রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ০৬:৩৯ পূর্বাহ্ন

পথে পথে সারাবেলা-সোহানুর রহমান শাহীন

পথে পথে সারাবেলা-সোহানুর রহমান শাহীন

পথে পথে সারাবেলা
সোহানুর রহমান শাহীন

পৌষ মাসের মধ্যবর্তী সময়। শীত জেঁকে বসেছে প্রকৃতির সবুজে। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। তখন ন’টা বিশ। ছুটির দিনের শীতসকাল! তারপরও থেমে থাকতে পারে না একদল ছুটন্তিস যুবকের উচ্ছল খেয়াল। আমাদের খুব ঘনিষ্ট একজন কবি ও সরকারি কর্মকর্তার আমন্ত্রণেই স্বল্পমাত্রায় নৌকা ভ্রমনের কথা ছিল, পুবের জেলায়। তাঁর বিশেষ ব্যাস্ততায় হঠাৎ করে সেই ভ্রমণের তারিখ পরিবর্তনের বিনয় আসে। যদিও এর আগে তার দেয়া নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তন করতে হয়, আমাদের চারজনের ছেলে-মেয়ের ভর্তি পরীক্ষার কারণে। সরকারি কর্মকর্তা বলে কথা, কখন কোন ব্যাস্ততা এসে ছুটিতে ছোবল মারবে, বোঝার উপায় নেই। বুদ্ধি বিশেষজ্ঞ জাকির আহমদ এর ওপর দায় পড়েছিল আমাদের একত্রিত করতে। একত্রিত হয়েছিও নৌকা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। কবি ফিরোজ কাওছার মামুন নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে তার ব্যক্তিগত ‘টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার’ গাড়িতে তুলে নিলেন আমাদের। সামনে দুজনের জায়গায় দুজন, পেছনে চারজনের স্থলে ছ’জন। শীত বলে সম্ভব হয়েছে সিটের অপ্রতুলতাকে বরন করা। যে যার মতো যুতসই করে বসেছি। গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে রঙধনু সম্পাদক জাকির আহমদ সংক্ষিপ্ত ব্রিফ করে জানালেন একরাশ হতাশার খবর। আবার চমকপ্রদ অন্য এক খবরে সবার চোখেমুখে শিশিরবিন্দু চিকচিকে জ্বলে ওঠে, ‘নির্ধারিত যাত্রা বাতিল হয়েছে, তো কি হয়েছে। আমরা অন্য কোথাও ভ্রমণ করছি।’ সবার মতামতে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা ‘সোনাহাট স্থলবন্দর’ পরিদর্শন এবং সে পর্যন্ত যেতে যেতে বিভিন্ন কবি লেখকদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ। ভ্রমণের নাম ‘পথে পথে সারাবেলা’ নামে তৎক্ষনাৎ ছড়াকার শরিফুল আলম অপু নামকরণ করে দেয়।
আমাদের রওয়ানা কামারপাড়া বাসষ্ট্যান্ড সংলগ্ন আমার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের সামন থেকে। গাড়ি ছুটছে শাপলা চত্বর, সাতমাথা, কাউনিয় পেরিয়ে। শীতের পরম ছোঁয়ায় কোমল হয়ে যাওয়া পিচঢালা সড়কের বুক চিরে। পলায়নপর সূর্যের আড়ালে কুয়াশার ঘনঘটা। না মেঘ, না রোদ্দুর। ছুটে চলা গাড়িতে হঠাৎ উদয় হলো পলিথিন ব্যাগে পেঁচানো মুড়ির মোয়া। জাকির আহমদ সেই মোয়া হাতে নিয়ে জানতে চায়- ‘পান খেয়েছেন কে কে।’ আমি এবং মেহেদী হাসান শাপলা দুজনে পান খেয়েছি, আমাদের সরল স্বীকারোক্তি পুঁজি করে অনায়াসে সে বলে ‘আমরা আছি আটজন, পান খেয়েছেন দুজন, বাকি থাকলো ছয়জন, এখানে মোয়া আছে ছয়টি।’ এমন হিসাবের ঝনঝনানিতে সবাই খিল খিলে হেসে গড়াগড়ি খাবার উপক্রম। কী দারুনভাবে আট জনের মাঝে ছয়টি মোয়ার ভাগ-বাটোয়ারা, আবার সবাই একটি একটি করে পাচ্ছে।
আমাদের এমন বণ্টন বিনিময় যখন তুমুলে তখন গাড়ির স্টার্ট বন্ধ! কী হলো মামুন, মামুন ড্রাইভিং সিট থেকে মাথা পিছনে ঘুরিয়ে সবার উদ্দেশ্যে ঠাট্টার ছলে বলে- ‘স্টপেজ শেষ, নেমে পড়েন।’ সামনের গ্লাস ভেদ করে চোখ যখন তিস্তা সেতু দৃষ্টি কাড়ে, তখন বুঝতে পেরেছি, সেলফিবাজ পাবলিক সকালের মনোরম দৃশ্য কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নয়। গাড়ি থেকে নেমে ক্যাচ ক্যাচ করে ছবি তোলা শুরু করেছে অপু আর মামুন। ছবিতে পোজ দিতে কারোরই বিন্দুমাত্র অনিহা নেই, বিকশিত দন্ত উপস্থাপনই মুখ্য। সেতুর নিচে নাম না জানা কতো পাখি, আধমরা তিস্তার বুকে চর জেগেছে, সেখানে ধান থেকে বীজতলার কাজে ব্যস্ত চাষি, পাখি আর চাষির বন্ধুতে তৈরি হয়ে আছে অসাধারণ এক আবহ। মনকাড়া মনোরম দৃশ্য পিছে ফেলে গাড়ির চাকা সামনের দিকে ঘুরছে আমাদের সাথে নিয়ে। উল্টো দিক থেকে আসছিল সেনাবাহিনীর সারিবদ্ধ গাড়ি, সম্ভবত প্রশিক্ষণ শেষে ফিরছিলেন সৈনিক দল। হঠাৎ ফিরতি গাড়িগুলো থেকে একের পর এক আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করে স্যালুট দিচ্ছিলেন ড্রাইভাররা। আমরা সবাই অবাক এবং হতবাক। বেশ কিছুক্ষণ ভাবনার জালে আবদ্ধ থেকে স্যালুট দেওয়ার কারণ আবিস্কার করে যা পাওয়া গেল, ‘টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার’ এই গাড়িটি সেনাবাহিনীর তাই গাড়িটিকে সম্মান প্রদর্শনার্থে ড্রাইভাররা স্যালুট করেছে। সেনাবাহিনীর মেয়াদ উত্তীর্ণ গাড়িটি অকশনে কিনে ব্যাবহার করছেন ফিরোজ কাওসার মামুন। কে কেনো কখন কাকে স্যালুট দিলো সে হিসাবের খাতা আপাতত বন্ধ রাখা হলো। এ যাত্রায় অনানুষ্ঠানিকভাবে অপুর ওপর দায় পড়লো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এবং আমাদের গ্রুপে সব ছবি পোস্ট করা। যেই কথা সেই কাজ। গ্রুপে ছবি পোস্টের পর রিপ্লাই এলো, কবি আসহাদুজ্জামান মিলনের পক্ষ থেকে। মিলন এ পথেই সারথি হতো, যদি অফিসিয়াল মিটিংয়ে ঢাকা যেতে না হতো। আমরা সবাই মিলনের অভাব অনুভব করছি। কবি ডা. ফেরদৌস রহমান ছিলেন