বৃহত্তর রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে প্রতিনিয়ত বিস্তর গবেষণা হয়েই চলেছে। সেই সব গবেষণায় আঞ্চলিক ভাষা বিষয়ে আমরা বিস্তারিত জানতে পারি। কিন্তু জন্মগতভাবে রংপুর সদরে বেড়ে ওঠায় আমি এর চারপাশের আঞ্চলিকতায় ভিন্নতা লক্ষ করেছি। শহরকে ঘিরে যারা যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে তাদের ভাষাতেই রয়েছে অনেক পার্থক্য। আবার আশপাশের জেলা উপজেলায় ভাষা বৈচিত্রতো রয়েছেই। পূর্বাঞ্চলের সাথে পশ্চিমের আবার উত্তরের সাথে দক্ষিণের ভাষায় অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এর কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
হালকা শীতে মোটামুটি সবাই নকশিকাঁথা গায়ে জড়াতে পছন্দ করি। নকশিকাঁথাকে আমরা বলি খ্যাতা। এই খ্যাতাকে আমাদেরই একদল বোঝেন পরিস্কারক হিসেবে। যাকে আমরা বলি ন্যাচড়া। যাকে চলিত বাংলায় ন্যাকরা বলে। আবার খ্যাতাকে যারা পরিস্কারক হিসেবে জানে তারা নকশিকাঁথাকে বলে দাগলা। ভাষার এইযে বৈচিত্র, এ সবই কিন্তু রংপুরের আঞ্চলিক ভাষা।
রাগ কে বলে আগ, কেউ বলে তাও। তোমার এতো রাগ? এই কথাই কেউ বলবে তোর এতো আগ? আবার কেউ বলবে তোর এতো তাও? ধরুন আপনার সন্তানকে রেগে বলছেন, ঘরে এস দেখাচ্ছি মজা। একই কথা কেউ বলবে বাড়ি সোন্দাও খালি তোর চামড়া ছিলিম অ্যালা। ছিলানোকে কোউ ক্যালানো বলে অর্থাৎ তোর চামড়া ক্যলাইম। এতোক্ষণে তোমার আসার সময় হল এর স্থলে কেউ বলবে এলানি তোর আইসপ্যার সময় হইল। কোউ বলবে এলানি আলু। এই আলু কিন্তু সবজি নয় এটি আসা এর আঞ্চলিকতা। সবজি আলু নিয়ে রংপুরে বেশ মজার একটি শ্লোক আছে তা হল, যখন আলু, তখন না আলু, আলুতা আলু, আলু ফুরি যায়া আলু।
তুমি ওখানে যাবে না এর আঞ্চলিক রুপ তুই অটে যাবারনেইস বা তুই উত্তি যাবু না বা যাইস না। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে, তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই, এই বাক্যের বৈচিত্র এমন, তোক মোক ভালো নাগচে, তোক মুই বিয়াও কইরব্যার চাও। চাইকে কেউ চাংও বলেন। আবার না কে বলে ন্যাও বা ন্যাং। যেমন, আমি যাব না। মুই যাবার ন্যাও, মুই যাইম ন্যা, মুই যাবার ন্যাং। আসবে কে আসপু, আসিবু ইত্যাদি বলা হয়। কে বলতে কায়, কাই বা কেটা বোঝায়।
মেয়েদের ডাকা হয় চেংরি, মাইয়া বা মাই বলে। ছেলেদের চ্যাংড়া, বাবা, বাউ। নারীদের বলে বেটিছাওয়া, বেইচ্চা, মাইয়া। পুরুষ বলতে ব্যাটাছাওয়া, গাবুর, যুয়ান বোঝায়। ঘর বলতে থাকার স্থান বোঝায়। কিন্তু একসাথে কয়েকজন বোঝাতেও ঘর ব্যাবহার হয়। যেমন নানির ঘর বাড়ি আলছে তোমরা একনা টপটপে আইসো। প্রাক্তন বাড়িকে বলে ওভিটা বা হোভিটা। কেউ ওবাড়িও বলে। হবে বলতে খায়, নাগবে ব্যাবহার হয়। তোমাকে একটু আসতে হবে এর স্থলে তোক যে একনা আইস্যা খায়, বা তোক একনা আইস্যা নাগবে।
আপনিকে সাধারণত তোমরা বা তোরা বলা হয়। কখনকে কোনভালা, কোনসম, কত্তন বলে। আপনি কখন এসেছেন কে আমরা বলি তোমরা কোনভালা আইনেন। তোমরা কত্তন আইনেন। আপনার সাথে একটু কথা আছে, এই বাক্য এখানে বলবে, তোমার সাতে একনা কতা কনু হয়। এতে অবস্য রংপুরের বাহিরের জেলার মানুষ খুব বিব্রতবোধ করেন কিন্তু এখানে এটাই স্বাভাবিক।
একটা বড় সমস্যা মহাপ্রান ধ্বণিতে, অ ধ্বণীর ব্যাবহার বেশি আর রংপুরের মানুষ হয়েও রংপুরকে অমপুর বা অংপুর বলা। আমার বাড়ি রংপুর কে এখানে মোর বাড়ি অমপুর বলার প্রবনতা দেখা যায়।
