাতুল দেববর্মণসহ যৌথভাবে।সময়ের তাগিদে পৌনমী প্রকাশন একদম।দশ টাকা পাঁচ টাকার গল্প থেকে শঙ্খপল্লব আদিত্যের কবিতা এক একটা বই যেন মুদ্রিত শিল্প। শঙ্খপল্লব আদিত্যের কবিতা বইটির কবি শঙ্খপল্লব আদিত্য মহোদয় পেলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পুরস্কার।পৌণমীর বই আমাদের অহংকার।
সৈকত ও মানস পাল
সৈকত ত্রিপুরার একটি উল্লেখযোগ্য লিটল ম্যাগাজিন।কবি মানস পাল(Saikat Prakasan) ছড়াও লেখেন।এক সময় প্রকাশনায় আসেন।সৈকতের বই পাঠকের কাছে নিশ্চয়ই রুচিশীলতায় উত্তীর্ণ। আমার নিজস্ব পাঠ তালিকায় সৈকতের অনেক বই এখনো সুরক্ষিত।সৈকত কাগজটিও এখনো প্রকাশিত হয়।
কাকলী ও চুনী দাশ
অনেকগুলো ছড়া সংকলন কাকলী থেকে প্রকাশিত।মূলত চুনী দাশের ছড়ার বইগুলো প্রকাশিত হয় কাকলী প্রকাশনী থেকে।
স্বাগতম ও সুভাষ সাহা
স্বাগতম থেকে গল্প প্রবন্ধের বই বের হয়।সুভাষ চন্দ্র সাহাও রাজ্যের একজন গল্পকার। বর্তমানে বয়সজনিত কারণে অঞ্জনদা কাজটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনিও বেশ কিছু কাজ করে যাচ্ছেন।
জ্ঞানবিচিত্রা ও দেবানন্দ দাম
কবিতা দিয়ে শুরু দেবানন্দ দামের।তারপর বাংলাভাষায় বিজ্ঞান আন্দোলনে রাজ্যে পথিকৃৎ। সাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই জ্ঞানবিচিত্রার অহংকার আমাদেরও।
ভাষাসাহিত্য ভাষা প্রকাশন
ভাষাসাহিত্য ভাষা ট্রাস্টের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্র।কল্যাণব্রত চক্রবর্তী রামেশ্বর ভট্টাচার্য দিলীপ দাস মাধব বণিক কৃত্তিবাস চক্রবর্তী অশোকানন্দ রায়বর্ধন সদানন্দ সিংহ কাকলী গঙ্গোপাধ্যায় সহ একটি বলিষ্ট লেখক সংস্থা। এরাজ্যের বুকে প্রথম লেখকদের একটি একত্রে পথচলার প্রতিষ্ঠান।
সাহিত্যপত্রের সাথে সমান তালে ভাষা প্রকাশন আমাদের রাজ্যে লেখক দ্বারা সমবেত ভাবে পরিচালিত একটি প্রকাশন সংস্থা।ভাষাও পরিশীলিত কাজ করে পাঠকের নজর কেড়েছেন।
জলজ সাতদিন একটি আন্দোলন
একদম জলজ সাতদিন সন্তোষ রায় সমান সমান। এটাও লেখা দরকার।জলজ একটি আন্দোলন।যার মূল কান্ডারী কবি সন্তোষ রায়।সাথে একঝাঁক তরুণ তুর্কি অভিজিৎ চক্রবর্তী তমাল শেখর দে সিদ্ধার্থ নাথ বাপ্পা চক্রবর্তী।ত্রিপুরার লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে ক্রমাগত পদক্ষেপ নিয়েছে জলজ।কিছুদিন পর জলজের প্রকাশন শাখা সাতদিন এই বিহঙ্গকাল সহ বাপ্পা তমাল অভিজিৎ সিদ্ধার্থের বই প্রকাশের পাশাপাশি আরো অনেকগুলো কর্মকান্ড করে দেখিয়েছেন।জলজ লিটল ম্যাগাজিন উৎসব তাদের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ।
জ্ঞান বীক্ষন প্রীতম ভট্টাচার্য
প্রীতম ভট্টাচার্যও একজন কবি।তিনি নিজেও রাজ্যের প্রকাশনায় কাজ করছেন।বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা প্রসারে তার নিরলস কাজ আমাদেরকে উৎসাহিত করে।
তুলসী নীলুৎপল সরকার
তরুণ আইনজ্ঞ নীলিুৎপল সরকার ছিলেন গল্পকার। গল্প লিখতে লিখতে চলে এলেন প্রকাশনায়।
অনার্য রসরাজ নাথ
অনেকগুলো বই অনার্য থেকে এক সময় প্রকাশিত।তিনি একজন কবিও।অনার্য একটি কবিতারও কাগজ।
মুখাবয়ব ও দেবব্রত দেব
তাঁর দীপ্ত পদচারণা গল্পে।এখনো লেখনি কথা বলে।তাঁর অন্তস্থল আমাদের (স্রোত প্রকাশনার)একটি উল্লেখযোগ্য গল্প সংকলন।মুখাবয়ব আমাদের অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যা উপহার দিয়েছে।একটি লিটল ম্যাগাজিন মুখাবয়ব।
দেবব্রত দেবও আমাদের রাজ্যের প্রকাশনায় এলেন।তাঁকে লেখক তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সাহস এ রাজ্যে নয় গোটা বাংলা সাহিত্যে হয়নি।