সারাবেলা অনলাইন সারথি হয়ে, ছবি দেখে দেখে রসালো মন্তব্য করতেও কার্পণ্য করেননি বিন্দুমাত্র। ফেসবুকের এমন খবর দেখে কবি ও সূত্রপাত সম্পাদক শামসুজ্জামান সোহাগের বন্ধুপ্রতিম ব্রাক প্রোগ্রাম অফিসার তুহিন আলম কুড়িগ্রাম প্রবেশদ্বার খলিলগঞ্জে পথরোধ করেন চায়ের নিমন্ত্রণে, এমন খবরে খুশিতে গদগদ কবি ও চর্চাপদ সম্পাদক মজনুর রহমান। কারণ, তার দুই নাম্বার জরুরত আদায় সময়ের দাবীতে পরিণত হয়েছে। চা নিমন্ত্রণকারী বন্ধু একশ গজ দূরত্বের নিজ অফিসে মজনুর রহমানের এহেন কর্মসম্পাদনের সু বন্দোবস্ত করে কৃতার্থ হন। রাস্তার পাশে চা পর্ব চলছিল মজনুকে ছাড়াই, আমাদের খবর পেয়ে অফিসের আরো তিন-চারজন যোগ দিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুললেন। মজনু ফেরে না! কিছুকক্ষণ পর ফোন দিলাম, ফিরতি বার্তায় মজনু জানায়- ‘ভাই আমার তো ইয়ে হয়ে গেছে, সোহাগ ভাই গল্প করছেন একজন পরিচিত নারী কর্মকর্তার সাথে।’ পাশে ফিরে দেখি সত্যিই তো সোহাগ নেই! কখন পাশ কেটে সেখানে গেছে টেরই পাইনি। অথচ তার বন্ধু আমাদের সঙ্গেই, চায়ের আড্ডায়।
কুয়াশাকে বধ করতে ব্যাস্ত এগারোটার লজ্জাময়ী সূর্য। ইতোমধ্যে আমাদের শরীর থেকে কিছু শীতের কাপড় মুক্তি পেয়েছে। মজনু ও সোহাগ ততক্ষণে ফিরেছে। সবার কাছে বিদায় নিয়ে সামনের দিকে গাড়ি চলতে শুরু করে। কুড়িগ্রাম শহর, ‘মঙ্গার দেশ’ বলে পরিচিত- শহরের বড় বড় বিল্ডিং পেরিয়ে মামুনের টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি চলছে তারই পরিচালনায়। এদিকে জাকির আহমদ সম্ভবত উচ্ছ্বাস সম্পাদক, নাগেশ্বরীর কবি ও সাংবাদিক হাফিজুর রহমান হৃদয়ের ফোন রিসিভ করে কথা বলছে তার সাথে। হৃদয় ফেসবুকের বদৌলতে জানতে পেরেছে, সেই পথ ধরে আমাদের যাত্রা। অমনি সে আমন্ত্রণ করে বসে, নাগেশ্বরী প্রেসক্লাবে যাত্রাবিরতি করবার।
কুড়িগ্রাম শহর পেরিয়ে গাড়ি থামানো হলো ধরলা সেতুর মাঝ বরাবর। উদ্দেশ্য, ছবি তোলা। অপু রেডি। ছবি তোলা নিয়ে কারো মাঝে উৎফুল্লতার কমতি নেই। সেতুর অপরপ্রান্ত ঘেঁষে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল তেলে ভাজা টনিক নিয়ে। আমরা আর গাড়িতে না উঠে সেতুর উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাই টনিকের চালা ঘরে। সেখানে গরম গরম পিয়াজু, আলুর চপ, রসুন চপ, ডিম চপ, কাঁচা মরিচ চপ, ধনিয়াপাতা ও সবজি চপ তৈরি হচ্ছে। নিজ নিজ পছন্দ মতো খাবার তুলে নিয়ে খেতে হুকুম জারি করলেন স্বয়ং দোকানী। গুনে গুনে খাবার জন্য সতর্কতার বাণীও শোনালেন। আহা বড় দয়াবান দোকানী! শীতের দিনে এমন খাবার খেতে মজাই অন্যরকম। খেতে খেতে এখনেও সবার ছবি তুলতে হলো অপু আর মামুনকে। এক সময় হোটেল বয়কেও কাজে লাগানো হলো ক্লিক কম্মে। খাওয়া শেষে চা, চায়ের শেষ চুমক দিয়েই জাকির ইঙ্গিত করে, হিসু দিতে হবে। সেতুর নিচের দিকে পা বাড়ায়। একই কাজে সোহাগ ও মুস্তাফিজ রহমান পিছু নেয়। বিল পরিশোধ করে বাকি ক’জনও সেই পথ ধরি। মুস্তাফিজ, আঁচর সম্পাদক। তার দুটি অপকর্ম আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তা হলো- মঞ্চে সুন্দর করে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা আর তার মনের মাধুরী মেশানো হাসি। আরো ভালোলাগার অনেক কিছু আছে, একদিন সময় করে সবাইকে বলবো। জাকিরের পিছু নেয়া মুস্তাফিজ রহমান যে হিসুই করবে তাও ক্লিয়ার। একে একে সবাই পিছু নিয়ে বাধের উপর দিয়ে একটু সামনে এগুতেই মেহেদী হাসান শাপলার চোখে ধরা পড়ে ধরলা নদীর হাঁটু পানিতে দুটি বয়স্ক পাঁঠা ছাগলকে গোসল করানোর দৃশ্য। কৌতহলীভাবে তা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করালো। শাপলা আমার বাল্যবন্ধু, লেখালেখির সাথে জোড়ালোভাবে যুক্ত না থাকলেও লেখকদের সঙ্গ ছাড়তে রাজি নয়। শীতের দিনে পাঁঠা ছাগলকে গোসল করানোতে তার এতো কৌতুহল কেন! এমন প্রশ্ন আমাদের সবার। তার উত্তরে পাওয়া গেল, ‘নিশ্চয়ই এটা বানিজ্যিক পাঁঠা।’ ‘বানিজ্যিক পাঁঠা মানে!’ মামুন সরাসরি শাপলাকে প্রশ্ন করে। ‘বানিজ্যিক পাঁঠা মানে, যে পাঁঠা দিয়ে পাল দেখানো হয়’। অর্থাৎ ছাগি ছাগলের গর্ভে বাচ্চা ধারণ করতে পাঁঠার সাথে মিলিত হতে হয়, উপযুক্ত পাঁঠা কি মাঠে-ঘাটে পাওয়া যায়! যায় না। আর পাওয়া যায় না বলে ছাগির মালিক পাঁঠাবাড়িতে এসে টাকার বিনিময়ে ছাগিকে যৌনমিলনের বন্দোবস্ত করেন, আজ মনে হয় ভালোই ক্ষ্যাপ মেরেছে, তাই গোসল করাতে নিয়ে এসেছে প্রিয় পাঁঠাদের। এবার বলেন বুঝাতে পেরেছি?’ শাপলার এহেন উত্তরের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। তারপরও হো হো করে হেসে উঠি সকলে। ব্রহ্মপুত্রের বাঁধ দিয়ে কয়েক গজ যেতে না যেতে এক মাঝি এগিয়ে এসে তার নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর আহবান করেন। নৌকায় ঘুরলে জুম্মার নামাজে ব্যাঘাত হবে ভেবে, মাঝির কথায় আমল দেয়না কেউ। সেখানে কিছু ছবি ক্লিকের মাধ্যমে স্থান ত্যাগ করি।