লতিফুর রহমান এর একগুচ্ছ কবিতা
সন্ধ্যা নামলেই
সন্ধ্যা নামলেই আজকাল শহরটা ছেড়ে দেই,
উচ্ছিষ্ট প্রানীগুলোর দখলে।
ঘরকুনো মানুষের মতো, জবুথবু হয়ে,
জানালায় দাঁড়িয়ে চোখ রাখি রাস্তায়।
হু হু করে ছুটছে কুকুর, শেয়ালের দল।
ঘেউ ঘেউ আর কামড়াকামড়ি করে,
সব অলিগলি, পথ ঘাট করেছে দখল।
আর আমরা লুকিয়েছি শেয়ালের খালে।
বউয়ের আঁচল ঘেসে, প্রেয়সীর চুলের আগা ধরে ধরে,
মাপানো পথে,
চক্রাকারে, চক্রাকারে ঘুর্নায়মান লাঠিমের,
একই বিন্দুতে পোষ্য প্রানীর মতো।
অবলা শিশুদের মতো,
দাড়ি, কমা, সেমিকোলনের জীবন।
আমার বন্ধুর তিলোত্তমা এখন ভুতুড়ে নগর,
ভুত প্রেতাত্মা রা রাত্রির আঁধার কালো মেখে মেখে,
উদ্দাম নৃত্য করছে আজকাল।
আমার বন্ধু তার তিলোত্তমা কে ফেলে পালিয়েছে,
দুর নগরের, মায়ের আঁচল তলে।
তুচ্ছ
অহমিকা গুলো আজকাল ভেঙে চুরমার,
লজ্জিত, বিবসনা।
খানখান হয়ে টুকরো টুকরো কাচের মতো,
যত্রতত্র ছড়ানো, ছিটানো, এলোমেলো।
অনুজীব বিজ্ঞানী আর ডাক্তারের টেবিলে।
লজ্জিত, হেট মুখে অপলক তাকিয়ে টেলিভিশনের,
নিচে বড় বড় অক্ষরে ভেসে উঠেছে সেই সব নাম,
তোমাদের মতো সেই সব মানুষ।
আমরা যারা আসন পেতে রেখেছিলাম,
ভগবানের কাতারে।
তুমি রোগমুক্তির উপায়, অবলম্বন, মাথার উপরে ছাদ।
অজেয় ভেবেছিলাম তোমাকে আমরা যারা,
আজ তোমার মলিন বদন, হাসপাতালের বিছানায়, মর্গে,
কফিনে মোড়ানো অযত্নকৃত লাশের সারিতে, জলন্ত আগুনে,
পুড়ে পুড়ে ছাই রং।
আজ তকমা গায়ে খচিত হলো
তুমি ব্যর্থ ব্যর্থ ব্যর্থ ব্যর্থ ব্যর্থ ব্যর্থ।
অসার উচ্চাভিলাস, অহমিকা গুলো আজকাল ধুলোয় গড়াগড়ি,
স্রষ্টার নগন্য ক্ষত মেরামতের জন্য,
তুমি চিরকাল রয়ে থাকবে জ্ঞানহীন, অজ্ঞ।
এবার সময় এসেছে ফিরে,
কপালে আলপনা একে একে বলে দাও,
তুমি তুচ্ছ, তুচ্ছ, তুচ্ছ, তুচ্ছ, তুচ্ছ।
কোয়ারেন্টাইন (সঙ্গরোধ)
সেই সেদিন একটা দুপুর,
নিঃশব্দে তুমি বিদায় জানালে তাকে,
সেদিনের সেই দুপুরের মতো,
রক্তক্ষরণ ঘটেনি আর আগে।
দশটা বছর, একটা বিছানা, দুটো বালিশ,
রাত্রির ঘোর আধারে, সীমানা ছাড়ো,
তুমি আর সে,
একটা বালিশে দুটো মাথা,
তবুও কিঞ্চিৎ ফাঁকা জায়গা পড়ে থাকে,
একটা বালিশে।
এভাবেই তুমি আর সে,
সেই কতকাল পুইয়ের লতার মতো পেচিয়ে আছো,
তোমরা দুজন।
আজ সেই একটা দুপুর এলো।
তোমার বাড়ির সবচেয়ে অগোছালো, যত্নহীন,
পরশ লাগেনি যে ঘরে। তোমার কঞ্চির মতো সুন্দর,
আংগুলের ডগা গুলো ছুয়ে দেখেনি এতকাল।
আর মনুষ্য প্রজাতির বসবাসের অযোগ্য ঘোষিত ঘরটা,
তুমি আংগুল তুলে দেখালে আজ।
তোমার টলমল দুটো চোখ,
চোখের গভীরে বাধের মতো উপচানো জল।
তার মুখে নিস্প্রভ শুকনো মেকি হাসি,
তুমি আর সে জানো সেটা কতটা অপ্রতুল,
শুধু তোমাকে ভোলানোর জন্য।
আজ সেই একটা দুপুর এলো।
দুটো দরজা বন্ধ, দক্ষিণের জানালা শক্ত করে আটকানো,
সেই জানালার কাঁচ বেয়ে উপচানো রোদ,
দুরের নীলাকাশ, মেঘের বুকে পাখির স্বাধীন ডানা ঝাপ্টা।
আর সে কতটা উদগ্রীব পরাধীন মানুষের মতো হাহাকারে।
স্বেচ্ছায়, নিঃসঙ্গ, নিসর্গ, নিঃশব্দে সঙ্গরোধ।
তুমি আর সে কতটা একলা করেছ নিজেকে।
একটা বিছানা, দুটো বালিশ, তোমার ঘুমহীন শয্যা,
খা খা শুন্য একটা বালিশ।
মাঝরাতে আবার কাচের দরজার কাছে গিয়ে দাড়াও,
চোখাচোখি হয়, চোখ পড়ে দুজনের।
গলগল করে,
অঝোরে কাঁদো তুমি আর সে,
শিশুর মতো তোমরা দুজন।
জ্বরের প্রকোপে জবুথুবু হয়ে হাত পা মুড়ে,
কাতরাতে কাতরাতে সে মরছে আজ।
তোমার হাতটা তার কপাল ছুতে আহাজারি,
বুকভাঙা আত্মচিৎকার সারা বুক জুড়ি।
বিদায়ের বেলা
এমনি ভেবেছিনু এতকাল,
সব শুরুর আছে বিদায়কাল।
আজও তাহা ভাবি, বিদায়ের বাশি বাজিবে জানি,
আজ যে রহিছে, কাল হবে বিদায়, সেটা নিয়ত মানি।
তবু জেনে শুনে কিছু বন্ধনের লোভে রোজ পড়ি,
বিদায়ের ঘন্টা বাজিবে কবে, সে ভাবনা হারি।
তবে সব বিদায় যেন তোঁমারই মতো হয়,
যেতে যেতে কিছু স্মৃতি তুমি একে দিলে হায়,
এমন বিদায় ত সকলেই চায়।
নেই আজ অভিযোগ, অনুযোগ, অপবাদ, ছিটেফোঁটা,
বন্ধনের আজ নেই ব্যাকুলতা,
ছিন্ন মন, ছলছল চোখে,
কিছু অশ্রু আজ দুজোড়া চোখে,
হোক না অজ্ঞাতে বিসর্জন।
বিদায় বেলা যেন এমনই হয়।
একটা শব্দের আঘাতে
সে তো বলে মিছামিছি , আমি হিসাব কষে রাখি,
হৃদয়ের দেয়ালে আলপনা আঁকি,
নিখুঁত, নিখাদ সত্যের কালি গুলে।
কিন্তু কিছু প্রস্নের দাড়ি, কমা, সেমিকোলনের,
আলতো আঁচড় দাগ কাটে যখন,
আমার আলপনা বুক পটে।
বিস্রী কালিমায় ভন্ডুল, ছিন্নভিন্ন,
একটা শব্দের আঘাতে।
আমি তাকাই একুল, ওকুল,
আমার দু ধারে অট্টরব ভেসে উঠে বাতাসে,
তার অভিনয় কলাকৌশলের, নিখুঁত ঘাতে,
রক্তাক্ত হয় আমার যত্নে গাথা,
আলপনার বুক চিরে।
আমি সত্যরে খুজি, আপনার তরে,
ঘুপটি মেরে বসে আছে নাকি,
মিথ্যে রুপি আমার কলবে
আমার সত্যর রুপ ধরি?
Leave a Reply