রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ১১:২৫ পূর্বাহ্ন

সংগ্রাম: এক সাহসী নারীর উপাক্ষাণ-পিয়াল হাসান

সংগ্রাম: এক সাহসী নারীর উপাক্ষাণ-পিয়াল হাসান

সংগ্রাম: এক সাহসী নারীর উপাক্ষাণ
পিয়াল হাসান


গ্রামের নাম দৌলদিয়া। এ গ্রামের এক হত দরিদ্র কৃষকের মেয়ে সোহাগী। এক বিকেলে সে পুকুর ঘাটে বসে ছিল। হঠাৎ, তার বান্ধবী লিমা এসে বলল, “কি রে সোহাগী। কলেজ যাবি না ?” “না রে। আসলে কি জানিস, বাবার কষ্ট আমি দেখতে পারি না।” “ঠিকই বলেছিস। তবুও তোকে পড়ালেখা করতে হবে।” এ সময়েই সোহাগীর মা ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। সোহাগী মাকে দেখেই বলে উঠল, “মা । বাবার কষ্ট আমি দেখবার পারব না মা।” “তবুও তোকে কলেজ যেতে হবে। কলেজ যা মা।” সোহাগী রাজি হয়। চলে যায় কলেজে। খুশি হন মা। সোহাগী চলে যাবার পর বাড়ীর কাজে হাত দেন সোহাগীর মা।
সেদিন বিকেলে চায়ের দোকানে সোহাগীর বাবা রমিজ এসেছে চা খেতে। তাকে দেখে চেয়ারম্যানের ছেলে রাকিব জানতে চাইল, সোহাগির পড়াশোনা কেমন চলছে। জবাবে রমিজ বলল, “চলছে এক রকম । কিন্তু বাবা আমি ভাবতাছি ওরে আর পড়াশুনা করামু না। একটা ভাল ঘর পাইলে বিয়া দিয়া দিমু।” “না চাচা। ওরে পড়াশোনা করবার দ্যান। এত তাড়াতাড়ি বিয়া দিয়া লাভ কি।”
রমিজ রেগে যায়। বলে সে সোহাগীর বিয়ে দেবেই। হয়ও তাই। কিছুদিন পরের ঘটনা । সোহাগীকে দেখতে এসেছে পাত্রপক্ষ। কিন্তু, পাত্রপক্ষের দাবি যৌতুক আদায় করা। সোহাগীকে দেখার পর যখন ঘড়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখনি এ যৌতুকের কথাটি ওঠে। ঘটক বলল, “রমিজ ভাই। কথা হলো গিয়া, যৌতুক আপনাক দেওয়াই লাগবো। আর তা হলো উপহার সরূপ একটি কালার টি. ভি., মটরবাইক আর নগদ একলক্ষ টাকা।”
ঘটকের কথ্ াশুনে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে রমিজের। তবুও শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়ে যায় সোহাগির। বিয়ের দিন কিছু টাকা দেয় রমিজ। আর কথা দেয় বাকি টাকা পড়ে দেবে সে। এতেই বিয়ের স¤পূর্ণ কাজ সম্পন্য হয় সোহাগীর। সেদিন বিয়েতে চেয়ারম্যান আসে। জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার রহিম । তোমার মেয়ের বিয়ে আর আমি কিছুই জানি না।” “ অনেক ঝামেলায় ছিলাম তো তাই দাওয়াত দিতে পারি নি।” জবাব দেয় রমিজ।
এ সময় যৌতুকের কথা শুনতে পায় চেয়ারম্যান। প্রতিবাদও করে। কিন্তু রমিজ জানায়, কেউ কাউকে সাহায্য করে না। প্রমান হিসাবে শুনায় চেয়ারম্যানের বাবা রমিজের বাবাকে প্রতারনার মুখে ফেলেছিল সেই ঘটনাটি। যাইহোক, সেদিন বিকেলেই সোহাগী বধূ বেশে চলে যায় শ্বশুর বাড়ি। শুরু হয় তার আরেক জীবন।


