রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ০৪:৪৩ পূর্বাহ্ন

নির্জন স্বাক্ষর-আনারুল ইসলাম রানা

নির্জন স্বাক্ষর-আনারুল ইসলাম রানা

নির্জন স্বাক্ষর
আনারুল ইসলাম রানা

অফিসের কাজে সেবার আমাকে যেতে হয়েছিল যশোরে। একেবারে শেষ মুহূর্তে আমাকে ঠিক করা হলো। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের ইকোনমি ক্লাসের টিকিট তখন বিক্রি শেষ। আমার লেভেলের কর্মকর্তার জন্য বিজনেস ক্লাসে টিকিট কেটে কোম্পানি টাকা পানিতে ফেলতে চায় না। শেষমেশ আমাকে তাই ধরিয়ে দেওয়া হলো ঢাকা-যশোর এসি বাসের টিকিট।
গাড়িতে উঠে বসলাম। একটু বাদেই গাড়ির সুপারভাইজার আমার ডান পাশে বসিয়ে দিয়ে গেলেন একজন বিদেশিনীকে। ধবধবে সাদা গায়ের রং, বাদামি চুল। হালকা লাগেজটা মাথার উপর বাংকে রেখে ঝপ করে বসে পড়ল। তারপর হাত বাড়িয়ে দিল সে আমার দিকে, ‘হাই। দিস ইজ জুলি। জুলি হান। ফ্রম বুসান, সাউথ কোরিয়।’
আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। সংক্ষিপ্ত কথাবার্তায় যেটুকু জানা গেল, তার সারমর্ম এ রকম। মেয়েটি ইনচন থেকে ব্যাংকক এসেছে গতকাল মাঝরাতে। লম্বা ট্রানজিট ছিল। ব্যাংক থেকে ঢাকা এসে পৌঁছেছে আজ দেড়টায়। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে আরও এক ঘন্টা, তারপর হোটেলে ঘন্টা চারেকের বিশ্রাম, তারপার রাত সাড়ে আটটার এই বাসটিতে চেপে বসা। তার আপাতত গন্তব্য যশোর।
মেয়েটির চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আমি তাকে জানালার পাশের সিটটাতে বসতে বলতেই সে সানন্দে রাজি হলো। ওয়াইপার দিয়ে কাচ পরিষ্কার করে এগোচ্ছে গাড়ি। খেয়াল করলাম, গাড়ির জানালায় মাথা রেখে মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ির দুলুনিতে তার শরীর কাঁপছে একটু একটু। হালকা নরম আলোয় মেয়েটিকে লাগছে মায়াময়।
গাড়িতে ঘুমাতে পারি না আমি। ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে শরীর এলিয়ে দিলাম সিটে।

দুই
আমাদের বাস ফেরিতে উঠল। গাড়ি থেকে নেমে ফেরির সামনের দিকটায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালাম। একটু বাদে পাশে এসে দাঁড়াল ভিনদেশি মেয়েটিও। এক কথায় দু-কথায় বলল তার দেশে আসার কারণ।
জুলি ওখানকার একটি ড্রাইসেল ব্যাটারি তৈরীর কারখানার মাঝারি পর্যায়ের চাকুরে। একই কারখানায় শ্রমিক হিসাবে কাজ করত সাইফুল নামে একজন বাংলাদেশি। সাত ভাই, তিন বোনের মধ্যে সাইফুল সবার বড়। ছোট ভাইদের মানুষ করতে হবে, ছোট বোনেদের বিয়ে দিতে হবে। তাই অর্থ উপার্জনের জন্য সে পাড়ি জমিয়েছিল বিদেশে। একই জায়গায় দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে জুলির সঙ্গে তার সখ্য হয়। এক পর্যায়ে তারা দুজন দুজনার প্রেমে পড়ে। মাস তিনেক আগে ছুটি নিয়ে সাইফুল দেশে আসে। আসার পরও জুলির সঙ্গে তার নিয়মিত কথা হয়েছে। কিন্তু গত এক মাস সাইফুলকে আর মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এই ছুটে আসা।
বুসান। ঢাকা থেকে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার পথ। এই লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে মেয়েটি ছুটে এসেছে এ কারণে! ভাবতে বেশ শিহরণই লাগছিল।
ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে মেলে ধরল জুলি আমার সামনে। সেখানে সাইফুলের ঠিকানা লেখা। আমি জুলিকে বললাম, ‘এই গাড়ি যাবে যশোর পর্যন্ত। সেখান থেকে তোমাকে অন্য আর একটা গাড়ি ধরতে হবে গদখালী যাওয়ার জন্য।’
জুলিকে একটু চিন্তিত দেখাল। জানতে চাইল, আমি তাকে গাড়ি ধরতে সাহায্য করতে পারি কি না।
খুব গুচিয়ে আমি তাকে একটা মিথ্যে বললাম। বললাম, ‘আমি অফিসের কাজে গদখালীর খুব কাছেই যাব। আমার একটু কষ্ট হবে, তবু আমি তোমাকে সাইফুলের বাসা পৌঁছে দিয়ে আমার কাজে যাব।’
আমার এ কথায় মেয়েটির চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

তিন
গদখালীর বাসস্ট্যান্ডে নেমে একজন ফুলওয়ালার কাছ থেকে কয়েকটা রজনীগন্ধা, কিছু গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা আর গ্ল্যাডিওলাস মিলিয়ে একটা তোড়া তৈরী করে নিল জুলি। ‘সাঈফুলের জন্য।’ বলল আমার দিকে তাকিয়ে। আমি হাসলাম।
সাইফুলের বাড়ি পৌঁচ্ছে জানা গেল, জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধে এক প্রতিবেশীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময় সাইফুল প্রচুর রকমের আহত হয়। থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেওয়ার পরপরই তার মৃত্যু ঘটে।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, জুলিকে কীভাবে এটা বলব। তার পরও এক সময় বলতে হলো। নিজের কানকে যেন সে বিশ্ব^াস করতে পারছিল না, ‘হোয়াট ! সাইফুল ডাইড?’ ‘ডেড?’
আমি মাথা নাড়লাম। জুলি দু’হাতে মুখ ঢাকল।
আমরা সাইফুলের কবরের কাছে গেলাম। জুলি ফুলের তোড়াটা সাইফুলের কবরের ওপর রাখল। মাটির দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার শরীর। আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম।

ছয় মাস পর
এই মাত্র একটা মেইল এসেছে। জুলি লিখেছে আমাকে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। ‘সে এসেছে আমার কোলজুড়ে। সাইফুলের একমাত্র স্মৃতি। আজ সাইফুল বেঁচে থাকলে কত খুশিই না হতো! জানো, আমার ছেলের নাম রেখেছি “সাইজু”, আমাদের দু’জনের নামের প্রথম অংশ নিয়ে।’
ফাইল খুলতেই দেখতে পেলাম একটা নবজাতকের ছবি। আমি সাইফুলকে দেখিনি। দেখলে হয়তো বুঝতে পারতাম, ছেলেটা সাইফুলের মতো হয়েছে কি না!

শেয়ার করুন ..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




© All rights reserved © পাতা প্রকাশ
Developed by : IT incharge