বাংলাভাষা : অবজ্ঞা ও অহেলা যার বিধিলিপি
ড. এ. আই. এম. মুসা
পৃথিবীতে সম্ভবত বাংলাই একমাত্র ভাষা যাকে রক্তাক্ত পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টা করতে হচ্ছে। যাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে বাহির এবং ভিতর উভয় শক্তির বিরুদ্ধে। বাহির শক্তি তথা সম্রাজ্যবাদী রাজভাষা ও রাজশক্তি বাংলা ভাষাকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং প্রতিরোধ করেছে তা এই নিবন্ধে আমরা আলোকপাত করব না বরং এর ব্যবহারকারীর আন্তর মানসিকতা ও হীনমন্যতা একে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং করছে তারই দু’একটি দিক এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করর। অতীতে তো অবশ্যই ; এমনকি বর্তমানেও সম্রাজ্যবাদী বিদেশি ভাষা ব্যবহার করাকে আমরা আভিজাত্য মনে করি। আমাদের এই হীনমন্যতাকে অবলোকন করেই হয়ত আব্দুল হাকিম প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণার সাথে উচ্চারণ করেছিলেন-
যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
যে কোনো সচেতন বাংলাভাষী আব্দুল হাকিমের মতো আমাদের আচরণে ও মানসিকতায় এখনো ক্ষুব্ধ হতে বাধ্য। কেননা, এখনো আমাদের অনেকেই বাংলা নয়, অন্য ভাষা ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে নিজেকে অভিজাত মনে করি। বায়ন্নের গৌরবময় আত্মত্যাগের পরও আমাদের সমাজের তথাকথিত উচ্চবিত্তরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন না এবং তাদের সন্তানদের বাংলা মাধ্যমে পড়াতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন না। শুধু উচ্চবিত্তরা কেন, ভাষার নামের যেই রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক অংশই এখনো বাংলা ব্যবহার করে না। রাষ্ট্রীয় আইন থাকার পরও রাষ্ট্রীয় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে কেউ কুণ্ঠিত হন না।
তবে আমরা যারা দায়ে পড়ে বাংলা ভাষা ব্যবহার করি তারা যে খুব একটা আন্তরিকতার সাথে বাংলা ব্যবহার করি, এমন নয়। আমাদের শিক্ষিতজনের অনেকেই বাংলা বর্ণমালা পর্যন্ত চিনি না। এ কথা শুনে অনেকেই আঁতকে উঠতে পারেন। কিন্তু এটি সত্য। দু’একটি উদাহরণ দিলেই আমার কথার সত্যতা খোঁজে পাওয়া যাবে। আমরা যারা কম্পিউটার ব্যবহার করি এবং বাংলায় টাইপ করি, তারা সবাই জানি প্রবর্তনের একটি সংস্করণে ‘আকাক্সক্ষা’ ’আপরাহ্ণ’ ইত্যাদি শব্দ যথাযথ বানানে লেখা যেত না। এর কারণ ‘ক্সক্ষ’ ’হ্ণ’ যুক্তাক্ষর দু’টির গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সফ্ট ওয়্যার প্রোকৌশলি সাহেব সচেতন ছিলেন না বা জানতেন না। ‘ষ্ণ’ যুক্তাক্ষরটির গঠনও ঐ সংস্করণে ভুল ছিল। ঐ সংস্করণে ‘ষ্ণ’ লিখতে হতো ‘ষ+ঞ’ দিয়ে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে ‘ষ্ণ’ লিখতে হবে ‘ষ+ণ’ দিয়ে। বিজয় কী বোর্ডের অন্য কোনো ত্রুটি আমার চোখে ধরা না পড়লেও ‘ষান্মাসিক’ শব্দটি এই কী বোর্ডে যথাযথ বানানে লেখা যায় না। যে শব্দটি এখানে লেখা হয়েছে এর গঠন প্রক্রিয়া হলো ঃ ষ+আ+ন+ম+আ+স+ই+ক । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ণ-ত্ব বিধানের নিয়ম মেনে বানানটি হবে – ষ+আ+ণ+ম+আ+স+ই+ক (ষাণ্মাসিক)।