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। যাত্রা বিরতি নাগেশ্বরী প্রেসক্লাব। অপু নিজের ফেসবুক আইডি থেকে আমাদের ট্যাগ করে করে ছবিগুলো পোস্ট করছে। ফেসবুকে ছবি দেখে কমেন্টের পাতায় যুক্ত হলেন, কবি হেলেন আরা সিডনি আপা, তিনিও ঘুরতে পছন্দ করেন। আমাদের শুভ যাত্রা কামনা করে যুক্ত হয়েছে কবি শারমিন আকতার মনি, তার সাথে সাক্ষাতে কথা না হলেও যাত্রাকালে ফেসবুকে কথপোকথন জমে উঠেছিল বেশ। দেখতে দেখতে নাগেশ্বরী প্রেসক্লাব, প্রধান সড়কের পাশে হাফিজুর রহমান হৃদয় হাত উঁচু করে গাড়ি থামানোর ইংগিত দেয় মামুনকে। মামুন গাড়ি ব্রেক করে। গাড়ি থেকে নেমে হৃদয়ের সাথে গলা মিলাই আমি। ছেলেটাকে কেন জানি আমার খুব ভালো লাগে। রংপুরে আমাদের অনুষ্ঠান এবং পিকনিকগুলোতে স্বতঃস্ফূর্ত যোগ দেয়। তার পিছু ধরে প্রেসক্লাবে প্রবেশ করে আমাদের টিম ‘পথে পথে সারাবেলা’। দারুন পরিপাটি প্রেসক্লাবের অফিস, পরিবেশটাও শান্ত। মিটিং অথবা আড্ডার আদলে বসলেও বিভিন্ন কথার ফাঁকে কবিতা পাঠের প্রস্তাব আসে দৈনিক বায়ান্নর আলো পত্রিকার নাগেশ্বরী প্রতিনিধি শফি’র পক্ষ থেকে। কবিতা শুনতে অনিহা নেই মোটেও। কবিতার আসর হলো। আমিও সদ্যপ্রসূত এবং প্রথম লেখা সনেট পাঠ করি। ছবি তুলছে হৃদয় নিজেই, পরে ছবি তুলতে লেগে যায় শাপলা। কবিতার পাট চুকিয়ে নানাবিধ আলোচনা করতে করেত জুম্মার নামাজের সময় ঘনিয়ে আসে। হৃদয়ের দেখা পথ অনুসরণ করে মসজিদের দিকে রওয়ানা দেই। মসজিদের সামনে গিয়ে অবাক হয়ে যাই, উপজেলা পর্যায়ে এমন সুন্দর মসজিদ দেখে, বাইরে যেমন অসাধারণ কারুকাজ ভিতরেও তেমনি। নামাজ শেষে ফিরোজ কাওসার মামুনের পূর্বপরিচিত রাজনৈতিক মামা, তপন বিএসসি’র দেখা মেলে। তিনি একজন কবি। রংপুরে থেকে কারমাইকেল কলেজে পড়াশোনা আর ছাত্ররাজনীতিও করেছেন। এখনো ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে জড়িত। বেশ মজার মানুষ। তার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু সময় মজার আড্ডা, হাসিঠাট্টা আর স্মৃতিচারণ হয়। ইতোমধ্যে জিলাপি, কলা ও কমলা খাওয়া হলো। এবার গন্তব্যের তাড়া। মামুন সিটবেল্ট বেঁধে গিয়ারে হাত ঘোরায়। ধীরে ধীরে চাকা ঘুরতে থাকে সামনের দিকে। স্পীড বাড়তে শুরু করবে এমন সময় পিছু ডাক! পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি শফি আর হৃদয়। তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। গাড়ি সাইড করে নেমে আসি সবাই। তাদের উদ্দেশ্য আমাদের আপ্যায়িত করা। চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে বল্ল ‘কী খাবেন?’ কেউ পছন্দ করতে পাচ্ছেন না কী খাওয়া যায়। হঠাৎ জাকির পছন্দ করে বসে মুড়ির মোয়া। এখানে অধিকাংশ দোকানে মুড়ি ও মোয়া পাওয়া যায়। জাকিরের মতের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে মোয়া খেয়ে বিদায় হই হৃদয় ও শফিকের কাছ থেকে।
এবার বিরতিহীন যাত্রা সোনাহাট স্থলবন্দর হলেও অপুর চাপানো ব্রেকে দাঁড়াতে হয় ভুরুঙ্গামারী উপজেলার আন্ধারীঝাড় নামক স্থানে। গাড়ি থেকে নেমে আমার দৃষ্টি আটকায় একটি টঙঘর মতো বন্ধ চায়ের দোকানে। দোকানের উপরে একটি সাইনবোর্ড সাঁটানো, লেখা আছে, ‘হোটেল সেরাটন’ সেখানে বেকারী সামগ্রী ও লাল চা পাওয়া যায়। দারুন উপভোগ্য সাইনবোর্ড। হোটেল শেরাটনের সামনে ছবি তুলে তৃপ্তি পেলাম সবাই। ঢাকার সেরাটনে না গেলেও মফস্বলের হোটেল সেরাটনের সামনে তোলা ছবি ইতিহাস হয়ে থাকবে। অপু যার উদ্দেশ্য গাড়ি থামিয়েছে, তিনি একজন মুরগির পাইকারী ব্যাবসায়ী, নাম সোলেমান আলী, তার সাথেই কথা বলছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। পরে সবার সাথে পরিচয় হলো এবং দুপুরের আহারের আহবান করলেন। সোলেমান আলীর আহবানে সাড়া না দিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পথ ধরি সোনাহাট স্থলবন্দরের দিকে। আমাদের জন্য সেখানে অবস্থান করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাজু এবং মামুনের বন্ধুর মামাতো ভাই রাসেল। গাড়ি ছুটছে স্বাভাবিক গতিতে। মামুন শুধু কবি ও রাজনীতির মনুষেই নয়, সে দক্ষতার সাথে গাড়ি ড্রাইভ করতে পারে, তার প্রমানটাও পেয়ে গেলাম। ‘পথে পথে সারাবেলা’ নামে ভ্রমণের ছবি পর্বভিত্তিক পোস্ট করতে অপু যখন মহা ব্যস্ত, তখন আবার ছবি তোলার মনোরম দৃশ্য কাছে চলে আসে। শহুরে জীবনযাপনে যে দৃশ্যগুলো সচারাচর দেখতে পাই না সেই দৃশ্য যদি সরাসরি চোখের সামনে ভেসে আসে তখন কার না মন জুড়ায়! বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সর্ষে ক্ষেত। চারিদিকে হলুদের সমারোহ। ক্ষেতের আলপথ ধরে হাঁটতে নাকে আসে কাঁচা সর্ষের চোরাঘ্রাণ।
ফিরোজ কাওসার মামুন আর শরিফুল আলম অপু নিজের সেলফি তোলার সময় এতোটা আবেগপ্রবণ হতে দেখা গেছে যে, সর্ষে ক্ষেতে শুয়ে পর্যন্ত ছবি তুলছিল। ক্ষেতের আলে বসে গ্রুপ ছবি তোলার সময় মধ্যবয়সী এক গরুর কান্ড দেখে রীতিমতো ভয় পেয়েছিল মজনুর রহমান। বারবার তার দিকেই তাড়া করছিল গরুটি। ছবি তোলা আপাতত খ্যান্ত দিয়ে গরুকে তাড়া করে মুস্তাফিজ। গরু তাড়া খেয়ে দূরে যায়, আবার তেড়ে আসে, আবার যায় আবার আসে। গরু-মানুষের এমন তাড়াহুড়ায় ছবি তোলা শেষ করে সবাই গাড়িতে উঠে বসলে শুরু হয় গাড়ি চলা। সোনাহাট স্থলবন্দরে অবস্থানরত রাসেল ফোন দেয় মামুনের ফোনে। আর কতটা সময় লাগতে পারে সে খবর জানতে। এপার থেকে মামুনের কাব্যিক উত্তর, ‘আমরা তো সবাই নতুন এই পথে, কেমন করে জানাবো আর কতটা সময় লাগবে!’