সোমবার চারুকৃষ্ণ কর
সাহিত্য সাময়িকী থেকে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইও প্রকাশিত সোমবার করেছেন।চারুকৃষ্ণ কর এলজন কবিও।
ত্রিপুরা দর্পণ ও সমীরণ রায়
এক সময় ত্রিপুরায় সংবাদ সাহিত্য আন্দোলনে রাজ্যের মুখ ছিলো ত্রিপুরা দর্পণ। সমীরণ রায়ের স্নেহপুষ্ট হননি এমন তরুণ রাজ্যে কমই আছেন।নৃপেন চক্রবর্তীর লংতরাই আমার ঘর উপন্যাস লাইন দিয়ে বইমেলায় বিক্রি হয়।তাতে স্টলে বসে নৃপেন চক্রবর্তীর অটোগ্রাফ নেওয়ার কী হিড়িক সেদিন আগরতলা বইমেলার পাঠক ত্রিপুরা দর্পণে এসে পড়ছিলো এসব নিজের চোখে দেখা।
ত্রিপুরাবাণী ও রঘুনাথ সরকার
রঘুনাথ সরকারও একজন লেখক।তাঁর সম্পাদিত অনেকগুলো বই ভাবীকাল মনে রাখবে।ত্রিপুরাবাণীও একটি সপ্তাহিক সংবাদপত্র।
মোটামুটি এই প্রকাশনার কর্ণধাররা লেখক হয়েও ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্পে একটি বাঁক আনতে সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
তৃণতট ও একঝাঁক তরুণদের মুখাবয়ব
আকবর আহমেদ তপন দেবনাথ আব্দুল আলিমদের মৃগয়াভূমি তৃণতট।সকলেই কবিতার ক্ষেত্রে নিজেদের মতো করে লিখে যাচ্ছেন কিন্তু প্রকাশনীটির দিকে আর কেউ মনোযোগ দেননি।
সম্ভবত ছুটির ঘন্টা,তপন দেবনাথের কবিতা সংকলনসহ অনেকগুলো গ্রন্থের প্রকাশ তৃণতটের।
তৃণতট লিটল ম্যাগাজিন পরবর্তী সময়ে তৃণতট প্রকাশনী নামেও বেশ কিছু বই প্রকাশ হয়েছে।আকবর আহমেদ, আব্দুল আলিম,তপন দেবনাথ, অপাংশু দেবনাথ, গোপেশ চক্রবর্তী ও পঙ্কজ বণিকরা ই প্রকাশনার চালিকাশক্তি ছিলেন।তপন যদিও এখন আর আমাদের মাঝে নেই।
অন্যান্য প্রকাশনা
বিদ্যা প্রকাশের প্রশান্ত ভট্টাচার্য, মানবীর কল্যাণী ভট্টাচার্য, রাইটার্সের দীনেশচন্দ্র সাহা,আবহমানের অনুপ ভট্টাচার্য ও দুলাল ঘোষ,সপ্তপর্ণার নিয়তি রায়বর্মন, বর্ণমালার ফুলন ভট্টাচার্যও এই ইতিহাসের অংশিদার।
স্রোত প্রকাশনা
শুধু সাধে স্রোত লিটল ম্যাগাজিন হয়েও প্রকাশনায় আসেনি।স্রোত পরিবারের প্রত্যেকেই কমবেশী কবিতা গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ কমিক্স ছড়া চর্চা করেন। করছেন এখনো।রাজ্যের লেখালেখির ইতিহাস বিকৃত করে লেখা হলে কথাকার ও কবি পদশ্রী মজুমদার অক্ষর শ্রমিক গোবিন্দ ধরকে বাতিল করা যেতে পারে।অন্যতায় এমন কোন ঘটনা এখনো ঘটেনি তাঁদের লেখনি থেমে যাওয়ার।সুতরাং প্রকাশক সুমিতা পাল ধরও একজন কবি হয়েও কেন স্রোত প্রকাশনা করতে হলো তার একটি ইতিহাস থাকবে না? ত্রিপুরায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন থেকে বই প্রকশনায় একটি অন্য মেজাজ ও তরুণ কবি সাহিত্যিকদের সব সময় অগ্রাধিকার দিয়ে স্রোত প্রকাশনাও পাঠক লেখকের নজর কাড়তে পেরেছে নিশ্চয়ই।
এছাড়াও আরো অনেকেই লেখক হয়েও লিটল ম্যাগাজিন বই প্রকাশ করে রাজ্যের সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের পাশে আছেন।
এ রাজ্যের প্রকাশনা শিল্পের সাথে যারা যুক্ত সকলেই লেখালেখি কিংবা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক কিংবা সংবাদ সাহিত্যের সাথেই যুক্ত।
স্বত্বও ধীরে ধীরে রাজ্যে দেওয়াও শুরু হয়েছে।এটা আনন্দের।স্রোতও লেখকস্বত্ব দেওয়া শুরু করেছে।
রাজ্যের প্রকাশকরার সাধ অনেক।সাধ্য কম।পাঠক লেখক প্রকাশকের যৌথ অলিখিত একটি মৌয়ের ফল আমরা বিশ্বাস করি।সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ত্রিপুরার প্রকাশনা সারা বাংলা সাহিত্যে নিজস্বতার চিহ্ন নিশ্চয়ই রাখতে পারছে বলে বিশ্বাস করি।
Leave a Reply