অন্য একটি ঘটনার কথা বলি। একবার আমাকে একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের সদস্য (বিষয় বিশেষজ্ঞ) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই বোর্ডের সভাপতি হলেন ইউএনও সাহেব। সিদ্ধান্ত হলো যোগ্য (!) প্রার্থী খোঁজে বের করার জন্য মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষাও নেয়া হবে। ইউএনও সাহেব আমাকে একটি লিখিত প্রশ্ন করতে অনুরোধ জানালেন। আমি একটি প্রশ্ন তৈরি করলাম। এতে বিভিন্ন প্রশ্নের সাথে একটি প্রশ্ন ছিল এরকম- ‘নিচের যুক্তাক্ষরগুলো বিশ্লিষ্ট করে লিখুন- ক্ষ, হ্ম, ক্ষ্ম, ক্ষè, হ্ণ, ষ্ণ, জ্ঞ, ঞ্জ, ঞ্চ, ঞ্ছ’। ইউএনও সাহেব প্রশ্ন দেখে বললেন, ‘এটা কী প্রশ্ন তৈরি করেছেন? আপনি কি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ দিবেন? তাঁরা তো কলেজে পড়াবেন। এই সহজ প্রশ্নের উত্তর সবাই পারবে।’ আমি বললাম, ‘পারলে তো ভালই’। উনি অনেকটা হুকুমের স্বরে বললেন-‘এই প্রশ্ন বদল করে কঠিন প্রশ্ন করেন।’ আমি বললাম, ‘এই প্রশ্নের উত্তর পারলে সবাই সমান নম্বর পাবে এবং অন্যান্য প্রশ্নের মাধ্যমে মেধা যাচাই করা হবে।’ তারপরও তিনি প্রশ্ন বদল করার জন্য বললেন। আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে বললাম, ‘প্রয়োজনে অন্য বিষয় বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসেন, আমি প্রশ্ন বদল করব না।’ অবশেষে আমার ইচ্ছারই জয় হলো। ১০/১২ জন চাকুরী প্রার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেন। সবাই উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু একটি-দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া কেউই শুদ্ধ উত্তর লিখতে পারলেন না। দেখলাম ইউএনও সাহেব খাতাগুলো নিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন উল্লিখিত প্রশ্নের সবাই ঠিক উত্তর লিখেছেন কি না। আমার প্রশ্ন প্রণয়নের ত্রুটি ধরাই ছিল তাঁর এই কৌতুহলের কারণ। তারপর দেখলাম তিনি নিজে এই প্রশ্নের উত্তরটা লিখেছেন এবং আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘দেখেনতো প্রফেসর সাহেব, এই সোজা উত্তরটা এম এ পাস ছেলেরা পারল না; আমার উত্তরটা হয়েছে কি না ?’ আমি দেখলাম একটি বাদে নয়টি যুক্তাক্ষরই ইউএনও সাহেব ভুল লিখেছেন।’ তাঁর এই ত্রুটি ধরিয়ে দেয়ার পর তিনি বললেন, ‘অনেক ছোট বেলায় পড়েছি তো এই জন্য ভুলে গেছি।’ এরপর থেকে বুঝলাম ভুলে যাওয়া মহত্তের লক্ষণ! না, কথিত ইউএনও সাহেবকে ছোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়। এটি তাঁর যোগ্যতার অভাব নয়, বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার প্রতি অবজ্ঞার ফল।