গ্রামীণ পথ-ঘাট মাড়িয়ে যেতে যেতে নানা ধরনের সৌন্দর্য আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। একদম অচেনা অজানা এলাকা। এখানে মামুন ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কেউ কোনোদিন আসিনি। চলন্ত গাড়ি থেকে চোখ পড়ে সামনের লোহার ব্রিজের দিকে। এই ব্রিজটি দুধকুমার নদীর উপর অবস্থান। দুধকুমার নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত রায়ডাক বা সংকোশ নদী পাটেশ্বরীর কাছে। বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুধকুমার নাম ধারণ করেছে। নদীটি পাটেশ্বরীতে গোদাধর ও গঙ্গাধর নদী দুটিকে উপনদী হিসেবে গ্রহণ করে আঁকাবাঁকা পথে প্রায় ৫২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। দুধকুমার নদী মূলত প্রবাহের অধিকাংশই ভারতের অন্তর্ভূক্ত। এ নদী জোয়ার-ভাটার প্রভাবমুক্ত, তবে মাঝে মধ্যে বন্যাকবলিত হয়ে থাকে। ১৮৮৭ সালে ইংরেজ সরকার তাদের সৈন্য ও রসদ চলাচলের জন্য লালমনির হাট থেকে ভুরুঙ্গামারী হয়ে ভারতের মনিপুর রাজ্যে যাবার জন্য গোহাটি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করে। তারই অংশ হিসেবে সোনাহাট রেলওয়ে সেতু তৈরি করা হয়। ভুরুঙ্গামারী উপজেলা সদর থেকে ৬কিলোমিটার পূর্ব দিকে পাইকেরছড়া ইউনিয়নে দুধকুমার নদীর উপর অবস্থিত সেতুটি। যার দৈর্ঘ ১২০০ ফিট। স্থানীয়ভাবে পাটেশ্বরী সেতু নামে পরিচিত। এটি রেল সেতু হিসেবে তৈরি করা হলেও বর্তমানে সড়ক সেতু হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সেতুর একটি অংশ গুড়িয়ে দেয়। পরবর্তীকালে তা এরশাদ সরকারের সময় সেতুটি মেরামত করা হয়
সেতুর কাছে এসে একে একে সবাইকে গাড়ি থেকে নামতে তাড়া দিলাম। কারণ এমন অদেখা নদী আর সেতুর ছবি তুলতেই হবে। ইতোমধ্যে মজনুর রহমান অপুকে প্রস্তাব করলো যে, শুধুমাত্র নদী ও প্রকৃতির কিছু ছবি তুলতে হবে, তার জন্য। সবার ছবি তোলা শেষ করে মজনুর জন্য স্পেশাল ছবি তোলা হলো। যে ছবিতে আমাদের বডি, মাথা, কথা কিছুই থাকলো না। ঘড়িতে বেলা তিনটের কাঁটা ছুঁই ছুঁই, পেট বলছে আরও বেশি। সময়ের কথাটা নিয়ে মুখ খুললে হৈচৈ শুরু হয়ে যাবে। আমি নিশ্চুপ থাকলাম। কারণ আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে আর বেশি দেরি নেই। পাশে বসা সোহাগের দিকে আড় চোখে দেখে নিলাম একবার, চোখ দুটো ছোট হয়ে এসেছে। বেচারার মুখটাও শুকনা দেখা যাচ্ছে। সে কি আসলেই ক্ষুধার্ত! অপু ব্যাবসায়ী মানুষ, সন্ধ্যার আগে খাবার সুযোগ হয় না তাই তাকে নিয়ে ভাবছি না। মুস্তাফিজ এনজিও কর্মকর্তা, সেও মাঠ চষে বেড়ায়। কখন কোন বেলার খাবার খায় হুঁশ থাকে না। ছোটবেলা থেকে শাপলাকে দেখে আসছি, সময় নিয়ে মোটেও মাথাব্যথা নেই, না খাবারে, না ঘুমে। মজনুর রহমান অফিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, তাকে অবলীলায় সব কিছু সামাল দিয়ে খেতে যেতে হয়। এ অবস্থায় খাবারের জন্য কতটুকু নিয়ম মানতে পারে, তা নিয়েও ভাবছি না। জাকির আহমেদ, মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, কখন খেয়েছে, কিংবা কতক্ষণ পর্যন্ত না খেলেও সমস্যা নেই। ফিরোজ কাওসার মামুন গাড়ি ড্রাইভ করছে, কবি ও রাজনীতি করা মানুষ, রাজপথে যখন হাত উঁচিয়ে শ্লোগান শুরু করে তখন খাবারের কথা মাথায় থাকে না। আর আমি, প্রতিদিনের মতো আজ সকালে পেটপুরে খিচুড়ি খেয়ে বেরিয়েছি সে কারণে তো দেরি হয়েছে বাসা থেকে বেরুতে। তাই কামারপাড়া পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে এসেছিল আমাকে নিতে।
সোনাহাট কলেজ মোড় থেকে গাড়িতে তুলে নেয়া হলো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজুকে, সে সোহাগের কলিগ, বয়সে আমাদের থেকে অনেক ছোট হবে। তার বাড়ি সীমান্ত এলাকায় বলে আমাদের জন্য পথ সহায়ক হবে। আমরা গন্তব্যের খুব কাছাকাছি চল এসেছি। সাজু জানায় ‘আর পাঁচমিনিটের মধ্যে পৌঁছাতে পারবো।’ তার কথায় সবাই একটু নড়েচড়ে বসছি। মনে হয়-দূরপাল্লার কোনো ট্রেনের যাত্রী আমরা। ট্রেনে বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, স্বস্তির বার্তায় ব্যাগপত্র গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। সাজুর সাথে কথপোকথনে ফুরিয়ে এলো পথ। দুপুরের খাবার হোটেল হোটেল ঠিক করে রেখেছিল রাসেল, তাই স্থলবন্দরের এক কিলোমিটার আগে ক্যাম্পের মোড় নামক স্থানে গাড়ি থেকে নেমে পড়ি আমরা। রাসেলের সাথে সৌজন্য বিনিময় করে হোটেলের দিকে পা বাড়াই সাবাই। এরই মধ্যে মজনুর রহমান টয়লেট খুঁজছেন রাসেল মারফতে। রাসেলের দেখানো পথে উল্টো দিকে হাঁটা ধরে মজনুর রহমান। ব্যাপারটা সবাই বুঝেতে না পারলেও, আমি ঢেঁড় বুঝেছি।
বিশাল স্পেস নিয়ে হোটেলটা তৈরি করেছেন। হোটেলের বাইরেও অনেক জায়গা ফাঁকা রেখেছেন, সম্ভবত গাড়ি পার্কিং এর জন্য এমন জায়গা রাখা হয়ে থাকতে পারে। এই পথ দিয়ে প্রতিদিন পাথর বোঝাই অসংখ্য ট্রাক যাতায়াত করে। ড্রাইভারদের কথা মাথায় রেখে হোটেলটিতে মানসম্পন্ন খাবার রাখাটাও হোটেল মালিকের ব্যাবসায়ীক ভাবনায়।
অনেকের কাছে গল্প শুনেছি, গাড়ির মালিকের থেকে ড্রাইভাররা সব সময় নাকি ভালো খাবারটা খায়। গাড়ির মালিক যদি মাছের লেজ খায়, ড্রাইভারের জন্য মাথা চাই। যাক আমরা সবাই মিলে হোটেলে ঢুকলাম, ঢুকে দেখি আলো স্বল্পতায় ভুগছে পুরো হোটেল। হোটেলের চেয়ার টেবিল, জগ গ্লাস, প্লেট, বেসিন সব কিছুই সোলার প্যানেলের সাহায্যে উঁকি মারছে। কারণ, লোডশেডিং চলছে। পল্লী বিদ্যুতের কারসাজি। একবার বিদ্যুৎ গেলে আর আসে না। স্বল্প আলোতে ফ্রেস হয়ে দুটি খাবার টেবিলে বসেছি। গরম গরম খাবার আসছে একের পর এক। যার যেটা পছন্দ সেটা খাবার পরামর্শ দিলেন হোটেল বয়। মধ্যবয়সী হোটেল বয় দারুনভাবে কথা বলতে পারেন। চমৎকার স্বাদের খাবারগুলোর মাঝে নেই গরুর গোস্ত। আমরা আসার আগেই নাকি ফুরিয়ে গেছে। পুরো টিমের পছন্দ গরু। কিন্তু গরু না থাকলে কি হবে, দেশি মুরগির ঝাল রান্না, পাতলা মুশুরডাল, করলা ভাজি, সবজি, গরম পিয়জু বিশেষ পদের মধ্যে আড়াই-তিন