রসকে বলে অস। তরকারির ঝোলকেও অস বলে। যেমন, খেতে বসে তরকারিতে ঝোল না পেয়ে স্বামী রেগে গিয়ে বলেন, শালি তরকাইত অস থুইস নেই ক্যােন। সুকান তকাইদি কি ভাত সোন্দায়। আবার ঝোলকে সরুয়া বা সুরুয়াও বলে। পাটকে বলে পাটা, কোষ্টা, তামাককে তাংকু, আলোয়া। তেলাপোকাকে তেইলক্যা, ত্যালচাটা।
সবজির ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচিত্র। কচুমুখীকে আড়াই, বই, সজি বলে। বরবটিকে বলে নবিয়া সিমা বা ভটভটি। চিচিঙ্গাকে কিসকিন্ডা, দুদকুশি, কায়তা।
তরকারিকে তকাই, বিড়ান। টাকি মাছকে সাটি, গড়াই বলে ডাকে। ধানের খরকে বলে পোয়াল। খরের গাদাকে পোয়ালপুঞ্জ। ধানের বোঝাকে আউর কারিয়া বা আটি বলে আর আমের আটিকে বলে আসু বা কয়া। আবার বলে অর্থেও কয়া শব্দের ব্যাবহার আছে। তোক কয়া কি হইবে! এর চলিত রুপ তোমাকে বলে কি হবে! ঘেমে যাওয়া কে বলে ঘামি যাওয়া বা ঝসি যাওয়া। টিকরা ফাটা অইদোত ছওয়াটা মোর ঝসি গ্যালো। যাচ্ছ কে যাওচিস, যাবার নাগচিস, যাইচিস। আসবেন না কে আইসপ্যারনেইস, আসপুনা, আইসপ্যারন্যান। আপনি আজ বাড়ি আসবেন না এর স্থলে তোমরা আইজ বাড়ি আইসপ্যারন্যান। আসব না কে আইসপ্যার ন্যাং, আসিম না আইসপ্যার নেও। আসছিকে আইসপ্যার নাকচুন, আইসিচি, আইসপ্যার নাকচং আইসুচুন, আইসং। যাচ্ছি কে যাবার নাকচং, যাউচুন, যাইচি, যাং, যাও। আমি আসবো না। মুই আইসপ্যার ন্যাং, মুই আসিম না, মুই আইসপ্যার পাবার ন্যাও।
আমি যাব না। মুই যাবর ন্যাং, মুই যাইম ন্যা, মুই যাবার ন্যাও। বলছি কে কবার নাকচুন, কউচুন, কেউ কেউ শুধু কচুও বলে। আমি বললাম তুমি এলে এর স্থলে মুই কচু তুই আলু এভাবে বলে।
এতো করে বলছি ওখানে যেওনা, তাও গেলে। এ্যাত করি কউচুন ওটে যাইসনা তাও গেলু, এতো করি কবার নাকচুন উত্তি যাইসনা তাও যাবর নাগে? এতো করি কনু উতি যাইননা তাও গেলু। তোক আইস্যায় নাগবে, তোক আসা খাইবে, তোক আইসপ্যারে নাগবে এর চলিত তোমাকে আসতেই হবে। ওখানে বোঝাতে উতি, অটে, অত্তি এর ব্যাবহার হয়। ওখানে তোমার কি? অত্তি তোর কি? জমাকে আঙ্গা বা পিড়ান বলে। বৃষ্টিকে ঝরি বা পানি। ইদ বা পুজায় যে মেলা বসে তাকে আমরা হাটিবাড়ি বলে জানি। গলাকে নল্লি বা টুটি বলে। তোর নল্লি ছিরি ফ্যালাইম বা তোর টুটি টানি ছিরিম। হাতপাখাকে পাঙ্খা বা বিচন বলে। কোটে, কুত্তি, কোনঠে এর চলিত রুপ কোথায়। তোমার বাড়ি কোথায় এর স্থলে তোর বাড়ি কোটে বাহে, কোনঠে বা কুত্তি ব্যাবহার হয়। তুই এটে কি করুচিস। এটে, এ্যটে মানে এখানে। প্রদীপকে ন্যামপো, নমপো বা কুপি বলে। মনে থাকা অর্থে ফম থাকা। আমার কিছু মনে থাকে না। এর আঞ্চলিক মোর কিচু ফম থাকে না। খুজে আনা হয়ে যায় উক্টি আনা। উক্টি আন দ্যাখে দেইম এ্যালা।
বড় পাত্রতে বোল, ডিস, টউ, গামলা এসব নামে ডাকে। টংকে বলে আটাল। ঘরের ব্যাড়াকে বলে টাটি বা চাটি। ঘরের ধারকে পিরালি বা ধারিয়া। বাড়ির পিছনের অংশ যেখানে টিউবওয়েল ও শৌচাগার থাকে তাকে চুয়াছালা বা কাইঞ্চা বলে।
ঘরে শোয়ার জন্য কাঠের পাটাতনকে আমরা বলি চকি, আবার কোথাও খেতের আলের পাশে ছোট নালাকে বলে চকি। সেই নালাকে আমরা বলি পাগার কেউ বলে পগাড়। এমন আরও বহু উপভাষা আছে যা রংপুরের মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যাবহার করে থাকে।
এই লেখা পড়তে পড়তে নিশ্চয়ই আপনার মনেও অনেক কথা বা ভাষা উকি দিচ্ছে? যদিও এখন আঞ্চলিক ভাষার ব্যাবহার বা চর্চা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমরা এখন আমাদের সন্তানদের প্রমিত ভাষা শেখাতেই বেশি মন দিচ্ছি। আর মিডিয়ার আগ্রাসন, রংপুরের বাহির থেকে এসে বসবাসকারী মানুষের আধিত্য আমাদের আঞ্চলিক ভাষাকে প্রতিনিয়ত সংকরায়িত করে চলেছে। তবুও আমাদের শেখরের প্রয়োজনে, নিজেদের আলাদা করে পরিচয় করাতে এর চর্চা ধনে রাখতে হবে।