শুধু বর্ণমালা নয়, বাংলা বানানের বিষয়েও আমরা খুব উদাসীন। ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষার বানানের বিষয়ে আমরা যতটা সচেতন, বাংলা বানানের প্রতি আমরা ততটাই উদাসীন। ভাবি, বাংলা বানান একরম লিখতে পারলেই হলো, বুঝতে পারলেই হলো। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। বিসিএস পাস করে দু’তিন মাস আগে কলেজে যোগদান করেছি। একদিন একটি পরীক্ষায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করছি। এক ছাত্র নকল করতে গিয়ে আমার এক সহকর্মীর হাতে ধরা পড়ে। তিনি ছাত্রটিকে বহিষ্কার করার জন্য খাতার উপরে অধ্যক্ষ বরাবর লিখলেন-‘ছাত্রটিকে ‘ঊীঢ়বরষ’ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’ খাতাটি নিয়ে নোটিস করার উদ্দেশ্যে আমি অধ্যক্ষ কক্ষে গেলাম। খাতার উপরে ‘ঊীঢ়বরষ’ বানানটি দেখে সিনিয়র একজন শিক্ষক বললেন, ‘আজকাল ছেলেরা যে কোথা থেকে লেখাপড়া শিখে এসেছে, একটি ইংরেজি বানান শুদ্ধ করে লিখতে পারে না।’ এতক্ষণে আমি লক্ষ করলাম, দেখলাম ‘ঊীঢ়বরষ’ বানানটিতে একটি ‘র’ বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। আমি লজ্জিত হয়ে পরীক্ষার হলে চলে এলাম। কতক্ষণ পরে অধ্যক্ষ স্বাক্ষরিত বহিষ্কারের নোটিস এলো। দেখলাম নোটিসটিতে ‘বহিষ্কার’সহ সাতটি বানান ভুল। একটি বাক্যও ভুল আছে। আমি নোটিসটি নিয়ে আবার অধ্যক্ষ কক্ষে গেলাম। দেখলাম, সেই সিনিয়র শিক্ষক;যিনি এই নোটিসটি লিখেছন; তখনও অধ্যক্ষের সামনে বসে আছেন। সকল প্রকার আদব বিসর্জন দিয়ে বললাম, ‘স্যার, আপনারা যে কোথা থেকে লেখাপড়া শিখে এসেছেন, বাংলা বানানও শুদ্ধ করে লিখতে পারেন না।’ অধ্যক্ষ খুবই বিব্রত হলেন। কিন্তু সেই শিক্ষক অবজ্ঞার সাথে বললেন, ‘আমারা তো বানানগুলো এরকমই লিখি। আর, বাংলা বানান ভুলের কী আছে? বুঝতে পারলেই হলো।’ না, এটি সেই শিক্ষকের দোষ নয়, সমস্ত জাতিই আমরা তা মনে করি। আর মনে করি বলেই যত্রতত্র বানান ভুলের মিছিল দেখি। সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পাঠ্যবই ও পত্র-পত্রিকা সব স্থানেই বাংলা বানানের প্রতি অবজ্ঞা লক্ষ করা যায়।
জাতি হিসেবে আমরা এমন একটি জাতি যারা ভাষাকে আশ্রয় করেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেছি। এই ভাষাকেই যদি আমরা অবজ্ঞা করি তা হলে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হতে বাধ্য। এ জন্যই বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র’ গ্রন্থে উচ্চারণ করেছেন- ‘…এভাবে যদি এগুতে থাকে বাঙলাদেশ, তাহলে বিশ ও একুশশতকের অনেক দশকে বাঙলা ভাষা ও তার শোষিত মিত্রদের, সাধারণ মানুষের, প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। বাঙলার শোষিত শ্রেণী, প্রগতিশীলতা ও বাঙলা ভাষা একই সূত্রে গ্রথিত, এ-তিনের প্রতিষ্ঠা ঘটবে একই দিনে। এর আগে শক্তির প্রতারিত উৎসরা শাসকসম্প্রদায়ের কাছ থেকে পাবে শুধু চমৎকার বাক্য, সময়োপযোগী স্তুতি, স্নিগ্ধ প্রতারণা, ও মাঝেমাঝে প্রচণ্ড উৎপীড়ন।’
তাই আমাদের উচিত একুশে ফেব্রুয়ারির আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে এর মর্মকে উপলব্ধি করা; বাংলাভাষাকে ভালবাসা এবং জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া।
Leave a Reply