ইঞ্চি সাইজের বাটামাছ কাঁচা ধনিয়াপাতা ফেলে আধা ডুবন্ত তেলে কড়কড়ে করে ভেজে হাজির করেছেন টেবিলে। সবাইকে দুটি করে ভাজা মাছ দিয়েছিল, পরে আবার অর্ডার দিয়ে মাছ ভাজানো হয় সবার জন্য। সাজু ও রাসেল বাসা থেকে খেয়ে বেড়িছেন বলে আমাদের সাথে বসতে রাজি হয়নি। মজনুর রহমান ফিরে এসে যোগ দেয় খাবার টেবিলে। ততক্ষণে কেউ কেউ খাওয়া শেষ করে পান চিবুচ্ছেন। ফিরোজ কাওসার মামুন তার বন্ধুর ছোট ভাই রাসেলের সঙ্গে কথা বলছে, অন্যদিকে সাজুকে নিয়ে সোহাগও মেতেছে গল্পমগ্নে। আমি আর শাপলা পান দোকেনের সামনে। জাকির আর অপু কোনো বিষয়ে কথা বলছে মনে হয়। তখনো মজনু খাচ্ছে, তাকে সঙ্গ দিতে মুস্তাফিজ রহমান হোটেলেই ছিল। মোট কথা খাওয়ার পর জিরিয়ে নেবার অঘোষিত পাঁয়তারা যাকে বলে। তবে আমাদের দূরত্ব ছিল, তিন থেকে চার গজের মধ্যে। সব শেষে হোটেলের বিল পরিশোধ করে গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা। জাকির গাড়িতে না উঠে রাসেলের বাইকে করে যাবে। বাইকে নাকি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ তার। জাকির আর রাসেল আগে রওয়ানা দেয় সোনাহাট স্থলবন্দরের দিকে। জাকিরের সিটে বসে সাজু। আমাদের গাড়ি স্টার্র্ট দিয়ে সামনে এগুতে যাবে, এমন সময় মামুনকে উদ্দেশ্য করে মজনু বলে। ‘মামুন ভাই দাঁড়ান দাঁড়ান, শাপলা ভাই ওঠে নাই।’ তাই তো! আমার পাশেই বসেছিল অথচ আমিই লক্ষ্য করিনি। কখন থেকে নেই! মোবাইলে কল দিলাম শাপলাকে, রিং হচ্ছে রিসিভ করে না। আবার দিলাম, জবাব নেই। সোহাগের ফোন থেকে কল দেয়া হলো একই অবস্থা। মুস্তাফিজ বলছে, ‘মনে হয় ইয়ে করতে গেছে!’ মুস্তাফিজের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা মিললো তার। ডানের পাকা সড়ক দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে নিতে হেঁটে আসছে আমাদের দিকে। কাছে এসে বলে, ‘দুঃখিত চাপ সইতে না পেরে বিনা অনুমতিতে ইয়েটা সেরে নিলাম, হি হি হি।’ তার হাসির সাথে ঠোঁট মিলিয়ে আমরাও একচোট হেসে নিলাম। মজনু তো বলেই ফেলে, ‘ভাই খাবারটা হজম না হতেই ঢেলে দিলেন?’ আবার সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করি।
গাড়ি সামনের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ ব্রেকে মাঝারি চাপ দিয়ে একটা গর্ত থেকে চাকা তুলে নেয় মামুন। এবার কাঁচা রাস্তা হয়ে চলছি। রাস্তা কাঁচা হলেও মাটি চোখে পড়ছে না। চোখে পড়ে পাথর। চওড়া রাস্তা, দু’ধারে পাথরের স্তুপ, ইন্ডিয়া থেকে এসব পাথর এনে এখানে রাখছে। বিভিন্ন সাইজের পাথর। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে মেশিন দিয়ে পাথরগুলো ভেঙে চাহিদা মতো সাইজ করছে শ্রমিকরা। রাস্তার কোল ঘেঁষে বাংলাদেশের বড় বড় ট্রাক লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পাথর লোড করার জন্য। এখানে শত শত ট্রাকের মাঝে ইন্ডিয়ান কোনো ট্রাক লক্ষ্য করা যায়নি।
রুগ্ন আর ভগ্ন রাস্তা পেরিয়ে আমরা এখন সোনাহাট স্থলবন্দরে। সোনাহাট স্থলবন্দর রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বঙ্গ সোনাহাট ইউনিয়নের সোনাহাট সীমান্তে অবস্থিত একটি স্থলবন্দর। ২০১২ সালের ১৭ নভেম্বর উদ্বোধন হয়। ২০১৪ সালের ১৮ এপ্রিল পণ্য আমদানী চালু হয়। নদীর তীরবর্তী হওয়ার কারণে ব্রিটিশ আমলে সোনাহাট স্থলবন্দরটি বিখ্যাত বানিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ছিল। সোনাহাট স্থলবন্দরটি ভারতের আসাম এবং পশ্চিবঙ্গের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত যা ভারতের সাত বোন বলে খ্যাত অঙ্গ রাজ্যের গেটওয়ে হিসেবে কাজ করছে। পূর্বে ভারতের সাথে রেল যোগাযোগের মাধ্যমে উভয় দেশের লোকজনের অবাধ যতায়াত ছিল। এই কারণে উভয় দেশের লোকজনের ইচ্ছায় এবং ভৌগলিক কারণে সোনাহাট স্থলবন্দরটি চালু হয়। ৪ বছর বন্ধ থাকারপর ২০১৮ সালের জুন মাসে তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী স্থলবন্দরটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ পণ্য ব্যতিরেকে দশটি পণ্য আমদানীর অনুমতি রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে- পাথর, কয়লা, তাজা ফল, ভুট্টা, গম, চাল, ডাল, আদা, গিঁয়াজ ও রসুন। বর্তমান এই বন্দর দিয়ে পাথর ও কয়লা আমদনী এবং প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী রপ্তানী হচ্ছে। এখান দিয়ে অভিবাসন চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সোনাহাট স্থলবন্দর, বিশাল এরিয়াজুড়ে অফিস। অফিসের গেটে কিংবা ভিতরে কোনো লোকজন চোখে পরেনি। গেটের পাশে গাড়ি পার্কিং করা হলো। নাহ, কেউ নেই! ছুটির দিনে সম্ভবত কেউ থাকে না। আমরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ঝপাঝপ কিছু ছবি তুলে নেই।
গেট থেকে অল্প কিছু দূরে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ আস্ত একটা বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে মানবকূলের যাতায়াত রোধ করার নাম ‘নো ম্যানস ল্যান্ড।’ এখানে মানুষের তেমন কোনো ভীড়-ভাট্টা নেই। আশপাশে বিজিবি সদস্যদেরও দেখা যাচ্ছেনা। আমরা বাঁশের ব্যারিকেড পার হয়ে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া সীমান্ত পিলারের কাছে চলে আসি। সিমেন্টের পিলারের গায়ে একদিকে বাংলাদেশ, অন্যদিকে ইন্ডিয়ার পিলার নাম্বার ১০০৯ খোদাই করে লেখা আছে। ইন্ডিয়া থেকে আসা পাকা রাস্তার সমাপ্তি হয়েছে এখানে। আমরা ইন্ডিয়ান পাকা রাস্তায় উঠে ছবি তুলি। অপু, সোহাগ, শাপলা, মামুন, মুস্তাফিজ, জাকির, মজনু ও আমি পর্যায়ক্রমে ইন্ডিয়ার মাটিতে হিসু করার কম্মটাও সেরে ফেলি। ইন্ডিয়ান পাকা রাস্তার দু’ধারে ফসলের জমি, ধান কেটে ফেলা জমির ওপরে ঘাসগুলো বিবর্ণ হয়েছে! অথচ বাংলাদেশের সবুজ সজীব ঘাসে শ্রান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকা। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আমাদের গর্ব। আমরা আর একটু ভিতরে যাবার চেষ্টা করি। কাঁটাতারের বেড়ার খুব কাছে। বিজিবি, বিএসএফের কোনো বাধা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। আমরা জানি এটা অনধিকার চর্চা হচ্ছে, অপরাধও বটে। কাঁটাতারের বেড়াঘেঁষে ওপারে বিশাল উঁচু উঁচু পিলারে হলুদ রঙের সার্চলাইট জ্বলে উঠে আমাদের জানান দেয়, সন্ধ্যা ঘনাতে আর বেশি সময় নেই।
এবার ফিরতে হবে। আমাদের দৃষ্টিতে না এলেও ওপারে সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীরা ঠিকই আমাদের লক্ষ্য করছেন। পান থেকে চুন খসলেই…।
ফিরতি পথে দেশের শেষ চায়ের দোকানে এককাপ করে চা খাবার প্রস্তাব দেয় সাজু। চায়ের দোকানে বিকেলের শেষ রোদটুকুও অবশিষ্ট নেই। আসেনি বিদ্যুৎ সংযোগ। জাকির আগেই চেয়ার নিয়ে চা দোকানের বাইরে বসেছে। আমরা কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে গল্পের সাথে চায়ের পর্ব চালাচ্ছিলাম। এখানে আগে থেকে বসে থাকা দুজন ভদ্রলোক আমাদের গল্পে সুর মিলিয়ে কথা বলছিলেন মজনুর সাথে। গল্পের বিষয় নয়, বেশভূষায় ভেবেছিলাম, তারা হয়তো বিজিবি অথবা সোনাহাট স্থলবন্দরের কোনো কর্তা ব্যক্তি হবেন। কিছু জানার আগ্রহে সোহাগের প্রশ্নে বুঝা গেল, তারাও এসেছেন ঘুরতে। চা শেষ করে সাজু নিজ হাতে পান নিয়ে আসে। যারা যারা পান খায় তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে। আমি পান মুখে পুড়ে দিয়ে সবাইকে তাড়া দিলাম, গাড়িতে উঠতে। এদিকে সাজু তার বাড়ি নিয়ে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ রাজিও হলো সাজুর পিড়াপিড়িতে। আমি নিশ্চুপ, গেলে মন্দ কি।
বিদায় সোনাহাট স্থলবন্দর, বিদায় সীমান্তের শেষ চা দোকান। বিদায় বাংলাদেশ ইন্ডিয়ার ১০০৯ পিলার। সব কিছু পিছে ফেলে গাড়ি সোনাহাট কলেজ মোড় এলে ডান দিকে যাবার আহবান জানায় সাজু। জাকির গাড়িতে নেই। রাসেলসহ তার বাইকে, গাড়ির পিছে পিছে চলছে। সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। সাপের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তা। তিন চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সাজুকে উদ্দেশ্য করে মামুন বলে, ‘আর কতদূর,’ সাজু নির্দিধায় বলে, এই সামনে, আর অল্প। তার বাড়ি আমরা কেউই চিনি না, দূরত্বের হিসাবটাও জানিনা। পিছন দিকে প্রচুর ধুলির কারণে জাকির ও রাসেল আমাদের গাড়ি ওভারটেক করে সামনে যায়। তারাও পথ চেনে না সাজুর বাড়ির। যেতে যেতে তিন মাথা চার মাথা রাস্তা দেখলে থেমে যায়, নতুন করে পথ নির্দেশনার। আমরা আরো কিলো দুয়েক রাস্তা অতিক্রম করেছি। এবার মজনুর রহমান সাজুকে বল্লো, ‘আর কতদূর?’ সহজ উত্তর, ‘এই তো, আর একটু সামনে।’ এবার সোহাগ মুখ খোলে, ‘সামনেই তো যাচ্ছি, আর কত কিলোমিটার হবে।’ ‘এই সামনে, আর তিনচার হবে।’ অজানা অচেনা পথ, সব সময়ই অনেক বেশি মনে হয়। আমরা ভাবতেও পারিনি এতটা পথ বেয়ে সে আমাদের নিয়ে আসবে, তার বাড়ি দেখাতে। কেউ কেউ বিরক্ত হচ্ছে ইতোমধ্যে। গুমোট অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে চতুর্দিক। গাড়ির হেডলাইটের আলো যেখানে পড়ছে সেখানে ছাড়া বাকি সব ভুতুড়ে অবস্থা। ড্রাইভিং সিটে বসা কবি মামুন এবার বিরক্তি প্রকাশ করে, সাজুর প্রতি, সাজু আবার বলে ‘এই তো আর বেশি নেই, দুই তিন মিনিটে পৌঁছাবো ভাই।’ ড্রাইভিং মনোযোগী মামুন হর্ণ দিয়ে ভ্যানগাড়ির কাছে সাইট নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ডানে গিয়ে বামে, কিছুদূর সামনে গিয়ে আবার ডানে আবার বামে। এমন মোড়ানো পথ অতিক্রম করতে করতে অল্প দূরত্বের মাঝে চোখে পড়ে সার্চলাইটের হলদে আলো। গাড়ি এগিয়ে যায়, হলদে আলোর দূরত্ব কমে। এই আলো সেই আলো, যে আলো দেখেছিলাম সোনাহাট স্থলবন্দর ঘেঁষে কাঁটাতারের ওপারে উঁচু পিলারে। অর্থাৎ আমরা আবারও ইন্ডিয়ার বর্ডারের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। মামুন আতঙ্কিত বোধ করছে। কারণ, গাড়িটা সেনাবাহিনীর কাছ থেকে নিলামে কেনা। মামুনের ধারণা, ওপার থেকে বিএসএফ জওয়ানরা যদি ফায়ার করে। আমরা এতটা কাছে চলে এসেছি যে, ইচ্ছে করলে জওয়ানরা সেনাবাহিনীর এই গাড়িটাকে সহজে সনাক্ত করে বিভ্রান্তে পড়তে পারে। সরু কাঁচারাস্ত দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেতে পথপ্রদর্শন করে সাজু। এতো চিকন রাস্তা যে, দক্ষ ড্রাইভার ছাড়া গাড়িটি সহজে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না। গাড়ি খুব আস্তে এবং সতর্কতার সাথে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মামুন। ধীরে ধীরে ওপারের হলুদ আলো প্রস্ফুটিত হতে থাকে, গাড়ির হেডলাইটের আলো সম্ভবত কাঁটাতারের বেড়া ভেদ করে জওয়ানদের দৃষ্টি কাড়ছে। আমরাও মোটামুটি ভীতুসন্ত্রস্ত। মামুন আতঙ্কে, সাজু গাড়িটি বামে প্রবেশ করতে বলে। এখন ওপারের হলুদ লাইটের পুরো আলো গাড়ির উপর। ডানে স্পষ্ট দেখা যায় কাঁটাতারের বেড়া, একটা জমি পার হলে সীমান্তের ওপার। ইন্ডিয়ার সীমান্তকে স্বল্প দূরত্বে রেখে আমরা বামে প্রবেশ করি, হাতের ডানে একটি বাড়ির আঙিনায় গাড়ি থামানোর নির্দেশ দেয় সাজু। আমরা এখন বহালগুড়ি গ্রামে।
এই বহালগুড়ি গ্রাম আজো বিদ্যুতায়ন হয়নি। গাড়ি থাকে নেমে চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা, চারিদিকে শুধু অন্ধকার। ইন্ডিয়া থেকে আসা হলুদ আলো যে বাড়িটিতে ধাক্কা খেয়ে পুরো আঙিনা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে, সে বাড়ি কার জানেন! দেশের স্বনামধন্য কারমাইকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, প্রফেসর মোজাম্মেল হক স্যারের বাড়ি। তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার। রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ এর সভাপতি, রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদ এর সভাপতি। এবং বিভাগীয় লেখক পরিষদ, রংপুর এর উপদেষ্টা। জাকির তো বলেই বসলো, ‘যিনি আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, তাঁর বাড়ি বিদ্যুৎবিহীন, অন্ধকার। এই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বেড়িয়ে এসে তিনি শিক্ষার আলো বিলিয়েছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের মাঝে।’ স্যারের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই জাকির মোবাইল ফোনে কথা বলে স্যার কে জানান দেয়, আমরা তাঁর বাড়ির আঙিনায় সাদা জবা গাছের নিচে এখন দাঁড়িয়ে আছি। স্যার কিছুটা হলেও অবাক হয়েছেন আমাদের আকস্মিক আগমনে। কারমাইকেল কলেজের এক’শ বছরপূর্তি অনুষ্ঠান সফল করার কাজে তিনি অস্থান করছিলেন ঢাকায়। স্যারের এই বাড়িতে কেউ থাকেন কি না আমরা জানিনা তবে আমরা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ দেখছি। অর্থাৎ বাড়িতে কেউ নেই।