বিয়ের পরদিন সোহাগী ঘুমিয়ে ছিল। এসময় সোহাগীর স্বামী যার নাম বজলু তার মা তাকে জিজ্ঞেস করল, “কিরে বাপ। বৌ তো সুন্দরই আছে। কিন্তু, শুধু টাকা দিলি হবি টি ভি, মটরসাইকেল ইল্লা দিব কবে।” “আরে মা। কেবল তো বিয়ে করে আনলাম। যদি কিছু না দেয় তবে বাপের বাড়ি পাঠাব হনে।”
এসময়ই মেম্বর অর্থাৎ বজলুর বাবা বড়িতে ধুকে। জিজ্ঞেস করে, কাকে বাপের বাড়ি পাঠাবে। বজলু জানায়, সোহাগীকে। তখন মেম্বর বলল, “তা, নবাবের বেটি কি উঠিছে। না এখনও বেহুস হয়া পরি আছে।” এ সময়েই সোহাগী বারান্দায় এসে দাড়ায়। বজলুর মা জিজ্ঞেস করে, ঘুম কেমন হয়েছে। সোহাগী হ্যাঁ সূচক মাথা নারে। বজলু তাকে কাজের কথা বলে গঞ্জে চলে যায়। এদিকে মেম্বার বজলুর মাকে নিয়ে ঘড়ে প্রবেশ করে।
সেদিন বন্দরে গিয়ে বজলু জানতে পারে সোহাগীর সাথে এক ছেলের সম্পর্ক ছিল। এ কথা শুনে বজলু রেগে যায। এদিকে সোহাগী রাতে ভাত নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। অনেক রাতে বজলু প্রবেশ করে বাড়িতে। সোহাগী তখন বজলুকে বলল, “ভাত খাইবা না।” এমনিতে বজলু রেগে আছে। তার উপর সোহাগীর ভাত খাওয়াবার কথা। বজলু রাগ ধরে রাখতে পারল না। সোহাগীর উপর অত্যাচার শুরু করল সে। বজলুর মা এসে বজলুকে বাধা দিল। বলল, “কি হইছে বজলু ? বিয়ের পরের দিন কি শুরু করলি।” বজলু জবাবে বলল, “মা। এই হারামি এক নম্বরের নিমকহারাম। প্রেম করে।”
এ কথা শুনে বজলুর মাও রেগে ফেটে পড়ল। একটু পরে বজলু সোহাগীর আরাল হলে বজলুর মা সোহাগীর উপর রাগ ঝাড়লো খুব আচ্ছা ভাবে। বলল, “বজ্জাত মেয়ে। এ বয়সে প্রেম করিস। কাল সারাদিন কাপড় ধুবি, উঠান ঝাড়বি, পানি আনবি। সব কাজ করবি।” সোহাগী কেঁদে কেঁদে জানাল, “ঠিক আছে।”


এক মাস পরের ঘটনা। সোহাগীর গ্রামে এক যুবক প্রবেশ করেছে। চেয়ারম্যানের ছেলে রাকিব তা দেখে তার কাছে আসল। জিজ্ঞেস করল, “এই যে ভাই। আপনি কি এ গ্রামে নতুন ?”“জ্বি। আমি এসেছি নারী পুনর্ববাসন কেন্দ্র হতে। যারা অবহেলিত নারী, তাদের সেবা করাই আমার কাজ।” যুবকটি জবাব দিল। পরক্ষনেই সে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ভাই, এ গ্রামে কি এমন অবহেলিত নারী আছে?”
একটু রেগে যায় রাকিব। বলল, “যান মিয়া। অবহেলিত নারীর খোজ আপনাকে নিতে হবে না। পারবেন আমার বন্ধুর মনের মানুষকে তার অত্যাচারিত স্বামীর হাত হতে বাঁচাতে।” এবার কি পরিষ্কার হতে পারছেন পাঠক সোহাগী প্রেম করে কার সাথে। যাইহোক, কথাটি শুনেই যুবকটি অবাক হল। জানতে চাইল, তার বিয়ে কোথায় হয়েছে। রাকিব জানাল, পূব পাড়ায়। ওরা দু’জন রওয়ানা হয় সেদিকে।
পথে ওদের সাথে দেখা হয় সোহাগীর বাবার। রাকিব সোহাগীর বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “আসছালামুআলাইকুম চাচা। শরীল কেমন ?” “ভালা না। মাইয়াতার জন্য কষ্ট হয়। ভাবতাছি কালই ওর সাথে দেখা করে আসব।” জবাব দেয় সোহাগীর বাবা। নারী পূণর্বাসন কেন্দ্রের যুবকটি রাকিবের কাছে জানতে চাইল, এনার মেয়েটিই সেই মেয়েটি অর্থাৎ অত্যাচারিত মেয়েটি কিনা। জবাবে রাকিব হ্যা সূচক মাথা নারে। তখনি সোহাগীর বাবা জানতে চায়, “কি হয়েছে আমার মেয়ের ?” জবাবে রাকিব জানায়, “আপনার মেয়ের কিছুই হয়নি।” সোহাগীর বাবাকে শান্তনা দিতে একটা মিথ্যা কথা বলে ফেলল সে।
যাইহোক, সেদিন গল্প করতে করতে বিকেলে ওরা পৌছিল পূব পাড়ায়। রাকিব বাড়ির ভিতরে গেল না। যুবকটি বাড়ির ভিতর গিয়েই হাক দিল, “কেউ আছেন।” সে সময় বাড়িতে কেউ না থাকায় সোহাগীই বের হয়ে এল। যুবকটি সোহাগীকে দেখেই বলল,“আপনিই কি সোহাগী।” “জ্বি। বলুন কি বলতে চান।” সোহাগী জবাব দ্যায়। “আমি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র হতে এসেছি। আপনাদের পাড়ার চেয়ারম্যানের ছেলের কাছে আপনার অত্যাচারের কথা শুনে এখানে আপনার অত্যাচারের কথা শোনার জণ্য আসলাম।” “ও-য়। বসেন।” চেয়ার বের করে দ্যায় সোহাগী। যুবকটি অনেক্ষন সোহাগীর অত্যাচারের ঘটনা শুনল সোহাগীর মুখে। আফসোজও করল। যাওয়ার সময় শুধু বলে গেল, পারলে যেন সে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে যায়। সোহাগী শুধু মাথা নেরে সায় দিল। বাড়ি হতে বের হতেই রাকিব জিজ্ঞেস করল, “কি ব্রাদার। কথা হলো।” “জ্বি।” “চলুন তাহলে সামনে রওনা হই।” “চলুন।” ওরা দু’জন রওনা দেয় সেদিকে সেখান হতে তারা এসেছিল।


নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র। সোহাগী এ কেন্দ্রে আজ তার দুঃখের কথা বলতে এসেছে। সব শুনে কেন্দ্রের মহিলা কর্মকর্তা বললেন, “শুনুন। এ মুহুর্তে আপনি মামলা করতে পারেন।” “মামলা !” “হ্যাঁ মামলা।” সোহাগী সব বুজতে পারল। অপেক্ষা করতে লাগল কবে সে মামলা করবে।
সেদিন দুপুরে বজলু এসে দেখল সোহাগী বাড়িতে নেই। রাগে ফেটে পড়ল বজলু। খানিক পর সোহাগী বাড়িতে প্রবেশ করে বলল, “চিল্লাও ক্যা। কি হইছে ?” “কোটে গেছিলা। কোটে গেছিলা কও।” “নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে।” “ক্যান গেছিলা কও?” “সেটা কি তোমাক কওয়া লাগবি।” সোহাগীও একটু উত্তেজিত হয়ে যায়। এ কথা শুনে বজলু মারতে থাকে সোহাগীকে। শেষ পর্যন্ত সে সোহাগীকে বের করে দেয়।
সোহাগী প্রথমে ভাবল সে আত্বহত্যা করবে। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবল আত্বহত্যা করে লাভ নেই। তারপরেই তার মনে পড়ল সেই যুবকটির কথা যে তাকে আশার বাণী শুনিয়েছিল। সোহাগী ছুটে যায় তার কাছে। সোহাগীকে দেখেই যুবকটি বলল, “কি হয়েছে আপনার ?” “ভাইজান। আপনি প্লিজ আমাকে বাঁচান। আমার স্বামীর অত্যাচার অনেক বেড়ে গেছে।” “ঠিক আছে। আমার সাথে থানায় চলুন। আমি রাকিব সাহেবকেও ডাকছি।” “চলেন।” ওরা পা বাড়ায় থানার দিকে।
সেদিন বিকেলে পুলিশ বজলুকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময়ে রাকিব সোহাগীকে বলল, “মারুফের কাছে জাবি না।” “মারুফ আইছে।” “হ্যাঁ। তোর জন্য বিলের পাড়ে অপেক্ষা করছে।” সোহাগী ছুটে যায় বিলের পাড়ে। মারুফকে দেখে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারল না সোহাগী। প্রিয়জনকে দেখে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সোহাগীর চোখ হতে। মারুফ সোহাগীর হাত ধরল। তার চোখ হতেও পড়তে লাগল আনন্দ অশ্রু।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge