ফ্লাশব্যাক-২ঃ একটি সেতুকাহিনী
মো. শওকত আলী
পুরানো এ্যালবামে এখনও আটকে আছি।ক’টা ছবিতে চোখ আটকে গেল।একটি সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ছবি উঠিয়েছিলাম।মনে পড়ে গেল স্কুল জীবনের কথা।আমি তখন নবম বা দশম শ্রেণির ছাত্র।রংপুরে থাকি।মেজোভাই বুয়েটে পড়েন।একদিন চিঠি পেলাম ওনার কাছ থেকে। মাঝে মাঝে চিঠি পেতাম। এটা করবে,ওটা করবে না,এটা পড়বে, ওটা পড়বে না,ইত্যাদি,ইত্যাদি।উনি ছিলেন আমার ছাত্রজীবনের মেন্টর। স্কুল জীবনে অসম্ভব চঞ্চল ছিলাম। পড়াশোনা,খেলাধুলা, দুষ্টুমি সমানতালে চলতো।কড়া শাসনে আবদ্ধ ছিলাম। মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করতো।কিন্তু আমার ছিল চিকেন হার্ট।ধরপরিয়ে ওখানেই শেষ। আমাদের সময় শুক্রবারে মর্নিংস্কুল হতো।স্কুল শেষে মাঝে মধ্যে বাসায় না জানিয়ে মর্নিংশো তে ইংলিশ সিনেমা দেখতে যেতাম ক’জন বন্ধু মিলে। তাছাড়া, মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালের সরকারি বাসার ফলের বাগান থেকে আম,জাম,লিচু, পেয়ারা কিম্বা যাদুমিয়ার বাসা থেকে ডাব চুরির মিশনও থাকতো শুক্রবার স্কুলশেষে।মেজভাই সেবারে যে চিঠি দিয়েছেন সেখানে উনি লিখেছেন যে ঢাকায় একটা ভালো সিনেমা এসেছে। সিনেমার নাম The Bridge on The River Kwai. রংপুরে মুক্তি পেলে দেখবি।খুব ভালো সিনেমা।সেরা ছবি হিসেবে অস্কার পুরস্কার পেয়েছে।এছাড়াও সাতটি ক্যাটাগরিতে সেরা পুরস্কার পেয়েছে।ছবিটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত।তারপর ছবিটি যখন রংপুরে গেল তখন আর গোপনে নয় রীতিমতো বাসায় অনুমতি এবং টিকিটের টাকা নিয়ে দেখতে গেলাম। সিনেমাটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। ঔপন্যাসিক Pierre Bowlle এর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত।River Kwai থাইল্যান্ডের পশ্চিম অন্চলের একটি নদী মিয়ানমারের একদম বর্ডার ঘেষে। সেই নদীতে জাপানি সেনারা যুদ্ধবন্দী বৃটিশ, অস্ট্রেলিয়ান,ডাচ,আমেরিকান সৈন্যদের বাধ্য করেছিল একটি সেতু নির্মান করতে। সেতু তৈরির সময় অনেককে জীবন দিতে হয়েছিল। কৌশলগত গুরত্বপূর্ণ হওয়ায় বৃটিশরা কিভাবে সেতুটি ধ্বংস করে সিনেমায় তা দেখানো হয়। ২০০১ সালে আমি যখন ব্যাংককে প্রশিক্ষণে তখন সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সাইট পরিদর্শনের ব্যবস্হা করতো।সেরকম একদিন জানতে পারলাম যে আমরা কান্চনবুরি যাবো কাওয়াই নদীর সেতু দেখতে। আমার মনে পড়ে গেল সেই সিনেমার কথা। বেশ রোমান্চিত বোধ হতে লাগলো।তাহলে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার স্হল পরিদর্শন করবো।যেখানে British Lieutenant Colonel Philip Tossy তার বাহিনী নিয়ে জাপানি সেনাদের প্রতিহত করেছিল। ব্যাংকক থেকে কান্চনবুরি আড়াই ঘন্টার মত পথ।মাঝে একবার স্বল্প সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি। থাইল্যান্ড গিয়ে ঐসময় কিছু নতুন বিষয় জেনেছিলাম। যেমন হাইওয়েতে একটানা দু’ঘন্টার বেশি পাবলিক
গাড়ি চালানো যাবে না। মূলতঃ ওয়াশরুমের জন্য বিরতি দিতে হবে।হাইওয়ের পার্শ্বে পেট্রলপাম্পগুলোতে টয়লেটের চিহ্নসহ উঁচুতে মার্ক থাকতে হবে।পেট্রোল পাম্পের সঙ্গে একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থাকতে হবে। ট্যুরিস্ট পুলিশের সঙ্গে পরিচয়ও থাইল্যান্ডে গিয়ে। ৷ সকাল আটটার দিকে রওনা দিয়ে এগারটার মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সেই জায়গায় পৌঁছালাম।সেখানে গিয়ে ব্রিজের দেখা পেলাম।স্টীলের ফ্রেমে তৈরি সেতু। কিছু ছবিও উঠালাম। সিনেমায় দেখা সেই কাঠের তৈরি সেতুর জায়গাটা খোঁজ করলাম, যে সেতুটা বৃটিশরা ধ্বংস করেছিল। এখন ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে দেখি। থাইল্যান্ডবাসীর একটি গর্ব হচ্ছে যে তারা কখনও কারো কলোনি ছিল না।কিন্তু কলোনি না থাকলেও তারা মাঝে মাঝে অন্যদের দখলদারিত্বে চলে গিয়েছিল।তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বাহিনী থাইল্যান্ড দখল করে নিয়েছিলো। সমুদ্র পথে নির্ভরতা কমিয়ে থাইল্যান্ড এবং বার্মার মধ্যে যোগাযোগ স্হাপন করে ভারত পর্যন্ত যাবার জন্য তারা নদীর উপর একটি রেলসেতু নির্মাণ করেছিল।মূলতঃ যুদ্ধবন্দী এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে হাজারো শ্রমিক দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এ সেতু। যুদ্ধবন্দীর মধ্যে যুক্তরাজ্য,নেদারল্যান্ডস, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকও ছিল। বহু প্রাণহানি ঘটে এ সেতু তৈরিতে।তাই এটা Death Railway নামেও পরিচিতি পায়।মান্ধাতা হাতুড়ি , শাবল দিয়ে পাহাড়ের পাথর, বন-জংগলের গাছ কেটে, অসহ্য ভেপসা গরম, সহ্য করে,খাদ্যাভাব,অসুখ এবং চিকিৎসার অভাবে এদের অনেককে প্রাণ দিতে হয় অঘোরে।সিনেমায় দেখানো কাঠের সেতুর মতো একটি সেতু ছিল নদীর উপরিঅংশে যেটি স্টীলের সেতু তৈরির গতিকে বাড়ানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল।তবে নদীর পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হবার কারনে যুদ্ধোত্তর সময়ে থাই কর্তৃপক্ষ ভেঙে সেটা ভেঙে ফেলেছিল। ১৯৪২ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ করা হয় সেতু তৈরির কাজ।মিত্রশক্তি অনেকবার বোমা মেরেছিল সেতুটিতে।বারবার যুদ্ধবন্দীদের দ্বারা মেরামত করে নিয়েছিল জাপানিরা। মজার বিষয় হলো River kwai এর উপর কোন ব্রিজ কোনদিন ছিল না। এটি Mae Klong River এর উপর ছিল যেটির কিছু অংশের নাম করা হয়েছে Kwai Yai.জেনেছিলাম সিনেমাটি প্রশংসিত হলেও এর তথ্যবিভ্রাট নিয়ে পরবর্তীতে যথেষ্ট সমালোচনা হয়।ছবিটির শ্যুটিংও হয়েছিল শ্রীলংকায়।
Leave a Reply