সাজুর বড়ভাই মোবাইলের লাইট ব্যবহার করে আমাদের নিয়ে গেলেন মোজাম্মেল হক স্যারের বাড়ির পাশেই তাদের বাড়িতে। ধীরে ধীরে সবাই ঘরে গিয়ে বসলাম, সেখানে আগে থেকেই আমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। নানারকম খাবারের সাথে খাঁটি সরিষার তেল, পিঁয়াজ আর কাঁচামরিচে মাখা বাড়িতে ভাজা মুড়ি, ছিল চিনির জিলাপি, আমরা আসবো জেনে হাট থাকে আনিয়েছেন বোধহয়। খাবার টেবিলে সবাই আছি কিন্তু জাকির আর সোহাগের হদিস নেই। বাইরের অন্ধকারে কী করতে পারে সে ভাবনায় সাজুকে খোঁজ নিতে পাঠাব, এমন সময় অন্ধকারে খরের গাদায় লম্ফঝম্প করে, ছবি তুলে উদয় হলেন তারা। যে যতটা খাবার খেয়ে নিলেন। চা এলো চা খাওয়ার পর্বটাও শেষ কিন্তু জাকির তখন খুব আয়েস করে মুড়ি আর জিলাপি খেয়ে চলছে, মুড়ি দিয়ে জিলাপি তার পছন্দের একটি খাবার তা অনায়াসে প্রকাশ করে সবার সামনে। শেষ অবধি গামলার সব মুড়ি সাটিয়ে ক্ষ্যন্ত দেয়। ততক্ষণে আমাদের সামনে পান সুপারি এসে হাজির। বাড়ির গাছের বিশাল আকৃতির পান, যা দেখে চোখ কপালে উঠে যাবে। পানে চুন লাগিয়ে মুখে পুরে দিলাম কিন্তু এমন সাইজের পানের লোভ কিছুতে সামলাতে পারেনি শাপলা। সাজুর বাবাকে বলে কিছু পান সুপারি প্যাকেট করে নেয়, পথে খাবে। মামুনের আতঙ্ক এখনো কাটেনি, বিজিবি, বিএসএফ, সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা নিলামে কেনা গাড়ি, স্বল্প দূরত্বে কাঁটাতারের বেড়া এবং হলুদ রঙের সার্চলাইটের আলোয় ধোয়াশা করে রেখেছে এক ধরনের ভীতি। এদের মধ্যে কেউ না বাগড়া দিয়ে বসে। যদিও গাড়ির কাগজপত্র সবকিছুই ফিট।
রাত ন’টা, ফেরার পথে বিদায় দিলেন সাজুর বাবা মা, এক ভাই তিন ভাবী। আবার সেই মোজাম্মেল হক স্যারের বাড়ির আঙিনা। যেখানে পার্কিং করা আছে গাড়ি। এবার জাকির প্রিয় বাইকে নয়, উঠে বসেছে গাড়িতে। আমি, শাপলা, মামুন ছাড়া সবাই বসেছে নিজ নিজ আসনে। গাড়ির রেডিয়েটারে পানি স্বল্পতা মনে করে ইঞ্জিন বনেট খুলে পানি চেক করে। পানি একটু কম মনে হলেও যেতে পারবে বলে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দেয় মামুন। গাড়ি ঘুড়িয়ে বামের রাস্তা ধরে। ওপার থেকে হলুদ লাইটের আলোক প্রক্ষেপণ হয় গাড়ির হুডে। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে সরু রাস্তা ধরে। এবার কাঁটাতার ভেদ করে ইন্ডিয়ার ভেতর হেডলাইটের আলো আর যাচ্ছে না।
রাসেল প্রথম থেকেই বাইক নিয়ে গাড়ির সামনে সামনে চলছে। ফিরতি পথে আর দূরত্ব মনে হচ্ছেনা। চারিদিকে আরো সুনশান হয়ে এসেছে। রাস্তায় লোকজনও তেমন চোখ পড়ছে না। কয়েকটি দোকান নিয়ে একটি বাজার দেখা গেলেও মিটিমিটি আলো জ্বলছে খুব কষ্ট করে। সম্ভবত চার্জ ফুরিয়ে আসা সোলার প্যানেলের সাহায্যে জ্বলছে বাতিগুলো। শীত পড়ছে মোটামুটি, শক্তিশালী হেডলাইট কুয়াশা ফেঁরে পথ চিনিয়ে দিচ্ছে আমাদের। মাঝপথে সোনাহাট কলেজ মোড়ে থেকে রাসেল বিদায় এবং সবার ধন্যবাদ নিয়ে চলে যায় নিজ গন্তব্যে।
দুধকুমারের লোহার সেতু অতিক্রম করে ভুরুঙ্গামারী উপজেলা শহর ছেড়ে যাচ্ছি। গাড়ির সবাই এখন নিশ্চুপ, নিজ নিজ মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে ফিরতি সময় পার করছে। জনশূন্য রাস্তা, পাথুরে ট্রাক আর দূরপাল্লার বাস ছাড়া তেমন কোনো কিছুর আনাগোনা নেই। নাগেশ্বরী পিছে ফেলেছি দুই তিন কিলোমিটার হবে। হঠাৎ বাহির থেকে হালকা একটি শব্দে ছন্দপতন করে মোবাইল মনোযোগী সবার। সামনে তাকিয়ে দেখি একটি ট্রাক যাচ্ছে, তার পিছে পিছে অটোরিকশা যাচ্ছে যাত্রী নিয়ে। অল্প সময়ের জন্য দেখা দেয় অস্থায়ী ধোয়া। তেমন বড় রকমের সমস্যা মনে না হলেও ভেবেছিলাম সামনের গাড়ির চাকা পাংচার, নয়তো ব্রাস্ট হয়েছে। মামুন কী বুঝে গাড়িটি বাম দিকে সাইড নিয়ে স্টার্র্ট বন্ধ করে দেয়। গাড়ি থেকে একে একে সবাই নিচে নেমে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কেউই বুঝতে পাচ্ছি না, ঘটনা কী এবং কোথায় ঘটেছে। গাড়ির বনেট টান দিয়ে ইঞ্জিনকে উন্মুক্ত করে মামুন। ইঞ্জিন থেকে সামান্ন ধোঁয়া বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরের দিকে। এ ধোঁয়া গরম পানির ধোঁয়া। আমার দিকে তাকিয়ে মামুন বলে, ‘তখন যদি রেডিয়েটরে পানি দিতাম, তাহলে এমন হতো না। এখন পানি দিতে হবে, তার আগে ইঞ্জিন ঠাণ্ডা করা দরকার।’ যেহেতু অপেক্ষা করতে হবে, তাই সবাই মিলে ঠেলে ঠেলে গাড়িটি পাকা রাস্তার পাশে ব্রাক অফিসের সামনে রাখা হলো। সামনে দু’চারটে খোলা দোকান দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশের খোলা মাঠে বড় বড় লাইট জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে ছেলেপুলেরা, সেখানকার আলো এসে পড়েছে গাড়ির গায়ে। রাত সাড়ে দশটা। কুয়াশা তেমন নেই। আমি, শাপলা অপু মামুন গাড়ির সামনে দণ্ডায়মান। মজনুর রহমান গাড়িতে বসে মোবাইল টিপছে। সোহাগ হিসু করছে পাশের নির্ধারিত হিসুয়ালয়ে। জাকির, মুস্তাফিজ অদূরে দাঁড়িয়ে কথা বলাবলি করছে। গাড়ি পুরোপুরি ঠাণ্ডা না হলেও পানি ঢালার মতো পরিস্থিতি হয়েছে। মামুন গাড়ি থেকে পানিভর্তি দুটি বোতল বের করে আনে, একটি দুই লিটার অপরটি এক লিটারের। রেডিয়েটরের ঢাকনা খুলে পানি ঢালা হলো তিন লিটার। আরো পানি দিতে হবে। সামনে চায়ের দোকানের কাছে টিউবওয়েল মিললো অপুর চোখে। পানি এনে ঢালা হচ্ছে বোতলে বেতলে। অল্প