আনন্দের একদিন
শাহ আব্দুল মজিদ বুলু
আনন্দের একদিন। কোনটি সেদিন? পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে। সেটা কী জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, নাকি বিয়ের সেই মধুর দিনটি। না এর কোনটাই নয়। সেটা এমন এক দিন তার শুরæ থেকে শেষ পর্যšÍ শুধু আনন্দ, আর আনন্দ। এরই নাম বনভোজন। আমরা ছোটবেলা গ্রামে বলতাম ভুরকাভাত। এই ভুরকাভাত শব্দের অভিধানিক অর্থটা এখনো অজানা রয়ে গেলো। বাড়ি থেকে একটু দূরে কোনো নদীর তীরে বা বনের মধ্যে এই ভোজনের আয়োজন বলেই এর নাম বনভোজন। কিন্তু আমরা রংপুর বিভাগীয় লেখক পরিষদের সদস্যরা ৩১ জানুয়ারী ২০১৪ এর শুক্রবারে যে বনভোজন খেলাম, সেটা বনে-জঙ্গলে ছিল না। ছিল বিশাল এক রাজবাড়ি প্রঙ্গণে। সেই রাজবাড়ির নাম তাজহাট রাজবাড়ি। এটি একটি ঐতিহাসিক বাড়ি, এতো বড় রাজবাড়ি বৃহত্তর রংপুরে দ্বিতীয়টি নেই। কারণ এটা রাজার বাড়ি নয়-এটা বরং এটা মহারাজার বাড়ি।এই রাজবাড়ির শেষ মহারাজ ছিলেন গোপাল লাল রায়। রংপুরে মানুষ তাঁকে রাজা বাহাদুর বলতো। তিনি এই রাজবংশের ছিলেন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। একাধারে শিÿিত, দানবীর ক্রীড়ামোদী এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী। তিনি রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানও ছিলেন। কারমাইকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় একলা টাকা দান করেন। সেই দানে নির্মিত ছাত্রাবাসের নাম জি. এল হেষ্টেল। রংপুর শহরের জাহাজ কোম্পানী মোড় থেকে সাতমাথা মাহিগঞ্জ পর্যন্ত রাস্তাটি তার নামে উৎসর্গিত নাম, জি এল রায় রোড। বলতেই হয় বিশ্বখ্যাত সামাদ মহারাজা জি এল রায়ের তাজহাট টিমে খেলে বিশ্বনন্দিত হন। দুর্ভাগ্য ১৯৫৬ সালে ইষ্টবেঙ্গল মেইল ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রংপুরেই এই নামী-দামী মানুষটি মারা যান। কোলকাতা কেওড়াপাড়া শ্মশানে তাঁকে দাহ করা হয়। তাজহাট রাজবাড়ির ইতিহাস বিশাল। ধান ভানতে শীবের গীত না গেয়ে মূল প্রসঙ্গে ফিরি এবার।
সুদীর্ঘ ৩২ বছর সৌদি প্রবাসী হওয়ায় রংপুরের কোনো বনভোজনে অংশগ্রহণ করা আমার সম্ভব হয়নি বহু বছর। তাই এবার প্রচন্ড শীতর সময় বিভাগীয় লেখক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সেহভাজন জাকির আহমেদ যখন বনভোজনের কথা বললো তখন আনন্দে মনটা উৎফুল্ল। সে শামসুজ্জামান সোহাগ ও শ্রাবণ বাঙালী বললো বনভোজনটা বিড়ি সিটি হারাগাছে হবে। কবি শোয়েব দুলাল সেই বিখ্যাত ধুমনদীর তীরে বনভোজনের প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু ধুমনদীর সেই জৌলুস হারিয়ে যাওয়ায় কারণে সিদ্ধাšÍ পরিবর্তন করে তাজহাট রাজবাড়িতে নেয়া হলো। এটা আসলেও চমৎকার সিদ্ধাšÍ। জাকিরের মোটর বাইকে পেছনে বসে আমি গেলাম রাজবাড়িতে, কারণ অনুমতি নেয়া দরকার। রাজবাড়ির গেটেই দেখা হয়ে গেলো কিউরেটর ইয়াংম্যান মুহাম্মদ জায়েদের সঙ্গে। দাঁড়িয়ে হাতে হাতে দরখাস্তটি দিলাম, স্মিত হেসে তিনি বললেন বনভোজনে আপত্তি নেই, তবে আপনাদের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি কুড়িটাকা হারে দিতে হবে। আমরা রাজি হলাম। সরকারী আইন মান্য করা নাগরিকের দায়িত্ব।
