বুধবার, ০৭ Jun ২০২৩, ০৯:৪০ অপরাহ্ন

শতাব্দীর সাক্ষী কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ-কাজী মোঃ জুননুন

শতাব্দীর সাক্ষী কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ-কাজী মোঃ জুননুন

শতাব্দীর সাক্ষী কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ
কাজী মোঃ জুননুন

আমার শ্রদ্ধে বাবজান (বাজান) আমরা সবাই এমনকি আমার চাচাতো, খালাতো ভাইবোনেরা সবাই ডাকতো বাজান বলে।
আজ তাঁর মৃত্যু বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে তাঁর ডায়েরি থেকে পাওয়া কিছু তথ্য তুলে ধরলাম আগামী প্রজন্মের জন্যঃ
পিতার নামঃকাজী মহাম্মদ সৈয়দ
মাতার নামঃকামরুননেছা বিবি
জন্মসাল ও তারিখঃ ১৯০১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর
জন্মস্থানঃমুন্সিপাড়া,রংপুর
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ ১৯২৫ সালে কলিকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রথম মুসলিম হিসেবে বি,কম
পেশাঃ১৯৩৭ হইতে ১৯৮৭ আইনজীবী।
কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ- উত্তর জনপদ তথা গোটা বাংলার এক গর্বিত নাম।১৯৯৪ সালের ১৪ই এপ্রিল,বাংলা ১৪০১ বৈশাখ তিনি এই ধরাশয় থেকে চিরবিদায় নিয়ে আমাদের জন্য রেখে গেছেন এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে শুরু করে এ অঞ্চলের রাজনীতি সহ নাট্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিতি ছিল ব্যাপক।এছাড়া আইন পেশায় অত্যন্ত সফলতা অর্জন করায় এ অঞ্চলের লোকমুখে তিনি ‘ইলিয়াছ মোক্তার’ নামে পরিচিত ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে কর্ম জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এ উপমহাদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য লাভেও সক্ষম হন। কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর মহীরুহ এবং একজন অন্যতম কীর্তিমান পুরুষ।তার কীর্তির ছোঁয়া শুধু রংপুর অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিস্তৃত ছিল ভারতবর্ষ তথা অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন জুড়ে।তিনি রংপুর শহরের মুন্সিপাড়াস্থ সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯১৮ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করে কারমাইকেল কলেজ থেকে ষ্টাইপেন্ড সহ আই,এ পাশ করে কলকাতা যান আইন পড়ার জন্য। সে সময় তিনি অসহযোগ আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তখন বহরমপুর কারাগারে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাজবন্দী ছিলেন। তিনি কৌশলে বন্দী কবি নজরুলের সাথে যোগাযোগ করেন। যার কারণেই পরবর্তিতে তিনি কবি নজরুলের স্নেহভাজন বনে যান। বহরমপুরে থাকাকালীন কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রখ্যাত নাট্যকার ও নাট্যশিল্পী তুলসী লাহিড়ীর সংস্পর্শে আসেন এবং ১৯২৫ সালে বহরমপুরেই কোন এক মঞ্চে তিনি প্রখ্যাত নাট্যকার ও নাট্যশিল্পী দিজেন্দ্র লালের ‘পরপারে’ নাটকের মাধ্যমে নাট্যাঙ্গনে জড়িয়ে পড়েন।এই নাটকের ‘দাদা মশাই’ চরিত্রে তিনি অভিনয় করে দাদা মশাই হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয়ের কারণে বহরমপুরের রাস্তাঘাটে বেরুলে তাঁকে লোকজন দাদা মশাই বলেই ডাকতো। একই বছরে তিনি বহরমপুর কে এন কলেজ থেকে বিকম পাশ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম বাঙ্গালী মুসলমান যিনি বহরমপুর কলেজ থেকে বি,কম পাশ করেন। এর বেশ কিছুদিন পরেও তিনি সেখানকার নাট্যাঙ্গনে জড়িত থাকার পর দেশের বাড়ি রংপুরের মুন্সিপাড়ায় চলে আসেন।এখানে এসেই তিনি সংসারের হাল ধরা শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে ১৯৩২ সালে তিনি ঘর বাঁধেন এবং পুরোপুরি সংসারের হাল ধরেন।
এ সময় থেকেই তিনি রংপুর কোর্টে আইন পেশার সাথে সম্পৃক্ত হন।অতি অল্প দিনেই তিনি এই পেশায় এত সফলতা লাভ করেন যে, উত্তর জনপদের কোন ভালো আইনজীবীর কথা ভাবতে গেলেই লোকজন কে ইলিয়াছ মোক্তারের কথা ভাবতে হতো। পেশা এবং ঘর সংসারের পাশাপাশি তিনি জড়িয়ে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। তার পদচারণায় পরবর্তিতে এ অঞ্চলের নাট্যাঙ্গনের সমাবেশ ঘটেছিল বহু প্রতিভাধর নাট্য ব্যক্তিত্বের। এদের মধ্যে তুলসী লাহিড়ী, প্রবোধ মুখার্জী,ডাঃবসন্ত ভৌমিক, চারু স্যানাল,রেখা চ্যাটার্জী,ললিত প্রামাণিক, মুক্তা আকবর,মদন মিয়া সহ প্রমুখ। কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ শুধুমাত্র অভিনয় করেই বসে থাকেননি।
