কবিতা হলো মানব সভ্যতার দর্পণ স্বরূপ-ইসমত আরা
পাতা প্রকাশ: কেমন আছেন? বসন্ত কেমন কাটছে?
ইসমত আরা: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। জীবন থেকে বায়ান্নটি বসন্ত হারিয়ে গেলেও এখনো উপভোগ করি সেই বৈভবের স্বাদ। যদিও শরীর এখন সেই আবহাওয়ায় মিতালি গড়ে না তেমন। হাঁচি, কাঁশি নানা রকম সমস্যা লেগেই থাকে এ ঋতুতে, তথাপি ঋতুরাজ বলে কথা! শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার হাতছানিতে ঘরে থাকতে পারি কই? হলুদ বৈচিত্র্যে তাই আমিও সখ্য গড়তে আনমনেই কখন যে হারিয়ে যাই, নিজেই জানি না–
পাতা প্রকাশ: আপনার লেখালেখির শুরুর গল্পটা শুনতে চাই…
ইসমত আরা: আসলে তেমন কোন গল্পই নেই আমার লেখালেখিকে ঘিরে। কারণ আমি যে কখনো লিখব সে চিন্তাও আসে নি মাথায়! তবে কবিতায় খুব টান অনুভব করেছি সেই ছোটবেলায়। ছোট ভাইটি যখন ছন্দ কবিতাগুলো সুরে সুরে পড়তো,আমি নিজের পাঠ বাদ দিয়ে তার কবিতা মনোযোগ দিয়ে শুনতাম এবং শুনেই মুখস্ত হয়ে যেতো কখনো ।মনে পড়ে, অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন কোন একদিন কবি কায়কোবাদের লেখা আযান কবিতাটি শুনে নিজের ভেতর কেমন কবিতার আবির্ভাব হয়েছিলো, লিখলামও নিজের মত করে ঠিক এ রকম–
” ঘুমের ঘোরে ঐ শোন দূরে,
কী মধুর সুরে ফজরের আযান
ওঠো,ওঠো, তরা,ওহে ঘুমে আছো যারা
শোন নামাজের তাগিদ হে মুসলাম। “
এভাবে কিছু এলোমেলো লাইন লিখে ইংরেজি গ্রামার বইয়ের পৃষ্ঠার ভাঁজে রেখে দেই। সম্ভবতঃ তার বছরখানেক পর কোন কারণে বাবা সেই বইটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই বই হতে চিরকুটটা মাটিতে পরে যেতেই কুড়িয়ে পড়ছিলেন যতন করে। আর তখনই ধরা পড়ে যাবার ভয়ে বাবার চোখের আড়ালে থাকার চেষ্টা করেও ধরা পড়ে যাই সাঁঝ বেলায়। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল সেদিন বাবার ডাকে। বাবা রাশভারি মানুষ,ইংরেজির টিচার খুব গুরুগম্ভীর কণ্ঠে মাকে ডাকলেন,রুবীর মা,তোমার মেয়ে তো কবি হয়ে গেছেন,তিনি এখন কবিতা লেখেন পড়া ফাঁকি দিয়ে। ” তারপর বাবার ডাকে ভয়ে ভয়ে কাছে গেলে,এক প্রকার আদুরে কণ্ঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,চালিয়ে যাও তবে বানানের দিকে নজর রেখো। আমি খুব পঁচা ছাত্রী হওয়ায় হাজার বানান ভুল ছিলো ছোট্ট কবিতাংশটুকুতে।তারপর আর লেখা হয়েছে কি না মনে পড়ে না তেমন। তবে কেউ কবিতা আবৃত্তি করলে খুব মন দিয়ে শুনেছি। এই শোনার স্পৃহা আমাকে একদিন মুগ্ধ করেছিলো ফের লেখার তাগিদে তখন পঁচিশ । কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় আমি ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম কিছু দগ্ধতার ক্ষতে। অতঃপর ক্ষতর ভেতরে হেঁটেছি নিত্য কবিতার চাষী হয়ে। এভাবে চলতে চলতে আজ এ পর্যন্ত–
পাতা প্রকাশ: ছোটোবেলায় জীবনের লক্ষ্য কী ছিলো? তা কি হতে পেরেছেন?
ইসমত আরা: কোন লক্ষ্যই ছিলো না হয়তো, কারণ পড়াশোনা আমার কোনকালেই ভালো লাগে নি তেমন। ভালো লাগবেই বা কেমন করে,গাঁধা ছিলাম তো! কত বকা খেয়েছি বাবার সে কারণে! তবে খুব স্বচ্ছ পরিপাটি একটা জীবন অতিবাহীত করব বড় স্বপ্ন ছিলো।সেটা কি করলে হতে পারে, ভাবি নি তাও।
আর যেহেতু হালহীন পালছেঁড়া একজন লক্ষ্যছাড়া কোন প্রকার পাশ করা একটি মানুষ, তার কপালে এই শিশু পড়ানোর কাজটা জুটেছে, সেটাই তো বেশি। আর আমিও তাতেই খুশি। কারণ আমার যোগ্যতা আমি জানি তো! তবু ধন্যবাদ সৃষ্টিকর্তায়, তিনি আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন এমন লক্ষ ফুলের মাঝে নিত্য আমার বিচরণে।সে ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে সুবাস ছড়ায় যখন, কত না আনন্দ তাতে! মনে হয় সে সুবাসের আমিও অংশিদার। হয়তো এটাই চেয়েছিলো অজ্ঞাত মন এবং হতে পেড়েছি।
পাতা প্রকাশ: আপনি নিজেকে কি কবি ভাবেন? নাকি অন্যকিছু?
ইসমত আরা: বড় কঠিন প্রশ্ন। সত্যি বলতে, কবি হবার প্রয়াস নিয়ে লেখার শুরু হয়নি আমার। আর কবি ভাববো এমন দুঃসাহসই বা আমার কই? লিখি শখের বসে। তবে পাঠক যদি যোগ্য মনে করেন।যদি কবিতারা যৌক্তিক প্রাপ্য পায়। আমি তো কেবল মনে ও মগজে ধারণ করি মানব কিংবা সমাজ দর্পণে ভেসে ওঠা কোন চিত্রে। হয়তো তার কোন একটি কবিতা হয়ে উঠতেও পারে। তবে আজকাল ইচ্ছে হয় বেঁচে থাকি।পদচ্ছাপ রেখে যাবার প্রত্যয়ে–
পাতা প্রকাশ: নিজের বই নিয়ে উপলব্ধি কী?
ইসমত আরা: এ পর্যন্ত পাঁচটি একক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও আরও পাঁচটি গ্রন্থ করার মত কবিতা সঞ্চয়ে রয়েছে আমার। তবে নিজের বই নিয়ে খুব একটা খুশি হবার মত আত্মতুষ্টির প্রকাশ নেই আমার । কারণ প্রজন্ম হয়তো এখন তেমন বই পড়ে না। কিংবা নতুন লিখছি যারা,তাদের লেখাগুলো লেখা হয়ে উঠছে না বলে তাদের অনীহা কি না ঠিক বোধগম্য নই। আবার নেট ঘাটলেই এখন সবই পাওয়া যায় তবে বইএ কেনো, হতে পারে সেটিও কারণ, জানিনা। তাই পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ জন্ম দিলেও এখনো মা হয়ে উঠতে পারি নি মমতাময়ীরূপে বলে সুখী হতে পারি নি। পারব সেদিন যেদিন বাংলাদেশ সহ বহির্বিশ্বে একটু হলেও সেসব গ্রন্থের দু একটি কবিতা কারো হৃদয়ে ঠাঁই পেয়ে উচ্চারিত হবে —
পাতা প্রকাশ: আপনার কাছে কবিতা কী?
ইসমত আরা: কবিতা হলো সাহিত্যের সুর। আমার মতে ছন্দবদ্ধ ভাবে যে সব কবিতা লেখা হয় সেটিই কবিতা। যা একজন কবির আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা করার সংক্ষিপ্ত রূপ এবং অনিবার্য ভাবার্থে কাব্যবিন্যাসের মাধ্যমে প্রকাশ পায় তাই কবিতা। কবিতা হলো মানব সভ্যতার দর্পণ স্বরূপ–
পাতা প্রকাশ: আপনার মাথায় লেখার ইমেজ কীভাবে আসে?
ইসমত আরা: ঠিক করে বলা কঠিন কারণ আমি যখন ঘুমোই তখনো হয়তো লিখি। কারণ ঘুম হতে জেগেই কোন একটা সৃষ্টির সুচনা হয়। আমার লেখার জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় জায়গা লাগে না। চলতে চলতে, বলতে বলতেই তার ফাঁকে হঠাৎ হয়তো একটি লাইন কাব্যিকতায় স্থান করে নেয় মস্তিস্কে আর তার সূত্র ধরেই হাঁটতে হাঁটতে হয়ে যায় কবিতা–
পাতা প্রকাশ: আপনি কার লেখা বেশি পড়েন? বিশেষ কারও লেখা কি আপনাকে প্রভাবিত করে?
ইসমত আরা: আনিসুল হকের” মা” উপন্যাসটি আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। যদিও হুমায়ূনের শঙ্খনীল কারাগার,নন্দিত নরকে বইদুটি দিয়েই আমার পড়া শুরু। পড়েছি শরৎচন্দ্রও তথাপি কবিতার বই আমাকে বেশি টানে। কবি হেলাল হাফিজ, মহাদেব সাহা,রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্যাহ,জয় গোস্বামী,শহীদ কাদরী,হুমায়ুন আযাদ, জীবনানন্দ দাশ,রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সহ
ভারতে বেশ কিছু কবির কবিতা আমায় মুগ্ধ করে যেমন দেবব্রত সিংহ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,অনির্বান ঘোষ,চন্দন নাথ–
পাতা প্রকাশ: আপনার সমকালীন লেখকদের কবিতা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? কার লেখা বেশি ভালো লাগে?
ইসমত আরা: অন্যের কবিতা নিয়ে সমালোচনা করার যোগ্যতা কই আমার যে দুঃসাহস দেখাব! তবে বলতে পারি অনেকেই ভাল লিখছে। ভালো লাগে অনেকের কবিতাও। যেমন,মাসুদ পথিক,রুখশানা হক,ইরশাদ জামিল,ছন্দা আখতার,মারজুক রাসেল এমন আরো অনেকে আছেন, যাদের কবিতাগুলো আমার ভালো লাগে এবং নিয়মিত পড়ি–
পাতা প্রকাশ: সবশেষে, লেখক হিসেবে চূড়ান্ত লক্ষ্য কী?
ইসমত আরা: লক্ষ্য একটাই, লিখে যেতে চাই আমরণ আর বেঁচে থাকতে চাই মরনের পরেও লেখার মাঝে।
লেখক হিসেবে প্রত্যাশা, বেঁচে থাক কবিতারা পাঠক হৃদয়ে। ছড়িয়ে যাক বিশ্বময়। যদি তার প্রচার, প্রসার না ঘটে তবে তো উদয়েই অস্ত যাবে কবিতা ও কবি। তাই আগামীর কাছে প্রত্যাশা, আপনারা বই পড়ুন আর বাঁচিয়ে রাখুন লেখককে তার লেখার মাঝে।
Leave a Reply