লেখক-লেখিকা নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী এমন কি গার্লফ্রেন্ড নিতেও আপত্তি নেই। আমার স্ত্রী তো ঢাকায়। এখন গার্লফ্রেন্ড পাই কই! ভাবলাম সুপার মার্কেট থেকে একটা পøস্টিকের মডেলকন্য ভাড়া করে নিয়ে যাবো এবং রাজবাড়ির পুকুরঘাটে বসে অসংখ্য লাল পদ্মের শোভা দেখবো আর পরাবাস্তব ঢঙে জলের সঙ্গে কথা বলে দুধের স্বাধ ঘোলে মেটাবো। কিন্তু তা কী হয়? কল্পনা অনেক সময় কল্পনাই থেকে যায়। বাস্তবে রূপ নেয় না। রাজবাড়ির প্রধান বিল্ডিং-এর সাথে সামিয়ানা খাটানো হয়েছে। সেখানে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন। যেন বসেছে কবি সাহিত্যিক আর লেখক-লেখিকার মিলন মেলা। টোয়েন্টি ভিলেস, অর্থৎ কুড়িগ্রাম থেকেও এসেছে লেখক মিলন, হৃদয় এসেছেন। বদরগঞ্জ থেকে সস্ত্রীক এসেছেন ছড়াকার আশরাফুজ্জামান বাবু। হারাগাছ থেকে কবি শোয়েব দুলাল, উপস্থিত ছিলেন এ্যাড. আব্দুল হালিম খসরæ, সাংবাদিক এস এম খলিল বাবু, কবি জাহ্নবী জাইমা, এস এম সাথী বেগম, ছান্দসিকের সাধারণ সম্পাদক কবি সোহানুর রহমান শাহীন, দৈনিক গণআলোর সাহিত্য সম্পাদক কবি শ্রাবণ বাঙালী, শামসুজ্জামান সোহাগ, মোশাররফ হোহেন রাজু, গল্পকার কামরুন নাহার রেনু, লেখক নূর-ই-হাসিন দিশা, কবি সানজিদা নাজনীন লুনা, নাহিদা ইয়াসমীন, ডা. শাহ জামাল মোল্লা, কবি শেখ ফাতিমা খাতুন, ভাবের কবি মজনুর রহমান, মুস্তাফিজ রহমান, মেহেদী হাসান শাপলা, সরদার আরিফ, আতাউর রহমান তুহিন এবং আরো অনেকে। সব মিলে ৫০/৬০ জন। মিসেস জাকিরের সঙ্গে পরিচয় হলো। চমৎকার মহিলা। সানন্দে বাসায় যেতে বললেন। রান্না-বান্না চলছে। খলিল বাবু সদা উৎফুল্ল ও প্রাণবন্ত। খসরæ ভাই ব্যস্ত। বহুদিন পর স্নেহভাজন শোয়েব দুলালের সঙ্গে দেখা। সে পল্প জুড়ে দিলো। হঠাৎ এক নববধূ লাজুক ¯^ভাবে সামনে এসে হাজির। মনে হলো আকাশ থেকে একটা পরী ডানা কেটে ধূলির ধরায় নেমে এসেছে। তারপর ডানা কেটে মানুষে রূপ নিয়ে স্নিগ্ধ হাসিতে বললো-আঙ্কেল আমাকে চিনতে পেরেছেন। বলøাম, না তো। আবার বললো চেষ্টা করে দেখেন তো। তার পরও চিনতে পারলাম না। পরে পরিচয়ের সূত্রটি মনে করে দেয়াতে চিনতে পারলাম। নাজিরেরহাটের মেয়ে সে। নাম রতœা। বহু বছর আগে বাসে পরিচয়। তার আমন্ত্রণে তাদের বাড়িতেও গিয়েছিলাম। সুন্দর পরিবার। ওর মায়ের অমায়িক ব্যবহার। সব মনে পরলো। ওকে আমার লেখা ‘পঞ্চডালের পরিজাত’ বইটা উপহার দিয়েছিলাম। তখন সে অনেক ছোট ছিলো। এখন দর্শনে মাস্টার্স পড়ছে। চেহারার বিরাট পরিবর্তন। বললো আঙ্কেল আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবতেও পারিনি। বললাম, দুনিয়াটা তো গোল আর রংপুরটা ছোট, তাই দেখা না হয়ে যাবে কোথায়।
এাইক্রোফোনে এর মধ্যেই ঘোষণা দিয়ে আমাকে কিছু বলতে বলা হলো। নাহিদা ইয়াসমিন বললো, বুলু ভাই সৌদি আরবের উপর কিছু বলেন। ওর কথা রাখতে হলো। পরিশেষে একটি পুরনো উক্তির উলেøখ করলাম। যেটা অনেকেই জানে। উক্তিটা হলো, যদি সারা জীবনের জন্য আনন্দ করতে চাও বিয়ে করো, আর যদি একদিনের জন্য আনন্দ করতে চাও তাহলে বনভোজনে যাও। সেই একদিনের আনন্দের স্মৃতি তাজহাট রাজবাড়িতে বনভোজন। এটা আনন্দ একদিনের কিন্তু অমলীন স্মৃতি চিরদিনের। সে স্মৃতি বেদনার নয়। সুখ, সুখ।
Leave a Reply