কলকাতা ভিত্তিক নাটক লেখা প্রবণতা বন্ধে তিনি আমাদের সমকালীন সমস্যার আলোকে নাটক লেখা শুরু করেন। তার রচিত নাটক ‘স্মাগলার’ সেসময় রংপুর সহ গোটা দেশেই আলোড়ন সৃষ্টি করে।এছাড়াও তার আরও বেশ কয়েকটি নাটকের পাণ্ডুলিপি রয়েছে। মঞ্চ কাপাঁনো নাটকের জন্য কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ চলার পথে আরো অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন।এদের মধ্যে নেতাজী সুভাষ বোস,শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, মহাপ্রাণ জি,এ সেন গুপ্ত,ডাঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ। দেশের নাট্য জগতের নানা প্রতিকূল পরিবেশ অবস্থান করেও শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি নাট্যাঙ্গনে যে ভূমিকা রেখে গেছেন তা কোনদিনও ভোলার নয়। তিনি ‘রংপুর নাট্য সমাজ’ এবং ‘রংপুর সাহিত্য পরিষদ’ এর সাথে দীর্ঘ ২৪ বছর সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিলেন। দেশের প্রাচীনতম লাইব্রেরী ‘রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী’ এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৮ বছর। এছাড়া তিনি রংপুর মিউনিসিপ্যালিটি’র নির্বাচিত কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ ১২/১৩ বছর।তার নাটক এবং নাট্য বিষয়ক অসংখ্য লেখা দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ওপর সম্মানিত হয়ে অসংখ্য পদক লাভেও সক্ষম হয়েছেন।
১৯২৭ সালের প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলন উপলক্ষে উপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষ বোস এবং আরও অনেক নেতার রংপুর আগমন ঘটেছিল।রংপুর নাট্য সমাজের উদ্যোগে মঞ্চায়িত ‘দত্তা’ নাটকের বিলাস চরিত্রে কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ এর অভিনয় দেখে শরৎচন্দ্র দারুণ অভিভূত হয়েছিলেন। কাজী সাহেবকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছিলেন ‘ একটা চাবুক হাতে তুলে যেন গোটা মঞ্চ দাবড়ে বেড়ালে হে!’ আরও বলেছিলেন ‘এক ঘন্টার নাটক দেখবো বলে এসেছিলাম, কিন্তু এরা আমায় উঠতে দিলোনা। এমনটা হবে ভাবিনিতো!’ নেতাজী সুভাষ বোসও নাট্য সমাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
রংপুরে এসেছিলেন ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। আমন্ত্রিত হয়ে তিনি নাট্য সমাজের ‘সীতা’ নাটকের অভিনয় দেখেন। ধর্মানুরাগী ডঃ শহীদুল্লাহকে সসংকোচে ‘সীতা’ নাটকটি দেখার অনুরোধ জানালে তিনি কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ কে বলেছিলেন “ধর্ম মানুষকে উদার করে।আমি খাঁটি মুসলমান বলে কি খাঁটি বাঙ্গালী নই? আমি একজন সাহিত্য প্রেমিকও বটে। আমার ধর্ম আমাকে সংকীর্ণতা শিক্ষা দেয়নি।”
সমাজ সেবায় কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ এর অবদান কম নয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব এস,এ, খায়েরের সহযোগিতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল (বর্তমানে শিশু নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়, রংপুর। এছাড়া রংপুর গার্লস স্কুল,মুন্সিপাড়াস্থ মরিয়ম নেছা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এবং কেরামতিয়া হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় তার অবদান উল্লেখযোগ্য।
আইন পেশায় কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ দক্ষতা ও সফলতার স্বাক্ষর রাখেন।একজন ডাকসাইটে আইনজীবী হিসেবে তিনি পরিচিত। ‘ রংপুর বার’এ মোক্তার হিসেবে যোগ দিলেও পরে পূর্বপাকিস্তান বার কাউন্সিল এবং স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বার কাউন্সিল তাঁকে এডভোকেট হিসেবে সনদ প্রাদান করেন। শতাব্দীর সাক্ষী দেশের নাট্য জগতের প্রবীণতম প্রাণপুরুষ দীর্ঘ ৯৩ বছর ধরে পৃথিবীর আলো বাতাস নিয়ে অবশেষে ১৯৯৪ সালের ১৪ই এপ্রিল বাংলা ১৪০১ বৈশাখ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের জন্য এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আর অসংখ্য স্মৃতি রেখে চির বিদায় নেন। তার রেখে যাওয়া সেইসব স্মৃতি আর মূল্যবান ইতিহাস আগামী প্রজন্মের চলার পথ প্রেরণার উৎস আর চালিকা শক্তি হিসেবে থাকবে যুগ যুগ ধরে। মহান রাব্বুল আল-আমিন এর নিকট ফরিয়াদ জানাই, তিনি যেন তাঁকে বেহেস্তবাসী করেন।
সংকলক : কাজী মহাম্মদ ইলিয়াছ এর কনিষ্ঠপুত্র।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge