বই আলোচনা : প্রাণতোষ ঘটক এর আকাশ পাতাল
সুতপা দত্ত দাশগুপ্ত
আকাশ পাতাল
লেখক… প্রাণতোষ ঘটক
প্রকাশনা… ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং লিমিটেড
বইটা ছিলো ছেঁড়া খোঁড়া, পাতাগুলো মুচমুচে, অল্পস্বল্প কোন ভাঙা , হালকা হলুদ পাতায় বহুপঠনের স্মৃতি । আর হবে নাই বা কেন? রবিবার দুপুরে আনন্দবাজার পত্রিকার এপ্রান্ত ওপ্রান্ত মুখস্হ হয়ে গেলে বাবার একান্ত সঙ্গী এই ছেঁড়া ছেঁড়া হলদে পাতা ব ইটা। নিবিড় মনোযোগে প্রতিদিনের মতোই চোখ বোলাতে থাকেন বাবা… কারণ?
বইটা ছিল আমার বাবার অমূল্য সংগ্রহের একটি । উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত । প্রথম পাতাটি অবলুপ্ত, শেষ পাতাটিও ছেঁড়া খোঁড়া
কোনোমতে আটকে রেখেছি ব ইটির সাথে যাতে শেষটুকু অন্ততঃ পড়া যায়… কোনো একটা পাতায় পেন্সিল দিয়ে হালকা করে লেখা ছিল…তাই জানতে পারলাম বইটার নাম আকাশ পাতাল…সেকালের জমিদার বাড়ির ঘটনা।
গল্পের নায়ক কৃষ্ণকিশোর…তার সূদর্শন চেহারা, বুটিদার বেনিয়ান, কলিদার চাপকান…মুক্তোর মালা, উষ্ণীষ…বাবুয়ানি
পাঠ চর্চায় অনীহা, নেশাগ্রস্ত আচরণ, বাইজি গমন, বেড়ালের বিয়ে দিতে ঘড়া ঘড়া টাকা অপচয়, বিলাসিতা …..সবকিছু নিয়ে সেকালের একটা স্পষ্ট রেখাচিত্রণ…
গৃহিণী কুমুদিনী ছেলের আচার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে কাশীবাসিনী ….সাধুমার আশ্রয়ে দিনাতিপাত করেন । অনন্ত অভিমান তাঁকে ছেলের মুখদর্শনে বিরত রেখেছে … কিন্তু দশাশ্বমেধ বা মণিকর্ণিকার চিতার দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে ভাসে ….ফেলে আসা ছায়া ছায়া স্ংসার …মায়া
বৌ আনা হলো মতি ফেরাতে …. অপূর্ব সুন্দরী ,অপরূপা কিশোরী…..ছেলের মতি ফিরলো না …..সে ছলাকলা পটিয়সী রূপোপজীবিনী গওহরজান বিবির রূপমুগ্ধ …. শুনতে যায় তার মিষ্টি গলায় কালোয়াতি গান , পান করে তার রূপ সুধা … সে তাকে রেঁধে খাওয়ায় খানদানী মুসলমানী মূর্গ মুসল্লম …..আর বাঁধে বেশরম প্রেম পাশে …… বিকেলে গলির বেলফুল ওয়ালা কোনদিন ফুল বিক্রি করতে এলে … মালিক খুশী হয়ে তার সব ফুল কিনে নেন …. গওহরজান বাঈ এর চাঁদমুখে হাসি ফুটবে বলে … তার খুশীর জন্য এমনকি বৌ এর জড়োয়া টায়রা চুরি করেও তার হাতে দেন …. এমন করে মোহর ছড়িয়ে বেঁধে রাখতে চান ভালোবাসার পলকি হীরে…আসলে ঘরের কোণে রাখা ঘড়াভরা ঠান্ডা জল তৃষ্ণা মেটাতে পারে কিন্তু আতরদানের সুগন্ধি পিচকিরি জল গন্ধে মাতাল করে দেয়….তেষ্টা বাড়ায় আকন্ঠ….
কৃষ্ণকিশোর ও তেষ্টায় ছটফট করে
আর আছে লোভী বাড়িওয়ালি মাসি সৌদামিনী … পয়সার জন্য গওহরকে তুলে দেয় ইচ্ছার বিরুদ্ধে খেটে খাওয়া মানুষের হাতে …ভালোবাসার মানুষের হয়ে থাকতে দেয়না তাকে …চিত্র পাই পুরোনো কলকাতার ,গরাণহাটার …বেণেদের দোকানপাতি, পুজোর সেল , সাড়ে বত্রিশ ভাজা, জলকচুরি আর কাটা কাপড় ওয়ালার তুমুল ডাকহাঁক … যাত্রা , পাঁচালি, পুতুল নাচ , অপেরা …. ঘরবাড়ির নাম কলকাতা
আছে এলোকেশী …. রাজোর বিশ্বস্ত বয়স্ক দাসী … রাজোর বাপের বাড়ির লোক … খাওয়া-দাওয়া, সাজনগোজন, মনের দুটো কথা বলা ,সব কিছুতেই রাজোর সই ….. আছেন হেমনলিনী ….রাজেশ্বরী , রাজোবৌ এর ননদ…তার মিষ্টি উপস্থিতি , আনন্দ, বেদনা , আশঙ্কার মধ্যেও দেবরের সাথে লুকোচুরি মিষ্টি প্রেমে ভালোবাসার পরশ খুঁজে পাওয়া, উত্তরণ ….অর্গান বাজিয়ে রবিবাবুর গান গাওয়া ,এমনকি রকমারী সাজগোজের মধ্যেও জীবনকে জড়িয়ে রাখার ওতপ্রোত অভ্যাস …..সব কিছু নিয়েই তার সস্নেহ ছেয়ে থাকা… অনন্তদার বিশ্বস্ততা, বড় বাড়ির বাবুদের বিলাসিতা , বাবুয়ানি চালচলন…আশীর্বাদী জড়োয়া টায়রার হীরেকুচির মতোই চিকমিকে ….আছেন ধীরোদাত্ত নায়ক কাকাবাবু… প্রখর জ্ঞানী , বিদ্বান….দেশমাতৃকার পূজারী কৃষ্ণকান্ত …পাশের বাড়ির মিষ্টি সুন্দরী বামুনের মেয়ে পূর্ণশশীর প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা ….অপরিনত, অপূর্ণ কিন্তু অপূর্ব ,
আছেন দন্তহীন ঠাগমা ….রাজোর প্রতি অবিমিশ্র স্নেহে …..
পড়তে পড়তে চলে যাই সেকালের অভ্যাসে…চিত্রণে…. বঙ্কিমী কথকতায় হারিয়ে ফেলি পাঠকমন… বুঁদ হয়ে থাকি এলিজাবেথ আর্ডেনিয়ার ৪৭১১ র সুগন্ধে…সেকালের কলিকাতা চলিতেই থাকে… নাড়িতে নড়িতে …
Leave a Reply