কিছু পানি প্রবেশ করার পর দেখা গেলো ইঞ্জিনের নিচে দিয়ে পানি পড়ে যাচ্ছে, কী হলো! মামুন নিজেই গাড়ির নিচে মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করে, কোথাও লিকেজ কিংবা ফেটে গেছে নাকি। তেমন কোনো চিহ্ন আবিষ্কার করতে পারে না। ফোন করে রংপুরের মেকানিকের কাছে। ফোনে কথা বলে আর ঘুরে ঘুরে দেখে, ইঞ্জিনের খুঁটিনাটিগুলো। কোনো ফল আসে না। স্থানীয় মেকানিক দিয়ে দেখানোর পরামর্শ প্রদান করেন রংপুরের মেকানিক। শুক্রবার, রাত এগারো পেরিয়েছে। কোথাও মেকানিক পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। নাগেশ্বরীর সেই রাজনৈতিক মামা, তপন বিএসসি কে ফোন করে মামুন, তপন বিএসসি মামা তখন তার বাসায়। আমাদের এমন দুর্ভোগের কথা শুনে বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন মেকানিকের সন্ধানে। অনেক্ষণ পর মোবাইলে খবর আসে, কোনো মেকানিক নাগেশ্বরীতে নেই, কুড়িগ্রাম ছাড়া পাওয়া সম্ভব হবে নয়। এখান থেকে কুড়িগ্রাম সতেরো কিলোমিটারের পথ, তাছাড়া রাত অনেকটা বেড়ে চলছে। সাতপাঁচ ভেবে আবার রংপুরে ফোন। রংপুর থেকে উত্তর আসে, যেখানে ছিদ্র হয়েছে জায়গা চিহ্নিত করে সেখানে নেগেটিভ পজিটিভ আঠা লাগিয়ে ছিদ্র বন্ধ করে গাড়ি নিয়ে আসেন। নেগেটিভ পজিটিভ আঠা কোথাও না পেয়ে আবার সেই তপন বিএসসি মামাকে ফোন। শীতের রাতে কষ্ট উপেক্ষা করে আঠা নিয়ে আসেন তপন মামা। তপন মামাকে চা খাইয়ে বিদায় দিয়ে আমি আর শাপলা এবার ছিদ্র খুঁজতে লেগে গেলাম। পাশের মুদি দোকান থেকে বড় বড় খালি কার্টুন এনে তা বিছিয়ে গাড়ির নিচে ঢুকলো শাপলা। তেমন কোনো ফলাফল দিতে না পেরে বেরিয়ে আসে। এরপর আমি চেষ্টা করতে গাড়ির নিচে ঢুকি, নাহ্ তেমন কিছু পাওয় গেলোনা। পরে গাড়ির সামন থেকে নানাভাবে খুঁজে খুঁজে আবিষ্কার হলো, রিডিয়েটরের উপরিভাগের ট্যাংকির জয়েন ছেড়ে দিয়েছে। লম্বালম্বিভাবে প্রায় ছয় ইঞ্চির বেশি ফাঁকা হয়েছে। যেখানে আঠা দিয়ে বন্ধ করা দুস্কর হবে, আঠা দিতে গেলেও উপরে একটি অংশ খুলে ভালো মতো দেখে দেখে আঠা দিতে হবে। পরে মামুনও মোবাইলের লাইটের সাহায্যে জায়গাটা চিহ্নিত করে। তবে এমন সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত নই। তবু কিছু তো একটা করতে হবে। বিপত্তি হলো, গাড়িতে টুলস্ নেই! পাশেই একটি মধ্যাবয়সী ছেলে আমাদের এমন হাল দেখে কাঠমিস্ত্রীর দোকান থেকে দুটো রেঞ্জ এনে দিয়ে সহযোগিতা করেন। দুটি বল্টু খুলে উপরিভাগ উন্মুক্ত করি। শাপলার দায়িত্ব আঠা দিয়ে পেস্টিং করা।
শাপলা হাতের তালুতে নেগেটিভ পজিটিভ আঠা গুলিয়ে কিছুটা সময় নিয়ে পোস্টিং করে। সেটা শুকনোর জন্য আরো কিছু সময় অপেক্ষার পর রেডিয়েটরে পানি ঢেলে দিতেই পেস্টিং এর কোন বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। তবে আগের তুলনায় অনেকটা কম। রেডিয়েটরে পানি না থাকলে ইঞ্জিন ক্রাস্ট হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। মামুন রংপুরে মেকানিকের কাছে ফোন দিয়ে এ অবস্থার কথা জানালে, মেকানিক কিছুতেই গাড়ি চালিয়ে নিতে অনুমতি দিচ্ছেন না। আমাদের মধ্যে একটা বোর্ড করে সিদ্ধান্ত নিলাম, যেভাবে পানি পড়ে এতে করে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে, তবে কিছুদূর পরপরই রেডিয়েটরে পানি ফুল করে নিতে হবে। সবাই একমত হয়ে আল্লার উপর ভরসা রেখে যাত্রা শুরু করে দেই। কিছুদূর বাদে একটি হোটেলের সামনে গিয়ে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে নেমে পড়ি পানি চেক করতে। রেডিয়েটরের ঢাকনা খুলে দেখলাম পানি কিছুটা কমে গেছে। বোতলে করে হোটেল থাকে পানি এনে ঢালা হলো, ছয় লিটারের মতো। পানি এখনো প্রায় আট লিটার রয়েছে। একইভাবে কুড়িগ্রাম এবং মুস্তফীতে দুই দফা পানি দেয়া হয়।
চলমান গাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে বাতাস প্রবেশ করছে। কেউ কেউ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব করতে থাকি। আমাদের মধ্যে অনেকের ঠাণ্ডা সহন ক্ষমতা থাকলেও শরীরে রীতিমতো গরম কাপড় থাকা সত্বেও মজনুর রহমান কুঁকড়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক অবস্থায় তার ব্যাগ থাকে একটি লুঙ্গি বের করে গায়ে জড়ানোর পরও ঠাণ্ডামুক্ত হতে পারে না। শেষমেশ জাকিরের গলায় ঝুলে থাকা একটি চাদর গায়ে পেঁচিয়ে কিছুটা হলেও সস্তি অনুভব করে। রাত গভীর হবার সাথে সাথে শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকে। একে একে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ার আপ্রাণ চেষ্টায় শীত যখন ব্যাস্ত, আমরা তখন রংপুরের সাতমাথায়। এবার সহযাত্রীদের গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছানোর পাঁয়তারা মামুনের। অল্প সময়ের মধ্যে চলে এলাম জাহাজ কোম্পানি মোড়ে। ঘড়িতে দেখি পৌনে তিনটা বেজেছে, জাহাজ কোম্পানি মোড় একদম নিরব। প্রচণ্ড শীত পড়ছে এখানেও। কোনো প্রকার যানবাহন, চা দোকান, নাইটগার্ড এমন কি পেট্রোল পুলিশ পর্যন্ত চোখে পড়ে না। অপু আর মজনু নেমে যায় জাহাজ কোম্পানি মোড়ে। গাড়ি শাপলা চত্বরের দিকে এগিয়ে আসে। আমি জাকির, সোহাগ, মুস্তাফিজ, আর শাপলা মামুনকে বিদায় জানিয়ে রিকশা অথবা অন্য কোনো বাহন খুঁজতে থাকি। কিন্তু না, এখানেও একই অবস্থা। হাঁটতে শুরু করি কামারপাড়া বাসষ্ট্যান্ডের দিকে। এই পথ দিয়েও সবার গন্তব্যে যাওয়া যায়। চামড়াপট্টির জনশূন্য পাকা সড়কে আর কেউ নেই, শুধুমাত্র কিছু নেড়িকুত্তা লেজ নাড়াচ্ছে আমাদের দেখে। ভাগ্যক্রমে গতিরোধ করেনি কুকুরগুলো। কামারপাড়া বাসস্ট্যান্ডে এসে অটো রিকশা পাওয়া গেল তিনটি, একটি যেতে রাজি হলো, দুটি যাবে না। সোহাগ, জাকির, মুস্তাফিজ একটি অটো রিকশায় উঠে কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনালের দিকে রওয়ানা দেয়, সেখান থেকেই ত্রিপথের বাহন মিলবে সেই ভাবনায়। আমি আর শাপলা বাসার উদ্দেশ্যে দুদিকে হাঁটতে শুরু করি তিন মিনিটের হাঁটাপথ।

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge